জ্ঞানবাপীর পর এবার মৌলবাদীদের চোখ আদিনায়

আইরিন শবনম

 


সম্প্রতি উত্তরপ্রদেশ থেকে মালদার আদিনায় হাজির হয়েছিলেন এক ‘বাবাজি’ তার সাঙ্গপাঙ্গ-সহ, তাদের আবদার ছিল সৌধটির গায়ে উত্থিত দেবদেবীর মূর্তিকে পূজা করার। মসজিদের গায়ে এই দেবদেবীর মূর্তি নিয়ে যেমন মুসলমানদের কোনও মাথাব্যথা নেই, তেমনি নেই স্থানীয় হিন্দুদেরও। সকলের কাছে এটি ঐতিহাসিক সৌধ হিসেবেই সমাদৃত। এমতাবস্থায় মন্দির-মসজিদ বিতর্ক যখন দেশের রাজনীতিতে প্রধান স্থান অধিকার করেছে, সেই সময় আদিনাকে কেন্দ্র করে নতুন উন্মাদনা জাগিয়ে তোলার একটি প্রচেষ্টা হিসেবেই এই পুজো করার চেষ্টাকে দেখতে হবে বলে মনে করি

 

রামমন্দির প্রতিষ্ঠার উন্মাদনা কাটতে না কাটতেই সামনে চলে এল আদিনা মসজিদ বিতর্ক। ইতিমধ্যে অবশ্য জ্ঞানবাপী মসজিদে পূজা করার অনুমতি দিয়েছে কোর্ট। এমতাবস্থায় লোহা গরম থাকতে থাকতেই তাকে পিটানোর কাজ করতে উত্তরপ্রদেশ থেকে মালদার আদিনায় হাজির হয়েছিলেন এক ‘বাবাজি’ তার সাঙ্গপাঙ্গ-সহ, তাদের নাকি আবদার ছিল সৌধটির গায়ে উত্থিত দেবদেবীর মূর্তিকে পূজা করার। এ-প্রসঙ্গে উল্লেখ্য এই সৌধটি এই উপমহাদেশের সর্ববৃহৎ মসজিদ হিসেবে একসময় খ্যাত থাকলেও ক্রমে এটি জঙ্গলাকীর্ণ ধ্বংসাবশেষে পরিণত হয়। ব্রিটিশ যুগে উদ্ধার হওয়ার পর থেকে এখানে নামাজ হয় না। এটি বিশুদ্ধ রূপেই একটি ঐতিহাসিক সৌধ হিসেবে মালদা তথা পশ্চিমবঙ্গবাসীর কাছে গর্বের বস্তু।

মসজিদের গায়ে দেবদেবীর মূর্তি নিয়ে যেমন মুসলমানদের কোনও মাথাব্যথা নেই, তেমনি নেই স্থানীয় হিন্দুদেরও। সকলের কাছে এটি ঐতিহাসিক সৌধ হিসেবেই সমাদৃত। এমতাবস্থায় মন্দির-মসজিদ বিতর্ক যখন দেশের রাজনীতিতে প্রধান স্থান অধিকার করেছে, সেই সময় আদিনাকে কেন্দ্র করে নতুন উন্মাদনা জাগিয়ে তোলার একটি প্রচেষ্টা হিসেবেই এই পুজো করার চেষ্টাকে দেখতে হবে বলে মনে করি। একথা ঠিক যে এই মসজিদে বেশ কিছু হিন্দু দেবদেবীর মূর্তি আছে, যেমন মসজিদের পশ্চিমদিকের সুবিশাল দুর্গ প্রাকারের মতো দেওয়ালের বাইরের গায়ে বেশ কিছু যক্ষিণীমূর্তি উৎকীর্ণ আছে (চিত্র ১), যা হিন্দু, বৌদ্ধ ও জৈন ধর্মীয় পুরাণের এক ধরনের নারী তবে বৌদ্ধধর্মের সঙ্গেই তার সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ যোগ।

চিত্র ১: যক্ষিণী মূর্তি

পশ্চিমদিক দিয়ে মসজিদে ঢোকার প্রবেশদ্বারের লিন্টেলের উপর গণেশের মূর্তি ছিল বলে স্পষ্ট বোঝা যায় (চিত্র ২)।

চিত্র ২: দরজার মাথায় গণেশ

মিম্বর অর্থাৎ যেখানে উঠে খুৎবা পাঠ করা হয় সেখানে ইমামের দাঁড়ানোর পাটাতনের নিচে কীর্তিমুখের আদল লক্ষ করা যায় (চিত্র ৩)— যা নেপাল, ভারত ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার মন্দির-স্থাপত্যে এবং বৌদ্ধস্তূপেও পাওয়া যায়।

চিত্র ৩: মিম্বর-এ কীর্তিমুখ

এছাড়া মসজিদের অলঙ্করণে নানা হিন্দু মোটিফ ব্যবহার করা হয়েছে। যেমন লম্বা শিকল দিয়ে ঝোলানো প্রদীপ, ফুল ও ঘন্টা[1], প্রস্ফুটিত পদ্ম (চিত্র-৪), শাখাপ্রশাখা সমন্বিত গাছ[2], কুলুঙ্গি, উলটানো ঘট ইত্যাদি। এখানে যেগুলিকে হিন্দু মোটিফ বলে উল্লেখ করা হয়েছে সেগুলো আসলে দেশীয় বা বলা ভাল বাংলার লোকসংস্কৃতির অঙ্গ। যে শিল্পীরা এই কাজগুলো করেছিলেন তারা হিন্দু বাঙালি ছিলেন বলে ধরে নেওয়া যায়, সুতরাং বিশাল জায়গা জুড়ে, টালি কেটে পোড়ামাটির কাজ করতে গিয়ে তারা যেসব নকশা করতে পারদর্শী ছিলেন, তাই ফুটিয়ে তুলেছেন স্বাভাবিকভাবেই। পশ্চিমদিকের সারা দেওয়াল জুড়ে ভর্তি এই টেরাকোটার কাজ। তবে গাছ, লতাপাতা ও ফুলের অলঙ্করণ ইরানীয় রীতিতে খুবই প্রচলিত। তারাই প্রথম রঙিন ফুল, লতাপাতা আঁকা কোরান শরিফ প্রস্তুত করেন।

চিত্র ৪: দড়িতে ঝোলানো প্রস্ফুটিত পদ্ম এবং পদ্মের কুঁড়ি

শিকল বা দড়ির প্রান্তে প্রদীপের মোটিফ (চিত্র-৫)-টি সুফি কালচারের অঙ্গীভূত। ‘India before Europe’ গ্রন্থে Catherine Asher, Cynthia Talbot বলছেন—

The Chishti Sufies, whose path to finding God was through music and jikir… and the Suhrabwardis, another important South Asian Sufi order, both commonly used light imagery to express God’s inner, almost unfathomable, qualities.

চিত্র ৫: দড়ি বা শেকলে ঝোলানো প্রদীপ

দেশের অধিকাংশ প্রাচীন ঐতিহাসিক ধ্বংসাবশেষের মতো আদিনা মসজিদের ধ্বংসাবশেষও ব্রিটিশরাই আবিষ্কার করেছিলেন, মনে রাখতে হবে এটি ধ্বংসাবশেষ, বর্তমান কাঠামো থেকে প্রত্নতাত্ত্বিকরা অনেক কিছু বের করলেও এর সম্বন্ধে সবটা নিশ্চিতভাবে বলতে পারেননি। যেমন এত বিশাল একটি মসজিদের প্রবেশদ্বার এত ছোট কেন, প্রায় খিড়কিদ্বার বলা যায়। মসজিদে ঢোকার রাস্তা সাধারণত পশ্চিমদিক দিয়ে হয় না, অথচ এখানে তা-ই হয়েছে! এছাড়া যে দ্বিতল অংশটি ‘বাদশা কি তখৎ’ নামে পরিচিত, তাই-বা একটা মসজিদে কী করে থাকতে পারে! ইসলাম গর্ব করে বলে যে, আল্লার দরবারে বাদশা-ফকির এক সারিতে দাঁড়িয়ে নামাজ আদায় করে, কোনও ভেদ নেই, তাহলে এই ব্যবস্থা কেন! মসজিদে দেব-দেবী কেন কোনও মূর্তিই থাকতে পারে না, তাহলে এই মূর্তিগুলি থাকতে পারল কেমন করে!

উপরের কয়েকটি প্রশ্নের উত্তর আমি নিজের মতো করে দিচ্ছি। মালদায় বাস করার সুবাদে আমি আরেকবার আদিনা ঘুরে এলাম আবিদ আলি, এএইচ দানি, সুখময় মুখোপাধ্যায়, তুষারকান্তি ঘোষ, এবং রজনীকান্ত চক্রবর্তীর বইপত্র পড়ার পর। স্বাভাবিকভাবেই এবারের পর্যবেক্ষণ আগের তুলনায় অনেক বেশি পুঙ্খানুপুঙ্খ এবং গভীর হল। প্রথমে প্রবেশদ্বারের কথা বলি, বেশিরভাগজন যাকে প্রধান প্রবেশদ্বার বলছেন, তা যে মসজিদে প্রবেশের প্রধান প্রবেশদ্বার ছিল না, তা একটু ভালভাবে পর্যবেক্ষণ করলেই বোঝা যায়, সেই দরজাটি খিড়কি দরজার কাজই করত বলে মনে হয়, কারণ ওই দরজাটি হয়তো ছিল ‘বাদশা কি তখৎ’-এ আসার কিংবা যাওয়ার জরুরি রাস্তা, কিংবা রাজা গণেশের কাছারিবাড়ি বানানোর লোকশ্রুতি যদি সত্যি হয় তবে সেটিকে তিনি কাছারিতে প্রবেশের রাস্তা হিসেবে পরে লাগিয়েছিলেন, তা-ও হতে পারে। তবে পশ্চিমদিকের দেওয়ালটি মসজিদের অন্তিম দেওয়াল ছিল বলেই মনে হয়। ওই দেওয়ালের একদম মাঝখানের জায়গাটিকে ইমামের দাঁড়ানোর জায়গা বলে চিনে নিতে অসুবিধে হয় না (চিত্র ৬)।

চিত্র ৬: ইমামের দাঁড়ানোর জায়গা। দেওয়ালের ঠিক মাঝখানে। পাশে উঁচু বেদি বা মিম্বর

সেই দেওয়াল সংলগ্ন এক বা একাধিক দ্বিতল ঘর ছিল যা দরজা দিয়ে ‘বাদশা কি তখৎ’ বা লেডিস ব্যাল্‌কনি-র সঙ্গে যুক্ত (চিত্র ৭)। আবার সেই ঘর থেকে একটি সিঁড়ি দিয়ে নিচে নেমে যাওয়ার রাস্তা আছে পশ্চিমদিকেই। মসজিদে বাদশার জন্য পৃথক উচ্চাসন থাকা যেহেতু কোনওভাবেই সম্ভব নয়, সেহেতু সেটি যে বাদশাহ কি তখৎ ছিল না একথা প্রায় সমস্ত ঐতিহাসিকরাই মেনে নিয়েছেন। মনে করা হয়, সেটি সুলতান পরিবারের মহিলাদের নামাজ পড়ার জন্য ব্যবহৃত হত, যতদূর সম্ভব বাদশা বা সুলতান পরিবারের মহিলারা নামাজের আগে তখৎ-এর লাগোয়া ঘরে এসে অপেক্ষা করতেন এবং নামাজ হয়ে গেলে সেইদিক দিয়েই বেরিয়ে যেতেন। এখনও বিল্ডিঙের যে ধ্বংসাবশেষ টিকে আছে, তা থেকে এমনটাই অনুমান করা যায়। এখন যাকে প্রধান দরজা বলা হচ্ছে সেই প্রায় খিড়কি দরজার মতো দরজাটিও হয়তো মহিলারা কিংবা সুলতান পরিবারের লোকজনেরাই ব্যবহার করতেন। মহিলারা কিন্তু জুম্মার অর্থাৎ শুক্রবারের নামাজ পড়ে না, ওটা শুধু পুরুষদের জন্য। মহিলারা কেবল ঈদ-বকরিদে কোথাও কোথাও মসজিদে নামাজ পড়তে যান। হয়তো সেই কারণেই এই পৃথক ব্যবস্থা করা হয়েছিল।

চিত্র ৭: লেডিস ব্যালকনি বা বাদশা কি তখৎ

খিড়কি-দরজা লাগোয়া কয়েকটি ঘরের ধ্বংসাবশেষ টিকে আছে, তার মধ্যে সিকান্দার শাহের সমাধি ছিল বলে ঐতিহাসিকরা মনে করেছেন। মসজিদটিতে পশ্চিমদিকের বিল্ডিংটি[3] ছেড়ে দিলে তিনটি দরজার হদিশ আমি পেয়েছি, এবং তিনটি দরজাই যে পাথরের চৌকাঠ-সহ অন্য কোথাও থেকে নিয়ে আসা হয়েছে তা যে কেউ বুঝতে পারবে। এই তিনটি দরজার একটির কথা ইতিমধ্যেই বলেছি, বাকি দুটি উত্তরদিকের দেওয়ালে অবস্থিত। এই দুটি দরজার উচ্চতা আগেরটির থেকেও কম, পাঁচ ফিট মতো। এই দুটির মধ্যে একটির মাথার উপর গণেশের মূর্তি উৎকীর্ণ ছিল। দরজাগুলো কেন বসানো হয়েছিল বলা কঠিন তবে মসজিদে ঢোকার জন্য যে ব্যবহৃত হত না তা এগুলির আকার দেখেই বোঝা যায় (চিত্র-৮)।

চিত্র ৮: উত্তরদিকের দেওয়ালের দরজা

লোকবিশ্বাসের উপর ভর করে সুখময় মুখোপাধ্যায়ের অনুমান যদি সঠিক হয় যে রাজা গণেশ এটিকে কাছারিবাড়িতে রূপান্তরিত করেছিলেন, তাহলে কিন্তু দরজার মাথায় ব্যবসা-বাণিজ্যের সঙ্গে যুক্ত গণেশের অবস্থান খুব স্বাভাবিক। আমরা জানি না আসল ঘটনা কী ছিল! অনেক ঐতিহাসিক যেমন মনে করেছেন দরজার পুরো ফ্রেমটাই কোনও মন্দির থেকে তুলে আনা হয়েছে, তা-ও হতে পারে। তবে তার অর্থ কিন্তু এ নয় যে, কোনও মন্দির ধ্বংস করেই তা আনা হয়েছে। নানা কারণে মন্দির অসম্পূর্ণ থাকত, পরিত্যক্ত হত, জীর্ণ হত, সে সমস্ত জায়গা থেকেও সংগৃহীত হতে পারে, কিন্তু ব্রিটিশ ঐতিহাসিকদের কল্যাণে মুসলমানদের সঙ্গে মন্দির ধ্বংসের এমন নিবিড় যোগ স্থাপিত হয়েছে যে দুয়ে দুয়ে চার সহজেই করে ফেলা হয়।

যাই হোক, আমরা দেখে নিই ঐতিহাসিকরা এই মসজিদ সম্পর্কে কী বলছেন! প্রথমেই আমরা সেই সমস্ত ঐতিহাসিকের বক্তব্য আলোচনা করব, যারা ধারণা করেছিলেন এই মসজিদটি একটি মন্দিরের কাঠামোর উপর তৈরি করা হয়েছিল। জে ডি বেগলার প্রথম আদিনা মসজিদে একটি ঐতিহাসিক খননকার্য চালান এবং তিনি মতপ্রকাশ করেন যে এখানে একটি মন্দির কাঠামো ছিল, তাঁর কথাকে সঠিক ধরে নিয়ে ‘খুরশিদ-ই-জাহান্নুম’-এর লেখক ইলাহি বক্সও বলেন যে, আদিনা মসজিদ একটি মন্দিরের উপর গড়ে উঠেছিল। এসকে সরস্বতীও এ-ব্যাপারে একই মত ব্যক্ত করেন তাঁর মালদা দিনাজপুর সফরনামার বিবরণীতে। তাঁদের এই ধারণার পেছনে কাজ করেছে মন্দিরে ব্যবহৃত ‘হিন্দু’ উপাদানগুলি। সরস্বতী উল্লেখ করেছেন— মসজিদের স্তম্ভগুলির গোড়ার দিকের নকশাগুলির সঙ্গে মন্দিরের কারুকার্যের ভীষণ মিল আছে। সেজন্য তিনি সৈয়দ ইলাহির সঙ্গে একমত হয়ে রায় দেন— এখানে একটি হিন্দু মন্দির অসম্পূর্ণ অবস্থায় ছিল, হাতের কাছে থাকা এই নগদ উপকরণগুলি দিয়ে সিকান্দার শাহ তাকে মসজিদে রূপান্তরিত করেছিলেন। অবশ্য সিকান্দারের বিশালাকার মসজিদ নির্মাণের পরিকল্পনার কারণে কিছু ত্রুটিও ঘটেছিল, যেমন— দক্ষিণদিকে স্তম্ভ বাড়ানো। এটা হয়েছিল সম্ভবত হিন্দু স্থাপত্যশৈলীর ব্যাপারে সিকান্দারের মিস্ত্রিদের অনভিজ্ঞতার কারণে।

এ-ব্যাপারে এএইচ দানি বলছেন— এটা বুঝতে অসুবিধে হয় সিকান্দারের মিস্ত্রিরা, যাদের মধ্যে হিন্দুর সংখ্যাই বেশি হওয়ার কথা, তারা এই ভুল করলেন কী করে! আসলে মসজিদ তৈরির উপাদানগুলি বিভিন্ন ‘সোর্স’ থেকে সংগ্রহ করা হয়েছিল, তার মধ্যে হিন্দু মন্দিরও অবশ্যই ছিল। সিকান্দারের মিস্ত্রিরা খুবই দক্ষতার সঙ্গে তা ব্যবহার করেছিলেন। এরপর তিনি মসজিদের পুঙ্খানুপুঙ্খ বিবরণ দিয়েছেন এবং দেখিয়েছেন কীভাবে এই মসজিদটির নির্মাণ পরিকল্পনায় সিকান্দার শাহ মসজিদ নির্মাণের চিরাচরিত রীতি[4] গ্রহণ করেছিলেন। উমাইয়া খলিফা আল ওয়ালিদ দামাস্কাসের মসজিদটি নির্মাণ করান ৭০৫-৭১৫ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে। এটিও ছিল একটি আয়তাকার ক্ষেত্র বিশিষ্ট বিশাল মসজিদ। এই ধরনের মসজিদগুলি তিন ধরনের চাহিদা পূরণ করত— কাঠামোগত (Physical), ধর্মীয় আচরণের উপযোগী এবং রাজনৈতিক কর্তৃত্বের প্রকাশ ঘটানো। আদিনা মসজিদ তিনটি চাহিদাই পূরণ করেছিল। শুধুমাত্র মসজিদ প্রাঙ্গনের পুকুর বা জলাধারটি পাওয়া যায়নি কিংবা বুজে গেছে। পূর্বদিকের শেষ পাঁচিলের লাগোয়া একটি পুকুর এখন আছে, জানি না তখনও সেখানে কোনও পুকুর ছিল কি না! এবং সেটিই ওজু করে মসজিদে ঢোকার কাজে ব্যবহৃত হত কি না!

তবে এই মসজিদ নির্মাণের প্রধান উদ্দেশ্য ছিল রাজনৈতিক কৃতৃত্বের প্রকাশ ঘটানো। সিকান্দার শাহের পিতা সুলতান সামসুদ্দিন ইলিয়াশ শাহ দিল্লির সম্রাটদের অধীনতা থেকে মুক্ত হয়ে প্রথম বাংলার স্বাধীন সুলতান হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেন এবং নিজেকে ‘শাহে বাঙ্গালিয়ান’ বা বাংলার রাজা বলে ঘোষণা করেন। ঐতিহাসিক সাম্‌স্‌-ই-সিরাজ আফিফ তাঁকে ওই নামেই অভিহিত করেছেন। এর আগে কেউ নিজেকে বাংলার রাজা বলেনি।

দিল্লির আনুগত্য ছিন্ন করার প্রতীক হিসেবে তিনি তাঁর রাজধানী গৌড় (লাখনৌতি) থেকে পাণ্ডুয়ায় স্থানান্তরিত করেন। দিল্লি অবশ্য বাংলা প্রদেশের এই স্বাধীনতাকে সহজভাবে নেয়নি, দিল্লির সম্রাট ফিরোজ শাহ তুঘলক বিশাল সৈন্যবাহিনি নিয়ে পাণ্ডুয়া আক্রমণ করেন এবং সামসুদ্দিন ইলিয়াস শাহের এক হাজার আশি লক্ষ বাঙালি সৈন্যকে কোনঠাসা করে ফেলেন। সুলতানকে সাময়িকভাবে রাজধানী পাণ্ডুয়া থেকে সরে একডালা দুর্গে আশ্রয় নিতে বাধ্য করেন, তা সত্ত্বেও তিনি কিন্তু বাংলা পুনর্দখল করতে পারেননি। এই সময় ইলিয়াস শাহের সেনাপতি ছিলেন সহদেব নামে এক হিন্দু বাঙালি যিনি একডালার যুদ্ধে প্রাণ বিসর্জন দিয়েছিলেন। এছাড়া জিয়াউদ্দিন বারনি স্পষ্টই লিখেছেন যে, হিন্দু রাজারা তাকে বিশেষভাবে সাহায্য করেছিল। বস্তুতপক্ষে এইসময় থেকেই সুলতানরা বাঙালি জীবনের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে যুক্ত হয়ে পড়েছিলেন। এ ক্ষেত্রে হিন্দু রমণী বিবাহ অন্যতম যোগসূত্রের কাজ করেছিল। ইলিয়াস শাহের পুত্র সিকান্দার শাহ ছিলেন সুলতানের হিন্দু স্ত্রীর পুত্র (অতুল সুর)। সিকান্দার শাহের আমলে ফিরোজ শাহ দ্বিতীয়বার বাংলা আক্রমণ করেন তবে এবারেও বাংলা কব্জা করতে পারেননি। তিনি সিকান্দারের সঙ্গে সন্ধি করতে বাধ্য হন এবং এরপর বাংলায় প্রায় দুশো বছর স্বাধীন সুলতানদের রাজত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়।

সিকান্দার শাহ তাঁর তথা বাংলার এই রাজনৈতিক স্বাধীনতাকে উদ্‌যাপন করেন বিরাট রাজকীয় ও জাঁকজমকপুর্ণ আদিনা মসজিদ নির্মাণের পরিকল্পনা করেন। এই নির্মাণটির মধ্যে দিয়ে তিনি যে দিল্লিতে তাঁর প্রতিপক্ষকে প্রতিবাদের কিংবা স্পর্ধার বার্তা দিতে চেয়েছিলেন, তা বোঝা যায় এই মসজিদটির বিশালতা ও রাজকীয়তার মধ্যে, যা শুধু দিল্লির ফিরোজ শাহ তুঘলকের বেগমপুর মসজিদের চেয়েই বড় ছিল না, এটা ছিল গোটা মুসলিম আমলেই ভারতীয় উপমহাদেশের সবচেয়ে বড় মসজিদ। তাছাড়া এটি নির্মাণে দিল্লির স্থাপত্যরীতি বর্জন করে মধ্যপ্রাচ্য এবং বাংলার রীতির সংমিশ্রণ ঘটিয়ে তিনি দিল্লিকে একটি বার্তা দিয়েছিলেন বলে মনে হয়। রিচার্ড ইটন বলেছেন যে, মসজিদটির কেবলামুখী অর্থাৎ পশ্চিমমুখী দিকটি যে রাজকীয় বৈশিষ্ট্য ফুটিয়ে তুলেছে তা প্রাক-ইসলামি ইরানের জাঁকজমকপূর্ণ অবস্থার কথা স্মরণ করিয়ে দেয়। এই দেওয়ালটি বহু ধাপবিশিষ্ট একটি বিশাল অন্তঃপট, যার বাইরের অংশে পর্যায়ক্রমিক কুলুঙ্গি এবং আনুভূমিক ও উল্লম্ব উভয়ভাবেই প্রতিচ্ছায়া ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। ইন্দো-ইসলামি স্থাপত্য নিদর্শনে এ-ধরনের কোনও স্থাপত্য নিদর্শন পাওয়া যায় না। এটি সাসানীয় আমলের সবচেয়ে জাঁকালো স্থাপত্য নিদর্শন তেসিফেনের বিখ্যাত তাক-ই-কিসারা প্রাসাদের বাইরের দেওয়ালের কথা মনে করিয়ে দেয়। মুসল্লিদের নামাজের অংশটির নকশায় এ বিষয়টি আরও সুস্পষ্ট। এছাড়া নামাজের জায়গাগুলির অলংকরণে পাল-সেনযুগের পোড়ামাটির শিল্পকলা ব্যবহৃত হয়েছে (চিত্র ৯)। অর্থাৎ এখানে আরব্য-পারস্য ও বাঙালি রীতির সংমিশ্রণ ঘটেছে।

চিত্র ৯: টেরাকোটার কাজ

যদিও চিরাচরিত মসজিদ রীতির অনুসরণ বাংলার জলবায়ুর উপযোগী না হওয়ায় পরবর্তীতে এই রীতি অনুসৃত হয়নি, বরং পরবর্তী সুলতানরা আরও বেশি করে বাংলার নিজস্ব রীতি[5] গ্রহণ করতে থাকেন। এতে জলনিকাশি ব্যবস্থা যেমন ভাল হয়, তেমনি দৃষ্টিনন্দনও হয়। এই মিশ্র বাঙালি রীতির পুর্ণ ব্যবহার প্রথম লক্ষ করা যায় একলাখি মসজিদে, যা গণেশ কিংবা গণেশপুত্র জালালুদ্দিন নির্মাণ করেছিলেন। এখানে পাথরের পরিবর্তে সম্পূর্ণ ইট ব্যবহার করা হয়, সৌধটির কার্নিশ বাঁকানো চালার আকারের এবং দেওয়াল জুড়ে টালির উপর অসাধারণ নক্‌শা করা। এভাবে স্বাধীন সুলতানি আমল থেকে ইসলামি সৌধগুলিতে বাঙালি রীতির অনুসরণ শুরু হয় এবং তার পথপ্রদর্শক ছিল আদিনা মসজিদ, একলাখি সমাধি সৌধে তার পূর্ণ প্রকাশ ঘটে।

শিল্পকলা বিষয়ক ইতিহাসবিদ পারভিন হাসান বাঙালিদের মসজিদ নির্মাণে আরেকটি দেশীয় সূত্রের কথা উল্লেখ করেছেন, তিনি বলেছেন— বাংলার বৌদ্ধমঠগুলির ঐতিহ্যই পঞ্চদশ শতকে বাঙালি মসজিদগুলির বর্গাকারে ইটের তৈরি নির্মাণের ধারা পুনর্জীবনে সরাসরি অবদান রেখেছে। আদিনা মসজিদের ক্ষেত্রেও বৌদ্ধ প্রসঙ্গ বারবার এসেছে। কেউ কেউ বলতে চেয়েছেন এটি আদতে একটি বৌদ্ধ মঠ ছিল। ঐতিহাসিক রজনীকান্ত চক্রবর্তী ‘গৌড়ের ইতিহাস’ গ্রন্থে বলেছেন—

…কোনও প্রকাণ্ড বৌদ্ধস্তুপ ভাঙিয়া তাহারই স্থানে এই মসজিদ নির্মিত হইয়াছে। (পৃ-২০৫)

ইতিহাসবিদ ও রাষ্ট্রীয় স্বয়ং সেবক সঙ্ঘের আজীবন সদস্য ‘মালদহের ইতিহাসের ধারা’ গ্রন্থের লেখক তুষারকান্তি ঘোষ উক্ত গ্রন্থে বলেছেন—

উত্তর ও দক্ষিণদিকের মঠগুলিতে অসংখ্য ছোট ছোট জানালা ছিল। টেরাকোটা ও পাথরের কাজ অনবদ্য। পাথরের মিম্বরে যক্ষী, সর্প ইত্যাদি দেবদেবীর মুর্তি এখনও আছে…। ধর্মপ্রচারের বেদীটি কেন্দ্রীয় হলের দক্ষিণে অবস্থিত। এখানে আছে কীর্তিমুখ, কোনও বিষ্ণুর মন্দিরের ধ্বংসাবশেষ। গোটা মসজিদ জুড়ে হিন্দু স্থাপত্যের চিহ্ন দেখা যায়। প্রথিত আছে শিবলিঙ্গ ও গৌরীপট্ট। পশ্চিমদিকের প্রবেশপথটি হিন্দু মন্দির থেকে নিয়ে আসা।

এই মসজিদের উত্তর দক্ষিণ দিক থেকে দেখলে মনে হয় এটি ছিল একটি বিশ্ববিদ্যালয় আর উত্তরে ৬৯ এবং পূর্বে ১০৮টি গম্বুজযুক্ত ঘর ছিল। আচার্য যদুনাথ সরকার এবং রজনীকান্ত চক্রবর্তী এটিকে প্রাচীন বৌদ্ধবিহার বলেছেন। (পৃ-৫৭৬)

তবে বৌদ্ধবিহার বলার মতো উপযুক্ত তথ্যপ্রমাণও হাতে আসেনি। বিক্ষিপ্ত বিচ্ছিন্ন কিছু চিহ্ন যেমন বৌদ্ধ চিহ্ন বহন করে তেমনি বেশকিছু হিন্দু চিহ্নও বহন করে সৌধটি। সেদিক দিয়ে দেখতে গেলে এটি বৌদ্ধ, হিন্দু ও ইসলামি স্থাপত্যশৈলী এবং অলঙ্করণ বৈশিষ্ট্য বুকে নিয়ে এক অনন্য কীর্তিরূপে যুগ যুগ ধরে ইতিহাসপিপাসু মানুষের মনোযোগ আকর্ষণ করে আসছে। সবচেয়ে বড় কথা এই মসজিদটি সুলতানদের বাঙালি সংস্কৃতির সঙ্গে একাত্মতা গড়ে ওঠার প্রথম নিদর্শন। স্বাধীনতা লাভ করার পর দিল্লির অধীনতা থেকে দেশকে মুক্ত রাখতে গেলে স্থানীয় মানুষদের সাহায্য ও সহযোগিতা একান্তভাবে প্রয়োজন। সেজন্য তাদের জীবন ও সংস্কৃতিকে জানা, সুশাসনের দ্বারা তাদের কাছে টানা দরকার; এই প্রয়োজনের জায়গা থেকেই তারা বাংলার জীবনচর্যা তথা সংস্কৃতির সঙ্গে যুক্ত হতে থাকেন। সামসুদ্দিন ইলিয়াস শাহর সময় থেকেই হিন্দুরা দরবারে উচ্চপদে নিযুক্ত হতে শুরু করে, যদিও তাদের চিশতি গুরুরা এই নিয়োগকে ভালভাবে নেননি, কিন্তু তবুও সুলতানরা তা করেছেন, বা করতে বাধ্য হয়েছেন বলা যায়। এই সাংস্কৃতিক মিলনে প্রধান অনুঘটকের কাজ করেছে সুলতানদের এদেশীয় রমণী বিবাহ করার ঘটনা। আমরা আগেই উল্লেখ করেছি সিকান্দার শাহের মা ছিলেন হিন্দু, বিক্রমপুরের বজ্রযোগিনী গ্রামের এক ব্রাহ্মণকন্যা। সিকান্দার শাহও বিয়ে করেছিলেন এক হিন্দু কন্যাকে, যার পুত্র ছিলেন আজম শাহ, পরবর্তী সুলতান। এইভাবে বাঙালি সংস্কৃতির সঙ্গে তাদের একাত্মতা তৈরি হয়, তাঁরা বাংলা সাহিত্যের পৃষ্ঠপোষকতা করতে শুরু করেন।

কিন্তু তা বললে কী হয়! আমাদের চাই মন্দির-মসজিদ ইস্যু, শুধু উত্তরপ্রদেশেই বা তা আটকে থাকবে কেন! সুতরাং চলো আদিনা— ‘যেখানে দেখিবে ছাই… পাইলেও পাইতে পারো অমূল্য রতন।’ এমন রতন অবশ্য বাংলায় আরও অনেক ছড়িয়ে রয়েছে, ভবিষ্যতে হয়তো সেগুলিতেও হাত পড়বে, সবটাই নির্ভর করছে রাজনীতির রাশ কাদের হাতে থাকে তার উপর।

তবে আদিনা মসজিদ নিয়ে বিতর্ক এই প্রথম নয়। একশো বছরেরও বেশি আগে জিতু সাঁওতাল নামে এক কৃষক বিদ্রোহের নেতা আদিনা মসজিদে কালীপূজা করে বিতর্কের কেন্দ্রবিন্দুতে চলে আসেন ১৯২৭ সালের ৭ মে। জমিদার-জোতদারদের শোষণ ও অত্যাচারের বিরুদ্ধে জিতু সাঁওতালদের সঙ্ঘবদ্ধ করেন এবং নিজেকে গান্ধিবাবার শিষ্য বলে ঘোষণা করে্ন। জমিদারদের জমি থেকে ধান লুঠ করতে থাকেন, নিজেকে রাজা ঘোষণা করে সরকারকে খাজনা দিতে অস্বীকার করেন এবং ১৯৩২ সালের ৩ ডিসেম্বর তিনি ঘোষণা করেন আদিনা মসজিদ আসলে আদিনাথের মন্দির। এরপর ১৪ ডিসেম্বর তাঁর নেতৃত্বে হাজার হাজার সাঁওতাল আদিনা মসজিদে ঢূকে পড়ে, মসজিদ আক্রমণ করে এবং সেটিকে দুর্গ হিসেবে ব্যবহার করে ব্রিটিশ পুলিশের সঙ্গে অসম যুদ্ধে অবতীর্ণ হয়। খবর পেয়ে ডিস্ট্রিক্ট ম্যাজিস্ট্রেট শহরের কয়েকজন গণ্যমান্য ব্যক্তি এবং মালদার জমিদার যদুনন্দন চৌধুরী ও কোতোয়ালির জমিদার এবিএ গণি খান চৌধুরীর বাবা আবুল হায়াত খান চৌধুরীকে নিয়ে সেখানে উপস্থিত হন, ভদ্রলোকেরা প্রথমে জিতুকে আত্মসমর্পণ করতে বলেন, কিন্তু তিনি রাজি হন না, শেষ পর্যন্ত আদিনা উদ্ধার করতে চলে লড়াই। শোনা যায় আবুল হায়াত খানের গুলিতে জিতু মৃত্যুবরণ করেন, তাঁর কয়েকজন সাথীও মারা যায়। বিষতিরের গুলিতে একজন কনস্টেবলের মৃত্যু হয়। ব্রিটিশরা আদিনা উদ্ধার করে।

জিতু সাঁওতালের নেতৃত্বে বরিন্দ অঞ্চলের সাঁওতালরা যে বীরত্বপূর্ণ লড়াই করেছিল তা আসলে কৃষক বিদ্রোহই ছিল, কিন্তু ধর্মের অনুপান যুক্ত হয়ে তা সাম্প্রদায়িক রূপ নেয়। এই অনুপানটি যোগ করেছিলেন কাশীশ্বর চক্রবর্তী। তিনি ছিলেন দিনাজপুরের কংগ্রেসের সম্পাদক, পরে এলাহাবাদ হাইকোর্টে ওকালতি শুরু করেন এবং একসময় সব ছেড়েছুড়ে অসহযোগ আন্দোলনে যোগ দেন। তিনি দয়ানন্দ সরস্বতীর আর্য সমাজের দ্বারা প্রভাবিত হয়ে ১৯০৫ খ্রিস্টাব্দে ‘সত্যম শিবম সম্প্রদায়’ গড়ে তোলেন। এই সম্প্রদায় আদিবাসী সাঁওতালদের হিন্দুতে ধর্মান্তরিত করার কাজ করত। এই সংগঠনটি করতে গিয়ে তিনি সাঁওতালদের মধ্যে দারুণ জনপ্রিয় হয়ে ওঠেন, তারা তাঁকে ‘সন্ন্যাসী বাবা’ নাম দেয়। এভাবে একদিকে তিনি যেমন সাঁওতালদের খ্রিস্টান ধর্মে ধর্মান্তরিত হওয়া অনেকটাই রুখে দেন, অন্যদিকে আবার তাদের নিজস্ব কৌমচেতনা থেকে সরিয়ে হিন্দু ধর্মের মধ্যে নিয়ে আসার চেষ্টা করেন। এই ধর্মান্তরিত সাঁওতালরা শূকর ও গরুর মাংস খেতে অস্বীকার করত, পচাই খেত না, কালীপূজা করত। জিতু ছিলেন কাশীশ্বর চক্রবর্তীর শিষ্য আবার একই সঙ্গে নিজের সম্প্রদায়ের নেতা। সে-সময়ে মালদা জেলায় জমিদারদের অধিকাংশই ছিলেন মুসলমান এবং তাদের শোষণের অন্যতম শিকার ছিল সরল আদিবাসীরা। উৎপন্ন ফসলের তিনভাগের দু-ভাগ দিতে হত জমিদারকে, এছাড়া আরও নানাভাবে শোষণ চলত, কেউ একবার জমিদারের কাছে ঋণ নিলে একজীবনে তা শোধ হত না। এই অন্যায় জুলুম মুখ বুজে সহ্য করত সবাই, কেউ প্রতিবাদ করার সাহস করত না। জিতু এই সাঁওতালদের সংগঠিত করেন এবং তাদের স্বপ্ন দেখান ‘গান্ধিরাজ’ বা সাঁওতাল রাজের যেখানে তাদের উপর কোনও শোষণ-পীড়ন থাকবে না। সেদিক দিয়ে দেখতে গেলে এটি ছিল সম্পূর্ণরূপেই একটি শ্রেণিসংগ্রাম কিন্তু শেষপর্যন্ত তা কিছুটা সাম্প্রদায়িক রূপ নেয়, কিংবা বলা যেতে পারে ধর্মীয় রূপ নেয়।[6] পরবর্তীকালে জিতুকে নিয়ে প্রচুর গালগল্প, গান রচিত হয়। গম্ভীরা শিল্পীরা তাকে নিয়ে গান বাঁধেন। এরকম একটি গান হল—

অনার্য জাতি এ সাঁওতাল
পচাই খেয়ে হয় মাতাল
আদিনাথ করতে এলাম দখল হে
গান্ধি মোদের বুঢ়াতি সেনাপতি
ছোঁড়াটি মন্ত্রী জিতু
এরা সবাই প্রজা হে…
জিতু— এটা আদিনাথের ঘর, এটা আদিনাথের ঘর
জনম জনম থাকব মোরা ইহারই ভিতর
ম্যাজিস্ট্রেট— এটা আদিনাথের ঘর বলিস যে
বলে কোন ইতিহাস বুঝে?
জিতু— শিবম সত্যম মোদের রাজা
বাস করেছেন পাণ্ডব রাজা
উড়িয়ে দিয়ে ধর্মের ধ্বজা
ভজব নিরন্তর
এটা আদিনাথের ঘর

এভাবে জিতু কিংবদন্তী নায়কে পরিণত হয়। এবং সবচেয়ে মজার ব্যাপার হচ্ছে এই গানটি বেঁধেছিলেন মালদার একজন প্রাচীন গম্ভীরা শিল্পী সুফি মাস্টার (মুসলিম)। এখনও (সাম্প্রতিক ঘটনার আগে) আদিনা মসজিদের গাইডরা (যারা অধিকাংশই মুসলমান) অবলীলাক্রমে বলে যান যে, এখানে আদিনাথের মন্দির ছিল… পাণ্ডবদের বাস ছিল ইত্যাদি। হয়তো প্রথমদিকের ঐতিহাসিকদের সেরকম অনুমানের কথা তাদের জানা ছিল, কিংবা স্থানীয় লোকশ্রুতির দ্বারাও তারা প্রভাবিত হয়ে থাকবেন। তাদের সাদা মনে কাদা ছিল না, কিন্তু এখন কি আর বলতে পারবেন ঠিক সেই সরলতায়?


[1] আমি নিজে অবশ্য ঘন্টা দেখিনি।
[2] এই গাছটিকে অনেকে কল্পতরু হিসেবে দেখেছেন।
[3] এই বিল্ডিংটি ভগ্নপ্রায় এবং ট্যুরিস্টদের জন্য প্রবেশ নিষেধ, তবে দূর থেকে যতটুকু দেখতে পেয়েছি তাতে সেখানে লেডিস ব্যালকানি থেকে ঘরে ঢোকার এবং ঘর থেকে বেরিয়ে সিঁড়িতে নামার দুটি দরজা আছে।
[4] এই রীতি ৬২২ খ্রিস্টাব্দে মদিনায় উদ্ভাবিত হয়ে কুফা, ফুস্তাত এবং জেরুজালেম হয়ে দামাস্কাসে পূর্ণ বিকশিত হয়েছিল।
[5] কুঁড়েঘরের বাঁকানো চালার আদলে তৈরি।
[6] জিতুর এই সংগ্রামের সঙ্গে ভীষণভাবেই মিল খুঁজে পাওয়া যায় তিতুমীরের লড়াই এবং এবং বাঁশের কেল্লা গড়ে ইংরেজদের সঙ্গে অসম লড়াইয়ে মৃত্যুবরণ করার ঘটনার। শুধু তাই নয়, সেটিও ছিল জমিদারের অত্যাচারের বিরূদ্ধে গরিব চাষি-মজুরদের লড়াই, যা শেষপর্যন্ত সাম্প্রদায়িক রূপ নেয়।

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 4664 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

1 Comment

  1. সাম্প্রতিক সময়ে এমন একটি বিতর্কিত ঐতিহাসিক সৌধকে নিয়ে লেখার হিম্মত সবার থাকে না।লেখিকা পরস্পর বিরোধী কিছু ঐতিহাসিক তথ্য কে যে নিপুণতার সঙ্গে তথ্য নিষ্ঠ পরিবেশন করেছেন তা অভিনন্দনযোগ্য।

আপনার মতামত...