“আমার ভিতরের নারীরা সবাই ক্লান্ত”— বিলকিস বানো ধর্ষণ ও খুন মামলা এবং আমরা

তানিয়া লস্কর

 


বিলকিস, বদাও এবং উন্নাও, এই তিনটি মামলার তুলনামূলক অধ্যয়ন করলে এটা অন্তত স্পষ্ট হয়ে পড়ে যে অমৃতকালে কীভাবে মহিলাদের সামাজিক অবস্থান ক্রমে অতলে নামছে। আর এর সঙ্গে পাল্লা দিয়ে অপরাধীদের সাহস কতটা বেড়ে চলেছে। সুতরাং আমাদেরকে এই চিন্তাগুলো মাথায় নিয়ে লড়ে যেতে হবে। বিলকিস কিংবা উন্নাও-এর পীড়িতার আইনি জয়গুলোর পিছনে লুকিয়ে আছে যে ক্লান্তি সেটাও আমাদেরকে স্বীকার করতে হবে। এর স্বীকৃতি দিতে হবে। আমাদের এই ক্লান্তিগুলো শুধু মেয়েলি আবেগের কাব্যিক বহিঃপ্রকাশ নয়। বরং আমাদের ক্লান্তিগুলো ভীষণ রাজনৈতিক

 

নারীবাদী জ্ঞানতত্ত্বে শিরোনামে উদ্ধৃত উক্তিটি বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। নারীবাদী কবি নায়রা ওয়াহিদ তাঁর লেখা কাব্যগ্রন্থ ‘সল্ট’-এ এই শিরোনামে একটি কবিতা লিখেছিলেন। পিতৃতান্ত্রিক ব্যবস্থায় নারীদের অস্তিত্বের লড়াই কীভাবে তাদের ভিতরের প্রাণশক্তি শুষে নিয়ে তাদেরকে ক্লান্ত অবসন্ন করে দেয় তারই দলিল হিসেবে যুগ যুগ ধরে উদ্ধৃত হয়ে আসছে এই উক্তিটি। ভারতীয় সমাজব্যবস্থা যাকে উমা চক্রবর্তী ‘ব্রাহ্মণ্যবাদী পিতৃতান্ত্রিকতা’ বলে চিহ্নিত করেছেন সেখানেও যুগ যুগ ধরে এরকমই ঘটে আসছে। তার একটি প্রমাণ হচ্ছে বিলকিস বানো মামলা।

সেই ২০০২-এর ৩ মার্চ তারিখে ঘটেছিল এই জঘন্য ঘটনাটি। বিলকিস বানোকে ৫ মাসের গর্ভাবস্থায় দলবদ্ধভাবে ধর্ষণ করে খুনের চেষ্টা করে ধর্মান্ধ এবং রাজনৈতিক মদতে বলীয়ান একদল পুরুষ। তাঁর পরিবারের অন্য ১৪ জনকে খুন করা হয়। এরপর ন্যায়ের লড়াই চলছে আজ দুই দশক। ঘটনার দিন অত্যাচারের পর বিলকিস চৈতন্য হারিয়ে ফেলেন বলে অপরাধীরা ধরে নেয় যে তিনি মারা গেছেন। তাই তাঁকে ফেলে চলে যায় তারা। তিনি ৩/৪ ঘন্টা পর হুঁশ ফিরে পেলে পাশে রাখা একটি পেটিকোট গায়ে জড়িয়ে গ্রামের দিকে হাটা দেন। সেখানে এক আদিবাসী নারী তাঁকে দেখতে পেয়ে আরও কিছু কাপড় দেন। তখন তিনি থানায় গিয়ে এজহার দেন। তিনি প্রায় সব অপরাধীদের নাম বললেও পুলিশ সেগুলো লেখে না এবং তাঁকে গোধরা রিলিফ ক্যাম্পে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। সেখানে একজিকিউটিভ ম্যাজিস্ট্রেট জায়ন্তি রবি তাঁর বয়ান লিপিবদ্ধ করেন এবং তাঁর বয়ানের ভিত্তিতে পরিবারের বাকি ৭ জনের মৃতদেহ উদ্ধার করা হয়। কিন্তু সে-বছর নভেম্বর মাসে গুজরাত পুলিশ ‘সামারি রিপোর্ট’ জমা দিয়ে বলে যে ঘটনা সত্যি হলেও অপরাধীদের সনাক্ত করতে পারেনি তারা। তাই মামলাটি এখানেই খারিজ করে দেওয়া হোক। আদালত পুলিশের আবেদন না মেনে তদন্ত চালিয়ে যাওয়ার নির্দেশ দেয়। পুলিশ ২০০৩ সনের ফেব্রুয়ারি মাসে আবার একই আবেদন জানায়। এবার কোর্ট সেই আবেদন মেনে নেয়। বিলকিস সুপ্রিম কোর্টে আপিল করেন এবং সিবিআই তদন্তের দাবি জানান। ২০০৩-এর ডিসেম্বর মাসে সুপ্রিম কোর্ট সিবিআই তদন্তের আদেশ দেয়। ২০০৪ সালের এপ্রিল মাসে সিবিআই ২ ডাক্তার এবং ৬ পুলিশ সহ মোট ২০ জনের বিরুদ্ধে চার্জশিট জমা দেয়। এর মধ্যে মামলায় গুজরাতে সরকারি হস্তক্ষেপের সন্দেহ করা হয়। সেজন্য সুপ্রিম কোর্ট মামলাটি মুম্বাইয়ের আদালতে স্থানান্তরিত করার নির্দেশ দেয়। ২০০৮ সালে শেষমেশ মামলায় রায় দান করা হয়। এবং ১১ জনকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেওয়া হয়। ২ জন অপরাধী মামলা চলাকালীন মারা যায়। ২০১৭ সালে এই রায়ের বিরুদ্ধে অপরাধীরা মুম্বাই হাইকোর্টে আপিল করে। সিবিআইও আপিল করে ৩ জন অপরাধীর ফাঁসির দাবি জানায়। মুম্বাই হাইকোর্ট আগের কোর্টের রায়কে বহাল রাখে। এরপর আরেক দফা সুপ্রিম কোর্টে আপিল হয় সেটাও মোটামুটি একই থাকে। এর মধ্যে ২০১৭ সালে বিলকিস সুপ্রিম কোর্টে ক্ষতিপূরণের দাবি জানিয়ে আপিল করেন এবং এটাও জানান যে মামলা চলাকালীন তাকে প্রাণের ভয়ে পরিবার-সহ লুকিয়ে থাকতে হয়েছে। এখন তিনি ফিরে যেতে চান তবে এখনও ভয়ে আছেন। সুতরাং তাঁর সুরক্ষা সুনিশ্চিত করে তাঁর জেলায় তাঁকে একটি সরকারি বাসভবন দেওয়া হোক। সুপ্রিম কোর্ট ৫০ হাজার টাকা ক্ষতিপূরণের রায়-সহ তাঁর দাবি মেনে নেন। ২০১৯ সালে প্রথমবারের মতো বিলকিস নিজের জেলায় ভোট দেন। এর মধ্যে ২০২২ সালে অপরাধী রাধেশ্যাম শাহ ১৪ বছর কারাদণ্ড ভোগ করার পর গুজরাত হাইকোর্টে সাজা মকুবের দরখাস্ত করে। সেখান থেকে তাকে মহারাষ্ট্র সরকারের কাছে আপিল করতে নির্দেশ দেওয়া হয়। শেষমেশ সে সুপ্রিম কোর্টে আবেদন করে। সুপ্রিম কোর্ট গুজরাত সরকারকে এই আবেদন বিবেচনা করতে নির্দেশ দেয়। অবশেষে ২০২২ সালের ১৫ আগস্ট ১১ জন অপরাধীর সাজা মকুব করে তাদেরকে মুক্তি দেওয়া হয়। এরপর শুরু হয় আরেক দফার লড়াই। এই সাজা মকুবের বিরুদ্ধে কয়েকটি জনস্বার্থ মামলা দাখিল হয়। সিপিএম নেত্রী সুভাষিণী আলি, সমাজসেবী রূপরেখা বর্মা এবং প্রাক্তন এনডিটিভি সাংবাদিক রেভতি লাল একটি মামলা করেন। তৃণমূল নেত্রী মহুয়া মৈত্র একটি মামলা করেন। এবং বিলকিস নিজেও একটি আবেদন দাখিল করেন। গত ৮ জানুয়ারি সেই আবেদনগুলির শুনানি করে অপরাধীদের ২ সপ্তাহের মধ্যে আত্মসমর্পণ করার নির্দেশ দেয় সুপ্রিম কোর্ট। এর মধ্যে জানা গেছে যে ১১ জনের মধ্যে ৮ জন অপরাধীই নিখোঁজ হয়েছেন।

গত ২১ বছর ধরে এই পুরো প্রকরণ চলছে। এর মধ্যে অনেক কিছু ঘটেছে। বিলকিসকে আইনি সাহায্য করতে এগিয়ে আসা তিস্তা শেতলওয়াড়কেও জেলে যেতে হয়েছে। গুজরাট গণহত্যার নায়করা দিল্লিতে বিরাজ এবং রাজ করছেন। কিন্তু বিলকিস হার মানেননি। তিনি লড়ে গেছেন। অবশেষে ফলাফল কী হল? অপরাধীদের জেল থেকে বেরোনোর পর মালা পরানো হল। গুজরাটের এক বিজেপি বিধায়ক অপরাধীদের পক্ষ নিয়ে বললেন যে অপরাধীদের অনেকেই ব্রাহ্মণ-সন্তান, তাই তারা এরকম কাজ করতেই পারে না। সুপ্রিম কোর্ট মহিলা আইনজীবীকে ধমক দিয়ে আবেগপ্রবণ না হতে আদেশ দিল। আমরা বেশিরভাগ মানুষ বছরের পর বছর ধরে শুধু নীরব দর্শক হয়ে থেকেছি। কিন্তু এছাড়া কীই বা করতে পারি আমরা। বিলকিসের পরে কি আরও এরকম মামলা ঘটেনি? ঘটেছে তো। ২০১৫-তে উত্তরপ্রদেশের বদাওতে দুজন নাবালিকাকে ধর্ষণ করা হয়। সে কেসে সিবিআই ক্লোজার রিপোর্ট দিয়েছে। কোর্ট সে রিপোর্ট ডিসমিস করেছে তাই রক্ষে। এখনও মামলা চলছে। ২০১৭তে উন্নাও ধর্ষণকাণ্ড হয়েছে। অপরাধী কুলদীপ সিং সেঙ্গারের সাজা হয়েছে। কিন্তু চরম মাশুল দিতে হয়েছে ভুক্তভোগীকে। তাঁর বাবা পুলিশ কাস্টডিতে মারা গেছেন। পরিবারের আরও দুজন লোক-সহ তিনি মারা যান কোর্টে যাওয়ার পথে একটি ট্রাক দুর্ঘটনায়। পরে জানা যায় সেটিও অপরাধীরা মিলে উদ্দেশ্যমূলকভাবে সংঘটিত করেছিল। সেও হয়তো কোনওদিন এরকম কোনও আইনের ফাঁক বের করে সাজা মকুব কিংবা অন্য কোনও উপায়ে ছাড়া পাবে। হতেই পারে তো। এই তিনটি মামলার তুলনামূলক অধ্যয়ন করলে এটা অন্তত স্পষ্ট হয়ে পড়ে যে অমৃতকালে কীভাবে মহিলাদের সামাজিক অবস্থান ক্রমে অতলে নামছে। আর এর সঙ্গে পাল্লা দিয়ে অপরাধীদের সাহস কতটা বেড়ে চলেছে। সুতরাং আমাদেরকে এই চিন্তাগুলো মাথায় নিয়ে লড়ে যেতে হবে। বিলকিস কিংবা উন্নাও-এর পীড়িতার আইনি জয়গুলোর পিছনে লুকিয়ে আছে যে ক্লান্তি সেটাও আমাদেরকে স্বীকার করতে হবে। এর স্বীকৃতি দিতে হবে। আমাদের এই ক্লান্তিগুলো শুধু মেয়েলি আবেগের কাব্যিক বহিঃপ্রকাশ নয়। বরং আমাদের ক্লান্তিগুলো ভীষণ রাজনৈতিক। তাই রাজনৈতিক উপায়েই এর উপশম সম্ভব। সেই রাজনীতিটা শিখতে হবে নতুন যুগের ছেলেমেয়েদেরকে। যত তাড়াতাড়ি আমরা সেটা বুঝতে পারব ততই আমদের ব্যাক্তিগত এবং সামাজিক ‘মুক্তি’ ত্বরান্বিত হবে।


*মতামত ব্যক্তিগত

 

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 4664 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

1 Comment

  1. ভালো লেখা, শেয়ার করছি, মুখপাত সহ।

    “মুক্তি”র কথা বলতে পারবো না, সে বড়োই জটিল। কিছু কিছু মুক্তি তো ঘটেই চলেছে সর্বদা, প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে।
    সার্বিক মুক্তি প্রচেষ্টা কতোটুকু সম্ভব, জানিনা, ১৯১৭ ১৯৯০তে শেষ, ১৯৪৯ এখনো বেঁচে আছে কি না অথবা ফ্লোরিডার বিপরীত তীর।
    আবার, কর্ণাটকের আগের সরকারের সময়ে মেয়েদের “হিজাব” পরা মুক্তির দ্যোতক ছিলো, অন্যত্র যা বন্ধনের, সঙ্গীতকার আল্লারাখা রাহমানের “হিজাব” সহ সারা শরীর ব্যান্ডেজ করা সঙ্গীতকার মেয়ের বোরখাতেই গর্বিত মুক্তি, সেই নিজের বাবার কাছেই ছোটবেলায় শোষিত উরফি জাভেদের নগ্নতায় বন্ধনহীনতা – তাই ব্যাপারগুলি আপেক্ষিকও বটে। কেয়া চক্রবর্তীর মুক্তি কি আর স্বাতীলেখা বা সোহিনীর তুল্যমূল্য?
    তবে একটা ব্যক্তি মানুষের পরিবেশ সাপেক্ষে বড়ো হয়ে ওঠা, চারপাশের মূল্যবোধ ব্যবস্থা তার মনের গড়ন করে, তার অন্যথা হলে সমস্যা তৈরি হয়।
    তারই প্রাসঙ্গিক বিবরণ-

    মানসিক স্বাস্থ্য সম্বন্ধিত একটি জরুরী নিবন্ধ
    যখন হিংস্রতা, বৈষম্য এবং অপমান বিরামহীন চলতে থাকে, তখন পোস্ট-ট্রমাটিক স্ট্রেস ডিসঅর্ডার (PTSD) জাতীয় প্রতিষ্ঠিত ক্লিনিকাল শব্দবন্ধ দিয়ে তাদের প্রভাব ঠিক ঠাক বোঝা যায় না। ট্রমা পরবর্তী প্রতিক্রিয়াগুলিও চক্রাকারে চলতে থাকে। মানসিক স্বাস্থ্য, স্বাচ্ছন্দ্য, স্থিতিস্থাপকতা এবং বেঁচে থাকার মানেকে আবার নির্দেশ করতে নতুন লেন্স আর পদ্ধতির প্রয়োজন। এমনটাই বলছেন সমাজ কর্মী, গবেষক হাসিনা খান, তাঁর সুদীতি জিএম আর উমারা জয়নবের সাথে করা সাম্প্রতিক এক গবেষণায় । গবেষণাটি করা হয়েছে তাঁর সংস্থা ‘বেবাক কালেক্টিভ’ দ্বারা যাতে গবেষকরা বিভিন্ন রাজ্য, শ্রেণি, বর্ণ, শিক্ষার বিভিন্ন স্তরের সাম্প্রদায়িকভাবে পীড়িত ভারতীয় মুসলমানদের সাক্ষাৎকার নিয়েছেন এইটা বোঝার জন্যে যে সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষপূর্ণ পরিবেশ পীড়িতদের যাপন এবং মানসিক স্বাস্থ্যের উপর কী প্রভাব ফেলে।
    এই বছরের ফেব্রুয়ারিতে শুরু করে ছয় মাস সময় ধরে খুব সতর্কতার সাথে একটি বিশেষ ধরণে সমীক্ষাটি করা হয়েছে। গত কয়েক বছরে সাম্প্রদায়িক মেরুকরণ এবং ঘৃণা উপজাত অপরাধের নাটকীয় বৃদ্ধি দেশের মুসলিম সম্প্রদায়ের মাথায় যে সামাজিক, মানসিক এবং আর্থিক সমস্যার দায় চাপায় তাকেই সমীক্ষার মূল বিষয় ধরা হয়েছে। গবেষণার পদ্ধতি হিসেবে বলা হয়েছে “আমরা বৃত্তটি প্রশস্ত রেখেছি এবং কারাবন্দী সমাজ কর্মী থেকে শুরু করে তাদের বন্ধুদের সাথে, যাদের পিটিয়ে মারা হয়েছে তাদের পরিবার, থেরাপিস্ট যারা মুসলিম রোগীদের মানসিক চিকিৎসা করেন, দাঙ্গার শিকারদের পরিবার এবং এছাড়াও বন্দী পুরুষদের পরিবারের অন্য সদস্যদের সাথে কথা বলেছি।”
    ভারতে মুসলমানদের মধ্যে মানসিক স্বাস্থ্য, আত্মসম্মান, সহনশীল প্রাণবানতা এবং বেঁচে থাকার মানে গুলিকে আবার নিশ্চিত করার জরুরী প্রয়োজন রয়েছে বলে মনে করা গবেষকরা প্যালেস্টাইনের স্বাস্থ্য মন্ত্রকের মানসিক স্বাস্থ্য ইউনিটের চেয়ার ডঃ সামাহ জাবরকে ব্যাপকভাবে উদ্ধৃত করেছেন। জাবর বলছেন মানসিক অসুস্থতার প্রাপ্তব্য/পশ্চিমী শ্রেণীভাগগুলিকে ব্যবহার করে পোস্ট-ট্রমাটিক স্ট্রেস ডিসঅর্ডারের বা মানসিক আঘাত পরবর্তী মানসিক চাপের সমস্যার ক্লিনিকাল সংজ্ঞা ফিলিস্তিনিদের অভিজ্ঞতার ক্ষেত্রে যথেষ্ট নয়। তিনি বলছেন,
    “পিটিএসডি বরং একজন আমেরিকান সৈন্যের অভিজ্ঞতাকে সুন্দর ভাবে বর্ণনা করে যে ইরাকে বোমা ফেলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে তার বাড়ির নিরাপত্তায় ফিরে যায়। যুদ্ধক্ষেত্র সম্পর্কিত তার যে দুঃস্বপ্ন এবং ভয় সেটি কাল্পনিক। উল্টোদিকে গাজার একজন ফিলিস্তিনি, যার বাড়িতে একবার বোমাবর্ষণ হয়েছে এবং আবার, বার বার হবার সম্ভাবনা খুবই বাস্তব। এটা কাল্পনিক নয়। এতে কোনও ‘পোস্ট’ বা পরবর্তী নেই কারণ ট্রমা বা আঘাত, আতঙ্কটি পুনরাবৃত্তিমূলক, চলমান, ধারাবাহিক।”
    এই মানসিক আঘাতের অনেক কারণ আছে, বেবাক কালেক্টিভ সমীক্ষা শুরু করে “আইনের ঘেরাটোপে” ঘটা হিংস্রতা গুলিকে খুঁটিয়ে দেখার মাধ্যমে। ভারতীয় মুসলমানদের পদ্ধতিগতভাবে বিচ্ছিন্ন এবং একা করে দেওয়ার জায়গাতে আইনের একটা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে এবং তার ভিত্তি হিসেবে কাজ করছে হিন্দুত্বের সংখ্যাগরিষ্ঠতাবাদী কল্পনা এবং তাকে তৃণমূলে ছড়িয়ে বা চারিয়ে দেবার সাফল্য। সমীক্ষাটি লক্ষ্য করে যে আইন গুলি এমন ভাবে প্রবর্তন করা হচ্ছে যাতে ভারতকে একটি “হিন্দু” জাতীয়তাবাদি রাষ্ট্র ভেবে নেবার, সাথে হিন্দুদের অস্তিত্ত্বের জন্যে “মুসলিমরা” হুমকি স্বরূপ এই ধারণাটি শক্তিশালী হয়।
    গত কয়েক বছরে, বিশেষত, নাগরিকত্ব (সংশোধন) আইন এবং দেশব্যাপী হতে যাওয়া আগামী জাতীয় নাগরিক নিবন্ধন (এনআরসি) এবং জাতীয় জনসংখ্যা নিবন্ধন (এনপিআর) এর বিরুদ্ধে প্রতিবাদের পরিপ্রেক্ষিতে ইউএপিএ বা বেআইনি কার্যকলাপ (প্রতিরোধ) ) আইনটি মুসলিম সম্প্রদায়ের নেতা, কর্মী এমনকি সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে নির্বিচারে ব্যবহার করা হয়ে চলেছে। “মুঝে রাত মে নিন্দ নেহি আতি। কোর্ট কা ওয়েবসাইট হি দেখা রেহতা হুঁ পুরি রাত। (আমি রাতে ঘুমাতে পারি না। সারা রাত আদালতের ওয়েবসাইটই চেক করতে থাকি)” বলছেন তরুণ বয়স্ক বিলাল, যার ভাইকে 2020 সালের ফেব্রুয়ারিতে দিল্লির গণহত্যার পর একটি মিথা মামলায় জড়ানো হয়েছে।
    শাহীনবাগ আন্দোলনের সক্রিয় কর্মী তৈয়বা গবেষকদের বলেছেন, “পরিবারের বাবা বা ভাই যদি সোচ্চার এবং রাজনৈতিকভাবে সক্রিয় হয়, রাষ্ট্রের প্রতিক্রিয়াতে পরিবারের বাকি সদস্যরা ক্ষতিগ্রস্ত হয়। পরিবারের প্রধান পুরুষ সদস্যকে গ্রেপ্তার করা হলে নিরাপত্তা না থাকায় বিচ্ছিন্নতা এবং সংকটের অতল অনুভূতিতে তলিয়ে যেতে হয়।” স্বামীকে গ্রেফতারের সময় তাকে একাই থানায় যেতে হয়েছিল এবং সেই মুহুর্তে কেউ তার পাশে ছিল না।
    গবেষকরা বলছেন, ক্রমাগত চলতে থাকা ট্রমা বা মানসিক আঘাতের জন্যে প্রায়শই নিপীড়িতের দৈনন্দিন জীবন এবং পারস্পরিক মানবিক সম্পর্ক রাখার পরিবর্তন ঘটায়। তারা কিভাবে তাদের চারপাশের জগতের সাথে সম্পর্ক রাখবে তাকে প্রভাবিত করে এবং এক্ষেত্রে তাদের ধর্মীয় পরিচয়টাই মুখ্য হয়ে দাঁড়ায়। তাদের ধর্মীয় পরিচয় ঠিক করতে থাকে তারা কোথায় যাবে না যাবে, কি করে যাবে না যাবে, কার সাথে বসবে না বসবে, কার সাথে কথা বলবে না বলবে, কতক্ষণ কথা বলবে না বলবে ইত্যাদি প্রভৃতি। মধ্যপ্রদেশের খামারিয়ায় দাঙ্গার সময় মহিলারা সতর্কতা হিসেবে বিভিন্ন বাড়ি থেকে এক জায়গায় জড়ো হয়ে তালাবদ্ধ হয়ে ছিলেন এবং তারা কোথাও যাচ্ছিলেন না যদিও অর্থ সংকট এবং সন্তান ও আত্মীয়দের জন্যে উদ্বিগ্ন ছিলেন।
    দাঙ্গার কারণে সুযোগ হারানো শুধুমাত্র পরিবারের অর্থনৈতিক সম্ভাবনাকেই সীমিত করে না সাথে সাথে মানুষের আকাঙ্খা, স্বপ্ন এবং সামাজিকভাবে এগিয়ে যাওয়ার সম্ভাবনাকেও পালটে দেয়। একটি সাক্ষাৎকারে দিল্লির তরুণ বিলাল বলছেন তিনি ভেবেছিলেন ডাক্তারি পড়বেন কিন্তু দিল্লির গণহত্যার জন্যে ১২ ক্লাসের বোর্ড পরীক্ষা দিতে পারেন নি। এখন তার ২২ বছর বয়স, এখন ভাবছেন স্কুলের পরীক্ষার পাশাপাশি কম্পিউটার কোর্স শেষ করে পরিবারকে সাহায্য করবেন।
    সাক্ষাত্কারগুলিতে অনেকেই কর্ণাটক সরকারের ছাত্রদের হিজাব পরা নিষেধাজ্ঞা পরবর্তী বন্ধু এবং প্রতিবেশীদের সমর্থন হারানোর বেদনাদায়ক অভিজ্ঞতা ভাগ করে নিয়েছেন। বেঙ্গালুরুতে কর্মরত মানসিক স্বাস্থ্যের চিকিৎসক, শামিমা আসগর, যিনি বৈষম্য পীড়িতদের জন্যে কাজ করে থাকেন, বলছেন যে, “লোকেরা বন্ধুদের ব্যাপারে হতাশা, সম্পর্ক হারানোর বেদনার ব্যাপারে কথা বলে। আরো কষ্টের জায়গাটা হলো সেই সম্পর্ক হারানোর জন্যে দুঃখ করার জায়গাটাও হারিয়ে ফেলা কারণ যাদের সাথে সম্পর্ক শেষ হয়েছে তারা নিজেরাই ঘৃণার উৎসাহী প্রচারক”।
    শামিমা বলছেন যে প্রথাগত মানসিক স্বাস্থ্য চিকিৎসা ব্যক্তি বিশিষ্ট হয়, মানসিক স্বাস্থ্য চিকিৎসা হিংসার মূল খোঁজে না বরং মানসিক আঘাত ও যন্ত্রণার খারাপ প্রভাবগুলি কমিয়ে আনতে সাহায্য করে। এটি বলে, যে হিংসা সহ্য করেছেন তা থাকবে, আপনাকে শুধু এর সাথে বাঁচতে শিখতে হবে।
    গবেষণা প্রতিবেদনটি এই বিস্তারিত কাজ থেকে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ উপলব্ধিতে পৌঁছায় যে গোষ্ঠী মানুষের উপরে আসা প্রতিকারহীন আঘাত ব্যক্তি মানুষের আত্মবিশ্বাস এবং নিশ্চিন্তিকে মারাত্মকভাবে প্রভাবিত করে, সে কঠিন আইনী লড়াই চালিয়ে যাওয়াতেই হোক বা নিজের হিংসাগ্রস্ত জীবনকে পুনর্গঠনেই হোক। ঘৃণ্য মতাদর্শের উপর দাঁড়িয়ে থাকা ফ্যাসিবাদী রাষ্ট্র ব্যবস্থার সামনে শক্তিহীন বোধ করার একটি সর্বব্যাপী অনুভূতি সাম্প্রদায়িক হিংস্রতার শিকার অনেক মুসলিমকে তাদের জীবনযাপন পরিবর্তন করতে বাধ্য করেছে ।
    রিপোর্ট এখানেই শেষ।

আপনার মতামত...