১৬ আগস্ট, ১৯৪৬: সত্য, অর্ধসত্য আর অবিশ্বাসের নির্মাণ

সৌমিত্র দস্তিদার

 



প্রাবন্ধিক, গদ্যকার, তথ্যচিত্রনির্মাতা

 

 

 

সেপ্টেম্বর কেন জানি না অনেক দিক দিয়েই বঙ্গজীবনে গুরুত্বপূর্ণ। বঙ্গ রেনেসাঁর দুই প্রভাবশালী ব্যক্তিত্ব, বিদ্যাসাগরের জন্মমাস, এবং রাজা রামমোহন রায়ের মৃত্যুমাসও বটে। কথিত আছে, বছরের এই সময়েই একদা রাজা-মহারাজারা গভীর জঙ্গলে মৃগয়ায় যেতেন। রামচন্দ্রের রাবণবধ— তাও তো এই সময়েই। এমন সব বিপুল কর্মকাণ্ডের মাঝখানে কে আর আলাদা করে মনে রেখেছে যে উপমহাদেশের রাজনীতির অন্যতম এক বর্ণময় চরিত্রের জন্মদিনও ঘটনাচক্রে এই সেপ্টেম্বরেই।

১৮৯২ সালের ৮ সেপ্টেম্বর মেদিনীপুরে জন্মেছিলেন হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দি। পূর্ববঙ্গ, অধুনা বাংলাদেশে তিনি অসাম্প্রদায়িক, গণতন্ত্রের মানসপুত্র। হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙ্গালি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের রাজনৈতিক শিক্ষাগুরু কোনও এক রহস্যময় কারণে এ বঙ্গে স্বাধীনতার এত বছর বাদেও এক আদ্যন্ত খলনায়ক, চূড়ান্ত দাঙ্গাবাজ।

একই লোকের এমন পরস্পরবিরোধী মূল্যায়ন পৃথিবীতে বিরল। এ যেন ঠিক ডঃ জেকিল অ্যান্ড মিঃ হাইডের জীবন্ত সংস্করণ। হিন্দু মধ্যবিত্ত মানসে ১৯৪৬ সালের ১৬ আগস্ট কুখ্যাত কলকাতা দাঙ্গার জন্য, আর এই ঘটনার দায়ী ওই একটিই লোক— হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দি।

১৬ আগস্ট এলেই আজকাল বুকের ভেতর কেমন যেন খচখচ করে ওঠে। এইটে হয়েছিল কয়েকবছর আগে মিজানুর রহমানের লেখা ‘কৃষ্ণ ষোলো’ বইটি পড়ার পর থেকে। তার আগে আমিও মোটামুটি শুনেছি কলকাতায় ভয়াবহ দাঙ্গার টুকরো টুকরো নানা আখ্যান। দেশভাগ নিয়ে একাধিক ডকুমেন্টারি ফিল্ম করার ইচ্ছে আমার বহুদিনের। একটা পর্ব করে উঠতে পেরেছি মাত্র। তবে দলিল দস্তাবেজ বিস্তর ঘাঁটতে গিয়ে মনে হয়েছে যে দেশভাগ নিয়ে যেটুকু যা কাজ হয়েছে তা মোটেও চূড়ান্ত কিছু নয়। সাহিত্য, ইতিহাস এবং সিনেমা সবক্ষেত্রেই বেশিরভাগের দৃষ্টিভঙ্গি মোটের ওপর একপেশে। দু-একজন বাদ দিয়ে পরিকল্পিতভাবেই যেন নির্দিষ্ট একটি সম্প্রদায়ের ওপর দোষ চাপিয়ে উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে বিকৃত ইতিহাস নির্মাণ করা হয়েছে। আমি কলকাতার অলিগলি ঘুরে, প্রচুর পুরোনো দিনের মানুষজনের সঙ্গে কথা বলে ৪৬-এর কালো দিনগুলোকে বুঝতে চেষ্টা করেছি। এটা ঠিক যে এদেশের খণ্ডিত যে স্বাধীনতা আমরা পেয়েছি, তাকে স্বাধীনতা না বলে ক্ষমতা হস্তান্তর বলাই উচিত। সে যাই হোক, তার পিছনে কলকাতা, নোয়াখালি ও বিহারের অত্যন্ত নির্মম, ভ্রাতৃঘাতী লজ্জাজনক দাঙ্গার ভূমিকা বিরাট। কলকাতা আমার নিজের শহর, ফলে কোথায় কোথায় সেদিন দাঙ্গার আঁচে ঝলসে গেছিল, আমি তা ঘটনার বহু বছর পর হেঁটে হেঁটে বোঝার চেষ্টা করেছি। নোয়াখালি গেছি। সেখানেও অজস্র মানুষের সঙ্গে কথা বলেছি। এরপর যাব বিহার। যেটুকু যা বুঝেছি তাতে মনে হয়েছে মৃতের সংখ্যা, লুটপাট, সম্পত্তি ধ্বংস ও দীর্ঘ সময় ধরে চলা দাঙ্গার হিসেবনিকেশ করলে ভয়াবহতার দিক দিয়ে নিঃসন্দেহে বিহারের দাঙ্গা সবচেয়ে মারাত্মক। অথচ চর্চা বিহার নিয়েই সবচেয়ে কম। সোহরাওয়ার্দি নিয়ে গালমন্দের শেষ নেই। কিন্তু কোনও অজ্ঞাত কারণে বিহারের তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী শ্রীকৃষ্ণ সিংহকে নিয়ে কোথাও কোনও আলোচনা শুনেছি বলে মনে করতে পারি না। সত্যি কথা বলতে কি, ওই ছেচল্লিশ-সাতচল্লিশে সারা ভারতের বিভিন্ন জায়গায় যে ভয়াবহ আগুন জ্বলে উঠেছিল, সাম্প্রদায়িক হানাহানি, পারস্পরিক বিদ্বেষ, ক্ষমতার লোভ যে কোন জঘন্য পর্যায়ে যেতে পারে, তা নিজের চোখে না দেখলে আমাদের কারও পক্ষেই পুরোপুরি অনুধাবন করা সম্ভব নয়৷ ।

বাংলা ও পাঞ্জাবের কথা সবাই জানেন। কিন্তু ছেচল্লিশ থেকে পঞ্চাশ, এই তিন বছরে রায়ট জোন বলে কুখ্যাতি কুড়িয়েছিল দিল্লি, বোম্বে, উত্তর প্রদেশের বেনারস, শাহজাহানপুর, পিলভিট, মোরাদাবাদ, মিরাট, কানপুর, লখনউ, বেরিলি, গড়মুক্তেশ্বর, এলাহাবাদ, এমনকি উত্তর ভারতের পাহাড়ি এলাকাতেও দাঙ্গা ছড়িয়ে পড়েছিল। সিমলা ও দেরাদুনে পরিস্থিতি ছিল বেশ খারাপ। গুজরাটের আহমেদাবাদ, গোধরা, ভদোধরা, বিহারের ছাপড়া, জামালপুর, জামশেদপুর সর্বত্রই দাঙ্গা ভয়াবহ চেহারা নিয়েছিল। এমনকি আপাতশান্ত দক্ষিণ ভারতের কিছু কিছু এলাকাতেও দাঙ্গা আয়ত্তের বাইরে চলে গেছিল। গুরগাঁওয়ের খুব কাছেই মেওয়াদ। স্বাধীনতা আন্দোলনে ওই গ্রামের অসংখ্য মানুষ শহীদ হয়েছিলেন। গান্ধিজি বলতেন, তোমরা আমাকে স্রেফ দশটা মেওয়াদ দাও। আমি স্বাধীনতা এনে দেব। সেই মেওয়াদের আশপাশের অন্তত আশিটা মুসলিম অধ্যুষিত গ্রামকে মাটির সঙ্গে মিশিয়ে দিয়েছিল উগ্র হিন্দুত্ববাদী বাহিনি।

অথচ শুধুমাত্র কলকাতা দাঙ্গা দ্য স্টেটসম্যান পত্রিকার সৌজন্যে গ্রেট ক্যালকাটা কিলিং হয়ে ইতিহাসের কলঙ্কজনক অধ্যায় হয়ে বছরের পর বছর টিঁকে আছে। আপনি বলতেই পারেন কলকাতা আর অন্য কোনও জায়গা তো এক নয়। তাছাড়া তখন সেখানে মুসলিম লিগের রাজত্ব। তাছাড়াও, স্বাধীনতার শেষ লগ্নে বাংলা ভাগ হলে কলকাতা কোন দিকে যাবে তা নিয়ে উৎকন্ঠা যে হিন্দু মুসলমান দুতরফেই যথেষ্ট ছিল— তা নিয়ে আজ আর কোনও বিতর্ক নেই। শুধু রাজনৈতিক মহল নয়, কলকাতা নিয়ে দড়ি টানাটানিতে বিরাট ভূমিকা ছিল একাধিক শিল্প গোষ্ঠীর। বিড়লা ও অন্যান্য হিন্দু শিল্পপতিদের যেমন ছিল, তেমনি ছিল ইস্পাহানিদের মতো নব্যউত্থিত লিগপন্থী ব্যবসায়ীদেরও। ব্রিটিশ সরকারের কাছেও কলকাতা ছিল নানা কারণে মাথাব্যথার বিষয়। ৪৬ সালে একের পর এক গণবিদ্রোহের ঢেউ ব্রিটিশ সরকারের ঘুম কেড়ে নিয়েছিল। নৌবিদ্রোহ, রশিদ আলি হত্যা, ডাক ও তার ধর্মঘট, সব মিলিয়ে উত্তাল শহর কলকাতাকে হিন্দু মুসলিম সাম্প্রদায়িক বাঁটোয়ারা শাসকদের কাছে ছিল একান্ত প্রয়োজনীয়।

ফলে দাঙ্গা কোনও এক পক্ষের প্ররোচনায় হয়েছে এটা বলা যায় না। এটা ঠিক যে রাজ্যের প্রশাসনিক হেড, প্রধানমন্ত্রী ছিলেন সোহরাওয়ার্দি। তাই অভিযোগের তীর মূলত তাঁর দিকে উঠবে এও অস্বাভাবিক নয়। উনি যে পুরোপুরি ধোয়া তুলসীপাতা নন, তাও সে সময়ের ঘটনাপঞ্জি বিশ্লেষণ করলেই বোঝা যাবে। কিন্তু একতরফা একজনকেই অপরাধী বলে সারাজীবন চিহ্নিত করা— এটা অনেকটাই উগ্র হিন্দুত্ববাদীদের প্রচর। দ্য গ্রেট ক্যালকাটা কিলিং-এও বিপুল ভূমিকা ছিল এই অতিরঞ্জিত প্রোপাগান্ডার।

বিশিষ্ট সাংবাদিক শঙ্কর ঘোষ লিখেছেন, মুসলিম এলাকা রাজাবাজারে ভিক্টোরিয়া মহিলা কলেজ ও হোস্টেল ছিল, যার আবাসিক ছাত্রীদের অধিকাংশ ছিলেন হিন্দু। তখনকার এক দৈনিক খবর করে, হোস্টেল মুসলিম দুষ্কৃতীরা আক্রমণ করে সব আবাসিকদের খুন করেছে। বিখ্যাত ঐতিহাসিক তপন রায়চৌধুরী তখন থাকতেন কলকাতাতেই কোনও এক হোস্টেলে। উনি লিখেছেন যে, বাতাসের গতিতে গুজব রটতে লাগল হাজার হাজার হিন্দু খুন হয়েছেন। নারী নির্যাতনের সীমা-পরিসীমা নেই। এ ধরনের গুজব একধরনের গনহিস্টিরিয়া তৈরি করে পরিস্থিতি আয়ত্তের বাইরে নিয়ে গেল। মিজানুর রহমানের কথা আগে বলেছি, তখন ওঁর বয়েস চোদ্দ কি পনেরো। কিশোর মিজানুর কোনও উদ্দেশ্য বা পক্ষপাত ছাড়াই স্মৃতিকথায় যা লিখে গেছেন তাতে ওই কালো অধ্যায়টি পরিষ্কার বোঝা যায়। মিজানুর স্পষ্ট করে জানিয়েছেন, কীভাবে হিন্দুদের দোকান লুঠ করা হয়েছে। কী নৃশংসভাবে নিরীহ হিন্দুদের মারা হয়েছে। আবার উল্টোদিকে, সাধারণ মুসলমানদের ওপরেও কীভাবে হামলা হয়েছে তাও বিস্তারিতভাবে জানিয়েছেন মিত্র ইনস্টিটিউশনের এই প্রাক্তন ছাত্র।

বলা হয় যে মুসলিম লিগের ‘ডাইরেক্ট অ্যাকশন ডে’ পুরোটাই ছিল আগে থেকে পরিকল্পনা করে হিন্দুদের ওপর হামলা করা। সেই পরিকল্পনার অঙ্গ হিসেবে সেদিন লিগ সরকার হরতাল ঘোষণা করেছিল। এ নিয়ে লিগের মধ্যেই পরস্পরবিরোধী মত ছিল। খাজা নাজিমুদ্দিন খোলাখুলি হিন্দুদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের ডাক দিলেও আবুল হাশেম ও অন্যান্য নেতাদের লক্ষ্য ছিল ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে সংগ্রাম পরিচালনা। লিগ সেদিন ময়দানে জনসভার ডাক দিয়েছিল। সেখানে যাওয়ার পথে অনেক জায়গায় লিগ কর্মী-সমর্থকদের ওপরে আক্রমণ হয়। রাস্তার দুধারের উঁচু বাড়ি থেকে মিছিলের ওপরে গরম জল ও ইট ছোঁড়া হতে থাকে বৃষ্টির মতো। মুসলিম লিগের কর্মী-সমর্থকরা বিনা প্ররোচনায় আক্রান্ত হয়েছিল— একথা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান স্বয়ং তাঁর অসমাপ্ত আত্মজীবনীতে লিখে গেছেন।

হাসপাতাল ও অন্যান্য পুরনো সূত্রে যেটুকু হিসেব পাচ্ছি, তাতে প্রথম দুদিন নিহতদের তালিকায় মুসলমানদের পাল্লা ভারী। প্রথম দিনে মুসলিম-হিন্দু সংখ্যাটা প্রায় সত্তর-তিরিশ। দ্বিতীয় দিনে ষাট-চল্লিশ। তৃতীয় দিনে পঞ্চাশ-পঞ্চাশ। হতেই পারে এ রিপোর্ট আংশিক। তাহলেও একটা জিনিস স্পষ্ট যে দুপক্ষই মরণপণ লড়াইয়ে নেমেছিল অপর পক্ষকে নিকেশ করতে। বল্লভভাই প্যাটেলের বয়ান অনুযায়ী, শেষ বিচারে অবশ্য কলকাতা দাঙ্গায় লাভবান হয়েছিল হিন্দু সম্প্রদায়ই। দুই পক্ষের লক্ষ্য ছিল অপর পক্ষের ধর্মীয় স্থানে হামলা করা। এই দাঙ্গার বেশ কিছু বৈশিষ্ট্য ছিল। হিন্দুরা তৎপর ছিল অপর সম্প্রদায়কে চিরতরে শেষ করে দিতে। অপর পক্ষে মুসলিম গোষ্ঠীর মূল লক্ষ্য ছিল লুঠপাট, সম্পত্তি নষ্টের দিকে।

অদ্ভুতভাবে এই দাঙ্গায় অংশগ্রহণে মুসলিমদের মধ্যে অগ্রণী ছিল গরিব অবাঙালিরা, মূলত কসাই, মেথর, মুচি ইত্যাদি সমাজের পিছিয়ে থাকা অংশ। অন্যদিকে হিন্দুদের মধ্যে মধ্যবিত্তদের এক অংশ এই দাঙ্গায় প্রবলভাবে যোগ দিয়েছিলেন। সরকারের এক পরিসংখ্যানে দেখা যায় যে, দাঙ্গা করার অভিযোগে যাদের ধরা হয়েছিল, তাদের মোট সংখ্যা ছিল ৩,৫৫৩ জন। তাদের মধ্যে হিন্দুদের অনেকেই ছিলেন ইংরেজি শিক্ষিত ‘ভদ্র’ ঘরের ছেলে। মুসলমানদের নিম্নবর্গের যে অংশ হিংস্র পশুদের মতো ‘শত্রু’নিধন করতে সক্রিয় ভূমিকা নিয়ে ছিল তাদের শিক্ষাদীক্ষাহীন লুম্পেন বলা যেতেই পারে, কিন্তু হিন্দু মধ্যবিত্তের এই মুসলিম বিদ্বেষ এত তীব্র কেন তা নিয়ে নতুন করে গবেষণার দরকার আছে।

অর্থাৎ শুধুমাত্র সোহরাওয়ার্দির ওপরে সব দোষ চাপিয়ে এই আপাত সাধারণ অথচ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়কে ইচ্ছাকৃত এড়িয়ে গেলে কখনওই দুটি সম্প্রদায়ের মধ্যে সুসম্পর্ক গড়ে উঠবে না। আজ ফের যে ইসলামফোবিয়া মাথা চাড়া দিচ্ছে তার বীজ কিন্তু বহু পুরনো। জল, হাওয়া, আলো বাতাস পেয়ে সে আবার প্রবলভাবে মাথা তুলে দাঁড়াচ্ছে। এবং আরএসএস সুপরিকল্পিতভাবে এটা করছে। বেশ কয়েক বছর ধরে রীতিমতো গুছিয়েই করছে। এই একতরফা ন্যারেটিভকে যারা চ্যালেঞ্জ জানাতে পারতেন, সেই প্রগতি শিবিরও বিনা প্রশ্নে বিষয়টিকে মেনে নিলেন। অথচ কার্ল মার্ক্স একাধিকবার বলেছেন, সবকিছুকেই প্রথমে সন্দেহ করতে, যাচাই না করে কোনও বয়ানকেই অকপটে মেনে না নিতে।

সোহরাওয়ার্দির বিরুদ্ধে সবচেয়ে বড় অভিযোগ তিনি পুলিশ প্রশাসনকে ইচ্ছেমতো কাজে লাগিয়ে হিন্দু নিধনে মদত দিয়েছেন। তিনি লালবাজার পুলিশ হেডকোয়ার্টারে বসে যাবতীয় সবকিছু কন্ট্রোল করেছেন। কিন্তু সেই সময়ের নথি নথি বলছে যে ওই সময় শহরের সবকটি থানার পুলিশকর্তা ছিলেন হিন্দু। লালবাজার পুলিশ কনট্রোল রুমের প্রধান আধিকারিকও মুসলিম ছিলেন না। কলকাতার জনসংখ্যা ছিল তখন ষাট লাখ। সেখানে পুলিশ ছিল মাত্র ১২০০। সেখানে একজন ডেপুটি কমিশনার ছাড়া ওপরতলায় মুসলিম পুলিশের সংখ্যা ছিল হাতে গোনা। এটাও জানা গেছে যে বারোশো পুলিশের মধ্যে মুসলিম ছিলেন মোটে তেষট্টি জন। তাহলে এইরকম একটা স্পর্শকাতর সময়ে সোহরাওয়ার্দি পুলিশ প্রশাসনের মূলত হিন্দু কর্মচারীদের হিন্দুদের বিরুদ্ধেই চালনা করতে পারলেন, এই তথ্য কতটা বিশ্বাসযোগ্য?

বরং ইতিহাস বলছে, সোহরাওয়ার্দি প্রথমদিনেই পরিস্থিতি করায়ত্ত করতে শহরে মিলিটারি ডাকতে চেয়েছিলেন। গভর্নর ব্যারোজ রাজি হননি। ওই ভয়ঙ্কর দিনগুলোতে যখন পারস্পরিক বিশ্বাস, আস্থা দুই সম্প্রদায়ের মধ্যে তলানিতে এসে ঠেকেছিল, তখনও সোহরাওয়ার্দি, বন্ধুদের হাজার নিষেধ সত্ত্বেও তার দুই বিশ্বস্ত সঙ্গী শিবু ও জগদীশকে এক মুহূর্তের জন্য কাছছাড়া করেননি। পাশাপাশি আর একটা কথাও বলা দরকার যে জাতীয় নেতাদের মধ্যে সর্বপ্রথম কলকাতা দাঙ্গার নিন্দা করেছিলেন মহম্মদ আলি জিন্নাহ। ১৭ আগস্ট সকালে এক বিবৃতিতে জিন্নাহ কলকাতায় অবিলম্বে শান্তি ফেরানোর আবেদন করেন।

১৬ আগস্ট, ১৯৪৬ নিঃসন্দেহে হিন্দু ও মুসলিম দুই সম্প্রদায়ের কাছেই এক অন্ধকারাচ্ছন্ন কলঙ্কময় দিন। এর দুঃসহ স্মৃতি ভুলে যেতে পারলেই আমাদের পক্ষে ভালো হত। কিন্তু এখন আবার ইচ্ছে করে সাম্প্রদায়িক ঘৃণার আবহ জাগিয়ে তোলার স্বার্থে ১৬ আগস্টকে বিকৃত করে সামনে আনা হচ্ছে। সত্যি, মিথ্যে, আধা সত্যি, পুরো মিথ্যে বলে বলে কদর্য বিষ ঢালা হচ্ছে জনমনে। অথচ ইতিহাস জানে সেদিন চরম হানাহানি যেমন সত্যি ছিল, তেমনই নিজের প্রাণ বিপন্ন করে এক সম্প্রদায়ের মানুষ অপর সম্প্রদায়ের মানুষকে বুক দিয়ে আগলেছেন, নিজ সম্প্রদায়ের দাঙ্গাবাজদের সামনে বুক পেতে দাঁড়িয়ে আশ্রিত বন্ধুকে রক্ষা করেছেন। এরকম অজস্র উদাহরণ আছে। ভিক্টোরিয়া কলেজ ও হোস্টেলের হিন্দু মেয়েদের তিন দিন তিন রাত আগলে রেখেছিলেন ট্রাম শ্রমিক নেতা সেলিম ও তার অনুগামীরা। যাঁর উল্লেখ এখানে বেশ কয়েকবার করেছি সেই মিজানুর রহমানের বাড়ি ছিল হিন্দু অধ্যুষিত গড়পাড় রোডে। দাঙ্গার দিনে মা ও পরিবারের অন্যান্য সদস্যদের সঙ্গে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছিল মিজানুর ও ওঁর দাদার। অসুস্থ বাবা ছিলেন মেডিকেল কলেজে। অপারেশন হবার অপেক্ষায়। মা বোনের বাঁচার আশা প্রায় ছেড়ে দিতে বাধ্য হয়েছিলেন মিজানুর ও বাকিরা। পরে অনেক কষ্টে পারিবারিক পুনর্মিলনের সময় জানা যায় অসম সাহসে রহমান পরিবারকে বাঁচিয়ে ছিলেন বিখ্যাত কুস্তিগীর বিষ্ণু ঘোষ। দৈনিক আজাদের সাংবাদিক মোহম্মদ মোদাব্বের নিজের স্মৃতিকথায় লিখেছেন, আঞ্জুমান রোডের এক সামান্য মাংস বিক্রেতা অর্থাৎ কসাই কীভাবে সেদিন নিজের প্রাণের ঝুঁকি নিয়ে এক হিন্দু পরিবারের জীবন বাঁচিয়ে ছিলেন। মুখে বঙ্গবন্ধু বললে কী হবে, কলকাতার বাবু ভদ্দরলোকদের একটা বড় অংশ আড়ালে আবডালে শেখ সাহেবের ক্যালকাটা কিলিং-এর সময়কার ভুমিকা নিয়ে ফিসফাস করেন। শেখ মুজিবুর রহমানের কলেজ জীবনের বন্ধু নীহার চক্রবর্তী। বেঁচে আছেন, এখন তাঁর বয়েস ৯২। বিখ্যাত ‘চতুরঙ্গ’ পত্রিকার মালিক ছিলেন। এক ইন্টারভিউয়ে তিনি সোজাসাপটা জানিয়ে ছিলেন যে কলকাতার সেই অভিশপ্ত দিনে তরুণ ছাত্রনেতা মুজিব বিপদ মাথায় নিয়ে রাস্তায় নেমে প্রচুর হিন্দুর প্রান বাঁচিয়েছিলেন। সেই ঘটনাগুলোর কথা ইচ্ছে করে বলা হয় না। সুতরাং ১৬ আগস্ট নিছক অন্ধকারের কথা বলে না। আলোর গল্পও বলে।

তথ্যসূত্র:

১। ভারতীয় উপমহাদেশের রাজনীতি, দ্বিজাতিতত্ত্ব ও দেশভাগ– আমিনুল ইসলাম।

২। বাঙ্গালনামা-তপন রায়চৌধুরী।

৩। হস্তান্তর–শঙ্কর ঘোষ।

৪। কৃষ্ণ ষোলোই- মিজানুর রহমান

৫। সোহরাওয়ার্দী পরিবার ঐতিহ্য ও উত্তরধিকার– আলিমুজ্জামান।

৬। Bengal Divided- Joya Chatterjee.

৭। The Great Partition- Yesmin Khan.

৮। Communal Riots in Bengal – Suranjan Das.

 

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 4659 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

Be the first to comment

আপনার মতামত...