সাম্প্রতিক সময়ে ইতিহাস ও বিজ্ঞানচর্চার দর্শন অনুসন্ধান

মধুশ্রী বন্দ্যোপাধ্যায়

 


পৃথিবীর বিভিন্ন অঞ্চল থেকে ভারতবর্ষে বহু পরিযান হয়েছে। তাই ইতিহাসের দীর্ঘ সময়কাল ধরে ভারতবর্ষ বিপুল সংখ্যক মানুষকে ধারণ করেছে। বিভিন্ন জনগোষ্ঠী যখন মিশ্রিত হয়েছে, তখন অন্যের থেকে কিছু শিখেছে, কিছু নিজেরা উদ্ভাবন করেছে। এই বিভিন্নতা আমাদের সংস্কৃতি। এটাই আমাদের ঐতিহ্য। উগ্র জাতীয়তাবাদ ও সাম্প্রদায়িক চেতনার পুনরুত্থান-প্রবণতা ইতিহাস ও বিজ্ঞানচর্চাকে স্তিমিত করে দিতে পারে। ভ্রান্ত পথে জাতিকে নিয়ে যেতে পারে

 

দেশে ইতিহাসচর্চা কি বেড়ে গেছে? আর বিজ্ঞানচর্চা? আমাদের মতো সাধারণ মানুষের কথা বলছি না, তবে দেশের কিয়ৎ পরিমাণ রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের মধ্যে এবং স্বঘোষিত দার্শনিকদের মধ্যে হয়তো বৃদ্ধি পেয়েছে বিজ্ঞান ও ইতিহাস চর্চা।

 

সাম্প্রতিক বার্তা

সেই যবে ২০১৪ সালে দেশের নবতম প্রধানমন্ত্রী মুম্বাইয়ের একটি হাসপাতালে চিকিত্সক এবং অন্যান্য পেশাদারদের এক সমাবেশে ঘোষণা করেছিলেন, ‘এক সময়ে আমাদের দেশ চিকিৎসাবিজ্ঞানে যা অর্জন করেছে তা নিয়ে আমরা গর্বিত বোধ করতে পারি, আমরা সবাই মহাভারতে কর্ণের কথা পড়েছি। আরেকটু চিন্তা করলে আমরা বুঝতে পারি যে মহাভারত বলছে কর্ণ তার মায়ের গর্ভ থেকে জন্মগ্রহণ করেননি। এর মানে সেই সময়ে জেনেটিক সায়েন্স ছিল। তাই কর্ণ তার মায়ের গর্ভের বাইরে জন্মগ্রহণ করতে পেরেছেন। আমরা গণেশের পূজা করি। সেই সময় নিশ্চয়ই কোনও প্লাস্টিক সার্জন ছিলেন যিনি মানুষের শরীরে হাতির মাথা রেখে প্লাস্টিক সার্জারির অনুশীলন শুরু করেছিলেন।… আমরা যদি মহাকাশবিজ্ঞানের কথা বলি, আমাদের পূর্বপুরুষেরা মহাকাশবিজ্ঞানে কোনও-না-কোনও সময়ে দারুণ শক্তি প্রদর্শন করেছিলেন। আর্যভট্টের মতো লোকেরা শতাব্দী আগে যা বলেছিলেন তা আজ বিজ্ঞান দ্বারা স্বীকৃত হচ্ছে। আমি যা বলতে চাচ্ছি তা হল আমরা এমন একটি দেশ যার এই ক্ষমতা ছিল। আমাদের এগুলো পুনরুদ্ধার করতে হবে।’

মোদিজি বলেছেন, তারপরে সেই কথার অনুরণন শুরু হয়— রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব, কিছু ইতিহাসবিদ এমনকী কিছু বিজ্ঞানী বা বিজ্ঞান শিক্ষাকেন্দ্রের সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিত্বদের মধ্যেও।

২০২২ সালে খোদ খড়্গপুর আইআইটির বিজ্ঞানশিক্ষকের ‘ক্যালেন্ডার চর্চা’ আরেকবার মনে করিয়ে দিই। কোন অধীত বিদ্যাচর্চার সঙ্গে সঙ্গতি রেখে সেই ক্যালেন্ডার রচিত হয়েছিল তা বোঝা সাধারণ বিজ্ঞানচর্চাকারীর পক্ষে সম্ভব নয়। বিজ্ঞানের উন্নতির সঙ্গে সঙ্গে প্রত্নতত্ত্ব, নৃতত্ত্ব, তুলনামূলক ভাষাতত্ত্ব ইত্যাদি ছাড়াও জিনবিদ্যা, প্রত্নজিনবিদ্যা, প্রত্ন-উদ্ভিদবিদ্যা ইত্যাদির সাহায্যে আজকে প্রাগিতিহাস ও প্রাচীন ইতিহাস লেখা হচ্ছে। আজকে ইতিহাসবিদরাও ওই সময়ের ইতিহাস লিখতে জিনবিদদের সাহায্য নেন। আর এটাই স্বাভাবিক। এভাবেই মানবসভ্যতা এগিয়েছে।

একথা বলাই বাহুল্য যে, বিদ্যাচর্চাকে এক সীমাবদ্ধ অঞ্চলে, এক নির্দিষ্ট ভাবনায় বন্দি করা যায় না। তাহলে তার পরিণতি হবে চাকাবিহীন আমেরিকার সভ্যতার মতো। এত সুপ্রাচীন ও উন্নত মায়া সভ্যতা বাকি মানবসভ্যতার একত্রিত জ্ঞানের সঙ্গে (এবং ইউরোপীয়দের দখলদারির সঙ্গেও বটে) পাল্লা দিতে পারল না। বিশ্বের অন্যতম বৃহৎ পিরামিড গড়লেও, তারা কলম্বাসের আগে চাকার ব্যবহার তেমনভাবে করেননি। অপরদিকে ইউরোপ-মধ্য এশিয়া-মিশর-ভারত-চিন, এসব জায়গায় খণ্ড খণ্ড সভ্যতাগুলো একে অপরের পরিপূরক হয়েছিল।

খড়্গপুর আইআইটির সেই ক্যালেন্ডার

খড়্গপুর আইআইটির ক্যালেন্ডার প্রমাণ করতে চেয়েছিল আমাদের সভ্যতায় পৃথিবীর অন্য অঞ্চলের কোনও অবদান নেই। ভারতবর্ষে কোনও ইন্দো-ইউরোপীয় জনগোষ্ঠী কখনও আসেনি, হরপ্পীয় ও বৈদিক সভ্যতা অবিচ্ছিন্নভাবে প্রবাহিত হয়েছে।

কেন এই কথা তাঁরা প্রমাণ করতে চাইলেন?

বিজ্ঞানের পত্রিকায় নেতিবাচক শব্দ দিয়ে পেপার প্রকাশিত হয়, ‘An Ancient Harappan Genome Lacks Ancestry from Steppe Pastoralists or Iranian Farmers’. সেই পেপারের প্রকাশ উপলক্ষে দেশের সংবাদপত্রগুলো কাগজে হেডিং করে ‘2500 BC Rakhigarhi skeletons have no traces of ‘Aryan gene’, finds DNA study’.

কেন এই প্রশ্ন এত দরকারি? কেন নেতিবাচক ইন্দো-ইউরোপীয় জিন ৪৫০০ বছরের পুরনো হরপ্পীয় নারীর দেহে পাওয়া যায়নি এই কথা এমনকি কিছু বিজ্ঞানীর কাছেও এত গুরুত্বপূর্ণ?

 

উই অর আওয়ার নেশানহুড ডিফাইন্ড

এক দেশ— হিন্দুস্তান। তাতে আছে এক জাতি (রেস)— হিন্দু জাতি। সেই জাতি-ধারণা সম্পূর্ণতা পায় হিন্দু ধর্ম, হিন্দু সংস্কৃতি ও হিন্দু ভাষার মাধ্যমে। এই হিন্দু ভাষা হল সংস্কৃত ও তার থেকে উৎপন্ন ভাষাগুলি। এক জাতি, এক ধর্ম, এক সংস্কৃতি, এক ভাষা মিলে তৈরি হয়েছে এক নেশন— হিন্দুস্তান।

১৯৩৯ সালে নাগপুর থেকে প্রকাশিত ভারত পাবলিকেশন্সের ‘উই অর আওয়ার নেশানহুড ডিফাইন্ড’ গ্রন্থে নেশন নিয়ে দীর্ঘ আলাপের শেষে এমএস গোলওয়ালকর আলোচনার নিস্পত্তি করেছেন হিন্দু রাষ্ট্রের ধারণার মাধ্যমে। এমএস গোলওয়ালকর ছিলেন রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘের দ্বিতীয় সরসঙ্ঘচালক অর্থাৎ সর্বোচ্চ প্রধান। গ্রন্থটিতে তিনি রেস বা জাতি, তার সংস্কৃতি নিয়ে দীর্ঘ আলোচনা করেছেন। রেস বলতে তিনি এমন এক জনগোষ্ঠীকে বুঝিয়েছেন যাদের অভিন্ন রীতিনীতি আছে, যারা এক ভাষায় কথা বলে, যাদের সংস্কৃতিও অভিন্ন। অতীত থেকে যেসব রীতি, আচারানুষ্ঠান, প্রথা, দর্শন ও ধর্ম অনুসরণ করা হচ্ছে তার একত্রিত প্রভাবে তৈরি হয় জাতির সংস্কৃতি। তিনি বলেছেন, ধর্ম ও সংস্কৃতি অবিচ্ছেদ্য। সংস্কৃতির আরেক অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ হল ভাষা। প্রতিটি জাতির নিজের দেশে নিজস্ব ভাষা উদ্ভূত ও বিকশিত হয়। আসমুদ্রহিমাচল সকলের সাধারণ ভাষা হল সংস্কৃত। আর সংস্কৃত থেকে উদ্ভূত আধুনিক ভাষাগুলির মধ্যে হিন্দি প্রায় সকলে বুঝতে পারে এবং বিভিন্ন রাজ্যে এটিই যোগাযোগের মাধ্যম হিসাবে ব্যবহৃত হয়। প্রাগৈতিহাসিক কাল থেকে হিন্দু জাতি হিন্দুস্তানে বসবাস করে। এদের উৎস, সংস্কৃতি এক। এক হাজার বছর আগে পর্যন্ত এই দেশে বিশুদ্ধ, খাঁটি দেশজ ধর্ম, সংস্কৃতি ও ভাষা ছিল।

গোলওয়ালকরের সেই বই

শেষ এক হাজার বছর ধরে মুসলমান ও ব্রিটিশদের সঙ্গে সংস্পর্শে এলেও এই সংস্কৃতি এখনও পৃথিবীর মহত্তম।

তাঁর এই লেখা এখনও আরএসএসের মূল মতাদর্শ।

এমএস গোলওয়ালকর তার কল্পনামাফিক হিন্দুস্তানের ইতিহাসকে বর্ণনা করেছেন। আধুনিক বিজ্ঞানের আলোয় আলোচনা করা দরকার কবে থেকে এই দেশে মানুষ বসবাস করছে। কীভাবে ভারতে এতগুলি ভাষাগোষ্ঠীর মানুষ এল? কেন আমি বা আপনি দক্ষিণভারতের ভাষা বুঝতে পারি না? আন্দামানের ওঙ্গেদের সঙ্গে পঞ্জাবের মানুষের চেহারা তুলনীয় নয়, আর তাদের ভাষাও একেবারে ভিন্ন।

 

ভারতবর্ষে বিভিন্ন পরিযান ও জাতিগোষ্ঠী গঠন

এমএস গোলওয়ালকর যখন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ-পূর্ব জার্মানির আদর্শে উদ্বুদ্ধ হয়ে একমাত্রিক স্বাধীন নেশনের কল্পনা করছেন, সেই একই সময়ে সারা পৃথিবীর বিজ্ঞানীরা খুঁজে বেড়াচ্ছেন প্রাগৈতিহাসিক মানুষের ইতিহাস। প্রথমে তারা পুরাবস্তু, দেহাবশেষ ইত্যাদি খুঁজে বার করে, পরীক্ষা করে তার ইতিহাস লিখেছেন। আবার এই শতাব্দীর প্রথম দুই দশকে জিনবিদ্যা বা জেনেটিক্সের সাহায্যে আরও সঠিকভাবে উত্তর দিতে পারা যাচ্ছে কিছু চিরন্তন প্রশ্নের।

প্রাগৈতিহাসিক কাল থেকে ভারতবর্ষে বিভিন্ন জনগোষ্ঠী পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্ত থেকে বারবার পরিযান করেছে। জিনবিদ্যার সাহায্যে শরীরের ডিএনএ বিশ্লেষণ করে আমাদের পূর্বপুরুষ ও পূর্বনারীর খোঁজ পাওয়া যায়। প্রমাণ করা যায়, মানুষের উদ্ভব আফ্রিকাতে। তারপর আজ থেকে ৭০-৭২ হাজার বছর আগে খাদ্যের অন্বেষণে একদল মানুষ শুষ্ক শীতল পূর্ব-আফ্রিকা ছেড়ে শুরু করে প্রব্রজন। সেই ছোট্ট গোষ্ঠীর সন্ততিরাই আজ আফ্রিকার বাইরের সমস্ত মানুষের পূর্বজ। অর্থাৎ আফ্রিকার বাইরে যত মানুষ আজ এশিয়া, ইউরোপ আমেরিকা বা অস্ট্রেলিয়াতে আছে, তাদের সকলের পূর্বজরা ছিল আফ্রিকা থেকে বেরিয়ে আসা সেই গোষ্ঠীতে।

আমাদের মাতৃক্রম যেখান থেকে যে-পথে এসেছে

আফ্রিকা থেকে বহির্গত সেই জনগোষ্ঠী ভারতবর্ষে প্রথম পদার্পণ করে অন্তত ৬৫ হাজার বছর আগে। তারা ছিল শিকারি ও সংগ্রাহক। তারাই আদি ভারতীয়। আজকের আন্দামান দ্বীপপুঞ্জের অধিবাসী ওঙ্গে, সেন্টিনেলিজ, জারোয়ারা ওই প্রাচীনতম জনগোষ্ঠীর নিকটতম প্রতিনিধি। এমনকি আজকের সমগ্র ভারতের ৭০ থেকে ৯০ শতাংশ মানুষ মাতৃক্রমের (maternal lineage) দিক দিয়ে সেই আফ্রিকা-আগত মায়ের সরাসরি বংশধর। অর্থাৎ ওই সময়ে যে নারীরা সোজাসুজি এদেশে এসেছিলেন আজকের ভারতের অধিকাংশ নরনারী মাতৃক্রমে সরাসরি তাদের উত্তরসূরি।

পিতৃক্রমের (paternal lineage) হিসেবটা ভিন্ন। সেই যে ৬৫ হাজার বছর বা তার আগে ভারতবর্ষে প্রথম মানুষ এসেছে তার পরেও এই দেশে আরও কিছু পরিযান হয়েছে। তারা পূর্বোক্ত জনগোষ্ঠীর সঙ্গে মিশ্রিত হয়ে গেছে। কিন্তু পরবর্তী পরিযানগুলিতে পৃথিবীর অন্য অঞ্চল থেকে যে জনগোষ্ঠীগুলি ভারতবর্ষে এসেছে তাদের মধ্যে পুরুষের সংখ্যা ছিল নারীদের তুলনায় অনেক বেশি। ফলে তাদের জিনগত ছাপ ভারতীয় পুরুষদের মধ্যে অধিক মাত্রায় রয়ে গেছে।

সাম্প্রতিককালে ভারতবর্ষে হরিয়ানার রাখিগড়িতে হরপ্পীয় মানুষের দেহাবশেষ পাওয়া গেছে। এছাড়াও ওই সময়কালের আরও কিছু দেহাবশেষ পাওয়া গেছে পার্শ্ববর্তী অঞ্চলে। এই দেহাবশেষগুলির ডিএনএ বিশ্লেষণ করে বোঝা যায় যে, আফ্রিকা থেকে প্রথম পরিযানের অনেক পরে, মাত্র ১২ হাজার বছর আগে, পূর্ব-ইরানের দিক থেকে ভারত অভিমুখে এক জনগোষ্ঠীর পরিযান শুরু হয়। এদের সঙ্গে আদি আফ্রিকা-আগত শিকারি-সংগ্রাহকদের মিশ্রণের ফলে এক জনগোষ্ঠী তৈরি হয়েছিল। আজ থেকে প্রায় ৪.৫ হাজার বছর আগে এদেশের উত্তর-পশ্চিম ও পশ্চিম দিকে তারাই হরপ্পীয় সভ্যতা গড়ে তোলে।

আবহাওয়ার পরিবর্তন ও তজ্জনিত অর্থনৈতিক বিপর্যয়ে আজ থেকে ৩.৯ হাজার বছর আগে হরপ্পীয় সভ্যতা ভেঙে পড়ে। তখন সিন্ধুনদের তীরের সেই মিশ্র জনগোষ্ঠী খাদ্যের আশায় সারা ভারতে ছড়িয়ে যায়। সম্ভবত তারা কথা বলত কোনও প্রোটো-দ্রাবিড় ভাষায়। এরা দক্ষিণ ও পূর্বভারতে এসে আবার সেখানকার প্রাচীন আফ্রিকা-আগত শিকারি-সংগ্রাহকদের সঙ্গে আরও একবার মিশ্রিত হয়। আর সেই মিশ্র মানুষ সমগ্র ভারতে জাতিগোষ্ঠী গঠনে পরবর্তীকালে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নেয়।

আজও ভারতবর্ষে দ্বিতীয় বৃহৎ ভাষাপরিবার হল দ্রাবিড় ভাষাপরিবার, এতে প্রায় ১৯.৬৪ শতাংশ ভারতীয় কথা বলে। আজ থেকে ৪ হাজার বছর আগেও ভারতবর্ষে সংস্কৃত ভাষা ছিল না, সেই সময়ের মানুষের ডিএনএ বিশ্লেষণ করে ইন্দো-ইউরোপীয় জিনও পাওয়া যায়নি। এই নেতি নেতি তথ্য একমাত্র প্রমাণ করে তখনও ইন্দো-ইউরোপীয়রা ভারতে আসেনি। কারণ আজকে বিশেষ করে উত্তর-পশ্চিম ও পূর্বভারতের জাতিগোষ্ঠীর মধ্যে ইন্দো-ইউরোপীয় জিন পাওয়া যায়।

ভারতে দ্রাবিড়ীয় ভাষাপরিবার

ইন্দো-ইউরোপীয় জিন কাকে বলে? কবে এই জনগোষ্ঠী ভারতবর্ষে এল? এবার সেই বিষয়ে কিছু আলোচনা করা যাক।

বেদ-রচয়িতা বৈদিক-সংস্কৃতভাষীদের উৎপত্তি ও তাদের সময়কাল জানতে একত্রিতভাবে প্রত্নতাত্ত্বিক, ভাষাতত্ত্ববিদ, শব্দতাত্ত্বিক ও জিনবিদদের চর্চার প্রয়োজন। কারণ উত্তরভারত, ইরান ও ইউরোপের বিভিন্ন ভাষার মধ্যে এক অভিন্নতা অনেকদিন ধরেই ভাষাতত্ত্ববিদরা লক্ষ্য করেছেন। দক্ষিণভারতীয় ভাষাগুলির তুলনায় সংস্কৃত ভাষা ইউরোপীয় বিভিন্ন ভাষা, যেমন গ্রিকের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে সম্পর্কিত। অথচ তুলনামূলকভাবে উত্তরপ্রদেশের অনেক কাছে তামিলনাড়ু অবস্থিত।

এই পর্যবেক্ষণ প্রমাণ করে অতীতে এদের মধ্যে এক সংযোগ ছিল। সমগ্র ইউরোপীয় ও প্রাচ্যের কিছু ভাষার উৎসের সন্ধানে দীর্ঘদিন ধরে এক আদি ভাষার খোঁজ চলে। শেষ পর্যন্ত ভাষাবিজ্ঞানের সাহায্যে এই ভাষাগুলিকে নিয়ে এক ভাষাবৃক্ষ তৈরি করা হয়। তার চূড়ায় যে আদি ভাষা আছে তার নাম দেওয়া হয় ‘প্রোটো-ইন্দো ইউরোপীয়’। সেই আদি ভাষা থেকে উদ্ভূত বিভিন্ন শাখাপ্রশাখাগুলিকে প্রাচীন ও আধুনিক ইউরোপীয় এবং পশ্চিম ও দক্ষিণ এশিয়ার বিভিন্ন ভাষা হিসেবে শনাক্ত করা যায়। আজকে অধিকাংশ ভাষাতত্ত্ববিদ মনে করেন প্রায় ৬.৫ হাজার বছর আগে পন্টিক-স্তেপ অর্থাৎ কৃষ্ণসাগর ও কাস্পিয়ান সাগরের মধ্যবর্তী অঞ্চলে একদল পশুপালক ওই ‘প্রোটো-ইন্দো ইউরোপীয়’ ভাষায় কথা বলত। এদের সঙ্গেই ওই ভাষা ও তার থেকে উদ্ভূত বিভিন্ন উপভাষা কাস্পিয়ান সাগরের পশ্চিমদিকে ও পরবর্তীকালে দক্ষিণদিকে বিস্তার লাভ করে। আজকে ভারতবর্ষে প্রায় ৭৮.০৫ শতাংশ ভারতীয় ইন্দো-ইউরোপীয় ভাষাপরিবারের অন্তর্গত বৈদিক সংস্কৃত থেকে উৎপন্ন ভাষাগুলিতে কথা বলে।

প্রোটো ইন্দো-ইউরোপীয় ভাষার উৎস এবং গতিপথ

বৈদিক সংস্কৃত থেকে উৎপন্ন ভাষাগুলিতে যারা কথা বলে তাদের মধ্যে এক বিরাট অংশের পুরুষদের ক্ষেত্রে ‘ওয়াই-ক্রোমোজোম ডিএনএ’ (যা পুরুষরা পিতার কাছ থেকে বংশপরম্পরায় পায়) রাশিয়া ও পূর্ব-ইউরোপীয় পুরুষের ওই ডিএনএ-র এক বিশেষ উপশাখার অনুরূপ। প্রায় ৪.৭ হাজার বছর আগের মধ্য-এশিয়াতে সেই বিশেষ উপশাখার প্রাচীনতম রূপটি এক প্রাচীন মানুষের দেহাবশেষে পাওয়া গেছে। অর্থাৎ আমাদের উত্তরভারতের কিছু মানুষের মধ্যে যে ডিএনএ-উপশাখা আছে তার সবচাইতে প্রাচীন রূপটি পাওয়া যায় মধ্য-এশিয়াতে। ভারতবর্ষে নয়।

৪ হাজার বছর আগে ইন্দো-ইউরোপীয় বৈদিক সংস্কৃতভাষী স্তেপ পশুপালকরা সিন্ধু উপত্যকায় প্রবেশ করে। হরপ্পীয় সভ্যতার মানুষ তখন দেশের দক্ষিণদিকে চলেছে। ইতিমধ্যে, যে হরপ্পীয় মানুষ উত্তরভারতে থেকে গেছে স্তেপের পশুপালকদের সঙ্গে তারা মিশে যাচ্ছে। এই মিশ্রণের প্রয়োজন হয়েছিল নারীর জন্য। ইন্দো-ইউরোপীয়দের মধ্যে নারী ছিল কম।

ভুলে গেলে চলবে না যে, যদিও ক্ষীয়মান তবুও এই দেশে তখনও যে সংস্কৃতি ছিল সেটা উপাদানগত বিচারে বৈদিক আর্যদের থেকে ছিল শ্রেষ্ঠতর। গুণগতভাবে এই শ্রেষ্ঠতর সংস্কৃতি পশুপালক বৈদিক আর্যদের উপরে প্রভাব বিস্তার করেছে। তার জন্যই বৈদিক সাহিত্যের শেষের দিকে এক মিশ্র সংস্কৃতির পরিচয় মেলে। আর প্রাচীন বৈদিক আচারের সঙ্গে যুক্ত হয়ে গেছে দেশজ প্রাগার্য ধর্মীয় চিন্তা। তবে এই মিশ্রণ সম্পূর্ণ সমসত্ত্ব ছিল না। দেশের অঞ্চল, ভাষা ও বর্ণভেদে মানুষের মধ্যে মিশ্রণের আনুপাতিক পরিমাণ ছিল ভিন্ন।

 

শেষের কথা

পৃথিবীর বিভিন্ন অঞ্চল থেকে ভারতবর্ষে বহু পরিযান হয়েছে। তাই প্রাগিতিহাস বা ইতিহাসের দীর্ঘ সময়কাল ধরে ভারতবর্ষ বিপুল সংখ্যক মানুষকে ধারণ করেছে। বিভিন্ন জনগোষ্ঠী যখন মিশ্রিত হয়েছে, তখন অন্যের থেকে কিছু শিখেছে, কিছু নিজেরা উদ্ভাবন করেছে। আবার মানুষের আঞ্চলিক মিউটেশন সাহায্য করেছে প্রকৃতির সঙ্গে অভিযোজিত হতে, বেঁচে থাকতে, উন্নততর প্রজন্মের জন্ম দিতে। এই বিভিন্নতা আমাদের সংস্কৃতি। এটাই আমাদের ঐতিহ্য।

উগ্র জাতীয়তাবাদ ও সাম্প্রদায়িক চেতনার পুনরুত্থান প্রবণতা ইতিহাস ও বিজ্ঞানচর্চাকে স্তিমিত করে দিতে পারে। ভ্রান্ত পথে জাতিকে নিয়ে যেতে পারে।

 

প্রধান কয়েকটি তথ্যসূত্র

  1. Golwalkar, M. S. We or Our Nationhood Defined. Nagpur: Bharat Publications. 1939.
  2. Oppenheimer, Stephen. Out-of-Africa, the peopling of continents and islands: tracing uniparental gene trees across the map. PubMed. Mar 19, 2012.
  3. Narasimhan, V. M. et al. The formation of human populations in South and Central Asia. Science. Sep 6, 2019.
  4. Moorjani, Priya et al. Genetic Evidence for Recent Population Mixture in India. PubMed. Sep 5, 2013.
  5. Mathieson, Iain. et al. Genome-wide patterns of selection in 230 ancient Eurasians. Nature. Nov 23, 2015.

 

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 4664 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

Be the first to comment

আপনার মতামত...