কেন চেয়ে আছ গো মা

শুভ প্রতিম

 


আমরা, এক সচেতন প্রয়াস’ এবং কয়েকটি সহযোগী সংগঠন মিলে কথা বলা হয় সাম্প্রতিক সময়ে বিশেষত বিজেপি-শাসিত রাজ্যে প্রহৃত, বিতাড়িত অভিবাসী শ্রমিকদের সঙ্গে। যদিও এর মধ্যে আম আদমি পার্টি-শাসিত পাঞ্জাবেও বাঙালি অভিবাসী শ্রমিক হয়রানির খবর এসেছে। এই পর্বে আমরা কথা বলি বিভিন্ন পরিসরে অভিবাসী শ্রমিকদের সঙ্গে। যেমন বাংলাদেশে পুশব্যাক থেকে ফিরে আসা বিএসএফ ও মহারাষ্ট্র পুলিশের হাতে নির্যাতিত শ্রমিক, পুনরায় ফিরে যেতে চাওয়া শ্রমিক, হেবিয়াস কর্পাস করা শ্রমিক, কোচবিহারে ছিটমহলের অধিবাসী, মতুয়া ইত্যাদি। প্রথমদ্বিতীয় পর্ব প্রকাশিত হয়েছে। আজ তৃতীয় পর্ব

 

মা শুধু চেয়ে থাকে পথের পানে, কখন তার দুই সন্তান ফিরবে। কখন আবার মা বলে ডাকবে। চিরকালীন মা ও তার সন্তানের মেলোডি নয়, আজকের কঠিন বাস্তবতা। বাংলার গ্রাম-কে-গ্রাম খালি করে যুবক ও সদ্য-যুবকেরা ভিনরাজ্যে পাড়ি দিচ্ছে। কারণ রোজগার নেই এই রাজ্যে। বাড়ির মানুষ অপেক্ষা করে থাকে ছেলে বা দাদা বা স্বামীর ফিরে আসার। আসে যখন সুখ নিয়ে আসে, অর্থ নিয়ে আসে। বাইরের রাজ্য থেকে নিয়ে আসা রোজগার থেকে হয় সমৃদ্ধি।

নদীয়ার রানাঘাট থানার অধীনে নোকরি গ্রামপঞ্চায়েত। গ্রামের নাম নবরায়নগর। গাছপালায় ঘেরা এক গ্রাম। গ্রামের মাঠপাড়ায় টিনের বেড়া দিয়ে ঘেরা এক-ঘরের এক বাড়ি। ঘরের দরজায় সামান্য হেলান দিয়ে দাঁড়িয়েছিলেন উনি। বৃদ্ধ স্বামী মাঠে কাজ করতে গেছেন, দিনমজুরের কাজ। রোপণের এই মরসুমে চাষের কাজ পাওয়া যায়। মজুরি অল্পই, কিন্তু উপায় কী? বাড়িতে রান্না এখনও চাপেনি, সূর্য মধ্যগগনে। এর মধ্যে দুইবার স্ট্রোক হয়েছে। দ্বিতীয়বার হয়েছে দুই ছেলের গ্রেপ্তারের খবর পাওয়ার পর। পুষ্পা বিশ্বাস, এখনও বিশ্বাস করতে পারছেন না, তার দুই ছেলে বিনা অপরাধে কেন জেলের কুঠুরিতে বন্দি!

 

নিশিকান্তের বয়স হয়েছে, দূরের মাঠে জন খাটতে যেতে পারেন না। তাই গ্রামের মধ্যেই কাজ পেলে করেন, মজুরি কম হলেও করেন। মা-বাপ আর দুই ছেলের ছোট সংসার। সংসারটা একটু গুছিয়ে নিচ্ছিলেন ওঁরা। দুই ছেলে, মণিশঙ্কর আর নির্মল কাঠের কাজ জানে, সেই কাজের সূত্রেই তাঁদের ভিনরাজ্যে পাড়ি। আগে দিনাজপুরে থাকতেন, বছর চারেক হল তাঁদের নদীয়ায় আসা। কাঠাখানেক জায়গা কিনে কোনওরকমে একটা ঘর তুলেছেন, টিন দিয়ে ঘেরা।

মণিশঙ্করের বয়স ২৩, আর নির্মলের ২২। ‘বিদেশি’ সন্দেহে দুই ভাইকে মহারাষ্ট্রের আকোলা থেকে গত ২৪ ডিসেম্বরে ভারতীয় ন্যায়সংহিতা, পাসপোর্ট আইন এবং বিদেশি আইনে গ্রেপ্তার করা হয়। আজ প্রায় ৮ মাস হল তাঁদের আটক। খবর শুনে অসুস্থ হয়ে পড়েন মা পুষ্পা বিশ্বাস। সংবাদে প্রকাশ, ‘ঘটনার অভিঘাতে তিনি পক্ষাঘাতগ্রস্ত।’

“ছেলে দুটোর তো ভোটার কার্ড, আধার কার্ড সবই আছে। মতুয়া কার্ড আছে।” “মন্ত্রী শান্তনু ঠাকুরের ইস্যু করা মতুয়া কার্ড”— জানালেন এক প্রতিবেশী। নিশিকান্ত বলছিলেন, “আমরা মহারাষ্ট্রে গিয়ে ছেলেদের সঙ্গে দেখা করতে পারিনি, আমাদের সামর্থ্য কোথায়? মন্ত্রী শান্তনু ঠাকুরের কাছে গিয়েছিলাম, বললেন দেখছি। আজ এত মাস হয়ে গেল, উনি আর কতদিনে দেখবেন?”

 

মমতাবালা ঠাকুর বনাম শান্তনু ঠাকুর

মতুয়া কার্ড হোক বা মতুয়া ভোট, প্রতিযোগিতা তীব্র। বাংলার রাজনীতিতে ধর্মীয় ও কৌম-সামাজিক গোষ্ঠীগুলি যেমন মতুয়া, ফুরফুরা যবে থেকে ‘নির্বাচনী-মূলধন’ হিসাবে গুরুত্ব পেতে থাকল তবে থেকেই প্রতিযোগিতার শুরু। প্রতিযোগিতা পরিবারের মধ্যে, বাইরে। ফুরফুরার পিরজাদাদের স্বার্থের লড়াইয়ের মতোই মতুয়া সমাজের ঠাকুরবাড়ির লড়াই এখন সর্বজনবিদিত। মতুয়া ধর্মের স্রষ্টা হরিচাঁদ ও গুরুচাঁদ ঠাকুরের উত্তরসূরিরা কেউ বিজেপি, কেউ তৃণমূল। ক্ষমতার লড়াই, সম্পত্তির লড়াই। সাধারণ মতুয়া সমাজ সেখানে শুধুমাত্র ‘ভোটার’। “‘আইনসভায় যাও, আমি বলি রাজা হও, দূর করো এ জাতির ব্যথা,” সেই কবে উপদেশ দিয়েছিলেন গুরুচাঁদ ঠাকুর। বাস্তবতা হল, ‘রাজা হওয়া’ থেকে বহু দূরে সাধারণ খেটেখাওয়া মতুয়াসমাজ।

নবরায়নগর, গ্রামটি মতুয়া অধ্যুষিত। বিজেপির ভোটভিত্তি আছে, জানালেন একজন মতুয়া সমাজকর্মী। তিনি আরও বলেন, এই পরিবারও বিজেপির ভোটার। তবে অনেকের কাছে মমতাবালা ঠাকুরের মতুয়া কার্ড আছে। এই কার্ড ইস্যু নিয়ে রাজনৈতিক প্রতিযোগিতা আছে। আবার এক গোষ্ঠীর কাছে কার্ড পেয়ে অন্য গোষ্ঠীকে আনুগত্য দেখানো, তাও আছে।

নাগপুরের মহারাষ্ট্র হাইকোর্টের বেঞ্চের আইনজীবী নিখিলেশ অধিকারী দুই ভাইয়ের জামিন পাওয়ানোর চেষ্টা করছেন। জামিনের প্রথম আবেদনটি প্রত্যাখ্যাত হয়েছে। পরবর্তী শুনানি সেপ্টেম্বরের ৮ তারিখ সাক্ষ্যপ্রমাণের জন্য। মোট ১৭ জন সাক্ষীর মধ্যে ৪ জনের সাক্ষ্য গ্রহণ করা হয়েছে। বাংলাভাষী মানুষদের অধিকারের লড়াইয়ে সামিল এই আইনজীবী জানালেন, আমাদের কাছে মহারাষ্ট্রে মতুয়া সম্প্রদায়ের বহু মানুষের মামলা আছে। ভাষার ভিত্তিতেই, তা সে হিন্দু হোক বা মুসলমান গ্রেপ্তার করা হচ্ছে। এই দুই ভাইয়ের পক্ষে দাঁড়ানোর জন্য আকোলা আদালতে আইনজীবী দরকার। দরকার রাজ্য থেকে এদের পাশে থাকার জন্য আইনি সহায়তা। এরপরে জামিন না হলে বা আদালত বিদেশি ঘোষণা করলে কী হবে? উত্তর তাঁরও জানা নেই।

বিজেপির সরকার মহারাষ্ট্রে, বিজেপির কেন্দ্রীয় মন্ত্রী শান্তনু ঠাকুর কিছুই করেননি এই দুই মতুয়া যুবকের মুক্তির জন্য। তৃণমূলের পক্ষ থেকে দোলা সেন সচেষ্ট হন, কলকাতা প্রেস ক্লাবে নিশিকান্ত বিশ্বাসকে নিয়ে যাওয়া হয়। ২১ জুলাই মঞ্চে যাতে তোলা যায় তার জন্যে সচেষ্ট হন স্থানীয় তৃণমূল বিধায়ক মুকুটমণি অধিকারী, কিন্তু সফল হননি। অভিবাসী শ্রমিকের হয়রানি এখন রাজনৈতিক লাভের লালসা বই কিছু নয়। ‘মঞ্চে তোলা’-র রাজনৈতিক লাভালাভ আছে, আইনি মুক্তির প্রচেষ্টা (এ-ক্ষেত্রে স্থানীয় আদালতে গিয়ে) নেই। মতুয়া তথা দলিত হিন্দু ভোটের ‘ঠিকাদার’ বিজেপি, বিশেষত, বঙ্গ-বিজেপির ভূমিকা? মণিশঙ্কর-নির্মলের বিষয়ে কোনও তৎপরতা চোখে পড়ে না।

কথোপকথনের সমগ্র পর্বে মা প্রায় নির্বাক ছিলেন। কথা বলছিল তাঁর চোখ, তাঁর দৃষ্টি। ফুঁপিয়ে ওঠা কান্না। কোনও শব্দ-শ্রাব্যতায় তা মাপা যায় না। গলার স্বর না জানালেও তাঁর অনুচ্চারিত স্বর জানাচ্ছিল, “আমার সন্তানদের ফিরিয়ে দাও।” রাজনীতি আবারও কাঠগড়ায়।

 

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 5217 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

Be the first to comment

আপনার মতামত...