বই-বিপণন-বইমেলা: বাদ-বিসম্বাদ— সপ্তম বর্ষ, অষ্টম যাত্রা

স্টেশনমাস্টারের কলম

 

…নানা প্রশ্ন। সহজ ও জটিল। প্রশ্নের টানে আরও প্রশ্ন উঠে আসে। বই, বইয়ের বিপণন ও বইমেলা- এই বিষয়গুলিকে মাথায় রেখে আমরা প্রশ্নগুলির উত্তর খোঁজার চেষ্টা করেছি চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম-এর বর্তমান সংখ্যায়। বইমেলা শেষ হয়ে গেছে তো কী হয়েছে? বাঙালির বই-উদযাপন যেন কখনও শেষ না হয়! চারিদিকে বই আর বই, এমন এক বৈভবময় স্বপ্নের অংশীদার হতে চেয়ে এই সংখ্যার প্রচ্ছদভাবনা— বই-বিপণন-বইমেলা: বাদ-বিসম্বাদ।…

 

১৯০৬ খ্রিষ্টাব্দে নেপাল-রাজের গ্রন্থাগারে হরপ্রসাদ শাস্ত্রী মহাশয় ‘চর্যাচর্যবিনিশ্চয়’সহ বেশ কয়েকটি প্রাচীন পুঁথির সন্ধান পেয়েছিলেন, যা বাংলা ভাষায় লিখিত পুস্তকের ইতিহাসকে এক ধাক্কায় পিছিয়ে দশম শতাব্দীতে (মতান্তরে সপ্তম শতাব্দীতে) নিয়ে গিয়েছিল। কাগজে মুদ্রিত গ্রন্থের যাত্রা শুরু হল ষোড়শ শতকের অবিভক্ত বাংলায়, ইউরোপীয় ঔপনিবেশিকদের প্রতিষ্ঠিত ছাপাখানায়। আর এই মুহূর্তে অর্থাৎ একবিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয় দশকের মধ্যভাগে দাঁড়িয়ে সারা বিশ্বের কথ্য ভাষাগুলির মধ্যে আমাদের মাতৃভাষা বাংলার স্থান সপ্তম। মাত্র কদিন আগে একুশে ফেব্রুয়ারি বিশ্বজুড়ে পালিত হল আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস, যা বাংলা ভাষার নিজ অধিকার অর্জনের জন্য রক্তক্ষয়ী লড়াইয়ের এক মানবিক স্বীকৃতি। ভাষা ও সাহিত্যের এই দীর্ঘ ও গৌরবময় পথ পেরিয়ে এসে পথ পেরিয়ে আজ কোথায় দাঁড়িয়ে আছে আমাদের প্রিয় বাংলা ভাষা? আগের বাক্যে ‘প্রিয়’ শব্দটি লিখতে গিয়ে দুবার ভাবতেই বা হল কেন? বর্তমানের ওটিটি, রিলস ও সোশ্যাল মিডিয়ার রমরমার যুগে বাংলায় লিখিত, মুদ্রিত ও বিক্রিত বইয়ের অবস্থানটি ঠিক কী রকম? কর্মসূত্রে ছড়িয়ে যাওয়া বঙ্গপুঙ্গবদের বিশ্বায়নের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাংলা বইয়ের বাজার কি সত্যিই বাড়ছে? বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতির পরিসর দুই বাংলা, ত্রিপুরা, অসমের বরাক উপত্যকা ও বিশ্বের নানা জায়গায় প্রসারিত ও প্রবাহিত। বাংলা সাহিত্যের কলকাতা-কেন্দ্রিক হওয়ার ভানকে আমরা প্রবলভাবে অস্বীকার করি, কিন্তু পশ্চিমবঙ্গের বাসিন্দা হিসেবে বর্তমান বিসম্বাদটি আপাতত ভাগীরথী তীরের স্থানিক ভূরাজনৈতিক অভিজ্ঞতার মধ্যেই সীমাবদ্ধ রাখা যাক।

পশ্চিমবঙ্গের বাঙালি আজ সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সমস্যায় দীর্ণ। বিত্তে ও প্রতিপত্তিতে একদা প্রথম সারিতে থাকা রাজ্যটির স্থানাঙ্ক ক্রমঃবিলীয়মান। এ রাজ্যে বাংলা ভাষাকে আমরা অর্থনীতির সঙ্গে যুক্ত করতে পারিনি, যা পেরেছে বাংলাদেশ। দেশজ ঐতিহ্য, অসম্পূর্ণ হলেও নবজাগরণের অহঙ্কার ও ঔপনিবেশিক ইতিহাসের অবশেষ- সবকিছু মিলেমিশে আমাদের মননে এমন এক জটিল দ্বান্দ্বিকতার সৃষ্টি করেছে যার জট আমরা কিছুতেই ছাড়াতে পারছি না। আমরা নিজেদের বাঙালি পরিচয় নিয়ে গর্ববোধ করি, ভাষাদিবসে ফেসবুক পোস্টে আমাদের মাতৃভাষা-প্রেমের উদ্গার ঘটে, অথচ পরবর্তী প্রজন্মকে বাংলা মাধ্যম স্কুলে পড়ানোর কথা ভাবলেই আমরা আতঙ্কিত হই। এই দ্বিচারিতা আমাদের অসহায়তা না ভণ্ডামি? আবার এই আমরাই বছরে একবার এক পক্ষকাল ধরে শ্রেণি-বর্ণ-সম্প্রদায় নির্বিশেষে এমনই এক ধর্ম-ছোঁয়াচশূন্য আধুনিক উৎসবে মেতে উঠি, যার কেন্দ্রে রয়েছে মুদ্রিত অক্ষর। সীমানার ওপারে যেমন অমর একুশে বইমেলা, তেমনি এপারে আন্তর্জাতিক কলকাতা বইমেলা। গোটা বিশ্বে বইকে কেন্দ্র করে এমন আশ্চর্য উন্মাদনার নির্দশন আর কটি আছে? বিদ্যাসাগর-রবীন্দ্রনাথ-বেগম রোকেয়ার উত্তরসূরি হিসেবে বইমেলা ক্লি যেকোনও বাঙালির পক্ষেই যথেষ্ট শ্লাঘার বিষয় নয়? নাকি বইমেলার ধুলো ও গরম ফিশ ফ্রাইয়ের ধোঁয়া থিতিয়ে এলে, খুঁতখুঁতে নজর রাখলে, আমরা দেখতে পাব এই উল্লাসের পেছনে বেশিটাই হুজুগ? এরকম নানা প্রশ্ন উঠে আসে। এক প্রশ্নের টানে আরও প্রশ্ন। ভারিক্কি ও মর্যাদাবান ‘আন্তর্জাতিক’ বিশেষণটি কি সত্যিই কলকাতা বইমেলার চরিত্র ও মানের সঙ্গে সাযুজ্যপূর্ণ? ভূতপ্রেত- জ্যোতিষ- তন্ত্রমন্ত্র- থ্রিলার- হরর, এর বাইরে মননশীল বাংলা বইয়ের বিপুল সম্ভারের কতটুকু বিক্রি হচ্ছে বইমেলায়? পরিসংখ্যান কী বলে? নাকি বার্ষিক বইমেলার তোয়াক্কা না করে যে নিবিড় পাঠক ও ক্রেতা সারাবছর ধরে বই কিনে ও পড়ে চলেছেন, তিনিই বাংলার বইবাজারের প্রকৃত শ্বাসবায়ু? সেই একক পাঠক এবং বাংলা প্রকাশনা, এরা কি সত্যিই একে অপরের পরিপূরক হয়ে উঠতে পেরেছে? বইকে ভালোবেসে ভালো বই প্রকাশ করতে চান, এই মন্ত্রে বিশ্বাসী বাংলাভাষার নবীন প্রকাশনার ভবিষ্যৎ-ই বা কী? বাংলাভাষায় বই লিখে সম্মানজনক জীবনযাপন ও জীবনধারণ মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের পক্ষে সম্ভব হয়নি। অর্ধশতাব্দী পর আজ সেই অবস্থান কতটুকু বদলেছে? একই প্রশ্ন যদি করা যায় বাংলা বইয়ের নবীন প্রকাশককে, তিনি কী উত্তর দেবেন? একইসঙ্গে যা গুরুত্ব দিয়ে ভাবার, আমরা বইপ্রেমী অভিভাবকেরা নতুন প্রজন্মের পাঠক তৈরি করতে পারছি কি? আজ যারা শিশু ও কিশোর-কিশোরী, তাদের হাত থেকে মুঠোফোন থেকে সরিয়ে বাংলা বইমুখো করতে না পারলে বাংলাভাষা ও বাংলা বইয়ের প্রকাশনার ভবিষ্যৎ কী?

 

প্রিয় পাঠক, পুরো ছবিটা অবশ্য নিরাশাজনক নয়। সোশ্যাল মিডিয়া ও সেখানে নিজের মাতৃভাষায় ভাবপ্রকাশের প্রাযুক্তিক সুবিধে হাতের মুঠোয় চলে আসার ফলে পাঠক ও লেখকের মাঝখানের কাচের দেওয়াল আজ ভেঙে গেছে। সাহিত্যের মধ্যসত্বভোগী শ্রেণিটি, যারা একইসঙ্গে দালাল ও স্বঘোষিত গুরুঠাকুরের ভূমিকা পালন করে এসেছে এতদিন, তার আজ নিশ্চিত বিলুপ্তির পথে। লেখক নিজে থেকে এসে দাঁড়াচ্ছেন পাঠকের নাগালে, তাঁর মাথার‍ পেছনে আর কোনও জ্যোতির্বলয় নেই। বহুল সম্ভার থেকে একনিষ্ঠ পাঠক ঠিকই খুঁজে নিতে পারছেন তার পছন্দের বইটিকে। সাহিত্য ও তার বাজার আজ এসে দাঁড়িয়েছে এমন এক রাস্তার মোড়ে, যা এক-কথায় অভূতপূর্ব।

বই, বইয়ের বিপণন ও বইমেলা- এই বিষয়গুলিকে মাথায় রেখে আমরা প্রশ্নগুলির উত্তর খোঁজার চেষ্টা করেছি চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম-এর বর্তমান সংখ্যায়। বইমেলা শেষ হয়ে গেছে তো কী হয়েছে? বাঙালির বই-উদযাপন যেন কখনও শেষ না হয়! চারিদিকে বই আর বই, এমন এক বৈভবময় স্বপ্নের অংশীদার হতে চেয়ে এই সংখ্যার প্রচ্ছদভাবনা- বই-বিপণন-বইমেলা: বাদ-বিসম্বাদ। লিখলেন সুব্রত দাস, তাপস কুমার দাস, সুস্নাত চৌধুরী, অনুপম মুখোপাধ্যায়, সংযুক্তা রায় ও জয়দীপ মিত্র।

সঙ্গে রইল অন্যান্য সমস্ত নিয়মিত বিভাগ।

বই পড়ুন, বই নিয়ে এই বাদ-বিসম্বাদে আপনিও শরিক হোন…

 

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 4662 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

Be the first to comment

আপনার মতামত...