বাণপ্রস্থযাত্রীর রোমন্থন

তাপস কুমার দাস

 


এবারের বইমেলায় মোট যত টাকার বই কেনা হয়েছে এবং মেলার মাঠে যত মানুষ এসেছিলেন, তা রামমন্দির উদ্বোধনের দিন থেকে পরবর্তী সমসংখ্যক দিনে মন্দির দেখতে আসা মানুষের সংখ্যা এবং জমা পড়া অনুদানের টাকার অঙ্কের কাছাকাছি। বাঙালি হিসেবে এই তথ্যে শ্লাঘা আসার কথা ছিল, তবে সেই গর্ব এবং শিক্ষার অহঙ্কার ভাল করে উপভোগ করা গেল না মেলারই আরেক ঘটনায়, যেখানে পথশিশুদের নিয়ে করা অনুষ্ঠান এবং বন্দিমুক্তির দাবিতে অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণকারীদের উপর রাষ্ট্রের নিলাজ হামলা নেমে এসেছিল বইমেলার প্রাঙ্গনেই, এবং বহু তথাকথিত জ্ঞানীগুণী সংস্কৃতিবান মানুষ সেই সময়ে মেলাতে উপস্থিত থাকা সত্ত্বেও নিন্দনীয় এই হামলার প্রতিবাদে সামিল হননি

 

ইউরি দ্রুজকভের ‘পেনসিল আর সর্বকর্মার অ্যাডভেঞ্চার’ মস্কোর প্রগতি প্রকাশন থেকে উনিশশো চুয়াত্তর সালে প্রকাশিত। অনুবাদ করেছিলেন মূল রুশ থেকে সরাসরি বাংলায় অনুবাদ করার বিখ্যাত কারিগর ননী ভৌমিক (হায়াৎ মামুদ, অরুণ সোম, কামাক্ষীপ্রসাদ চট্ট্যোপাধ্যায় এবং তাঁর স্ত্রী এবং কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের শ্যালিকা স্মৃতিরেখা চট্টোপাধ্যায়— এঁরা ছিলেন রাশান থেকে বাংলায় অনুবাদের বাকি সব দিকপালেরা। কোভিডে সদ্যপ্রয়াতা রেখার আত্মজীবনী— দে’জ পাবলিশিং থেকে প্রকাশিত ‘স্মৃতিরেখার স্মৃতির ঝাঁপি’তে সেই স্বর্ণযুগের ইতিহাস পাওয়া যাবে)। একশো চুয়াল্লিশ পাতার অপূর্ব কাগজে ছাপা বইটিতে পাতায় পাতায় অসামান্য রঙিন ছবি ছিল নিকোলাই গ্রিশিন-এর আঁকা। এই হল কলকাতা আন্তর্জাতিক বইমেলায় কেনা জীবনের প্রথম বই। যখন ক্লাস এইট আমার, সালটা উনিশশো বিরাশি। বাবার হাত ধরে সেই প্রথম বইমেলা যাওয়া। ফ্যাকড়া ছিল অনেক— বাসে চড়লেই বমি হত— যেতে হবে আড়িয়াদহ (দক্ষিণেশ্বর মন্দিরের কাছে ছোট্ট এক লোকালয়) থেকে ময়দান! দিন-আনা-দিন-খাওয়া বাপের পক্ষে ট্যাক্সিতে যাওয়া অসম্ভব— সেই বাজারে, ট্যাক্সি চড়বে বড়লোকেরা আর হাসপাতালযাত্রীরা, এমনই এক ধারণা ছিল। ফলে ভেঙে ভেঙে যাওয়া— দক্ষিণেশ্বর থেকে বালি, বালি থেকে হাওড়া, হাওড়া থেকে ট্রামে ধর্মতলা, ধর্মতলা থেকে আরেক ট্রামে ময়দান— সে প্রায় অভিযান এক! সঙ্গে ছ-বছর বয়সের ভাই। তার জন্য কেনা হয়েছিল আনাতোলি মিতায়েভের বই পিঁপড়ে ও ব্যোমনাবিক— সেই ননীবাবুরই অনুবাদ। দুরন্ত এক পিঁপড়ে মুরাশকার সঙ্গে এক মহাকাশযাত্রীর মোলাকাত নিয়ে মজার গল্পের ছবিগুলি এঁকেছিলেন য়্যুরি মোলোকানভ। কুড়ি পাতার চটি বই। অসামান্য রাশান অনুবাদসাহিত্যগুলি ছিল সত্যিকারের গরিববান্ধব বিদ্যার আধার।

 

প্রথম বইমেলা ঘোরার সে উত্তেজনা লিখে প্রকাশ করার নয়, এত বছর বাদেও সেই স্মৃতি মনকে মেদুর করে। তার আগে বইমেলা বলতে সে অর্থে কোথাও যাইনি, কিন্তু এমন জায়গায় গিয়েছিলাম, যেগুলিকে, আজকালকার মাপকাঠিতে, স্থানীয় বইমেলা বলা চলতে পারে। সাতাত্তরে বামপন্থীরা পশ্চিমবঙ্গে ক্ষমতায় আসার পরপরই উত্তরবঙ্গের যে গ্রামে আমি থাকতাম, সেখানে একটি স্থানীয় সাংস্কৃতিক মেলা হয়, যে মেলায়, সত্তর এবং আশির দশকের বামপন্থী পরিভাষায় যাকে প্রগতিশীল সাহিত্য বলত, সেইসব বইয়ের স্টল দেওয়া হয়েছিল। আমি নাচতে নাচতে গেছিলাম বাবার হাত ধরে— বাবা কিনে দিয়েছিল ‘ফাঁসির মঞ্চ থেকে’— চেক কমিউনিস্ট বিপ্লবী জুলিয়াস ফুচিকের বই (বা ডায়েরি এবং চিঠির সঙ্কলন— যে নামেই তাকে ডাকা হোক না কেন)— কিনে দিয়ে বলেছিল এখন বুঝবি না, আর ক-বছর বাদে পড়তে হবে। সেই বই তখন বাঁধানো ছিল গোলাপি মলাটের, কাঁটাতার দিয়ে বানানো ফাঁসির দড়ির মাঝখানে কমরেড ফুচিকের মুখ। সম্প্রতি দেখলাম ন্যাশনাল বুক এজেন্সি থেকে আবারও বেরিয়েছে, এবং কিমাশ্চর্যম— বিনিময়মূল্য মাত্রই তিরিশ টাকা!

 

প্রায় তিরিশ বছর বছর বাদে, যখন চেক রিপাবলিকের রাজধানী প্রাগ শহরের অকাদেমি অফ সায়েন্সেস ইন চেক রিপাবলিকে মহাকাশবিজ্ঞানের অতিথি অধ্যাপক হিসেবে যোগদান করি, তখন আমার থাকার জায়গা থেকে শহরের কেন্দ্রে যেতাম যে মেট্রো চড়ে, তার একটি স্টেশনের নাম ছিল পানক্রাস! পানক্রাস জেলখানা, যেখানে বন্দি রাখা হয়েছিল ফুচিককে, যেখানে বসে লেখার সঙ্কলনই ফাঁসির মঞ্চ থেকে— পানক্রাস হল সেই জেলখানা শহর। গায়ে কীরকম কাঁটা দিয়ে উঠত সেই স্টেশনে মেট্রো থামলে পাবলিক অ্যাড্রেস সিস্টেমে ‘স্টেশন পানক্রাস’— এই ঘোষণায়, তা সহজেই অনুমেয়।

 

চুরাশির পরে আরও কয়েকবছর বাবা নিয়ে যেত বইমেলায়, ওই সেই বিপুল যাত্রা করেই। আমি আর ভাই ছাড়াও, বাবার সঙ্গে তখন জুটেছে আমার কাকার মেয়ে, আমার চেয়ে বছর দশেকের ছোট। তারপর লায়েক হলাম, একা একাই যেতে শিখলাম। উচ্চমাধ্যমিক দেওয়ার পর থেকেই ছোটখাট টিউশন শুরু করেছিলাম, ফলে বই কেনার ব্যাপারে বাবার ওপর চাপ দিইনি আর। সেই বিরাশি সাল থেকে শুরু করে দু-হাজার দুই সাল, টানা কুড়ি বছরে একবারও না-যাওয়া হইনি। তারপর গবেষণার কাজে টানা দীর্ঘ সময়ের জন্য বিদেশে চলে যাওয়ার কারণে যাওয়া অনিয়মিত হয়ে গেল। দেশে চাকরি নিয়ে ফিরে আসার পর থেকে আবার যেতে শুরু করি। এখন আমার হাত ধরে ধরে মেয়ে যায়— বছর বারো আগে যখন তিন বছর বয়স, গুটগুট করে হাত ধরে ধরে প্রথম ঢুকেছিল— এখন দৃপ্ত ভঙ্গিতে আগে আগে হাঁটে। এবার সময় এসে গেল, বাবাকে আর দরকার পড়বে না, ইশকুল পালিয়ে একাই যেতে শুরু করবে।

ময়দান থেকে শুরু করে, একাধিক জায়গা ঘুরে, বইমেলা করুণাময়ীতে থিতু হয়েছে এখন (সম্ভবত)। বইয়ের সঙ্গে দেদার খাবারও বিকোয়, তা নিয়ে হাসিঠাট্টাও চলে যে বইমেলা না খাদ্যমেলা— তবে আমি তাতে কোনও সমস্যা দেখি না। এই বিশ্বায়ন এবং পণ্যায়নের ক্রান্তিকালে খুব বেশি কিছু বিশুদ্ধতা আশা করার মানে নেই। বরং বইমেলার মূল অ্যাকাডেমিক স্পিরিটটি যদি ধরে রাখা যায়, তাহলে ফিশফ্রাই দেদার বিক্রি হলেই বা কী এমন ক্ষতি?

এ-বছরের বইমেলা সময়ের একটু আগেই হয়েছে। তাতে, অন্তত আমার কাছে, বইমেলা উপভোগ করার আরও সুবিধা হয়েছে, কারণ ঠান্ডা ঠান্ডা আবহাওয়ায় দুপুর-রোদের ওম মেখে ঘুরতে মজা। এছাড়াও ভিড় থেকে ছড়ানো রোগ, যেমন জলবসন্ত, তার সংক্রমণের সম্ভাবনাও তুলনায় কম থাকে এই সময়টায়। প্রতি বছর যে সময়ে বইমেলা হয় সেটি জলবসন্ত সংক্রমণের পিক সিজন, আমি নিজেই অষ্টাশিতে জলবসন্ত বাধিয়েছিলাম বইমেলা থেকে। সেই হিসেবেও এই বছরে মেলার সময়টি তুলনায় নিরাপদ ছিল।

এবারের বইমেলা এক ক্রান্তিকালে হয়েছে, কলকাতায় বইমেলার পাশাপাশি তখন অযোধ্যায় চলেছে গণতন্ত্র, মূল্যবোধ, যুক্তিবাদ এবং সমানাধিকার হত্যার বীভৎস উল্লাস। বইমেলা শেষ হওয়ার পর, মেলায় কত মানুষ এসেছিলেন, এবং কত টাকার বই কেনা হয়েছে তার কিছু নথি পাওয়া গেছে। সেখান থেকে দেখা যাচ্ছে, বইমেলার কদিনে মোট যত টাকার বই কেনা হয়েছে এবং মেলার মাঠে যত মানুষ এসেছিলেন, তা রামমন্দির উদ্বোধনের দিন থেকে পরবর্তী সমসংখ্যক দিনে মন্দির দেখতে আসা মানুষের সংখ্যা এবং জমা পড়া অনুদানের টাকার অঙ্কের কাছাকাছি। বাঙালি হিসেবে এই তথ্যে শ্লাঘা আসার কথা ছিল, তবে সেই গর্ব এবং শিক্ষার অহঙ্কার ভাল করে উপভোগ করা গেল না মেলারই আরেক ঘটনায়, যেখানে পথশিশুদের নিয়ে করা অনুষ্ঠান এবং বন্দিমুক্তির দাবিতে অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণকারীদের উপর রাষ্ট্রের নিলাজ হামলা নেমে এসেছিল বইমেলার প্রাঙ্গনেই, এবং বহু তথাকথিত জ্ঞানীগুণী সংস্কৃতিবান মানুষ সেই সময়ে মেলাতে উপস্থিত থাকা সত্ত্বেও নিন্দনীয় এই হামলার প্রতিবাদে সামিল হননি। বাঙালি হিসেবে, ভারতবর্ষে রাজনৈতিক বিপ্লববাদের উত্তরসূরি হিসেবে এই লজ্জা আমাদের রয়ে যাবে।

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 4662 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

Be the first to comment

আপনার মতামত...