কলকাতা বইমেলা: এক কাল্পনিক ভূখণ্ড

সুস্নাত চৌধুরী

 


২০০০ সালে প্রকাশিত হয় আলবের্তো মাঙ্গেল ও জিয়ান্নি গুয়াদালুপি-র বিচিত্র একটি বই— ‘The Dictionary of Imaginary Places’। বিশ্বসাহিত্যে উল্লেখ হওয়া বিবিধ কাল্পনিক স্থানের অভিধান। মাঝেমধ্যে ভাবি, এমন একটা বই যদি বাংলায় থাকত, কী ভালই-না হত! বর্ণানুক্রমে না-সাজানোর স্বাধীনতা পাওয়া গেলে আমি চাইতাম, সে-বইয়ের প্রথম এন্ট্রিটিই হোক— ‘কলকাতা বইমেলা’। আমার কাছে যা আজ খুব প্রিয় এক কাল্পনিক ভূখণ্ডের নাম

 

এতদিন পরে এসে আমি বুঝেছি, জীবন থেকে দু-টি জিনিস আমার স্রেফ মুছে গিয়েছে। শীতকাল আর বইমেলা। ইশকুলবেলার ‘একটি শীতের সকাল’ রচনা থেকে হালফিল বন্ধুজনের ‘রঙিন নৈশকালীন পার্টি’ প্ররোচনা— আমার সঙ্গে এই সবকিছুরই যোজন দূরত্ব তৈরি হয়েছে কালক্রমে। পার্ক স্ট্রিট থেকে খেজুরের রস, বার-বি-কিউ থেকে বাইশ গজের টস। শীতের এসব ফুর্তিফার্তা একেবারে নেই হয়ে গিয়েছে জীবনে। শুকনো নেশার থেকেও শুকনো— ফাটা গোড়ালির মতো এক শীতকাল আমার বাৎসরিক ক্যালেন্ডার সেজে কম্পিউটারের ডান কোণে শেষমেশ জায়গা করে নিয়েছে।

আর আমি— উৎপল ও ভাস্করের গুরুচণ্ডালে, আমার ব্যক্তিগত শীতকাল বাদামপাহাড়ে হারিয়ে কোন মহৎ কাজে ব্রতী হয়েছি? সংশোধন আর সম্পাদন। লেখা বাছা আর পাতা সাজানো। তাগাদা দেওয়া আর তিনবার মার্তণ্ড-মার্তণ্ড-মার্তণ্ড জপে মাথা ঠান্ডা করা। অভিশপ্ত লাল কালি ঘুম ভাঙিয়ে দিচ্ছে মধ্যরাতে। ভোরের কুয়াশায় ভেজা বকুলফুল অস্থানে ঝরে পড়ছে ভুল যতিচিহ্নের মতো। আমার পাহাড়-প্রমাণ অশিক্ষা ঢাকা-চাপা দিতে সার বেঁধে ঠায় দাঁড়িয়ে থাকছেন হরিচরণ থেকে অশোক মুখুজ্জে, ঘোর বিব্রত বোধ করছে শিকাগো ম্যানুয়াল কিংবা চলন্তিকা। প্রুফ থেকে প্রুফান্তরে এ যেন এক অনন্ত যাত্রা। ভায়া গঙ্গানগর, মধ্যমগ্রাম। শীতের দুপুরে ময়দানের বদলে আমি পৌঁছে যাচ্ছি নির্ধারিত ছাপাখানায়।

কোন দেশোদ্ধারের উদ্দেশ্যে এই কৃচ্ছসাধন? আহা! বই বেরোবে, পত্রিকা বেরোবে! আমরা বইমেলায় যাব! এই পর্যন্তও না হয় ঠিক ছিল; কিন্তু বইমেলা যে বইমেলা, সেও কি আর বরাতে রইল? চাষ করে ঘরে ফসল তুললেই তো শুধু হয় না, তা যে হাটে গিয়ে বেচতেও হবে। অতএব এডিটরের শীতকালীন পোশাক ছেড়ে মেলা উপলক্ষ্যে মার্কেটিং আর সেলসের হ্যাপা সামলানো। পায়ে পায়ে ধুলো উড়িয়ে একদিন যে বইমেলা চষে ফেলা হত, সেইসব অভ্যাস স্মৃতি হয়ে উড়ে গেল কাজ-ফুরোনো রংচটা কার্বনিক পেপারের সঙ্গে। স্থিতি আর গতির অবস্থান বদল ঘটল। বইমেলা আর ঘুরতে আসা নয়— বসতে আসা। দেখতে আসা নয়— দেখাতে আসা। এই বই, সেই বইয়ের বদলে মন ব্যস্ত হয়ে পড়ল কৌরব শিবিরের মতো একশো গৃধ্নু ও অভিন্ন পাতায় ঠাসা একটি মাত্র বই নিয়েই— ক্যাশমেমো। এই একঘেয়ে পাটিগণিতের নাম হয়ে গেল লিটল ম্যাগাজিন। বিগ বাজারের নাম বইমেলা।

 

এসব অবশ্য এক দিনে হয়নি। কলকাতা বইমেলা যখন ময়দানে ছিল, তখন হাওড়া স্টেশন থেকে বেলা দেড়টা-দুটোর পার্ক স্ট্রিট-গামী বাসে উঠেও এতটা টের পাইনি। দু-পায়ের ফাঁকে পত্রিকার ব্যাগ, কিন্তু চোখ থাকত জানলা দিয়ে বাইরের দিকে স্থির। বাটা মাঠ, কালীঘাট মাঠে তখন হয়তো চলছে কোনও টু-ডেজ ম্যাচ। বাস যদি সিগনালে দাঁড়াত, বাউন্ডারির কাছাকাছি থাকা ফিল্ডারের পোশাকের ঔজ্জ্বল্য দেখেই সচরাচর আঁচ করে নেওয়া যেত, এই খেলা ফার্স্ট ডিভিশন না সেকেন্ড ডিভিশনের। সেসব টি-টোয়েন্টির আগের জমানা। ক্রিকেট তখনও মৃদুমন্দ ঢঙে উপভোগ করা যেত। কলকাতা মাঠের লাল বলের খেলা তো যেতই। দু-দশ জন দর্শক, গাছের ছায়ায় হয়তো কিছুটা জিরিয়ে নিচ্ছেন সস্তার শাঁকালু বিক্রেতা, তাঁর পাশেই লেবু-জল। বাস ছেড়ে দিত, ক্রিকেট থেকে মোড় ঘুরিয়ে এনে দিত বইয়ের কাছাকাছি। কার্ডাসের দীর্ঘ বাক্যের মতো খুব ধীর পায়ে মাথা নিচু করে আমিও ঢুকে যেতাম বইমেলায়— ‘The Australians stuck to the hopeless toil philosophically and Bradman changed his bowling, and the umpires counted the overs, and the runs mounted, and the clouds rolled on, and the gas-holder went up and down, and the trams went by the ground, and the hours waxed and waned, and somewhere even the weariest river wound safe to sea.’

 

শীতের হাতছানিগুলি ক্রমে চলে যেতে থাকলেও, কলকাতা বইমেলা তখনও পর্যন্ত বইমেলার মতো টিকে ছিল আমার কাছে— ডেবিট-ক্রেডিটের খতিয়ান হয়ে ওঠেনি। কিন্তু বছর কয়েকের মধ্যেই পত্রিকার ব্যাগ ভারী হয়ে উঠল। বাসের বদলে আমাকেও উঠতে হল ট্যাক্সিতে। যুবভারতী পেরিয়ে বইমেলা চলে গেল খেলাধুলো থেকে বিস্তর দূরে। বইমেলায় নিত্য উপস্থিতি যত আবশ্যক হল, নির্দিষ্ট কাজে যত বাঁধা পড়তে থাকলাম, ততই দ্রুত যেন তাকে হারিয়েও ফেললাম। সেসব স্মৃতি আজ ছেলেবেলার পাঠ্যপুস্তকের মতো যুগপৎ সহজ ও বাতিল। ফলে এই বছরের কিংবা সাম্প্রতিক অতীতের কোনও কলকাতা বইমেলাতেও আমার অভিজ্ঞতা, এ-লেখায় সম্পাদকমণ্ডলী যা চেয়েছেন, তা বস্তুত বইমেলায় থেকেও আমার বইমেলায় না-থাকার অভিজ্ঞতা মাত্র। অকিঞ্চিৎকর, অর্থহীন।

অর্থহীন লেখা যে শুধু অর্থের প্রয়োজনেই লিখতে হয়, তা নয়। লেখ্য বস্তুর অভাব কিংবা পাঠকের ধৈর্য-পরীক্ষাও তার উদ্দেশ্য হতে পারে। তবে উপস্থিত পাঠকের ধৈর্যের পরীক্ষা আর চালিয়ে যাওয়া অসমীচীন হবে। গত কলকাতা বইমেলার একটি মাত্র অভিজ্ঞতার কথাই শেষমেশ শেয়ার করা যাক। সন্দীপ দত্তের নামাঙ্কিত হলেও লিটল ম্যাগাজিন তাঁবুটি এ-বছর নিপুণ দক্ষতায় নির্মিত হয়েছিল টাইটানিক থিমে। টালমাটাল পাটাতনে-সিদ্ধ সেই প্যাভেলিয়নের পাশে শুধু কৃষ্ণকলি ইসলামের গানের লাইনগুলিই যা লেখা ছিল না— ‘আজ ঝড় ভালবাসা আনন্দে ভেসে যাওয়া, ডুবি ডুবি ভেসে উঠি অঙ্গনে আমার!’ সেখান থেকেই টানা চোদ্দ দিন হজম করা এ একেবারে প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা।

অভিজ্ঞতার কেন্দ্রবিন্দুটির নাম মুক্তমঞ্চ। লিটল ম্যাগাজিনকে সাহিত্য-সংস্কৃতির পীঠস্থান, মানে পিঠের দিক ঠাওরেই সম্ভবত তার সন্নিকটে বিচিত্র এই মঞ্চের আয়োজন। এখানে সর্বক্ষণ সৃষ্টি হয়ে চলে বাংলার এক সাংস্কৃতিক বাটিচচ্চড়ি। শহর কলকাতা যেমন আছে, দূরের জেলা কি মফস্সল থেকেও শিল্পীরা সাড়ম্বরে হাজির। বেলা বারোটা, ক্রেতা-বিক্রেতা কেউ এসেছেন কি আসেননি ঠিক নেই, গান তার আপন খেয়ালে শুরু হয়ে যাবে তারস্বরে। পরক্ষণেই ‘আব্‌বৃত্‌তি’। মাঝেমধ্যে টুকরো বক্তৃতা। চোখ বন্ধ করেও আপনার রেহাই নেই, কারণ আপনার কানে সেসব ঢুকবেই— কখনও ছুঁচ হয়ে, কখনও গজাল। বাংলা ছবিকে শুধু নয়, এই যদি কোনও জাতির সার্বিক রুচির প্রদর্শন হয়, তাকেও ‘ঘাটিয়া’ বলাই উচিত।

 

তবে কি মুক্তমঞ্চের দৌলতে কিছুই পাইনি? হুগলির কবি রতন ধাড়া সন্ধান দিলেন এই মুক্তমঞ্চের ধারে-কাছেই মিলছে, চিন্তার বিন্যাসকে আগাপাশতলা কাঁপিয়ে দিয়ে যাওয়া একটি অনুবাদ-কর্ম! ইসা ৎরা-র উত্তর-ঔপনিবেশিক অনুসন্ধান ‘মুক্তমঞ্চে লন্ডানাচ’। আরও একটি প্রাপ্তির কথা না বললে অনুরাগ কাশ্যপ পাপ দেবেন। বইমেলার শেষদিন, মেলার সমাপ্তির পরে এই মুক্তমঞ্চেই ছিল প্রশান্ত, পৌলমী, শুভেন্দুদের মন ভরানো পারফরম্যান্স। তাঁদের সচিত্র ‘জামাল কুদু’ সংস্করণটি কেন সময়োচিত ও যথোপযুক্ত একটি অবস্থান, তা বোঝার জন্য চোদ্দ দিন ধরে ওই সাংস্কৃতিক বাটিচচ্চড়ি গেলার অভিজ্ঞতা থাকাটাও হয়তো জরুরি!

 

২০০০ সালে প্রকাশিত হয় আলবের্তো মাঙ্গেল ও জিয়ান্নি গুয়াদালুপি-র বিচিত্র একটি বই— ‘The Dictionary of Imaginary Places’। বিশ্বসাহিত্যে উল্লেখ হওয়া বিবিধ কাল্পনিক স্থানের অভিধান। মাঝেমধ্যে ভাবি, এমন একটা বই যদি বাংলায় থাকত, কী ভালই-না হত! বর্ণানুক্রমে না-সাজানোর স্বাধীনতা পাওয়া গেলে আমি চাইতাম, সে-বইয়ের প্রথম এন্ট্রিটিই হোক— ‘কলকাতা বইমেলা’। আমার কাছে যা আজ খুব প্রিয় এক কাল্পনিক ভূখণ্ডের নাম।

 

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 4662 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

Be the first to comment

আপনার মতামত...