লোকসভা নির্বাচনে বামপন্থীদের কাছে মানুষ কী চায়?

নন্দন রায়

 


দীর্ঘ অবসর কাটিয়ে বামপন্থীরা গত কয়েক বছর ধরে আবার রাস্তায় নেমেছে, পুলিশের মোকাবিলায় অদম্য সাহস দেখিয়েছে, দলের শিরা-উপশিরায় তরুণ রক্তের অভিযোজন ঘটিয়েছে এবং ইনসাফ যাত্রায় ও ডিওয়াইএফআই-এর ব্রিগেড সমাবেশে সাড়া জাগানো সমর্থন পেয়েছে। বামপন্থীদের লক্ষ্য আগামী লোকসভা নির্বাচনে প্রাপ্ত ভোটের নিরিখে দ্বিতীয় স্থানটি দখল করা। বামপন্থীরা নিশ্চয়ই জানেন যে পশ্চিমবঙ্গ-সহ গোটা দেশের কাছে ফ্যসিবাদী বিজেপিকে হারানোটাই কেন্দ্রীয় কর্তব্য। সেই কাজে সফল হলে তৃণমূলকে উৎখাত করা কেবল সময়ের অপেক্ষা

 

২০১০ সাল নাগাদ, যখন তৃণমূলিরা আসন্ন বিধানসভা ভোটে জয়ের গন্ধ পেতে শুরু করেছিল, তখনই প্রতিবিপ্লবী গুপ্ত মন্ত্রণাসভায় নির্ধারিত হয়ে গিয়েছিল যে বামপন্থীদের আসন্ন নির্বাচনে এবং পরবর্তী নির্বাচনগুলিতে কিছুতেই আর সরকারে ফিরে আসতে দেওয়া যাবে না। অবশ্য প্রতিবিপ্লবী সংগঠনগুলির সিদ্ধান্ত অনুসারে রাজনৈতিক ভারসাম্যের পরিবর্তন ঘটবে এমন কোনও কথা নেই। রাজ্য অথবা দেশের রাজনীতিতে পরিবর্তন ঘটে তখনই যখন রাজ্য বা দেশের সার্বিক পরিস্থিতি পরিবর্তনের জন্য উন্মুখ হয়ে আছে— বস্তুগত (objective) ও বিষয়ীগত (subjective) উভয় ক্ষেত্রেই। অর্থাৎ যখন শাসকশক্তিগুলি আর আগের মতো পুরনো কায়দায় শাসন চালাতে পারছে না এবং জনগণও আর পুরনো কায়দায় শাসিত হতে চাইছে না— সমাজে একটা অস্থিরতা বিরাজ করছে। এটা বস্তুগত দিক। এরই পাশাপাশি বিষয়ীগতভাবে বিদ্যমান শাসকদলগুলির ওপরে জনগণ আর ভরসা রাখতে পারছে না। জনগণকে তাদের পক্ষে দেওয়ার মতো কিছু অবশিষ্ট নেই। এর পেছনের কারণ হিসেবে যে বৃহৎ অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক-সামাজিক কারণগুলি রয়েছে, সেসব বহুকথিত এবং বহুবিশ্লেষিত কারণগুলি আর এই আলোচনায় আনতে চাইছি না। নিজেদের মধ্যে অনেক মতপার্থক্য সত্ত্বেও প্রতিবিপ্লবী শক্তিগুলির একযোগে এইরূপ সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়া ঐতিহাসিকভাবে নির্ধারিত ছিল। এটাই হচ্ছে আসল ‘সেটিং’। মমতা বন্দোপাধ্যায় দিল্লি গিয়ে মোদির সঙ্গে বৈঠক করলেই যে সেটিং সেটিং চিৎকার ওঠে, তা নেহাতই বালখিল্য রাজনীতিবোধের প্রকাশ মাত্র।

বলার কথা এটাই যে, আজ থেকে চোদ্দ বছর আগে বামপন্থীদের বিরুদ্ধে প্রতিবিপ্লবী শক্তিগুলির নিজেদের মধ্যে যে সমঝোতা গড়ে উঠেছিল, আজ ২০২৪ সালের সংসদীয় নির্বাচনেও তা বলবৎ রয়েছে। কারণ এটি হচ্ছে আরএসএস-এর মতাদর্শগত অবস্থান। লুণ্ঠন ছাড়া যেহেতু তৃণমূলের আর কোনও মতাদর্শ নেই, তাই বামপন্থীদের ইতিহাস-প্রমাণিত মতাদর্শের বিরুদ্ধে আরএসএস-বিজেপি চক্রের সাম্প্রদায়িক হিন্দুত্ববাদী মতাদর্শের অনুগামী হতে তৃণমূলের কোনও আপত্তি নেই, লুণ্ঠনের সুযোগ ও স্বাধীনতা তাদের করায়ত্ত থাকলেই হল। তৃণমূলের চুরি-জোচ্চুরিতে আরএসএস-বিজেপি চক্রের তেমন আপত্তি কিছু নেই, কারণ ইলেক্টোরাল বন্ডের সত্য উদ্ঘাটনের মধ্য দিয়েই প্রমাণিত হয়েছে যে রাষ্ট্রযন্ত্রের দমনমূলক সংস্থাগুলিকে কাজে লাগিয়ে বিজেপিই দুনিয়ার সবচেয়ে বড় তোলাবাজির কারবার চালিয়েছে। তাই গত ২৬ ফেব্রুয়ারির আরএসএস-এর মুখপত্র ‘স্বস্তিকা’র সম্পাদকীয় প্রতিবেদনে সঙ্ঘের কর্মীদের সতর্ক করা হয়েছে এই বলে যে তৃণমূলের বিরুদ্ধে জনরোষের কারণে বামপন্থীরা যেন শক্তি বাড়াতে না পারে, আবার বিজেপির বিরুদ্ধে মানুষের ক্ষোভের কারণে জনমত যেন বামপন্থীদের দিকে চলে না যায় সেদিকেও নজর রাখতে হবে। স্বয়ংসেবকরা যেন মনে রাখেন বামপন্থী এবং ধর্মনিরপেক্ষ শক্তিদের আটকাতে মমতা বন্দোপাধ্যায়ের ‘অবদানের’ কথা ভুললে চলবে না এবং এই নারীর নেতৃত্বেই কিন্তু বাংলার ‘মুক্তিলাভ’ ঘটেছিল। সঙ্ঘ নেতৃত্ব ইতিমধ্যেই সিদ্ধান্ত নিয়েছে যে, যেখানে মনে হবে বাম ও ধর্মনিরপেক্ষ শক্তিরা জিতে যেতে পারে, সেখানে তারা প্রয়োজনে তৃণমূলের পক্ষে ‘কাজ’ করবে।

এটাই সঙ্ঘ পরিবারের একশো বছর টিকে থাকার সঞ্জীবনী। পরিবারভুক্ত অসংখ্য সংগঠনের গোপন ও প্রকাশ্য নানাবিধ কর্মপ্রণালীর দ্বারা স্বয়ংসেবকরা নিরলসভাবে সাম্প্রদায়িক হিন্দুত্ববাদী ফ্যাসিবাদের মধ্যযুগীয় চেতনার প্রসার ঘটিয়ে চলেছে, শুধু তাদের রাজনৈতিক সংগঠন বিজেপিকে রাষ্ট্রক্ষমতায় প্রতিষ্ঠা করার জন্য নয়, তার চেয়েও বড় কথা, প্রগতিবাদী মুক্তচেতনার মতবাদে বিশ্বাসী যাবতীয় শক্তিকে নিশ্চিহ্ন করার উদ্দেশ্যে। বলাবাহুল্য, বামপন্থীরা তাদের প্রধানতম শত্রু। তাই কখনও তারা এমনকি কংগ্রেসকেও বিজয়ী করতে সচেষ্ট হয়েছে। বিপদে পড়লে তৃণমূলকে যে তারা সমর্থন করবে এ আর বেশি কথা কী।

এখানে প্রশ্ন উঠতে পারে, এই যদি অবস্থা হয় তাহলে আরএসএস-এর মতাদর্শকে তো কোনওদিনও পরাভূত করা সম্ভব নয়। এখানেই আসে শ্রেণির প্রশ্ন এবং শ্রেণিসংগ্রামের প্রশ্ন। পুঁজিবাদী উৎপাদন সম্পর্কের কারণেই গুটিকয়েক শাসকশ্রেণিগুলি কখনওই তাদের সামাজিক ভিত্তি অটুট রাখতে পারে না (স্বয়ংসেবকদের নিরলস প্রচেষ্টা সত্ত্বেও), এবং যেহেতু শেষ বিচারে ইতিহাসের গতি সমুখপানেই ধাবিত হয়, তাই বিদ্যমান ব্যবস্থা থেকে সমাজেরও উত্তরণ ঘটে— কারণ এই শাসকশ্রেণিগুলি সৃষ্টি করেছে তাদেরই সমাধিখনকদের।

 

দুই.

উপরে যা বর্ণিত হল তা হচ্ছে সুদুর ভবিষ্যতের এক সর্বজনগ্রাহ্য রূপরেখা। কিন্তু আমাদের সামনে তো এখন আশু কর্তব্য হচ্ছে ২০২৪ সালের সংসদীয় নির্বাচনের একটি সততাপূর্ণ ও জনবোধ্য বিশ্লেষণ, যেখানে প্রাধান্য পাবে পশ্চিমবঙ্গে বামপন্থীদের সম্ভাব্য ফলাফল।

এই পর্যায়ে অবধারিতভাবে যে প্রশ্নটি উঠে আসে, তা হল এ-রাজ্যের মানুষ বামপন্থীদের কাছে কী চায়।

প্রশ্নটি সহজ, কিন্তু এর উত্তর হাজির করাটা বেশ কঠিন। একজন পণ্ডিত মানুষকে প্রশ্নটা করাতে তিনি পালটা প্রশ্ন করলেন, বামপথীদের কাছে আদৌ কিছু চায় কি? কথাটা তির্যকভাবে বলা হলেও ফেলনা নয়। এই প্রশ্নের উত্তর পেতে হলে ৩৪ বছরকে একবার আলোচনায় আনতেই হবে। বুর্জোয়া ব্যবস্থার ঘেরাটপের মধ্যে কোনও অঙ্গরাজ্যে যদি নির্বাচনের মাধ্যমে বামপন্থীরা সরকার গড়ার অবস্থায় উপনীত হয়, তাহলে কী রণকৌশল অনুসরণ করা হবে, এই বিষয়টি অনেককাল ধরে বামপন্থীদের চিন্তা-ভাবনার মধ্যে ছিল। শেষ পর্যন্ত এটাই সাব্যস্ত হয় যে এরূপ অবস্থায় যেহেতু কোনও র‍্যাডিকাল কর্মসূচি নেওয়া যাবে না, তাই জনগণকে রিলিফ দেওয়ার কিছু ‘বিনম্র’ কর্মসূচি পালনের চেষ্টা করতে হবে। পাশাপাশি বিদ্যমান ব্যবস্থার অসারতা সম্পর্কে মানুষকে সচেতন করতে হবে। কেরল ও পশ্চিমবঙ্গে প্রথম ও দ্বিতীয় যুক্তফ্রন্টের আমলে দেখা গেল যে শ্রেণিসংগ্রামকে তীব্র করার ফলে কায়েমি শক্তিগুলির স্বার্থে আঘাত আসতেই বামপন্থীদের সরকারগুলিকে ফেলে দেওয়া হল। কিন্তু তা সত্ত্বেও সমাজের শ্রেণিগুলির ভারসাম্য বামপন্থীদের অনুকূলে থেকে গেল। বরং শাসকশ্রেণিগুলির মধ্যে বাম-বিরোধিতার প্রশ্নে কোনও ঐকমত্য প্রতিষ্ঠা হল না। আসলে সেই সময় থেকেই শাসকশ্রেণিগুলির মধ্যে একটা আলোড়ন চলছিল এবং নতুন শ্রেণিবিন্যাসের অভ্যুদয় ঘটছিল।

১৯৭৭ সাল থেকে গত শতাব্দীর নব্বই-এর দশকের আগে পর্যন্ত এই অবস্থাটা চলেছিল এবং বামপন্থীদের জনসমর্থনে কোনও ভাঁটা এই সময়কালে পরিলক্ষিত হয়নি। এর পরবর্তীকালে সরকারে থাকার সুবিধেগুলি নেওয়ার জন্য নতুন গ্রামীণ বড়লোকরা এবং শহুরে মধ্যবিত্ত সুযোগসন্ধানীরা নেতাদের চারপাশে ভিড় জমাল, এমনকি দলের মধ্যেও ঢুকে পড়ল। এই ব্যাপারে তাদের সাহায্য করল সামগ্রিক বুর্জোয়া ব্যবস্থার মধ্যস্থিত মতাদর্শগত অবস্থান এবং সেই ব্যবস্থার দ্বারা লালিত পুলিশ ও আমলাবাহিনি। ফলে দলের মধ্যেকার বুনিয়াদি শ্রেণিসমূহের জোরের জায়গাটি কিছুটা ঢিলে হয়ে গেল। ওদিকে সরকার চালাবার প্রতিদিনের বাধ্যবাধকতার ব্যস্ততার মধ্যে যে ক্যাডারদের ‘জলের মধ্যে মাছের মতো’ জনগণের সঙ্গে মিশে থাকার কথা, সেই প্রক্রিয়াটি ব্যাহত হতে লাগল, জনগণের ‘অধিকারের’ প্রশ্নটি ম্লান হয়ে ‘পাইয়ে দেওয়ার’ রাজনীতি ক্রমশ প্রাধান্যের ভূমিকায় চলে এল।

 

তিন.

২০১১ সালের প্রতিবিপ্লবী বিজয়ের পরে নিচের তলার দলীয় সংগঠন যে ভেঙে পড়ল তার কারণ এটাই। বাম সরকার ও অন্যান্য বুর্জোয়া সরকারের মধ্যেকার তফাতটি আবিল হয়ে গিয়েছিল কারণ বামপন্থী সরকার তার যাবতীয় কাজের মধ্যে যে left imprint রেখে যায়, শ্রেণিদৃষ্টিভঙ্গির যে ছাপ তার কর্মসূচির মধ্যে প্রোথিত হয়ে থাকে, সেই জোরের জায়গাটা হারিয়ে গিয়েছিল। প্রতিবিপ্লব ঘটে যাওয়ার পেছনে বস্তুগত কারণ ছাড়াও যে বিষয়ীগত কারণ থাকে, তা হল বামপন্থীদের এই ব্যর্থতা।

প্রতিবিপ্লবী শক্তিগুলি আর একটা কাজ খুব দক্ষতার সঙ্গে করেছিল। বুনিয়াদি শ্রেণিসমূহের নিচের তলার যে সংগঠন বামপন্থীদের প্রাণ-ভোমরা, তার ওপরে হামলা চালিয়ে, তাদের উৎখাত করে, মিথ্যে মামলার পাহাড় চাপিয়ে, জরিমানা আদায় করে গ্রামে গ্রামে পাড়ায় পাড়ায় সন্ত্রাস সৃষ্টি করে সেসব এমন তছনছ করে দিল যে আজও তা মেরামত করা যায়নি। সেই জন্য ভোটের সময়ে বুথ রক্ষা তো দূরের কথা, পোলিং এজেন্ট বসানোর মতো লোক খুঁজে পাওয়া যায় না। ব্যতিক্রম কি নেই? অবশ্যই আছে, তবে তা এই সাধারণ সত্যকে বলবতী করে।

তাছড়া, আমাদের দেশের বুর্জোয়া নির্বাচনী ব্যবস্থায় কিছু অন্তর্নিহিত ত্রুটি রয়েছে। প্রদত্ত ভোটের আনুপাতিক প্রতিনিধিত্ব, প্রান্তিক ও দুর্গম এলাকা, মূল রাজনীতির বাইরে থাকা জাতপাত-সহ সমাজের প্রান্তদেশে অবস্থিত বিভিন্ন জনগোষ্ঠীর আনুপাতিক প্রতিনিধিত্বের মতো বড় বড় বিষয়গুলির কথা না-হয় ছেড়েই দিলাম, এমনকি দারিদ্র্য, অশিক্ষা এবং সামাজিক বর্জনের কারণে এখানে অবাধ ও নিরপেক্ষ মতদান বাস্তবত অসম্ভব। এই শেষের কারণগুলির মোকাবিলা করতে রাজনৈতিক দলগুলি এখানে ভোট ‘করায়’। এর জন্য প্রয়োজন নির্বাচনী সংগঠন, বুথে বুথে জনসমাবেশ, অথবা পেশিশক্তির প্রদর্শন ও ব্যবহার। ৩৪ বছরের দ্বিতীয়ার্ধে নির্বাচনী সংগঠনের ওপরে যাবতীয় উদ্যোগ কেন্দ্রীভূত করার কারণে নির্বাচনী রাজনীতিতে অংশগ্রহণ করাটা যে একটি কৌশল মাত্র সে-কথা ভুলে গিয়ে বামপন্থীরা এটাকে প্রায় রণনীতিগত অবস্থানে নিয়ে গিয়েছিল। এর থেকে ‘শিক্ষা’ নিয়েই তৃণমূল তার সঙ্গে প্রতিক্রিয়াশীল দমন, হামলা, ছাপ্পার বিষ মিশিয়ে যে ককটেল তৈরি করেছে তা এককথায় ভোটে জেতার মহৌষধ।

বিজেপিও একই পন্থা নিয়েছে, তদুপরি তার সঙ্গে যোগ করেছে হিন্দুত্ববাদী সাম্প্রদায়িকতা, যাতে করে তারা নিজেদের সাংগঠনিক দুর্বলতা আংশিকভাবে হলেও পুষিয়ে নিতে পারে। তার ওপরে রয়েছে কর্পোরেট মিডিয়ার নিরলস প্রচার, যাতে ইদানিংকালের যে কোনও নির্বাচনকে তৃণমূল বনাম বিজেপির বাইনারিতে পরিণত করেছে—যেন অন্য কোনও দল নির্বাচনী ময়দানে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছে না। কজন আর গণশক্তি পড়ে অথবা বামপন্থীদের খোঁজখবর রাখে? তার চেয়ে ঢের বেশি লোক আনন্দবাজার, বর্তমান ইত্যাদি পড়ে এবং আরও বেশি লোক এবিপি আনন্দ অথা ২৪ ঘন্টা দেখে! বামপন্থীরা এর মোকাবিলা করতে পারত একমাত্র গ্রামস্তর অবধি প্রসারিত সচেতন শ্রেণি-সংগঠন দিয়ে। হায়! আজ সেই সংগঠন এমন শীর্ণ হয়ে গিয়েছে যার ওপরে মানুষ ভরসা রাখবে কেন?

তৃণমূল-বিজেপির কথা যখন উঠলই, তখন তাদের মধ্যেকার সম্পর্কের দ্বান্দ্বিকতাকেও বিচার করা যাক। উভয়ই যেহেতু স্বৈরাচারী প্রতিবিপ্লবী শক্তি, তাই তাদের মধ্যেকার সম্পর্কের দ্বান্দ্বিকতায় সাধারণভাবে সমঝোতার উপাদানটিরই প্রাধান্য থাকে। কিন্তু ভিন্ন ভিন্ন স্বার্থের কারণে সংঘাতের উপাদানটি গৌণ হলেও অপ্রধান অবস্থায় বিরাজ করে। নির্বাচনের সময়ে যেহেতু কে শাসন ক্ষমতায় আসীন হবে, অর্থাৎ কে রাজ্যের রাজকোষ তথা জনগণকে লুঠ করার ‘ছাড়পত্র’ পাবে, এই প্রশ্নটি নির্ধারক ভূমিকায় চলে আসে, তখন সংঘাতের উপাদানটি প্রধান ভূমিকায় দেখা দেয় এবং সমঝোতার উপাদানটি অপ্রধান হয়ে ওঠে। এই কারণেই বাম-কংগ্রেসকে দিনরাত গালি দিয়েও মমতা বন্দোপাধ্যায়কে ‘ইন্ডিয়া’ গোষ্ঠীতে জয়েন করতে হয়। এখন তৃণমূলের অবস্থা এতটা সঙ্গীন হয়ে উঠেছে যে মমতা বন্দোপাধ্যায় চাইছেন যে এবারের নির্বাচনে বামপন্থীরা কিছু ভোট টানুক যাতে anti-incumbent ভোট গোটাটাই বিজেপির দিকে ঢলে না পড়ে। তাঁকে আশ্বস্ত করে বলা যায় যে বাংলার শক্তিশালী এবং ঐতিহ্যশালী ভাষা-সংস্কৃতিগত হেরিটেজ বিজেপির মতো বহিরাগত উচ্চকিত ঘৃণার মতাদর্শকে আপন বলে মনে করে না— মধ্যবিত্ত শিক্ষিত ও ‘ভদ্রলোক’ বাঙালি তো নয়ই। এই বাঙালিই এখনও এখানে জনমত প্রভাবিত করে।

 

চার.

এখন অবস্থার কিছু পরিবর্তন লক্ষ করা যাচ্ছে বস্তুগত এবং বিষয়ীগত উভয় ক্ষেত্রেই।

প্রথমত, তৃণমূলের অপরিমিত তোলাবাজি, রাহাজানি এবং দুঃশাসন রাজ্যটাকে একেবারে খাদের কিনারায় এনে ফেলেছে, এতটাই যে বিজেপিকে ঠেকানোর জন্য এতদিন ধরে যে সংখ্যালঘু ভোট তৃণমূলকে সঙ্গ দিচ্ছিল, সেখানে বেশ বড়সড় ফাটল ধরেছে। তাদের বেশিরভাগ মানুষই গরিব। ভোট-আনুগত্যের বিনিময়ে ‘বদান্য’ স্বৈরাচারীর লক্ষ্মীর ভাণ্ডারের মুষ্টিভিক্ষায় এই ক্ষতি পূরণ হওয়ার নয়। একই কথা অন্যান্য গরিব মানুষের ক্ষেত্রেও সমান সত্য। চিটফান্ড কেলেঙ্কারিতে নিম্নবিত্তের ভীষণ ক্ষতি হয়ে গিয়েছে। অথচ তখন মধ্যবিত্ত উদাসীন ছিল। তত্সত্ত্বেও ২০১৬ সালের বিধানসভা নির্বাচনে মমতা বন্দোপাধ্যায় ঘাবড়ে গিয়ে লোকের বাড়ি বাড়ি গিয়ে বাসন মেজে দিয়ে আসার কথা বলেছিলেন। এবারে বেলাগাম চাকরি বিক্রির দুর্নীতিতে শিক্ষিত মধ্যবিত্তের স্বার্থে আঘাত লেগেছে। এই মধ্যবিত্তই সবচেয়ে বেশি ভোকাল। অর্থাৎ দেখা যাচ্ছে যে তৃণমূলের বিরুদ্ধে শ্রেণিভারসাম্যের একটা পরিবর্তনের সূচনা হচ্ছে। এখন প্রশ্ন হল শাসকদলের প্রতি এই অনাস্থা কি বিজেপিকে সুবিধে করে দেবে?

বিজেপির কিছু সুবিধে হবে নিশ্চিত। উপরন্তু, ভ্রান্ত মধ্যযুগীয় স্থূল চেতনা ধর্মীয় বিদ্বেষ ও গোষ্ঠী-পরিচিতির আবেগের কাছে যে আবেদন রাখে, তা বাঙালির কৃষ্টি-অহঙ্কারকে কিছুটা ধাক্কা দিতে পারে। তদুপরি বিজেপি কেন্দ্রীয় ক্ষমতায় আসীন। মোদির জুমলা যে কোনও প্রভাবই ফেলবে না সে-কথাই বা বলি কী করে?

দ্বিতীয়ত, দীর্ঘ অবসর কাটিয়ে বামপন্থীরা গত কয়েক বছর ধরে আবার রাস্তায় নেমেছে, পুলিশের মোকাবিলায় অদম্য সাহস দেখিয়েছে, দলের শিরা-উপশিরায় তরুণ রক্তের অভিযোজন ঘটিয়েছে এবং ইনসাফ যাত্রায় ও ডিওয়াইএফআই-এর ব্রিগেড সমাবেশে সাড়া জাগানো সমর্থন পেয়েছে। বামপন্থীদের লক্ষ্য আগামী লোকসভা নির্বাচনে প্রাপ্ত ভোটের নিরিখে দ্বিতীয় স্থানটি দখল করা। বামপন্থীরা নিশ্চয়ই জানেন যে পশ্চিমবঙ্গ-সহ গোটা দেশের কাছে ফ্যসিবাদী বিজেপিকে হারানোটাই কেন্দ্রীয় কর্তব্য। সেই কাজে সফল হলে তৃণমূলকে উৎখাত করা কেবল সময়ের অপেক্ষা।

 

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 4664 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

Be the first to comment

আপনার মতামত...