যে তোরে হকার বলে, তুই তারে বলিস নে কিছু

অনুপম মুখোপাধ্যায়

 


রোদে পুড়ে জলে ভিজে হকারি করেই যদি নিজের লেখক পরিচয়কে বাঁচাতে হয়, সেটুকু সংগ্রাম মেনে নিতেই হবে। এটা সেই সময় যখন লেখকের সঙ্গে পাঠকের প্রত্যক্ষ যোগাযোগ তৈরি হবে। আজকের লেখক জানালার ধারে বসে ভাবের ঘোরে নিজের লেখা লিখে যেতে পারেন না। পাঠক যেমন তাঁর কাছে আসবেন, তাঁকেও পাঠকের কাছে যেতে হতে পারে। ফেসবুকে লেখকদের নিজেদের বই নিয়ে প্রচারকে যাঁরা অপমান করছেন, হয় তাঁরা ঈর্ষাকাতর, অথবা অন্ধ, অথবা তাঁরা প্রতিষ্ঠানের দালাল

 

আত্মপ্রচার আমার ধর্ম। কারণ আত্মপ্রকাশ আমার কর্ম। আমি সোশ্যাল নেটওয়ার্কে আছিই নিজের লেখা ও বইপত্রের খবর প্রচার করব বলে। অন্যথায় ফেসবুকে সময় নষ্ট করতাম না। বিদেশের একজন লেখক তাঁর বই বেরোনোর আগে প্রেস কনফারেন্স করেন। একের পর এক দেশে যান এবং বইটির সম্পর্কে বলেন, প্রশ্নের উত্তর দেন। বইটি যাতে বিক্রি হয়, সে-জন্য তাঁর চেষ্টার কোনও ত্রুটি থাকে না। তাঁকে ঘিরে ভিড় যে হয়, সেই ভিড় সেই লেখক এবং তাঁর প্রকাশক তৈরি করেন। হারুকি মুরাকামি, সলমন রুশদির একটি উপন্যাস সেভাবেই প্রকাশিত হয় যেভাবে একটি বিগ বাজেট সিনেমা। বিদেশের বিখ্যাত লেখকদের অটোগ্রাফ নেওয়ার জন্য লাইন দিয়ে লোকজন বই কেনে। আর সেটা আজ কেন? ঊনবিংশ শতাব্দীতে ইংল্যান্ডের চার্লস ডিকেন্স তাঁর বইয়ের প্রচার পৃথিবীতে ঘুরে ঘুরে করেছেন।

রবীন্দ্রনাথ বিংশ শতাব্দীর শুরুতে নিজের পাণ্ডুলিপি নিয়ে লন্ডনে গেছেন, এবং নোবেল ছিনিয়ে এনেছেন। ইয়েটস কি তাঁর সঙ্গে যোগাযোগ করেছিলেন? নাকি তিনি ইয়েটসের সঙ্গে? আর আজ আমাদের এখানে? লেখকরা নিজের বইয়ের সম্পর্কে কথা বললেই ভাবা হয় তাঁরা বই ফেরি করছেন, তাঁরা নাকি হকার হয়ে গেছেন। প্রচার করলেই ভাবা হয় তাঁরা হ্যাংলা। নিজের বই নিয়ে লেখকের কথা বলতে নেই, নিজের লেখার অকারণ নিন্দার প্রতিবাদ করতে নেই, এই ধারণাটার সূত্রপাত এখানে কবে থেকে হল? রবীন্দ্রনাথের আমলে তো ছিল না!

নিজের বইকে যে নিজের যৌনাঙ্গের মতো জনসমক্ষে আড়াল করে বের করতে হবে, এই ধারণা কবে থেকে এল? ‘উনি তো নিজের ঢাক পেটাতে ওস্তাদ।’… এই উক্তিগুলোর সূত্রপাত কবে থেকে? বাকি পৃথিবীর সঙ্গে তো এর কোনও মিল নেই! ‘প্রচারবিমুখ’… এই আখ্যাটা কবে থেকে লেখকের গুণ হয়ে উঠল? বইকে নাকি পণ্য বলতে নেই। কেন নেই? ‘পণ্য’ খুব খারাপ শব্দ, এটা বাঙালি ছাড়া অন্য কোনও জাত ভাবে কি? ওষুধ ছাড়া আমরা বাঁচি না, ওষুধ আমাদের জীবন দেয়। ওষুধ পণ্য নয়? আপনি টাকা না দিয়ে ওষুধ কিনতে পারবেন? দাতব্য চিকিৎসালয়ের ওষুধেরও কিন্তু দাম থাকে, এবং সেটা কাউকে না কাউকে দিতে হয়।

একজন নামকরা লেখক হয়তো আরও নামকরা এক খবরের কাগজে উত্তর-সম্পাদকীয় লিখলেন অথবা কোনও ফিচার লিখলেন। সেই লেখা তাঁকে কাটিং হিসেবে ফেসবুকে পোস্ট করতে হয় কেন? কারণ আজ খবরের কাগজের তুলনায় ফেসবুক অনেক শক্তিশালী মাধ্যম। তরুণ প্রজন্ম খবরের কাগজও মোবাইলের পর্দায় পড়ে। কিংবা তারা খবরের কাগজ পড়ার প্রয়োজন বোধ করে না। ফেসবুকই তাদের সমস্ত খবর দেয়। এটা ভাল না মন্দ সেই প্রশ্ন পরে, কিন্তু এটাই বর্তমান পরিস্থিতি। তাহলে কি সেই নামকরা লেখক আত্মপ্রচার করলেন না? কেন তাঁকে খবরের কাগজের কাটিং এখানে দিতে হল? কেন তখন তিনি লজ্জিত হলেন না?

একজন লেখক তাঁর বইয়ের প্রচার সামাজিক মাধ্যমে করবেন কিনা, তা নিয়েও কিছু বাঙালিকে ভাবতে হচ্ছে? কতখানি অধঃপতিত হয়েছে তাঁদের বাস্তববোধ আর সময়চেতনা? বই জিনিসটাকে তাঁরা কোন চোখে দেখেন? বই কি আকাশের রামধনু? নাকি বই তার লেখকের যৌনাঙ্গ যে তাকে লুকিয়ে রাখতে হবে? নিজের বইয়ের প্রচার এখানে করলে লেখক নাকি হকার হয়ে যাবেন! কী নির্লজ্জ উক্তি! প্রথম কথা এই উক্তিতে হকারদের অপমান করা হয়। দ্বিতীয় কথা, যদি একজন লেখকের পেছনে ঝাঁ চকচকে শোরুম না থাকে, কর্পোরেট ব্যবস্থা না থাকে, তিনি কী করবেন? তিনি কি সিস্টেমের কাছে আত্মসমর্পণ করবেন? নাকি একজন নাছোড়বান্দা হকারের জেদ সম্বল করে নিজেই লড়ে যাবেন নিজের বই নিয়ে? উচ্চাকাঙ্ক্ষী লেখককে আক্রমণ করতে গিয়ে একজন হকারের পরিশ্রম আর আত্মসম্মানবোধকে অপমান করা হল না কি?

এখানে যদি আপনি পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ উপন্যাসটাও লেখেন, কিন্তু আপনার পেছনে না থাকে কর্পোরেট প্রকাশক, সে বইয়ের খবর এমনিতে কেউ জানতেই পারবে না। প্রতিষ্ঠানের পালিত কিছু লোকই লেখক সেজে এখানে ঘুরে বেড়াবে। বইয়ের বাজারকে সেভাবেই তৈরি করা হয়েছে। একমাত্র উপায় নিজের বই নিয়ে নিজেই প্রচারে ঝাঁপিয়ে পড়া। সেই বইয়ের বিভিন্ন দিক পাঠকের সামনে তথা ক্রেতার সামনে তুলে ধরা। ফেসবুক সেই সুযোগ আজকের লেখককে দিয়েছে। এতে প্রতিষ্ঠান আপত্তি তো করবেই। তার একচেটিয়া কারবার নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। তার বই আর বিক্রি হচ্ছে না৷ ছোট প্রকাশনা থেকে বড় লেখকরা উঠে আসছেন। ক্রেতারা সেখানে ভিড় জমাচ্ছেন।

আমি ক্রেতা শব্দটাকে ব্যবহার করলাম। কারণ আমি বিশ্বাস করি বই একটা পণ্য। সাহিত্য তার বিমূর্ত ধারণা অনুসারে অবশ্যই পণ্য নয়। কিন্তু যে বইয়ের পাতায় তা লিপিবদ্ধ থাকে তা অবশ্যই পণ্য। যেমন গান পণ্য নয়, কিন্তু গানের MP3 প্লেয়ার পণ্য। একটা বইয়ের প্রত্যেকটা কপি পণ্য, কারণ তাদের গায়ে দাম লেখা থাকে, কপিরাইট লেখা থাকে। পণ্য শব্দটায় কিছু ছাপোষা বাঙালির এত আপত্তি কিসের? যে ওষুধ আমাদের জীবন দেয়, যে স্যালাইন আমাদের জীবন দেয়, যে ভ্যাকসিন আমাদের রোগ থেকে রক্ষা করে, সেগুলোও কিন্তু পণ্য। টাকা না থাকলে আপনার চিকিৎসা হবে না। আজ যদি পৃথিবীতে অমৃত আবিষ্কৃত হয়, সেটাও পণ্যই হবে, সবাই তা কিনতে পারবে না, পৃথিবীর সবচেয়ে ধনী লোকেরাই তা কিনতে পারবে। লিওনার্দো দা ভিঞ্চি বা পাবলো পিকাসোর আঁকা ছবিও পণ্য। উইলিয়াম শেক্সপিয়রের রচনাবলি পণ্য। আমার লেখা উপন্যাসও পণ্য। টাকা না থাকলে আপনি রবীন্দ্র রচনাবলি বাড়িতে আনতে পারবেন? আপনার কিন্তু ‘রক্তকরবী’ পড়াই হবে না।

একটা বই তৈরি হয় বিভিন্ন ধাপে। কম্পোজিটর, প্রুফ রিডার, মলাটশিল্পী, বাঁধাইকর্মী… প্রত্যেকে নিজের নিজের কাজ করেন টাকার বিনিময়ে। বই বিক্রি হয় বলেই তাঁদের পারিশ্রমিক জোটে। অন্যথায় তাঁরা খেতে পেতেন কি? বইকে পণ্য নয় বলার আগে তাঁদের মুখগুলো একবার ভেবে দেখবেন।

 

আসলে প্রতিষ্ঠান এখন আর সহ্য করতে পারছে না যে তাদের বাজার গেছে, আর ফেসবুকের লেখকরা নিজেদের প্রচারের জোরে নিজের কাজ পাঠকদের কাছে পৌঁছে দিচ্ছেন। আগে লেখকদের চড়তে হত প্রতিষ্ঠানের কোলে। প্রতিষ্ঠান তখন খোকা দেখাত… ‘এই দ্যাখো খোকাবাবু কত সুন্দর, এই হল আমাদের আসল খোকা, বাকি সব দুষ্টু লোক, ওদের দিকে তাকিও না।’ অথবা ‘এই দ্যাখো আমাদের মিষ্টি খুকুমণি। আমাদের এই খুকু ছাড়া যারা লেখে তারা সবাই রাক্ষসী, ওদের দিকে তাকাতে নেই।’ কিন্তু আজ ফেসবুকের দৌলতে লেখকরা নিজেরাই নিজেদের দেখাতে পারেন। আজ লেখকরা বই কেনার অনলাইন লিঙ্ক মেল করে দিতে পারেন। তখন প্রতিষ্ঠান তো বিলাপ করবেই। সে নালিশের সুরে বলবে লেখক কেন আত্মপ্রচার করছে। ইশ, অনুপম কী যাচ্ছেতাই, শুধু নিজের লেখা লোককে পড়িয়ে নিতে চায়!! আগেই ভাল ছিল, বলুন? যখন প্রকৃত ক্ষমতাশালী লেখকদের খবরই পেত না পাঠক, আর প্রতিষ্ঠানের পোষা কলমচিরাই রাজত্ব করতেন… নিশ্চয়ই ভাল ছিল সেদিন?

কিন্তু, তাহলেও, সর্বাধিক প্রচারিত সাময়িকপত্রটিতে প্রকাশিত লেখা সেইদিনই ফেসবুকে কেন পোস্ট করতে হয়? আসলে প্রতিষ্ঠানের কোল এখন ছোট হয়ে গেছে, আর আন্তর্জাল… বিপুল।

হে লেখক, আসুন নিজে প্রতিষ্ঠান হয়ে উঠুন, নিউজে প্রতিষ্ঠিত হবেন না, লাভ নেই আর।

এরপর যদি কেউ আপনাকে নিজের বইয়ের হকার বলে… মন্দ কিছুই নয়। সবাই তো ঝাঁ চকচকে দোকানে বসে ‘বেওসা’ করতে পারে না। রোদে পুড়ে জলে ভিজে হকারি করেই যদি নিজের লেখক পরিচয়কে বাঁচাতে হয়, সেটুকু সংগ্রাম মেনে নিতেই হবে। আমি স্পষ্ট কথা বলছি। এটা সেই সময় যখন লেখকের সঙ্গে পাঠকের প্রত্যক্ষ যোগাযোগ তৈরি হবে। আজকের লেখক জানালার ধারে বসে ভাবের ঘোরে নিজের লেখা লিখে যেতে পারেন না। পাঠক যেমন তাঁর কাছে আসবেন, তাঁকেও পাঠকের কাছে যেতে হতে পারে। আজকের দিনে দাঁড়িয়ে সেটাই বাঞ্ছনীয়। ফেসবুকে লেখকদের নিজেদের বই নিয়ে প্রচারকে যাঁরা অপমান করছেন, হয় তাঁরা ঈর্ষাকাতর, অথবা অন্ধ, অথবা তাঁরা প্রতিষ্ঠানের দালাল। তাঁরা চান স্থিতাবস্থা বজায় থাক। বাজার যেমন চলছে চলুক। শক্তিশালী লেখকরা নিঃশব্দে প্রতিষ্ঠানের চাকার তলায় পিষে যান আর ছদ্মলেখকদের রাজত্ব চলুক।

 

 

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 4662 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

1 Comment

  1. খুব ভালো লেখা। অনুভূমিক প্রসারের সময় কিছু তরলিকরণ অনিবার্য। তা নিয়ে হাহুতাশ করা বুদ্ধির কাজ নয়।

আপনার মতামত...