দেবকুমার সোম
কথাসাহিত্যিক, প্রাবন্ধিক
প্রিয় পাঠক। আজ থেকে ঠিক পঞ্চাশ বছর আগে কলকাতার উত্তরপ্রান্তে টানা দু দিন ধরে যে গণহত্যা সংঘটিত হয়, এই লেখা মূলত তারই ফিরে দেখা। তথ্যকে অবিকৃত রেখে ঘটনার পুনর্নির্মাণ এই নিবন্ধ রচনার মূল উদ্দেশ্য। তার সঙ্গে নামে বহুদলীয় সংসদীয় গণতন্ত্র হলেও আমাদের সমগ্র রাষ্ট্রব্যবস্থাটি যে মূলত স্বৈরতান্ত্রিক, সেই পরম্পরাকে বুঝে নেওয়ার দায়ও থেকে যাচ্ছে সেদিনের গণহত্যার পুনরাবলোকনে।
আলোচনার সুবিধার জন্য এই নিবন্ধকে চারটে ভাগে ভাগ করে নেওয়া হয়েছে। সেই ভাগগুলি হল:
ক) গণহত্যা সম্পর্কে সংশ্লিষ্ট রচনাকারের ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা।
খ) অর্ধশতক বছর আগের কাশীপুর-বরানগর অঞ্চলের ভৌগোলিক রেখাচিত্র।
গ) গণহত্যার বিবরণ।
ঘ) গণহত্যার পরবর্তী সময়ের বিবিধ রাজনৈতিক সমীকরণ।
গণহত্যা সম্পর্কে সংশ্লিষ্ট রচনাকারের ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা
১৯৭১ সালের ১২ ও ১৩ অগস্ট কাশীপুর-বরানগর (কিংবা বরানগর-কাশীপুর) গণহত্যা যখন সংঘটিত হয়, তখন আমার বয়স পাঁচ বছর পাঁচ মাসের কাছাকাছি। ফলে শৈশবস্মৃতিতে তুখোড়ভাবে থেকে যাওয়া কিছু ঘটনা যা আমার ভাবনাকে এখন এই প্রৌঢ়ত্বেও এলোমেলো করে দেয়, তার ওপর নির্ভর করে আমি সেই সময়কার সার্বিক অবস্থাকে একবার স্মরণ করতে চাই। এই প্রসঙ্গে জানাই, আমার জন্ম এবং বেড়ে ওঠা সবটাই বরানগরের সেই অঞ্চলে, যেখানে গণহত্যার ঘাতকবাহিনি ছিল সবচেয়ে শক্তিশালী। মূলত এক বাক্যে বলতে গেলে আমাকে বলতে হবে আমার জন্ম এবং বেড়ে ওঠা কাশীপুর-বরানগর গণহত্যার খোদ ঘাতকদের ডেরার মধ্যেই।
আমি জ্ঞান হওয়ার সময় থেকেই বোমাবাজি আর খুনখারাপি জীবনের স্বাভাবিক ছন্দ হিসাবে জেনেছি। সে-সব কিছু এখনও আমার সেরিব্রাল কর্টেক্সের মধ্যে বহমান। সেই স্মৃতি আপনাদের সঙ্গে ভাগ করে নেওয়া কর্তব্য মনে করেই এই অংশ রচিত।
চার বছর বয়সে পুলিশি রাইফেল হাতে নেওয়ার স্পর্ধা দেখাতে পেরেছিলাম আমি। এখনও মনে আছে জিনিসটার ওপর আমার ভয়মিশ্রিত ষোলোআনা লোভ ছিল। কিন্তু হাতে তুলে নেওয়ার তাকত তখন ছিল না। আমাদের পাঁচ ভাড়াটে বাড়ির বাইরের রকে ওই রাইফেল নিয়ে বসে থাকতেন বাচ্চু আর ছোট্টু দুইভাই (তাঁদের প্রকৃত নাম আমার জানা নেই)। পরবর্তীকালে জেনেছি তাঁরা ছিলেন গৌরীবাড়ির হেমেন মণ্ডলের ডানহাত। শত ঘোষ অর্থাৎ প্রফুল্লকান্তি ঘোষের ঠ্যাঙাড়ে বাহিনির অন্যতম সেরা রত্ন। তাঁরা দুজনেই ছিলেন নামী শুটার। বলা বাহুল্য যে রাইফেলে আমার হাতেখড়ি হয় সেটা পুলিশের কাছ থেকে তাঁদের পাওয়া। এর আগেই পাইপগান কীভাবে চালাতে হয় তা আমাকে কোলে বসিয়ে শিখিয়েছিলেন পাড়ার দাদারা।
আমরা আমাদের ছেলেবেলায় (ওই চার–পাঁচ বছর বয়সে) দিনেরবেলায় চুন–সুরকি জলে ভিজিয়ে পেটো বানাতাম। ভেতরে গুঁজে দিতাম স্টোনচিপস্ (অর্থাৎ স্প্লিন্টার)। সেগুলো রোদে শুকিয়ে বিকেলে পাশের পাড়ার সমবয়সীদের সঙ্গে চলত আমাদের ছোটদের পেটোবাজি। এই খেলা আমরা বিকেল পাঁচটার মধ্যে শেষ করতাম। কারণ তারপর অন্ধকার নামলে পাড়া ব্ল্যাকআউট হয়ে যেত আর আমাদের পাড়ার বড়রা, যাঁরা দিনেরবেলায় জোড়া–বলদের ছবি আঁকতেন, তাঁরাই রাতে রাস্তার হাই–টেনশন তামার তার কাটতেন বিক্রি করে নেশা করার জন্য। তখন তাঁদের নিজেদের মধ্যেই শুরু হত বোমাবাজি। আর এভাবে কেলোদার (ভালোনাম আজ আর মনে নেই। বামফ্রন্ট আমলে সরকারি বাসের কন্ডাকটর হন। ১৯৭৮–৭৯ সাল নাগাদ পাড়ার কংগ্রেসিরা কেলোদার বাড়ির দেওয়ালে আলকাতরায় লিখে দিয়েছিলেন ‘এই কেলো সিপিএম’) বাঁ হাত কনুই থেকে উড়ে গিয়েছিল। রঞ্জিতদার (পরে ‘নিউ তরুণ’ সিনেমার লাইটম্যান হয়েছিলেন) ডানহাতের কবজি উড়ে যায়। বাকি জীবন তাঁরা বিশিষ্ট স্বাধীনতা সংগ্রামীর মতো তাঁদের বীরগাথা আমাদের সঙ্গে ভাগ করে নিতেন। বলছি বটে দাদা। আসলে এঁরা প্রত্যেকেই বয়সে আমার বাবার বয়সী। কিন্তু পুরনো পাড়ায় সে–সময় ‘দাদা’ বলাই ছিল দস্তুর।
সেই শৈশবেই আওয়াজ শুনলে বুঝতে পারতাম কোনটা বোম আর কোনটা শেল। বোম ফাটার আওয়াজ অনেক জোরে হত, কিন্তু তার স্থায়িত্ব তেমন থাকত না। শেলের আবার গমগমে ব্যাপারটা বেশি ছিল। শেল দেখতে ছিল শক্তিগড়ের ল্যাংচার মতো। রং আর আকৃতি এক। সাইজ বেশ বড়। বোম বানানো হত সুতলি দড়ি দিয়ে, যাকে বলা হত পেটো। আমি সাত বছর বয়সে পেটো বাঁধতে শিখি। তখন পাড়ায় বাইরের লোক ছিলেন প্রচুর। এরা মূলত এসেছিলেন পাড়া রক্ষা করার জন্য। নেশাভাং আর নারী শরীরের প্রতি দুর্বলতা ছিল তাঁদের জীবনের স্বাভাবিক চলন। তখন বোধহয় ‘ধর্ষণ’, ‘শ্লীলতাহানি’ এসব ভদ্রলোকজনচিত শব্দের আমদানি হয়নি। ফলে তখন রাস্তায় যেমন তরুণের লাশ পড়ে থাকত, তেমন ডাস্টবিন থেকে ভেসে আসত সদ্যোজাতর কান্না। পাড়ায় অন্য পুজোর সঙ্গে কার্তিকপুজোরও বেশ চল ছিল।
ছোটবেলায় একবার আমার জ্বরের সময় সোনাদা জয়ন্তর তাড়া খেয়ে আমাদের ঘরে ঢুকে পড়েন। আর বিছানায় ঠিক আমার মাথার পাশে তার পাইপগান আর একখানা পেটো রেখে চৌকির নীচে লুকিয়ে পড়েন। জয়ন্ত (তাঁর সম্পর্কে বিশদ কোনও বিবরণ আমার জানা নেই) ছিলেন ডাকসাইটে নকশাল। তাঁর পাড়ায় প্রবেশ ছিল অনেকটা গব্বর সিংয়ের মতো। হাতে পিস্তল ঘোরাতে ঘোরাতে পাড়ায় ঢুকে তিনি স্থানীয় কংগ্রেসিদের খুঁজতেন। যাঁরা তখন আমাদের মতো বাড়িগুলোতে হয় গা ঢাকা দিয়েছেন, কিংবা কোনও বাড়ির ছাদের পাঁচিলের পেছন থেকে উঁকি মারছেন। এক রোবাবার সকালে বাবার সঙ্গে আমি বাড়ির বাইরে যেতে আমরা জয়ন্তর মুখোমুখি হয়ে যাই। বাবাকে সামনে পেয়ে জয়ন্ত কিছু প্রশ্ন করেছিলেন। তাঁর হাতের পিস্তলটা দেখে আমাদের বাপ–ব্যাটা দুজনেরই অবস্থা বেশ সঙ্গীন হয়ে গিয়েছিল সেটা মনে আছে।
তখন আমাদের পাড়া একরকম ফাঁকাই ছিল বলা চলে। আমাদের বাড়ির লাগোয়া ছিল পরিত্যক্ত একটি স্কুলবাড়ি। মেয়েদের জন্য তৈরি হওয়া সেই স্কুল খানিকটা হয়ে অর্থাভাবে বন্ধ হয়ে যায়। ফলে সেই স্কুলবাড়িটা ছিল কাঁটাঝোপের জঙ্গল। আর সেখানেই পাড়ার দাদারা রাখতেন পেটো, সোর্ড, পাইপগান এইসব। এছাড়া ছিল ভাঙাচোরা একটা জমিদারবাড়ি। যাকে আমরা সকলে ‘গোলকধাম’ বলতাম। সেই গোলকধামের পেছন দিকে ছিল গরুহীন গোয়ালঘর। দুটো শুকনো কুয়ো। একটা কাঁচামিঠে আমগাছ। সেখানেও থাকত পাইপগান আর পেটোর ভাণ্ডার। ওয়ান-শটার পিস্তল বড়দের পকেটেই ঘুরত। কেউ আবার এমনি ক্যাপ ফাটানোর মজা নিয়ে দু-চারটে পেটো মেরে স্কুলের দেওয়ালে টার্গেট প্র্যাকটিস করতেন।
তখন পাড়াগুলো ছিল ক্লাবকেন্দ্রিক। ক্লাবঘরে লোহার ডাম্বেল আর ওয়েট লিফটিং নিয়ে শরীরের কসরত হতো। ব্যান্ডপার্টি ছিল। ছিল ব্যাগপাইপার। ক্রেটল। বছরে একটা সামাজিক নাটক পাড়ার ক্লাবে মঞ্চস্থ হত। নায়িকা আসতেন প্রফেশনাল থিয়েটার থেকে। বাকি সময় বোমাবাজি। দু–চারটে লাশ ফেলা। জুয়াখেলা। বিভিন্ন ধরনের মাদকের নেশা করা। আর কালীপুজোর পরদিন বালকভোজন।
আমার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা বর্ণনায় এবার বিরতি টানব একটি খুনের ঘটনা দিয়ে। এই খুন গণহত্যার আগের ঘটনা। এবং আমার জীবনে দেখা প্রথম খুন। তখন আমার বয়স চার বছর সদ্য পেরিয়েছে।
আমাদের পাড়ার উঠতি যুবনেতা ছিলেন অশ্বিনী ভৌমিক। আমরা ডাকতাম ‘অশ্বিনীকাকু’ বলে। তখন তাঁর কত বয়স— মধ্য কুড়ি? বিয়ে করেছিলেন। বউটি ছিলেন গ্রাম্য চেহারার। সাদাসিধে। একটা মেয়েও ছিল। অশ্বিনীকাকু আমাদের বাড়ির রকে বসে আড্ডা মারতেন। তখনকার হিন্দি সিনেমার নায়কদের মতো বড় কলারওলা শার্ট আর চোস্ত ট্রাউজ়ার পরতেন। চোখে গগল্স থাকত। হিপ পকেট থেকে উঁকি মারত পাইপগান কিংবা ওয়ানশটারের বাঁট। আমাদের পাড়ার লাগোয়া ছিল কাশীপুর অঞ্চল। সেখানে জেলেপাড়ার লাল রকওলা বাড়িটা ছিল অষ্টদের। অষ্ট আর ভন ছিলেন ওই অঞ্চলের টেরর। তাঁরা কস্মিনকালেও স্কুলের মুখ দেখেননি (তখন আমাদের অঞ্চলে পাড়াশুনার চল বিশেষ ছিল না)। তাঁরা ছিলেন চারুবাবুর ভাষ্যে ‘লুম্পেন প্রলেতেরিয়ত’। রেডবুক না পড়েও তা থেকে দু–চারটে স্লোগান ঝাড়তে পারতেন। অষ্টের এক বোনের সঙ্গে প্রেম করতেন অশ্বিনী ভৌমিক (বলিহারি সাহস)। তখন অষ্ট আর ভন তাঁদের পাড়াকে প্রায় ‘মুক্তাঞ্চল’ করে নিয়েছিলেন। তাঁদের পাড়ার দেওয়ালে কালো আলকাতরায় লেখা হত ‘চিনের চেয়ারম্যান আমাদের চেয়ারম্যান’, কিংবা ‘বন্দুকের নল ক্ষমতার উৎস’ এইসব। অশ্বিনী ভৌমিকের এই খুল্লামখুল্লা প্রেম নিয়ে দু পক্ষের একটা সংঘর্ষ অবধারিত ছিল। সেই সুযোগ এল ‘ত্রয়ী’ ক্লাব আর ‘সমীর সংঘ’-এর মধ্যে ফুটবল খেলাকে কেন্দ্র করে। পাঠক এই ঘটনা থেকে আপনি বুঝতে পারবেন তখনকার (১৯৭০-৭১ সালে) ব্যক্তিহত্যার সঙ্গে শ্রেণিশত্রু খতমের নূন্যতম কোনও যোগাযোগ উভয় পক্ষের ছিল না। একে কেউ যদি রাজনৈতিক মতবাদ দিয়ে নিপাতনে সিদ্ধ করতে চান, তবে বলতেই হবে তাঁর উদ্দেশ্য মহৎ নয়।
ফুটবল খেলাটা হয়েছিল রামেশ্বর স্কুলের মাঠে। রেফারির একটা ভুল সিদ্ধান্ত নিয়ে খেলা ভণ্ডুল হয়ে যায়। আর দু পক্ষই তৎক্ষণাৎ বের করে ফেলে তাদের মজুদ অস্ত্রভাণ্ডার। একপশলা বোমাবাজি হয়। সে–যাত্রায় খুনোখুনি হয়নি। তারপর কিছুদিন দু পক্ষই টেনশনে কাটান। এদিকে রাত জেগে পাহারা দিচ্ছেন ‘এশিয়ার মুক্তিসূর্য’-এর দামাল ছেলেরা। অন্য পাড়ায় রাত জেগে অস্ত্রে শান দিচ্ছেন ‘চিনের চেয়ারম্যান’-এর লোকেরা।
এর পরবর্তী ঘটনা মহাকাব্যের মতো। সম্পূর্ণ নারীকেন্দ্রিক। অষ্টের বোন অশ্বিনী ভৌমিককে খবর পাঠান সন্ধেবেলায় বড়ালপাড়ার মুখে এসে দাঁড়াতে। জায়গাটা খুব নির্জন। পাশেই গোলকধামের পোড়ো বাড়ি। সম্ভবত ওখানেই তাঁরা প্রেম করতেন (পড়ুন শারীরিক প্রেম)। প্রেমিকার ডাকে সাড়া দিয়ে অশ্বিনী সেদিন বড়ালপাড়ার নির্দিষ্ট মোড়ে গিয়েছিলেন। তাঁর সঙ্গী ছিলেন পাড়ারই এক সদ্য তরুণ (বাকি ঘটনাটা আমার তাঁর মুখ থেকেই শোনা। তিনি এখনও জীবিত, তাই তাঁর নাম উহ্য রাখতে হল।)। দুজনে বড়ালপাড়ার মুখটায় গেলে দেখতে পান অষ্ট আর ভন তাঁদের জন্য প্রতীক্ষায় রয়েছেন। তাঁরা মুখোমুখি হলে সৌজন্যবশত কিংবা কনফিডেন্স বাড়ানোর জন্য অষ্ট সিগারেট বের করে দেশলাই চান। অশ্বিনীর কাছে দেশলাই না থাকায় সঙ্গী তরুণকে দেশলাই কিনতে পাঠান পাশের বিহারির দোকান থেকে। যাকে এলাকার লোক বাঙালির দোকান বলতেন। অশ্বিনীর সঙ্গী দেশলাই কিনে ফিরতে মিনিট তিনেক সময় নিয়েছিলেন। তার মধ্যে অষ্ট আর ভন অশ্বিনীর গলার টুটি ভোজালি দিয়ে কেটে ফেলেছেন (তখনকার দিনে খুন করার এটা ছিল খুব চালু রুট। বুলেট খরচ হত না। লোকে জানতেও পারত না। ভোজালি কিংবা ক্ষুর অথবা ব্লেড খুব দ্রুত চালিয়ে অনেক লাশ নামিয়ে দিতেন তাঁরা)। তারপর লাথি মেরে রাস্তায় ফেলে দেওয়া হয় অশ্বিনীকে। ততক্ষণে অশ্বিনীর সঙ্গী অকুলস্থলে পৌঁছে গেছেন। কিন্তু তাঁরই সামনে (যেমনটা তিনি পরে বিভিন্ন সময় আমাকে বর্ণনা করেছেন) অশ্বিনীর বুক লক্ষ্য করে অষ্ট আর ভন পাইপগান চালান। আর ওখানেই অশ্বিনী ভৌমিক খতম হন। প্রত্যক্ষদর্শী দৌড়ে পাড়ায় ফিরে খরব দিলে তারপর যথারীতি নিয়ম মেনে খানিক বোমাবাজি হয়।
অর্ধশতক বছর আগের কাশীপুর-বরানগর অঞ্চলের ভৌগোলিক রেখাচিত্র
কাশীপুর কলকাতা করপোরেশনের এক নম্বর ওয়ার্ড। অর্থাৎ কলকাতা করপোরেশনের উত্তরভাগ সূচিত হয় কাশীপুর থেকে। সঠিকভাবে বললে আজকের সিঁথির মোড় হল কলকাতা করপোরেশনের প্রধান ফটক। এরই লাগোয়া বরানগর পৌরসভা। দক্ষিণদিকের ফুটপাত যদি কলকাতা হয়, তবে উত্তরদিকের ফুটপাতের ঠিকানা বরানগর পৌরসভার। বহুভুজ এই অঞ্চলের একটা মোটাদাগের পথনির্দেশ পাঠকদের সামনে আমি রাখতে চাইছি। কারণ গণহত্যার কার্যপ্রণালী অনুধাবন করতে গেলে এই ভূগোল পাঠকের চোখের সামনে ভেসে না উঠলে এই লেখা ব্যর্থ হিসাবেই বিবেচিত হবে।
কাশীপুর-বরানগরের পশ্চিমপ্রান্ত দিয়ে বয়ে চলেছে গঙ্গা বা হুগলি নদী। এর পূর্বপ্রান্ত তখনকার দিনে বি টি রোডে সীমায়িত ছিল এমনটা বলা যায়। কেবল টবিন রোড ধরে অক্ষয় কুমার মুখার্জি রোড, যা আজকের নোয়াপাড়া মেট্রো স্টেশন, সেদিকে খানিক বসতি ছিল। আর সিঁথির মোড় টপকে কালীচরণ ঘোষ রোড ধরে আটাপাড়া, পূর্বসিঁথি হয়ে দমদমের দিকে কয়েক অঞ্চলে জনবসতি ছিল বেশ ঘন। ছিল নেতাজি কলোনিও। দক্ষিণ দিকে গান অ্যান্ড শেল ফ্যাক্টরি, সর্বমঙ্গলা ঘাট অবধি ছিল কাশীপুর অঞ্চল। তারপর চিৎপুর। উত্তর দিকে ডানলপ ছাড়িয়ে অশোকগড় আর এল-নাইন বাসস্ট্যান্ডের আগে পর্যন্ত বরানগর পৌর অঞ্চল। এই যমজ অঞ্চলের বৈশিষ্ট্য হল সব প্রধান রাস্তা পশ্চিমে গঙ্গামুখো। আর এটাই গণহত্যার নীলনকশা যাঁরা সেদিন বুনেছিলেন, তাঁদের ক্ষেত্রে কাজের হয়ে ওঠে।
তখনকার মূল বরানগর অঞ্চলটা ছিল প্রায় গঙ্গার কোল ঘেঁষে। কারণ আমরা বরানগর নামের প্রাচীন যে জনপদের মানচিত্র পাচ্ছি, যে অঞ্চলে প্রায় সওয়া পাঁচশো বছর আগে শ্রীচৈতন্য এসেছিলেন, সেই অঞ্চল, কিংবা রামকৃষ্ণ, স্বামী বিবেকানন্দ যে-সব স্থানে দিনযাপন করেছেন, সে-সবই গঙ্গার ধারের অঞ্চল। এই অঞ্চল চিরকালই ঘন জনবসতিপূর্ণ। বরানগরের আদি পোস্টাপিস যেখানে ছিল, সেখান থেকে একটা রাস্তা (কুঠিঘাট রোড) সোজা গঙ্গায় গিয়ে পড়েছে। ওখানেই ছিল বরানগরের সাবেক থানা, যা পরবর্তীকালে জনপদের চেহারা ফুলে-ফেঁপে উঠতে পোস্টাপিসের মতোই স্থানচ্যূত হয়ে এখন বি টি রোডে নেতাজি কলোনির মুখে অবস্থান করছে। পোস্টাপিসের সামনে ডানহাত ধরে যে রাস্তাটা এঁকেবেঁকে চলে গেছে, সেই রাস্তাটা ঝুলনতলা, কাচের মন্দির (অর্থাৎ মণিমন্দির), পাঠবাড়ি, হয়ে আলমবাজারের রাস্তা ধরেছে।
বি টি রোডের সমান্তরাল একটা রাস্তা (গোপাল লাল ঠাকুর রোড) বরানগরের ভেতর দিয়ে ডানলপ থেকে কাশীপুর অঞ্চলকে জুড়েছে। এই রাস্তার ওপর সে-সময়কার খুব গুরুত্বপূর্ণ রাস্তা ছিল জমিদার রতন রায়ের নামে; রতনবাবু রোড। এই রাস্তাটার শুরু কাশীপুর রোডের (গোপাল লাল ঠাকুর রোড বরানগর বাজারের পরে কলকাতা করপোরেশনে ঢুকে নাম নিয়েছে কাশীপুর রোড) ওপর নর্থ সুবারবন হসপিটালের সামনে আর পশ্চিমে গিয়ে শেষ হয়েছে রামকৃষ্ণ মহাশ্মশানে। এই রাস্তার ওপর মুখোমুখি জমিদার রতন রায়ের বাড়ি আর বিশ্বাসবাড়ি। রতন রায়ের বংশধরের মধ্যে অন্যতম কবি তুষার রায় এবং কবি ফাল্গুনী রায়। আজ থেকে পঞ্চাশ বছর আগে তখনকার জমিদারবাড়ি প্রায় মুখ থুবড়ে পড়েছিল। অন্যদিকে ব্যবসায় ফুলেফেঁপে উঠেছিল বিশ্বাসবাড়ি।
গণহত্যার বিবরণ
১৯৯৬ সালে কাশীপুর–বরানগর গণহত্যার পঁচিশ বছর পূর্ণ হলে ‘সরোজ দত্ত স্মৃতিরক্ষা কমিটি’র তরফে একটি ক্ষেত্রসমীক্ষা করা হয়। যেখানে মূলত আমার সক্রিয় অংশগ্রহণে গণহত্যা সংক্রান্ত অতীততথ্য সংগ্রহ করা হয়েছিল। ১৯৯৭ সালের ২৮ ও ২৯ জানুয়ারি দু দিন The Asian Age খবরের কাগজে গণহত্যা সংক্রান্ত দীর্ঘ প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। খবরের কাগজে আমার নামসহ উক্তির যথাযথ উল্লেখ ছিল। তবে উল্লেখ থাক ‘সরোজ দত্ত স্মৃতিরক্ষা কমিটি’ আমার দেওয়া তথ্যের ওপর বহুলাংশে নির্ভর করে এই বিষয় পুস্তিকা প্রকাশ করলেও, কোথাও আমার ঋণ তাঁরা স্বীকার করেননি।
আগেই বলেছি তখন এলাকায় ক্লাব সংস্কৃতির রমরমা ছিল। কলোনি কিংবা বস্তি অঞ্চলের ক্লাবগুলোর কর্তৃত্ব ছিল সিপিএম-এর। অপেক্ষাকৃত বর্ধিষ্ণু পাড়ার ক্লাবগুলো চলত কংগ্রেসি মতাদর্শে। ১৯৬৯ সালের আগুপেছু সময় থেকে নকশালপন্থীদের তৎপরতার কারণে ক্লাবভিত্তিক এই রাজনৈতিক সমীকরণ অনেকটা পালটে যায়। সিপিএম-এর হাত থেকে যেমন বহু ক্লাবের কর্তৃত্ব চলে যায় নকশালদের হাতে, তেমনই কংগ্রেসলালিত ক্লাবগুলোকে চাপে ফেলে দেয় জয়ন্তর মতো বহিরাগত বহু নকশাল নেতা। স্থানীয়ভাবে বিগড়ে যাওয়া এই রাজনৈতিক সমীকরণের কুপ্রভাব বেশ তীব্র হয়ে ওঠে ১৯৭০ সাল থেকে। তখনই পোস্টাপিস কিংবা স্কুল পোড়ানোর হিড়িক ওঠে। শ্রেণিশত্রু নিকেশের নামে অশ্বিনী ভৌমিকের মতো বহু লাশ পড়ে। এসব কারণে এই অঞ্চল, যা এক সময় নকশালদের দুর্দান্ত ঘাঁটি ছিল, তা হাতছাড়া হতে থাকে। স্থানীয় গৃহস্থরা, যাঁরা রাজনীতির প্যাঁচের বাইরে থেকেও তরুণ নকশালপন্থীদের নীরব সমর্থন জানাতেন, তাঁদের আশ্রয় দিতেন, তাঁরা ধীরে ধীরে মুখ ফিরিয়ে নিতে থাকেন। নকশালপন্থীরা সে-সব ঠিকঠাক সেদিন বুঝে উঠতে পেরেছিলেন বলে মনে হয় না।
নির্মল চট্টোপাধ্যায় ছিলেন ইউনাইটেড কার্বাইড, যারা এভারেডি ব্যাটারি তৈরি করে, সেই কারখানা আইএনটিইউসি-র সাধারণ সম্পাদক। এছাড়া তিনি ছিলেন বরানগর বাজারের কাছেই কাশীনাথ দত্ত রোডের ওপর ‘নবজীবন’ ক্লাবের প্রধান ব্যক্তি। তিনি ছিলেন একজন দক্ষ সংগঠক। তাঁর সাংগঠনিক ক্ষমতা ভোটের সময় কাজে লাগাতেন শত ঘোষ, দেবী ঘোষালের মতো কংগ্রেসি নেতারা। যদিও নির্মল চট্টোপাধ্যায়ের ছত্রছায়ায় সেদিন যাঁরা ছিলেন, তাঁরা কেউ ধোয়া তুলসিপাতা নন। যেমন পরেশ সাউ। বরানগর বাজারের সাট্টার পেন্সিলার। যেমন বাসু গুন্ডা (এই নামে তিনি এমন প্রসিদ্ধ ছিলেন, যে তিনি যে বাড়িতে বাস করতেন, আজও সেই গলিটার চলতি নাম ‘বাসুগুন্ডার গলি’), বংশী–নিতাই দুইভাই। এমন আরও বহু তরুণ। যাঁরা বিদ্যালয়ের শিক্ষা শেষ না করেই পাইপগান ধরতে শিখে গিয়েছিলেন।
আপাতদৃষ্টিতে নির্মল চট্টোপাধ্যায়কে খুন করার কারণ নকশালপন্থীদের থাকার কথা নয়। যে–কারণে আজও কোনও নকশালপন্থী গ্রুপ সেই খুনের দায় স্বীকার করে না। কিন্তু এ কথাও তো খুব সত্যি, যে ১৯৭০ সালের মাঝামাঝি এসে সিপিআই(এম-এল)-এর কোনও রাজনৈতিক শৃঙ্খলা ছিল না? ছিল না কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব? নকশালবাড়ি অন্দোলনের মূল নেতারা, তাত্ত্বিক ছাত্রনেতারা চারু মজুমদারের সমালোচনা করে হয় পার্টি থেকে বহিষ্কৃত, কিংবা জেলে, না হলে পুলিশি এনকাউন্টারে লাশ হয়ে গেছেন। তখন চারু মজুমদারের চারপাশে দুর্ভেদ্য পাঁচিল তুলে দিয়েছিল তাঁরই সসৃষ্ট মুদ্রাদোষ এবং কিছু খোশামোদি ক্যাডার বাহিনি। ফলে তখন পাড়ায়–পাড়ায় অষ্ট–ভনেরা এক একজন ডাকসাইটে গেরিলা নেতা। তাঁদের মধ্যে থেকে আঞ্চলিক স্তরে, ব্যক্তি আক্রোশ থেকে নির্মল চট্টোপাধ্যায়কে সেদিন নকশালপন্থীরাই খুন করেননি, তামা–তুলসিপাতা হাতে নিয়ে আজ সে কথা বলা আদৌ যৌক্তিক কী?
পরিকল্পনা যার হোক (নকশালপন্থীরা বিভিন্নভাবে বলতে চেয়েছেন খুনটা কংগ্রেসিরাই করেছিলেন। গণহত্যার নিখুঁত চিত্রনাট্য সাজানোর প্রয়োজনে), ১২ অগস্ট ১৯৭১ সালের বিকেল সাড়ে চারটে নাগাদ চার নম্বর বাস টার্মিনাসের সামনে (জায়গাটা নর্থ সুবারবন হসপিটাল আর রতনবাবু রোডের ক্রসিং-এ) একটা চায়ের দোকানে নির্মল চট্টোপাধ্যায় যখন বসেছিলেন, তখন দুজন যুবক এসে তাঁকে পয়েন্ট ব্ল্যাঙ্ক থেকে গুলি করে রতনবাবু রোডের ভেতরে পালিয়ে যান। স্থানীয় ছেলেরা তাঁদের ধাওয়া করলে তাঁরা বিশ্বাসবাড়িতে গিয়ে আশ্রয় নেন।
বিশ্বাসরা ব্যবসাদার ছিলেন। তাঁরা ছিলেন সিদ্ধার্থশঙ্কর রায়ের বিশেষ স্নেহভাজন। কিন্তু বিধির ফের সেই বাড়ির ছেলে গণেশ বিশ্বাস হয়ে যান নকশাল। ফলে বিরাট বিশ্বাসবাড়ির একটা অংশ নকশালদের আশ্রয়ের জায়গা হয়ে ওঠে। পরবর্তী সময় গণেশ বিশ্বাস আমাকে বলেছিলেন, যখন গণহত্যা ঘটে, তখন তিনি জেলে। আর সে-সময়ে তাঁদের বাড়িতে কোনও নকশালের আশ্রয় নেওয়ার প্রশ্নই নেই, কারণ তিনি স্বয়ং বিরোধী রাজনীতির কারণে দীর্ঘকাল এলাকা ছাড়া ছিলেন। তাঁর এই মতকে হাতিয়ার করে অনেকই বলেন পুরোটাই ছিল সাজানো ষড়যন্ত্র।
নির্মল চট্টোপাধ্যায় খুন হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে কাশীপুর–বরানগরের ছবিটা তাৎক্ষণিকভাবে পালটে যায়। বিকেল পাঁচটা নাগাদ বিশ্বাসবাড়িতে আগুন লাগিয়ে দেওয়া হয়। তারপর সারা অঞ্চল ব্ল্যাকআউট করে ঘরে ঘরে ঢুকে হাতের সামনে যাঁকে পেয়েছেন তাঁকেই কংগ্রেসি সমাজবিরোধীরা খুন করতে থাকেন। ১২ তারিখ সন্ধে থেকে খুনের যে উৎসব শুরু হয়, তা চলে পরদিন বিকেল পৌনে পাঁচটা অবধি। ‘নবজীবন’ ক্লাবে নির্মল চট্টোপাধ্যায়ের মরদেহ এলে তদানীন্তন পুলিশ মন্ত্রী সুব্রত মুখোপাধ্যায় এসে মাল্যদান করেন। তারপর মুখ্যমন্ত্রী সিদ্ধার্থশঙ্কর রায় কার্ফু জারি করেন। এলাকায় সিআরপিএফ-এর টহলদারি শুরু হলে গণহত্যা বন্ধ হয়।
সেদিন ঠিক কতজন খুন হয়েছিলেন? তার কোনও হিসাব কোনও পক্ষের কাছে নেই। তবে সরকারি হিসাবে বলা হয় আঠেরো–কুড়িজন। নকশালপন্থীদের মতে সংখ্যাটা দেড়শোর বেশি। পরবর্তীকালে তাঁরা শহীদদের যে তালিকা বের করেছেন সেখানে পঞ্চাশজনেরও নাম নেই। সমর সেন সম্পাদিত ফ্রন্টিয়ার কাগজের প্রতিবেদনে লেখা হয়েছিল কুঠিঘাট রোডের ওপর একটা ল্যাম্প পোস্টে মৃতদের তালিকা লেখা হচ্ছিল। সেখানে একশো তিরিশজনের নাম লেখার পরে আর নাম লেখা সম্ভব হয়নি। অসমর্থিত সূত্র ধরে The Times of India বছর কয়েক আগে জানিয়েছে সংখ্যাটা ৯০ থেকে ১০০-র মধ্যে হওয়া সম্ভব।
এ বিষয়ে ঘাতকেরা কী বলেছেন? আগেই বলেছি সেই সময় পাড়া রক্ষা করতে প্রচুর কংগ্রেসি গুন্ডা পাড়াতেই আশ্রয় নিয়েছিলেন। এরা ছিলেন বাইরের লোক। এদের সঙ্গে নিতাই-অশ্বিনী-কেলোরা মিলে নকশাল সাফাই অভিযানে নেমেছিলেন। কংগ্রেস জমানা চলে যাওয়ার পরে এই বাইরের লোকেরা ফের তাঁদের স্বস্থানে চলে যান। এবং পরবর্তীকালে ভদ্রলোকের পেশা ও জীবন বেঁচে নেন (যেমন বাচ্চু–ছোট্টু দুইভাই লিলি বিস্কুট কোম্পানিতে চাকরি পান। তেমনই কেলো, রঞ্জিতেরা। এঁদের শাস্তি কখনও কেউ চাননি। এমনকি ক্ষমতায় এসে সিপিএম-ও নয়। কারণ এই হত্যাকাণ্ডে সিপিএম-ও তাদের হাত রঞ্জিত করেছিল)। ১৩ তারিখ সকাল থেকে ভ্যানরিকশায় ডেডবডিগুলোকে ডাঁই করে তুলে গঙ্গার ধারে নিয়ে যাওয়া হয়। তারপর বডিগুলোকে জলে ভাসিয়ে দেওয়া হয়। আমাদের বাড়ির সামনে দিয়ে যে রাস্তাটা গেছে, সেটা তিনটে ঘাটকে ছোঁয়। আমাদের বাড়ি থেকে গঙ্গার ঘাট মাত্র দুশো–তিনশো মিটার দূর। বাড়ির বড়দের কাছে শুনেছি, কমবেশি কুড়ি থেকে তিরিশটা ডেডবডি আমাদের বাড়ির সামনে দিয়ে নিয়ে যাওয়া হয়। সেটাকে যদি গড় ধরি, অর্থাৎ এক একটা পাড়ার ঘাটে কুড়ি-পঁচিশটা ডেডবডি ফেলা হয়ে থাকে, তাহলে হিসাবটা এমন দাঁড়ায়— দক্ষিণের সর্বমঙ্গলা ঘাট, তারপর ক্রমে উত্তরে এগোলে রতনবাবু রোডের শেষে রামকৃষ্ণ মহাশ্মশানের ঘাট, তারপর প্রামাণিক ঘাট, শিলাঘাট, কাঁথাধারীর মঠের ঘাট, কুঠিঘাট, জয় মিত্র কালীবাড়ির ঘাট, জেলেপাড়ার ঘাট, কাঁচের মন্দিরের ঘাট, পাঠবাড়ির ঘাট হয়ে একেবারে উত্তরপ্রান্তে আলমবাজার ঘাট অবধি কমবেশি বারোখানা মূল ঘাট। আমি এই ঘাটগুলোর নাম উল্লেখ করলাম এইজন্য, যে এখান দিয়ে ডেডবডিগুলো নিয়ে যাওয়া অনেক সহজ। কারণ এই অঞ্চলগুলোতে তখন নকশালদের আর কোনও অস্তিত্ব ছিল না। পাড়ার দাদাদের সঙ্গে হিসাব কষে মোটামুটি একশো কুড়ি থেকে দেড়শোটা খুন সেই দুইদিন ধরে হয়েছিল এমন একটা যুক্তিগ্রাহ্য সংখ্যায় আমি আসতে পারছি। কারণ সঠিক হিসাব তাঁরাও কেউ জানেন না।
এখন প্রশ্ন হল, যারা খুন হন, তাঁরা সকলেই কি নকশালপন্থী ছিলেন? আর তাই যদি হয় কারা সেদিন সনাক্তকরণ করেছিলেন হন্যমানদের?
ঘটনার ময়না তদন্ত করলে বোঝা যায়, এমন একটা সুযোগের অপেক্ষায় বহুদিন ধরে অস্ত্র মজুত করছিল কংগ্রেস আর সিপিএম। নকশালদের হঠকারিতাই হোক, কিংবা কংগ্রেসের সাজানো চাল, ঘাতকেরা সুযোগের সম্পূর্ণ সদ্ব্যবহার করতে পেরেছিলেন। কারণ পুলিশ প্রশাসনকে নিষ্ক্রিয় করে দেওয়া হয়েছিল। অভিজ্ঞজনেরা জানেন ১৯৭০-এর দশকে রাজ্য জুড়ে যত খুন হয়েছিল, তার সিংহভাগ ঘটিয়েছিল পুলিশ। কিন্তু কাশীপুর–বরানগরের গণহত্যায় পুলিশের ভূমিকা ছিল গৃহস্থদের মতো নিরপেক্ষ দর্শক।
এসইউসিআই-এর স্থানীয় কর্মী সুশীল নন্দী আমাকে জানিয়েছিলেন, তিনি এবং তাঁর পার্টির অন্য নেতারা পরদিন সকালে বরানগর পৌরসভার কাছে সিপিএম পার্টি অফিসে গিয়ে চন্দ্র রায় এবং লক্ষ্মণ ভট্টাচার্যকে বারবার অনুরোধ করেন পদক্ষেপ নেওয়ার জন্য। কিন্তু রাজনৈতিক শত্রুতার কারণেই সেদিন সিপিএম কেবলমাত্র নিষ্ক্রিয় থাকেনি, পাড়ায়-পাড়ায় বহুলাংশে তারাই চিহ্নিত করেছিল কারা-কারা শত্রু। কাদের নিকেশ করতে হবে। যতজন সেদিন খুন হন, স্বাভাবিক নিয়মেই তার মাত্র এক-তৃতীয়াংশ ছিলেন নকশাল। ফলে আজও নকশালপন্থীদের পক্ষে পঞ্চাশজন শহীদের নামও জোগাড় করা সম্ভব হয়নি। তবে রাজনীতির খেলায় তাঁরাও কম দড় নন। সেদিন যে দেড়শোজনের মতো যুবক খুন হয়েছিলেন তাঁদের মধ্যে তো সিপিএমও ছিল। আমার নিজের মামা তপন ঘোষাল। ১২ তারিখ রাতে তাঁকে টবিন রোড়ের বাড়ি থেকে ডেকে নিয়ে গিয়ে খুন করা হয়। মামা ভিক্টোরিয়া স্কুলে ক্লাস টুয়েলভে পড়তেন। বয়স তখন তাঁর আঠেরো বছর। তিনি কিন্তু সিপিএম করতেন। তাঁদের সবাইকে নিজের দলের কর্মী নাম দিয়ে এক ব্র্যাকেটে এনে ফায়দা তোলার রাজনীতি আজ অর্ধশত বছর পরেও অম্লান।
গণহত্যার পরবর্তী সময়ের বিবিধ রাজনৈতিক সমীকরণ
কাশীপুর–বরানগর গণহত্যার আগুপেছু সময়ে আরও অনেক জায়গায় গণহত্যা সংঘটিত হয়। যেমন দক্ষিণেশ্বর, বারাসাত কিংবা কানাইপুর (কোন্নগর)। দু দশক পরে বিহারের আরোয়ালও ঘটেছে। অন্ধ্রপ্রদেশেও। সিপিএম রাজত্বে জঙ্গলমহলে কিংবা সাঁইবাড়িতেও ঘটেছে গণহত্যা। কিন্তু কাশীপুর-বরানগর গণহত্যার মতো এমন ব্যাপক, পূর্বপরিকল্পিত অথবা তাৎক্ষণিকভাবে পরিকল্পিত, খোদ কলকাতা মহানগরে দু দিন ধরে বাইরের সঙ্গে সব যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করে যেভাবে হত্যাযজ্ঞ চালানো হয়েছিল, তার সঙ্গে একমাত্র জালিয়ানওয়ালাবাগ হত্যাকাণ্ডের প্রতিতুলনা করা চলে। জালিয়ানওয়ালাবাগে যেমন অসংখ্য নিরীহ মানুষকে খুন করা হয়েছিল, ঠিক তেমনই কাশীপুর-বরানগরের গণহত্যায় বহু আঠেরোর তরুণকে খুন করা হয় রাজনৈতিক প্রতিহিংসার কারণে। যাঁদের সঙ্গে রাজনীতির হয়তো ন্যূনতম সম্পর্কও ছিল না। এই ঘটনার সূত্র ধরে পরবর্তী সময় বহু নিরীহ তরুণকে পড়াশুনা ছাড়িয়ে তাঁদের বাড়ির অভিভাবকেরা অন্যত্র পাঠিয়ে দিয়েছিলেন। এই হত্যাকাণ্ডের দায় কেবলমাত্র কংগ্রেসিদের নয়। এর সমান দায় সিপিএম পার্টির স্থানীয় নেতৃত্বের। এর সমান দায় পুলিশ প্রশাসনের। এবং সবচেয়ে বড় কথা এর সমান দায় নকশালপন্থীদেরও। কারণ বিস্ফোরক তাঁরাই তৈরি করেছিলেন। হয়তো দেশলাইকাঠিটা (যা তাঁরা এখনও বলেন), অর্থাৎ নির্মল চট্টোপাধ্যায়কে খুন তাঁরা না করলেও এতগুলো তরুণের খুনের দায় তাঁরা এড়িয়ে যেতে পারেন না। তাই দেখা যায় এই হত্যাকাণ্ড নিয়ে দু-দুটো কমিশন গঠন করা হলেও সবকিছু চলে যায় ঠাণ্ডাঘরে। কারণ যাঁরা নিকেশ হয়েছেন, তাঁদের হয়ে কথা বলার যোগ্যতা তাঁদের রাজনৈতিক সমর্থকেরাই হারিয়েছেন। ফলে এই গণহত্যাকে প্রেক্ষাপট করে উপন্যাস, কবিতা, গল্প, নাটক এমনকি ব্যক্তিগত ডায়েরি রচনার বিপুল আয়োজন হয়েছে সত্যি, কিন্তু মূল ঘটনার কোনও সৎ অনুসন্ধান হয়নি। আর হবেও না।
জালিয়ানওয়ালাবাগ হত্যাকাণ্ডের অব্যবহিত পরেই ব্রিটিশরাজ তদন্ত কমিশন গঠন করেছিল এবং জেনারেল ডায়ারকে দোষী সাব্যস্ত করেছিল (যতই লঘু হোক সেই শাস্তি)। অথচ, স্বাধীন ভারতে বহুদলীয় সংসদীয় গণতান্ত্রিক আবহাওয়ায় বাস করেও কোনও শাাসকেরই হিম্মত হল না কাশীপুর-বরানগর গণহত্যার তদন্তের নিষ্পত্তি করার।
তাই অর্ধশতবর্ষ কেটে গেলেও সেদিনের গণহত্যার যন্ত্রণাটা এখনও আমার মতো অনেকের কাছে একইরকম টাটকা।