ঊনবিংশ শতকের ভ্রমণবৃত্তান্ত নিয়ে একটি গুরুত্বের কাজ— এক প্রকল্প ও লড়াইয়ের কাহিনিও

যশোধরা রায়চৌধুরী

 

বিগত নভেম্বরে মুসৌরি পাহাড়ে যাওয়ার সুযোগ হয়েছিল। সেই পাহাড়ে খুব ভিড়, তাই পাশেই ধনৌল্টি নামের আরেক টঙে ফরেস্ট বাংলোতে গিয়ে উঠি। আর ইনোভা চেপে সেই পর্বতশৃঙ্গে চড়তে চড়তে দেবতাত্মা হিমালয়ের যে রূপ দেখি, বুকের ভেতরটা ছাঁৎ করে ওঠে। মনে হয় এ দেবতাত্মা তো যুগ যুগ ধরে এক রয়ে গেছেন… অথচ মাত্র দুশো বছরে আমরা কতখানি পথ পাড়ি দিয়ে এসেছি। ভাবতে চেষ্টা করি গাড়িঘোড়া যখন এমন ছিল না সেই সময়ে এসব জায়গায় আমার বয়সী কজন মহিলা আসতে পারতেন, আর কীভাবেই বা আসতেন। ঘোড়ার গাড়ি বা ডুলি? হঠাৎ মনে হয়, দিদিমা বলতেন দাদু খুব ঘুরে বেড়িয়েছেন কর্মব্যপদেশে, প্রায়শ দিদিমার যাওয়া হয়নি। রবি ঠাকুরের পুরাতন ভৃত্যের একটা লাইন খুব বলতেন আমার দিদিমা, “পতির পুণ্যে সতীর পুণ্য নহিলে খরচ বাড়ে”। এই কথাটিকে আপন করে নেওয়ার কারণ ছিল ওই “মেয়েদের ট্যাঁকে নিয়ে ঘোরাঘুরি খুব ঝামেলার ব্যাপার” বা “মেয়েরা ভাল ভ্রমণকারী নয়” জাতীয় ধারণা, যার বশে বউবাচ্চা নিয়ে কোথাও যাওয়াকে লোকে হাস্যকর ঝামেলা ঝঞ্ঝাট বলেই ভাবতে শিখেছিল। এমনকি, ছেলেপিলে বড় হলে সংসারের দায়দায়িত্ব শেষ হলে তবেই যেন মহিলারা যেতে পারতেন দূরে, এবং তাও, অবশ্যই ধর্মীয় কারণে। “তীর্থ করতে” বেরুতেন। অথবা কাশী-বৃন্দাবন-দেওঘর জাতীয় ধর্মীয় স্থানে গিয়ে ডেরাডান্ডা ফেলে কদিন থাকতেন।

নারীর ভ্রমণ যেন সোনার পাথরবাটি ঊনবিংশ শতকে। আর, নারীর ভ্রমণকথা লেখা? কোথা থেকে আসবে, শুনি? সিলভিয়া প্লাথকে লিখতে হয়েছিল ডায়েরিতে, আমার খুব ইচ্ছে করে খোলা ট্রাকের পিঠে চেপে ঘুরি, আকাশের তারা দেখতে দেখতে পাড়ি দিই পথ। সে অভিজ্ঞতা নারীজন্মে আমার হল না। তাই, তাঁর লেখায় বাদ থেকে গেল মনুষ্যজীবনের কত না অভিজ্ঞতার কথা! সে কারণেই, মেয়েদের ভ্রমণবৃত্তান্তও, বিশেষত ঊনবিংশ শতকের বাঙালি মেয়েদের, পাওয়ার কথা আমরা ভাবি না। তবে না লেখা একরকমের, লিখলেও তা কি সংরক্ষিত? আলোচিত? স্বীকৃত? সেই প্রশ্নেরই উত্তর খুঁজেছেন দময়ন্তী দাশগুপ্ত। বইয়ের নাম আমাদিগের ভ্রমণবৃত্তান্ত: “ঊনবিংশ শতাব্দীর বঙ্গমহিলাদের ভ্রমণকথা”। চার খণ্ডের এই গ্রন্থাবলির প্রকাশক গাঙচিল।

 

দুই.

আমাদের ছোটবয়সেও মেয়েরা বাড়ির বাইরে বেশিক্ষণ থাকলে বাবা-মায়েরা বলতেন বহির্মুখী, বড্ড পা হয়েছে। আমাদিগের ভ্রমণবৃত্তান্তের তৃতীয় পর্বে দেখি, স্বর্ণকুমারী দেবীর দীর্ঘ ভ্রমণকথার তালিকা। আর তার ভিতরে এক জায়গায় পড়তে পাই:

“আগেকার চেয়ে এখন আমরা ঢের বেশী বেড়াইয়া বেড়াই, লোকে বলে আমাদের পা হইয়াছে। তবু কিন্তু বেড়াইয়া সাধ মেটেনা, মনে হয় সারাদিনই বাহিরে থাকি, পর্ব্বতের মুক্তদৃশ্যের মধ্যে এমন একটা উদার মহান ভাব আছে, যে শোক তাপের গুরু ভারও সেখানে লঘু হইয়া আসে, প্রাণের ক্ষুদ্রতা— সেই অনন্তের মধ্যে যেন আর দাঁড়াইতে পারে না, সেই অনন্তের মধ্যে অনন্ত প্রসারণ লাভ করিয়া হৃদয় যেন অনন্ত হারা-হৃদয়ের সঙ্গে একত্ব লাভ করে।”

এই স্বতঃস্ফূর্ত ভ্রমণবৃত্তান্ত শুধু একটা জায়গার বর্ণনা থাকে না, আসলে হয়ে ওঠে এক মানবীর দিনলিপি, আর তাঁর সময়ের প্রতিচ্ছবি।

স্বর্ণকুমারী দেবী

দময়ন্তী দাশগুপ্তের “আমাদিগের ভ্রমণবৃত্তান্ত”র কাজটিই কিছুটা এমন। অতি পরিশ্রমী এক প্রকল্পনা। দময়ন্তী জানান এর সলতে পাকানোর কাজ শুরু হয়েছিল নিজের ভ্রমণপত্রিকা চালাতে গিয়ে। আর তারপর তা দাঁড়ায় পুরনো মেয়েদের ভ্রমণকাহিনি সংগ্রহের এক দুর্মদ নেশায়।

পুরনো লেখা পড়তে গিয়ে ভাললাগার থেকে ‘আমাদের ছুটি’ আন্তর্জাল পত্রিকায় নিয়মিত প্রকাশ করছি শতাধিক বছরের পুরনো বিস্মৃতপ্রায় বাংলা ভ্রমণকাহিনিগুলি। শুধুমাত্র পুরনো ভ্রমণকাহিনিকে নতুন মলাটে যেনতেন প্রকারেণ পাঠকের কাছে হাজির করার জন্য আমার এ ভ্রমণ নয়। পুরনো কাহিনিকে নতুন মলাটে পরিবেশন করার জন্য আমার এ লেখা, তার ভূমিকাও নয়। আজকের পাঠকের কাছে পুরনো লেখকদের কয়েকটা লেখা ‘রিপ্রিন্ট’ না করে সেই সময়, সেই সমাজের একটা সার্বিক চিত্র তুলে ধরতে চেয়েছি। ঊনবিংশ শতকে মেয়েদের পক্ষে যখন ঘরের বাইরে বেরনোটাই সমস্যার এবং সমালোচনার বিষয় ছিল তখন কেন তাঁরা ভ্রমণ করেছেন এবং কেন লিখেছেন তা না জেনে পড়লে কিছুতেই সেই পাঠ সম্পূর্ণ হয় না। লেখিকাদেরই শুধু নয়, সেই সময়ের ভ্রমণ-লেখকদের লেখা কাহিনিও কিন্তু সময়ের প্রেক্ষিত বিচার করেই পড়তে হবে।

এই চারখণ্ডের গ্রন্থাবলি শুধু তো ঊনবিংশ শতকের শেষ পর্যন্ত (অর্থাৎ ১৯০০ সালের আগে অব্দি) মেয়েদের বাংলা ভ্রমণকাহিনির সঙ্কলন নয়। এই গ্রন্থাবলির সবচেয়ে বড় সম্পদ তার ভূমিকাগুলি যেগুলি দময়ন্তী লেখেন নিজেকে উজাড় করে। দুটো স্তরে বয়ে যায় ভূমিকাগুলি। এক, এতে তিনি ঐতিহাসিক প্রেক্ষিতটি রাখেন। যেমন, এইখানে তিনি লেখেন:

The Virgo Book of ‘Woman Travellers’ বইটি পড়তে গিয়ে দেখলাম ভূমিকায় সম্পাদক Mary Morris-এর বক্তব্যও যেন এটাই— “The late John Gardner once said that there are only two plots in all of literature. You go on a journey or a stranger comes to town. Since women, for so many years, were denied the journey, they were left with only one plot in their lives- to await the stranger. Indeed, there is essentially no picaresque tradition among women novelists. While the latter part of the twentieth century has seen a change of tendency, women’s literature from Austen to Woolf is by and large a literature about waiting, usually for love.”— বাঙালি মেয়ের কাহিনিই বা এর থেকে ভিন্ন হবে কী করে? তাই এই কথারই প্রতিধ্বনি শুনি উনিশ শতকের মাঝামাঝি সময়ে বামাসুন্দরী দেবীর লেখায়। ‘সোমপ্রকাশ’ পত্রিকায় বামাসুন্দরী দেবীর লেখা একটি চিঠি প্রকাশিত হয়েছিল। স্বামী তাঁর এক বন্ধুর সঙ্গে বেড়াতে গেছেন। স্ত্রীকে সঙ্গে নেওয়ার তো প্রশ্নই ওঠে না। চিঠিতে তাঁদের বেড়ানো সংক্রান্ত খবরাখবর পেয়ে স্বামীর সেই বন্ধুকে উত্তরে বামাবোধিনী লিখছেন, “লিপিখানি পাঠ করিতে করিতে যে কত অশ্রুপাত হইল, তাহা আর কী লিখিব। মহাশয়! জানি না সে আনন্দাশ্রু না বিষাদাশ্রু! আপনারা মুঙ্গেরে গিয়া নানাপ্রকার রমণীয় পদার্থ সকল দর্শন করিয়া চমৎকৃত ও অনির্বচনীয় আনন্দ লাভ করিতেছেন। শিববাবু! আমরা দেখিতে তো পাইবই না, মনুষ্যের একটা আশা থাকে, তাহাও আমাদের নাই।… এক একবার মনে হয় যে পড়িতে শিখিয়াছিলাম কেন, যদি পড়িতে না পারিতাম তাহা হইলে নানা স্থানের বৃত্তান্ত জানিতেও পারিতাম না, জানিবার ইচ্ছাও হইত না। মন একপ্রকার পশুর ন্যায় হইয়া থাকিত, কোনো ক্লেশই অনুভব করিতে পারিতাম না।

বামাসুন্দরী দেবী

নিজে নিজের জীবনকে অবমানবের বা ঊণমানবের জীবন বলে জানতে বা বুঝতে পারার বেদনা এইসব লেখায় লেগে থাকে, আর সেই বোধ অক্ষর চুঁইয়ে এসে পৌঁছায় আমাদের আজকের ইনোভা চড়ে পাহাড় দেখার সময়ে!

প্রথম যে নারী লিখিত অক্ষরে রেখে গেছেন তাঁর ইংলন্ড ভ্রমণের ঐতিহাসিক দলিল সেই কৃষ্ণভাবিনী দেবী আবার বলেছিলেন, “আমিও আপনাদের ন্যায় একটা বাড়ীতে আবদ্ধ ছিলাম; দেশের, পৃথিবীর কোন বিষয়ের সহিত সম্পর্ক ছিল না; সামান্য গুটিকতক জিনিষে মনকে সন্তুষ্ট রাখিতে চেষ্টা করিতাম কিন্তু পারিতাম না।” বলেছেন বিলেত সম্পর্কে তাঁর জানার আগ্রহ ছিল। যাওয়ার সুযোগ হল অনেক পরে। কৃষ্ণভাবিনীর ক্ষেত্রে “বাঙালি নারীর লেখা প্রথম বিদেশ ভ্রমণ কাহিনি”-র তকমা প্রাপ্ত হয়েছে কিন্তু দময়ন্তী খেদ করে তুলনা করেছেন মেরি ওলস্টোনক্রাফটের “লেটারস রিটেন ডিউরিং এ শর্ট রেসিডেন্স ইন সুইডেন, নরওয়ে আন্ড ডেনমার্ক”-এর, যে টেক্সটের নারীবাদী চর্চাও হয়, আর ভ্রমণকথা হিসেবে আগ্রহও জোটে।

কৃষ্ণভাবিনী দেবী এবং তাঁর বই

বারে বারে দময়ন্তী বলেন বাঙালি মেয়েদের ভ্রমণকথাকে সাহিত্য হিসেবেই আদৌ কোনও গুরুত্ব না-দেওয়ার দীর্ঘ প্রচলনের কথা।

দময়ন্তীর ভূমিকাগুলিতে একটি দ্বিতীয় ও আকর্ষণীয় স্তর আছে। তা হল, এখানে বিধৃত আছে তার নিজের একটা জার্নি, কোয়েস্ট। বিধৃত আছে “ঊনবিংশ শতাব্দীর বঙ্গমহিলাদের ভ্রমণকথা” এই গ্রন্থাবলি সম্পাদনার আগের দীর্ঘ যাত্রাটি, যা স্বভাবতই ছিল বাত্যাবিক্ষুব্ধ এবং বাধাসঙ্কুল। সেখানে আছে কলকাতা ও পার্শ্ববর্তী অঞ্চলের এক প্রাচীন ঐতিহ্যপূর্ণ লাইব্রেরি থেকে অন্য লাইব্রেরিতে চক্কর কাটা ও নানা কীটদষ্ট পত্রিকা থেকে হাতে লিখে ভ্রমণকথাগুলি উদ্ধার করার ইতিহাস। সেখানে আছে নানা অ্যানেকডোটে একেক লেখকের লিখিত পাঠবস্তুর তালিকাকরণের সমস্যা থেকে এমনকি প্রাচীন পত্রপত্রিকা সংরক্ষণের সমস্যার গল্প, আছে নানা শ্লেষ, বিস্ময়, এবং যথাযথ ব্যঙ্গ। দময়ন্তী দুঃখ করেন, যে বাংলায় রবি ঠাকুরের নোবেল পদক অব্দি চুরি হয়ে যায়, সে বাংলায় একেকটি লাইব্রেরিতে নথির “ছবি তুলে নেওয়া” অব্দি আজও নিষিদ্ধ!

 

তিন.

প্রথম খণ্ডে ধরে দেওয়া হয়েছে নিচের এই লেখাগুলি, যা প্রায় অন্ধকার কয়লা খুঁড়ে হিরে খুঁজে আনার মতো।

কাশী দর্শন/রমাসুন্দরী ঘোষ, বিদেশ ভ্রমণ/লক্ষ্মীমণি বসু, আমাদিগের ভ্রমণ বৃত্তান্ত ও বম্বাই ভ্রমণ/অজানা, THE WHITE HILLS OF JABBALPORE/অজানা, পর্ব্বত-ভ্রমণ (নৈনিতাল)/অজানা, তাজ মহল/সুবর্ণপ্রভা বসু, দার্জিলিং ভ্রমণ/কামিনী সেন, বান্দেলের গির্জা/হিরন্ময়ী দেবী, হিমালয় ভ্রমণ/নলিনীবালা বসু, মহীশূরের পত্র/কুমুদিনী খাস্তগির (দাস), দেওঘর/গিরীন্দ্রমোহিনী দাসী, মহানদী বক্ষে শ্রীগিরিবালা দেবী (সেনগুপ্ত), সিংভূমের কোলজাতি/গিরিবালা দেবী (সেনগুপ্ত), কোলজাতির আমোদপ্রমোদ/গিরিবালা দেবী (সেনগুপ্ত), বিদেশবাসিনীর পত্র/অজানা, মসুরী/স্নেহলতা সেন, জ্বালামুখী/বনলতা দেবী, কানি ও জব্বলপুর/সরযুবালা দত্ত, চন্দনতলার চাপ/শ্রীঅম্বুজা সুন্দরী দাস, বনবাসিনীর পত্র/অজানা।

দ্বিতীয় পর্ব সাজানো হয়েছে কৃষ্ণভাবিনী দাসের লেখাগুলি দিয়ে। আর আছে প্রসন্নময়ী দেবীর আর্যাবর্তে বঙ্গমহিলা।

তৃতীয় পর্বে স্বর্ণকুমারী দেবী ও অবলা বসু। চতুর্থ পর্বে সরলা দেবী, গিরীন্দ্রনন্দিনী দেবী, তিনটি অজানা লেখকের লেখা এবং প্রমীলা নাগের একটি লেখা।

বাঙালি মহিলার বিলাত যাওয়ার ইতিবৃত্ত জানিয়ে দিয়েছেন দময়ন্তী যা নিজেই খুব চিত্তাকর্ষক। যেহেতু দ্বিতীয় খণ্ডটি সেজে উঠেছে কৃষ্ণভাবিনী দাস-এর সুবিখ্যাত ইংলণ্ডে বঙ্গমহিলা ও বিলাতের গল্প দিয়ে, সেহেতু এই তথ্যগুলিও জেনে নেওয়া যায়:

কৃষ্ণমোহন বন্দ্যোপাধ্যায়ের কন্যা এবং জ্ঞানেন্দ্রমোহন ঠাকুরের স্ত্রী কমলমণি-ই প্রথম বাঙালি মেয়ে যিনি ইউরোপে যান। দেশে ফিরে কমলমণির মৃত্যুর পর দুই কন্যা ভবেন্দ্রবালা ও সত্যেন্দ্রবালাকে নিয়ে আবার বিলেত পাড়ি দেন জ্ঞানেন্দ্রমোহন। ১৮৬৩ সালে কবি মাইকেল মধুসূদন দত্ত জীবনসঙ্গিনী হেনরিয়েটা ও সন্তানদের নিয়ে বিলেত যান। কন্যা শর্মিষ্ঠা তখন বেশ ছোট। ১৮৬৯ সালে গোবিন্দ্রচন্দ্র দত্ত স্ত্রী ক্ষেত্রমোহিনী এবং দুই কন্যা তরু ও অরুকে নিয়ে বিদেশের মাটিতে পা রাখেন। ১৮৭১ সালে শশীপদ বন্দ্যোপাধ্যায় সস্ত্রীক ইংলণ্ডে গিয়েছিলেন। ১৮৭৪ সালে নাবালক সন্তানদের নিয়ে সাগরপাড়ি দেন হেমাঙ্গিনী দেবী। তাঁর স্বামী ব্যারিস্টার উমেশচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায় তখন বিলেতেই। চারকন্যা নলিনী, সুশীলা, মিলি এবং জানকী লণ্ডনেই উচ্চশিক্ষা লাভ করেন। ১৮৭৭ সালে নাবালক সন্তানদের নিয়ে বিলেত পাড়ি দেন আধুনিকতম বঙ্গমহিলা জ্ঞানদানন্দিনী দেবী। সেই অভিজ্ঞতার খানিক জানতে পারি অনেক পরে মেয়ে ইন্দিরা দেবীর অনুলিখিত বইটিতে। কৃষ্ণধন ঘোষ স্ত্রী স্বর্ণলতা, তিন পুত্র ও কন্যা সরোজিনীকে নিয়ে ১৮৭৯ সালে বিলেত যান। স্বর্ণলতা ছিলেন রাজনারায়ণ বসুর কন্যা। উনিশ শতকে এর পরে কৃষ্ণভাবিনী, অবলা ছাড়াও কুচবিহারে মহারানী ও কেশবচন্দ্র সেনের কন্যা সুনীতি দেবী ১৮৮৭ সালে এবং প্রথম বাঙালি মহিলা চিকিৎসক কাদম্বিনী গঙ্গোপাধ্যায় ১৮৯৩ সালে বিলেত পাড়ি দেন। এরপর মনোমোহন ঘোষ, রমেশচন্দ্র দত্ত, বিহারীলাল গুপ্ত, কৃষ্ণগোবিন্দ গুপ্ত, ব্রজেন্দ্রনাথ দে প্রমুখ সেই সময়ের শিক্ষিত ও আধুনিকমনস্ক বাঙালিরা অনেকেই স্ত্রীদের নিয়ে একাধিকবার ইউরোপ গেছেন।

ঊনবিংশ শতকে যে ক’জন মহিলা বিলেত যাওয়ার সুযোগ পেয়েছিলেন তাঁদের প্রায় কেউই ভ্রমণ অভিজ্ঞতা লিপিবদ্ধ করে যাননি। ফলে এই শতকে বাঙালি মেয়ের লেখা বিলেতভ্রমণ কাহিনি একেবারে হাতে গোনা— কৃষ্ণভাবিনী দাস (১৮৮৫) এবং পরবর্তী কালে অবলা বসুর (১৮৯৭-৯৮)। ঊনবিংশ শতকের শেষভাগে (১৮৯৪) জগৎমোহিনী চৌধুরী ইংল্যাণ্ডে যান এবং ফিরে এসে সেই ভ্রমণকাহিনি লেখেন— ‘ইংলণ্ডে সাত মাস’। কিন্তু লেখাটির প্রকাশকাল ১৯০২ সাল।

দময়ন্তী জানান, এই বৃত্তান্ত যেহেতু উনিশ শতকে প্রকাশিত লেখালেখিকেন্দ্রিক তাই রাখা গেল না সেটিকে।

কৃষ্ণভাবিনীর লেখা পড়লে দেখি, সেখানে শুধু নিজের কথা নেই, বা বিলাতের দৃশ্য সম্পর্কে কেবল নীরব প্রেক্ষণ নেই। রীতিমতো সামাজিক বিশ্লেষণ আছে। বিলাতের সঙ্গে ফরাসি সমাজের তুলনা করেছেন। সাধারণ গরিব ফরাসি রমণীদের তিনি দেখছেন। তাদের কর্মকুশলতা, স্বামীর কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে কাজ করা, লাঙল বওয়া, জল টানা ইত্যাদি নিয়ে কথা বলেছেন। আবার চিন্তা করছেন, বিদেশি পোশাক আশাক আচার ব্যবহার করার ফলে তিনি সঙ্কীর্ণমনা ভারতীয়দের কাছে কতটা হাস্যাস্পদ হবেন। স্থানীয় সংবাদপত্র থেকে তিনি তথ্য সংগ্রহ করে লিখছেন, একপ্রকার প্রস্তুতি নিয়েই।

 

চার.

তৃতীয় পর্বের দুই ভ্রমণলেখিকা স্বর্ণকুমারী দেবী ও অবলা বসু।

ঊনবিংশ শতাব্দীতে কৃষ্ণভাবিনী দাসের ঐতিহাসিক বিলাত ভ্রমণকাহিনি এবং প্রথম ভারত ভ্রমণকারী লেখিকা হিসেবে প্রসন্নময়ীর পুস্তক প্রকাশ বাঙালির সাহিত্য ও ভ্রমণ ইতিহাসে সামান্য হলেও দাগ কেটেছিল। কিন্তু প্রায় সমসাময়িক সময়ে স্বর্ণকুমারীর ভারতবর্ষের নানা প্রান্তে বৈচিত্র্যময় ভ্রমণ এবং বৈঠকি থেকে আত্মানুসন্ধানী, সমাজসচেতন বিভিন্ন ভঙ্গির ভ্রমণকাহিনি রয়ে গেছে প্রায় আড়ালেই। কখনও তাঁর কোনও সঙ্কলনে পত্র, প্রবন্ধ বা গল্প হিসেবে ছড়ানোছিটানো ভাবে কিছু সঙ্কলিত হয়েছে মাত্র। না হলে উনবিংশ শতকের অন্যতম ভ্রমণলেখিকা হিসেবে বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে তাঁর নামটি স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকা উচিত ছিল। প্রায় একই কথা বলা যায় অবলা বসু সম্বন্ধেও। উনবিংশ শতাব্দীতে অবলা বসুর মতো দেশ-বিদেশ ভ্রমণ করবার সুযোগ অন্য কোনও বাঙালি মেয়েই পাননি। ভ্রমণের অনুপাতে লেখার সংখ্যা কম হলেও তিনি যে আদৌ লিখেছেন এই বিষয়টিই কেন এত দীর্ঘকাল লোকচক্ষুর অন্তরালে রয়ে গেল তাই বা কে জানে! আসলে ওই যে একে ভ্রমণকাহিনির মতো বাংলা সাহিত্যের একটি অবহেলিত দিক, তায় মেয়েদের লেখা। স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ ছিন্নপত্রাবলীর এক জায়গায় লিখছেন, “মেয়েরা ভালো ভ্রমণকারী নয়।” অথচ তাঁরই নদিদির লেখা সে কথা বলে না।

অবলা বসু

অন্যত্র দময়ন্তী জানান:

আবার ঊনবিংশ শতকের বাঙালি ভ্রমণলেখিকাদের মধ্যেও স্বর্ণকুমারী দেবী এবং অবলা বসু ছিলেন একেবারে আলাদা। এঁদের ভ্রমণ সেই সময়ের অন্যান্য মহিলা ভ্রমণলেখিকার মতো ‘ঘোমটা খুলে’ বেরোনো নয়। ঠাকুরবাড়ির খোলা হাওয়ায় বেড়ে ওঠা স্বর্ণকুমারী দেবীর ভ্রমণ কাহিনিগুলির প্রকাশের সময়কাল লক্ষ করলে দেখা যাবে বেশিরভাগই প্রকাশিত হয়েছে তাঁর দুই পর্বে ‘ভারতী’ পত্রিকা সম্পাদনার সময়ে। অর্থাৎ সম্পাদকের নিজস্ব তাগিদও এর পেছনে হয়তো-বা কাজ করেছে। আবার এই দুই মহিলাই সেই সময়ে পরিবারের সঙ্গে শুধুমাত্র বেড়ানোর জন্যও বেড়াতে গেছেন— সেই সময়ের মেয়েদের ঘরের বাইরে পা রাখার অন্যতম উপায় তীর্থদর্শন বা শরীর সারানোর উদ্দেশ্যে নয়। আবার কৃষ্ণভাবিনীর মতো স্বামীর সঙ্গে বাইরে যাওয়ার বা বাইরে থাকার কাজটিও করেছেন, যদিও কৃষ্ণভাবিনীর বিরুদ্ধ পরিস্থিতি এঁদের ছিল না।

শিক্ষা বিষয়ে আগ্রহী লেডি বসু ছেলেমেয়েদের শিক্ষার প্রসারের জন্য ভ্রমণকাহিনি লেখার মাধ্যম হিসেবে ছোটদের পত্রিকাই বেছে নেবেন সেটাই স্বাভাবিক। কাশ্মীর নিয়ে লেখা তাঁর প্রথম ভ্রমণকাহিনিটির শুরুতেই এই কথা বলেওছেন। সত্যি বলতে কী সেই সময়ের প্রেক্ষিতে দেখতে গেলে অবরোধবাসিনী বাঙালি মেয়ের কাছে বেড়াতে যাওয়া এবং ফিরে এসে সেই কাহিনি লেখার মধ্যেই নারী শিক্ষা ও নারী স্বাধীনতার বীজটি লুকিয়ে ছিল। তাই খুব স্বাভাবিক ভাবেই অবলা বসুর ‘জাপান ভ্রমণ’ হয়ে উঠেছিল তাঁর নারী শিক্ষা সমিতির প্রতিষ্ঠার অনুপ্রেরণা। ভ্রমণকে বৃহত্তর অর্থে দেখা-র তাঁর এই চোখ আমাকে অনুপ্রাণিত করেছিল আলাদা ভাবে তাঁর লেখাগুলিকে আজকের পাঠকের সামনে তুলে ধরতে। যার ফলশ্রুতি পরশপাথর থেকে প্রকাশিত ‘অবলা বসুর ভ্রমণকথা’ বইটি।

মেয়েদের শিক্ষিত ও স্বাবলম্বী করে না তুললে সমাজ এগোবে না। বিভিন্ন দেশভ্রমণের অভিজ্ঞতায় এ কথা বুঝেছিলেন অবলা।

 

পাঁচ.

ফিরে আসি আমার মুসৌরি ভ্রমণের সেই বাসনাটির কথায়। ফিরে এসে বইটি সংগ্রহ করে, গোগ্রাসে পড়ে ফেলি স্নেহলতা সেনের মসুরী ভ্রমণ। প্রথম খণ্ড থেকে।

তিন বৎসর হইল মসুরী পাহাড়ে বেড়াইতে গিয়াছিলাম। মসুরী পর্বত এবং সেখানে যমুনার যে অপূর্ব্ব রূপ দেখিয়াছিলাম, তাহা চিরকালের জন্য আমার মনের মধ্যে অঙ্কিত থাকিবে।

দার্জিলিং-পাহাড়ে অনেক বাঙ্গালি বেড়াইতে যান, কিন্তু মসুরীতে বোধ হয় খুব অল্প লোকই গিয়া থাকেন। মসুরী বহু দূর এবং রাস্তাও অত্যন্ত দুর্গন বলিয়াই বোধ হয় বেশী লোক সেখানে যান না। আমরা বাঁকিপুর হইতে সকালে ৮টার সময় রওনা হইলাম; সমস্ত দিন ও এক রাত ট্রেনে কাটাইয়া, তার পর দিন ১১টার সময় সাহারানপুরে পৌঁছিলাম। এখান থেকেই ঘোড়ার গাড়ীতে মসুরী যাইতে হইবে। এখানে আমরা এক দিন এক রাত বিশ্রাম করিলাম। তার পর দিন ৯টার সময় ডেরা ডুনের দিক রওনা হইলাম। ডেরাডুন সাহারানপুর হইতে প্রায় ৫০ মাইল হইবে, ডেরাডুন মসুরী পাহাড়ের ঠিক নীচে একটি সুন্দর উপত্যকা। ৫০ মাইলই ঘোড়ার গাড়ীতে যাইতে হয়; দুই ঘণ্টা অন্তর ছোট ছোট স্টেসনে ঘোড়া বদলান হয়। এই প্রকার ভ্রমণ তত সুবিধা জনক না হইলেও প্রথম আমরা যতটা খারাপ মনে করিয়াছিলাম তাহা হয় নাই। এই স্থানের পথের দৃশ্য সকল অতিশয় সুন্দর এবং প্রতিপদেই নূতন দৃশ্য দর্শনে আমাদিগের পথক্লেশের অনেক লাঘব হইয়াছিল। ডেরাডুনের সম্মুখে এক শ্রেণী ছোট পাহাড় আছে।…আমরা ডেরাডুন থেকে রওনা হইয়া তিন চারি ঘণ্টার মধ্যে রাজপুরে পৌঁছিলাম। সেখান থেকে ডাণ্ডিতে চড়িয়া পর্ব্বতে উঠিতে আরম্ভ করিলাম। দার্জিলিঙ্গে যাইতে হইলে পাহাড়ের উপর দিয়া ঘুরিয়া ঘুরিয়া যাইতে হয়। কিন্তু মসুরীতে উঠিতে হইলে একেবারে সমতল ভূমি থেকে ডান্ডি করিয়া তিন চারি ঘন্টার মধ্যে উপরে উঠা যায়। এই রাস্তাটি অত্যন্ত খাড়া। যাহা হউক বৈকালে আমরা মসুরীতে আমাদের বাড়ী পৌঁছিলাম। মসুরীতে দুই মাস ছিলাম। মসুরীর উপর থেকে যে দৃশ্য দেখা যায়, তাহা অত্যন্ত সুন্দর। পশ্চাতে চাহিয়া দেখ, কেবল পর্ব্বত শ্রেণী; এই পর্ব্বত শ্রেণীর পশ্চাতে নীল আকাশের গায়ে সাদা ধপ্ ধপে এক শ্রেণী ছোট বরফের পাহাড় (Snowy range), ছবির ন্যায় আঁকা রহিয়াছে। এ দিকে চাহিলে মনে হয় যেন পৃথিবী কেবল এক অনন্ত পৰ্ব্বত শ্রেণী।

মিলিয়ে নিই অভিজ্ঞতার তফাতকে, মিলিয়ে নিই দুর্গমতার সংজ্ঞাকে। বহু বছরের ব্যবধান থেকে আসা এই দৃশ্যে কিন্তু কোনও তফাত নেই। কোথাও যেন হৃদয় পূর্ণ হয় কৃতজ্ঞতায়। আমাদের পূর্বনারীদের লড়াইয়ের প্রতি কৃতজ্ঞতা। আর কৃতজ্ঞতা দময়ন্তীর প্রতিও। কেননা তাঁর লড়াইয়ের ফলেই এই বইটি আমাদের সামনে আজ।

 

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 4664 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

Be the first to comment

আপনার মতামত...