ভোটার তালিকায় বিশেষ নিবিড় সংশোধন: লক্ষ্য যখন রাজনৈতিক

সুমন কল্যাণ মৌলিক

 


এই এসআইআর যদি অপরীক্ষিতভাবে চলতে থাকে, আমরা এক বিপজ্জনক অঞ্চলে প্রবেশ করব। ভোটাধিকার হয়ে উঠতে পারে নথিভুক্ত মধ্যবিত্তের— শহুরে, বেতনভোগী, প্রযুক্তিসক্ষম একটি বিশেষাধিকার, যখন দরিদ্র, বাস্তুচ্যুত এবং নথিহীনরা পিছিয়ে পড়ে থাকবে। আমরা দুটো ভারত তৈরির ঝুঁকির মধ্যে রয়েছি; একটায় ভোটাধিকার থাকবে, অন্যটায় নয়। রাজনৈতিক দলগুলো তখন কেবল তাদের জন্য কাজ করবে যাদের অংশগ্রহণ গোনা যায়— আক্ষরিক অর্থে। যাদের ভোট নেই, তারা নীতিনির্ধারণ, কল্যাণ এবং ন্যায়বিচারে উপেক্ষিত হবে। এই মুহূর্তে প্রতিরোধের প্রয়োজন— কেবল আদালত থেকে নয়, নাগরিক, সুশীল সমাজ, সংসদ এবং অবশ্যই রাস্তা থেকে। আমাদের অবশ্যই এই নীতি পুনরুদ্ধার করতে হবে যে, ভোটাধিকার জনগণের, কাগজপত্রের নয়

 

ভোটার তালিকায় সংশোধন যে-কোনও গণতন্ত্রে একটি স্বাভাবিক বিষয়। ভারতবর্ষ কখনও তার ব্যতিক্রম ছিল না। মৃতদের তালিকা থেকে বিয়োজন, নতুনদের সংযোজন, স্থানান্তরিত মানুষদের এক তালিকা থেকে অন্য তালিকায় নাম ওঠানো এক স্বাভাবিক প্রক্রিয়া এবং নির্বাচন কমিশন-নিযুক্ত বুথ-লেভেল অফিসাররা বছরের পর বছর ধরে অত্যন্ত যোগ্যতার সঙ্গে এই গুরুত্বপূর্ণ কাজটি সম্পাদন করছেন। কিন্ত এবার বিহার বিধানসভা নির্বাচনের ঠিক আগে ২৪ জুন (২০২৫) কেন্দ্রীয় নির্বাচন কমিশন বিহারে যে নিবিড় ভোটার তালিকা সংশোধন শুরু করেছে এবং তার প্রথম পর্যায়ের কাজ শেষ করেছে, তা শুধু বিতর্কই তৈরি করেনি, দেশের একটা বড় অংশের মানুষের মনে আতঙ্ক তৈরি করেছে। ইতিমধ্যে ৬৫ লক্ষ মানুষের নাম ভোটার তালিকা থেকে বাদ গেছে, এর মধ্যে আমরা যদি মৃত মানুষদের নাম তালিকা থেকে বাদও দিই, তবুও সংখ্যাটা যথেষ্ট বড়।

প্রক্রিয়ার প্রাথমিক অভিঘাত থেকে এটা স্পষ্ট, যদি কার্যকরী প্রতিরোধ ও আদালতের হস্তক্ষেপ না হয় তবে এক বিরাট সংখ্যক ভোটারের নাম তালিকা থেকে বাদ হয়ে যাবে। আবার সংখ্যাতত্ত্ব বলছে এই বাদ হওয়া মানুষদের মধ্যে সংখ্যাগরিষ্ঠ হবেন গরিব ও প্রান্তিক মানুষ। সবচেয়ে বড় কথা হল এই বিতর্ক এমন সময়ে হচ্ছে, যখন খোদ নির্বাচন কমিশনের কাজকর্মের নিরপেক্ষতা নিয়ে একাধিক প্রশ্নচিহ্ন উঠে গেছে এবং বিভিন্ন প্রতিবেদন, নির্বাচনী কাগজ থেকে এটা স্পষ্টভাবে প্রতীয়মান হচ্ছে যে নির্বাচন কমিশন কেন্দ্রে ক্ষমতাসীন শাসক দল ভারতীয় জনতা পার্টির প্রতি আনুগত্য দেখাচ্ছে। অতি সম্প্রতি রাহুল গান্ধির বহু আলোচিত ‘Democracy Destroyed’ শীর্ষক সাংবাদিক সম্মেলনে একাধিক তথ্যপ্রমাণ এসেছে। কিন্তু তথ্যের খাতিরে এ-কথাও মনে করিয়ে দেওয়া দরকার যে বিগত লোকসভা নির্বাচনের সময় কত ভোট পড়েছে সংক্রান্ত সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ নথিটি (১৭সি) নিয়ে একাধিক অভিযোগ উঠেছিল। বিশেষ করে ভোট শেষ হয়ে যাওয়ার পর ভোটের শতাংশের হার এবং তার দুদিন পরে চূড়ান্ত ভোটের হারের মধ্যে পার্থক্য নিয়ে এখনও পর্যন্ত কমিশন যথাযথ জবাব দিতে পারেনি, বিশেষ করে উত্তরপ্রদেশে বারাণসী কেন্দ্রে যেখানে খোদ নরেন্দ্র মোদি ভোটপ্রার্থী ছিলেন, সেখানেও একাধিক অভিযোগ ওঠে। এই পরিস্থিতিতে নির্বাচন কমিশনের এই সিদ্ধান্ত একাধিক বিতর্কের জন্ম দিয়েছে, দেশের সর্বোচ্চ আদালতে করা একাধিক মামলা তার প্রমাণ।

ভোটার লিস্ট সংশোধন বলতে যে কাজগুলো বোঝায় তা হল মৃত ব্যক্তিদের নাম তালিকা থেকে বাদ দেওয়া, যে-সমস্ত ভোটাররা স্থায়ীভাবে অন্য জায়গায় চলে গেছেন তাদের নাম বাদ দেওয়া, যাদের আঠারো বছর বয়স হয়ে গেছে তাদের নাম ভোটার তালিকায় সংযোজন করা। কিন্তু বিহারের ক্ষেত্রে যাদের নাম ভোটার তালিকায় আছে তাদেরকেও ফর্ম ভর্তি করতে বলা হচ্ছে। এ-কথা কারও অজানা নয় যে, কোনও তালিকায় নাম তুলতে বা রাখতে গেলে অবশ্যই ভোটারদের কিছু নথি জমা দিতে হয়। এই একই কথা ভোট দেওয়ার ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। বিহারে এসআইআরের ক্ষেত্রে মানুষের কাছে যে তিনটি নথি সহজলভ্য অর্থাৎ আধার কার্ড, সচিত্র ভোটার আইডেনটিটি কার্ড এবং প্যান কার্ডকে বাতিল করা হচ্ছে। দীর্ঘ সময় ধরে অধিকার আন্দোলনের কর্মীদের বিরোধিতা ও আদালতের রায় থাকা সত্ত্বেও সমস্ত সরকারি কাজে আধার সংযুক্তি আবশ্যিক করা হয়েছে। স্বাভাবিকভাবে আজকে সরকারের ক্রমাগত প্রচারের কারণে আধার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ নথি হিসাবে প্রচারিত। সেটিকে বাতিল করা হয়েছে। একইভাবে খোদ নির্বাচন কমিশনের দেওয়া ভোটার আইডেনটিটি কার্ডেরও কোনও মূল্য নেই। গ্রামের দিকে আরও দুটো গুরুত্বপূর্ণ নথি হল রেশন কার্ড এবং মনরেগা কার্ড। এগুলোও বাতিল। পরিবর্তে যে-সমস্ত নথিগুলোকে (যে-কোনও একটা) চাওয়া হয়েছে তা বেশিরভাগ মানুষের কাছে সহজলভ্য নয়। এগুলোর মধ্যে রয়েছে— ১) পেনশন পেমেন্ট অর্ডার, ২) ১৯৮৭ সালের ১ জুলাই-এর আগে সরকার, স্থানীয় প্রশাসন, ব্যাঙ্ক, এলআইসি, পোস্ট অফিস কর্তৃক ইস্যু করা কোনও পরিচয়পত্র, ৩) জন্ম সার্টিফিকেট, ৪) মাধ্যমিক বা সমতুল কোনও সার্টিফিকেট, ৫) পাসপোর্ট, ৬) স্থায়ী বাসস্থানের শংসাপত্র, ৭) অরণ্য অধিকার সংক্রান্ত শংসাপত্র, ৮) তফসিলি জাতি/উপজাতি/ওবিসি সার্টিফিকেট, ৯) ন্যাশানাল রেজিস্টার অব সিটিজেন, ১০) ফ্যামিলি রেজিস্টার, ১১) জমি বা আবাস যোজনার শংসাপত্র। এই তালিকার নবম ও দশমটা বিহারের জন্য প্রযোজ্য নয়। এগারো নম্বর নথিটা পেতে গেলে আধার কার্ড জমা করতে হয়। ছয় নম্বর নথিটা বেশিরভাগ মানুষের কাছে থাকার কথা নয়। পাসপোর্ট তো সারা দেশের এক শতাংশও মানুষের কাছে নেই। আমাদের মতো দেশে সবচেয়ে সমস্যা হল অশিক্ষা, দারিদ্র্য। নব্বইয়ের দশকের আগে সন্তানের জন্ম গ্রামের দিকে মূলত বাড়িতেই হত। কোটি কোটি মানুষের কাছে সেই অর্থে জন্ম ও জন্মস্থানের কোনও শংসাপত্র পর্যন্ত নেই।

এই অবস্থায় গণতন্ত্রের কাজ হল ভোটার লিস্টে নাম তোলার প্রক্রিয়াটাকে সরল করা। এতদিন তা হয়ে এসেছে কিন্তু বর্তমান নির্বাচন কমিশন পরিকল্পিতভাবে প্রক্রিয়াটিকে জটিল করে নাগরিকদের আতঙ্কিত করতে চাইছে। এখানে কেন নির্দিষ্টভাবে বিহারে ২০০৩ সালের ভোটার তালিকাকে মাপকাঠি মানা হচ্ছে তার কোনও যুক্তিগ্রাহ্য উত্তর নেই। বলা হচ্ছে পূর্ববর্তী এসআইআর ২০০৩ সালে হয়েছিল। কিন্তু সেবার এইভাবে কোনও প্রক্রিয়া চালানো হয়নি যাতে ভোটার তালিকায় যাদের নাম আছে তাদেরও ফর্ম জমা করতে হয়। এমনকি নির্বাচন কমিশন এমন কোনও সার্কুলার দেখাতে পারেনি যাতে এবারে যে নথিগুলো চাওয়া হয়েছে, সেবারও সেগুলোর উল্লেখ ছিল। সর্বোপরি সেবার নির্বাচন কমিশন তার নিজের দেওয়া ভোটার আইডেনটিটি কার্ডকে অস্বীকার করেনি।

সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ও প্রাবন্ধিক সঞ্জয় হেগড়ে সম্প্রতি ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেসে প্রকাশিত এক নিবন্ধে আমাদের সঠিকভাবে মনে করিয়ে দিয়েছেন যে যখন ভারত একটা প্রজাতন্ত্র হয়েছিল: সাক্ষরতা, আর্থিক রোজগার এবং জাতি বা লিঙ্গ-নির্বিশেষে সকল প্রাপ্তবয়স্ককে ভোটাধিকার দিয়েছিল। সংবিধান সভায় এ নিয়ে ব্যাপক আলোচনা হয়েছিল। অনেক সদস্য সন্দেহ প্রকাশ করেছিলেন যে দেশ এর জন্য প্রস্তুত কি না। কিন্তু ডঃ বিআর আম্বেদকর-সহ অন্যান্যরা জোর দিয়েছিলেন যে, সামাজিক ও অর্থনৈতিক সমতা অর্জনের পূর্বশর্ত হিসেবে রাজনৈতিক সমতাকে অগ্রাধিকার দিতে হবে। এই নীতি বাস্তবে রূপান্তরিত করেছিলেন দেশের প্রথম প্রধান নির্বাচন কমিশনার সুকুমার সেন। ১৭৩ মিলিয়ন সম্ভাব্য ভোটারের মুখোমুখি হন তিনি, যাঁদের বেশিরভাগই ছিলেন নিরক্ষর। কিন্তু তিনি উদ্ভাবনের রাস্তায় হেঁটেছিলেন। তিনি প্রতীক চালু করেছিলেন এবং প্রক্রিয়াগুলো এমনভাবে নকশা করেছিলেন যাতে অংশগ্রহণ সহজ হয়, দুরূহ নয়। ভারতের প্রথম নির্বাচন নিখুঁত ছিল না ঠিকই, কিন্তু সেটা ছিল অন্তর্ভুক্তিমূলক। বিপরীতে ভারতের ২৬তম মুখ্য নির্বাচন কমিশনার, জ্ঞানেশ কুমারের নেতৃত্বে বিহারের এই সংশোধন ঠিক তার বিপরীত। জন্মসনদ এবং পাসপোর্টের মতো বিরল নথির দাবি করে— যা জনসংখ্যার একটা অতি ক্ষুদ্র অংশের কাছে রয়েছে— নির্বাচন কমিশন এমন একটি মানদণ্ড খাড়া করেছে যা লক্ষ লক্ষ মানুষ পার হতে পারবে না। আধার কার্ড ও রেশন কার্ড, যা দরিদ্রদের কাছে ব্যাপকভাবে রয়েছে, তা গ্রহণযোগ্য হচ্ছে না। বিহারে আজ যে বিপুল সংখ্যক মানুষ ভোটাধিকার হারানোর ঝুঁকির মধ্যে রয়েছেন তার সম্পূর্ণ দায় নির্বাচন কমিশনের।

এটা কোনও বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। আমরা আসামে একই ধরনের কার্যক্রম দেখেছি। নির্বাচন কমিশনের কর্মকর্তারা লুঙ্গি-পরা, বাংলাভাষী মুসলিম বাসিন্দাদের ‘ডি-ভোটার’ হিসাবে শ্রেণিবদ্ধ করেছিলেন, যার ফলে হাজার হাজার মানুষ রাষ্ট্রহীন হয়ে পড়েছিল। আর এখন বিহারে সেই একই অন্যায্যতার পুনরাবৃত্তি ঘটতে চলেছে। বিহার ঐতিহাসিকভাবে দরিদ্র, বন্যাপ্রবণ ও পরিকাঠামোগতভাবে দুর্বল। নাগরিকদের বর্ষাকালে নির্দিষ্ট কিছু নির্ধারক নথি কঠোর সময়সীমার মধ্যে জমা করার নির্দেশ শুধু এক অবিবেচক পরিকল্পনা নয়, একই সঙ্গে ভোটমুখী বিহারে এক ঘৃণ্য রাজনৈতিক পরিকল্পনার অংশ। এই এসআইআর দরিদ্র, প্রান্তিক শ্রমজীবী মানুষদের ভোট দেওয়ার অধিকারের পক্ষে এক অন্তরায় এবং নাগরিকত্ব প্রমাণের দায়িত্ব উল্টোপক্ষের ঘাড়ে। নাগরিকদের প্রমাণ করতে হবে যে তারা এই দেশের লোক, রাষ্ট্রকে তাদের বেনাগরিক প্রমাণ করার দায় নিতে হবে না। সমাজকর্মী যোগেন্দ্র যাদব সর্বোচ্চ আদালতে তাঁর গুরুত্বপূর্ণ সওয়ালে মনে করিয়ে দিয়েছেন যে বিহারে এসআইআরের পর প্রথম খসড়া ভোটার তালিকায় একটা নতুন নামও সংযুক্ত হয়নি। তাই এই সংশোধন চরিত্রগতভাবে বিয়োজনের। অ্যাসোসিয়েশন অব ডেমোক্রেটিক রিফর্মস সর্বোচ্চ আদালতে যে আবেদন রেখেছে তাতে সম্পূর্ণ সম্মতি দিয়ে বলতে পারি: “The declaration required under the SIR process violates article 326 of the constitution, as it mandates voters to provide documents provoking the citizenship and of their parents failing which their names may not be added to the draft electoral roll or may be deleted from it.”

এই এসআইআর নাগরিকত্ব নির্দিষ্ট করার মসিহা হিসাবে নিজেকে প্রমাণ করতে চাইছে যা অসাংবিধানিক। ভোটার তালিকা সংশোধনের নামে এটা ঘুরপথে বহুবিতর্কিত এনআরসিকে কার্যকর করতে চাইছে। নাগরিকত্ব প্রশ্নে কিছু মামলার রায়ের কথা উল্লেখ করা আবশ্যক। ইন্দরজিত বড়ুয়া বনাম নির্বাচন কমিশন (১৯৮৫) মামলায় সর্বোচ্চ আদালত স্পষ্টভাবে বলেছিল যে, কোনও ব্যক্তির নাম একবার ভোটার তালিকায় উঠেছে, সেটাই তার নাগরিকত্বের একটা শক্তিশালী প্রমাণ। তাকে আবার আলাদা করে ‘নাগরিক কি না’ সেটা প্রমাণ করতে বলা ঠিক নয়। ভোটার তালিকা তৈরির সময় নাগরিক না হলে নাম তোলা যাবে না— এটা ঠিক। কিন্তু একবার যদি কারও নাম ভোটার তালিকায় উঠে যায় তাহলে ধরেই নেওয়া হবে সে ভারতের নাগরিক। কেউ যদি দাবি করে ওই ব্যক্তি নাগরিক নয়, তাহলে তার উপরেই দায়িত্ব পড়ে প্রমাণ করার ভোটার তালিকায় নাম থাকা ব্যক্তি নাগরিক নয়। লাল বাবু হুসেন বনাম নির্বাচনী আধিকারিক (১৯৯৫) মামলায় সর্বোচ্চ আদালত বলে, ভোটার তালিকা থেকে কারও নাম বাদ দেওয়া খুব গুরুতর বিষয়। এটা সহজে বা সন্দেহের বশে করা যায় না। এছাড়া কারও নাম বাদ দিতে হলে তাকে আগে জানাতে হবে এবং তার বক্তব্য বলার সুযোগ দিতে হবে। এমনকি মামেজা খাতুন ডি-ভোটার মামলায় (২০২৫) সর্বোচ্চ আদালত বলে যে, বুথস্তরের আধিকারিকরা (বিএলও) বিদেশি সনাক্ত করতে পারেন, কিন্তু নাম কাটার ক্ষেত্রে ফরেন ট্রাইবুনালই শেষ কথা।

নির্বাচন কমিশন যেভাবে বিহারে এসআইআর প্রক্রিয়াটি সম্পাদিত করছে, সেই প্রক্রিয়াটি চূড়ান্ত অগণতান্ত্রিক। বিহারে প্রথম দফার খসড়া ভোটার তালিকা প্রকাশের পর তারা এখন বলছে এবার গোটা দেশে এসআইআর হবে। আমরা সবাই জানি যে নির্বাচন কমিশন একটি সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান যার কাজ হল মুক্ত ও স্বচ্ছ পদ্ধতিতে ভোটপ্রক্রিয়াটিকে সম্পাদন করা। এক্ষেত্রে সরকারি মেশিনারির সাহায্য নিলেও নির্বাচন কমিশন একটি স্বাধীন ও স্বতন্ত্র সংগঠন, যার কাজকর্ম পরিচালনার সঙ্গে সরকারের কোনও সম্পর্ক থাকার কথা নয়। নির্বাচন তালিকা শুদ্ধিকরণের কাজটা সুষ্ঠু নির্বাচনের স্বার্থে তাকে নিয়মিতভাবে সম্পাদন করতে হয়। এবার বলা হচ্ছে নির্বাচন কমিশন একটি সমীক্ষা করিয়েছিল যাতে না কি বোঝা গেছে যে ভোটার তালিকায় অনেক গন্ডগোল আছে। এখন নিরপেক্ষতার স্বার্থে প্রথম কমিশনের উচিত ছিল এই সমীক্ষা ও তার থেকে সংশোধনের নবতম পদ্ধতি এসআইআরের খসড়া প্রস্তাবকে জনসমক্ষে আনা ও নির্বাচন প্রক্রিয়ার সঙ্গে যুক্ত সমস্ত পক্ষের সঙ্গে একটা আলোচনার প্রক্রিয়া শুরু করা। কিন্তু এক্ষেত্রে তা করা হয়নি বরং আদ্যন্ত গোপনীয়তা বজায় রেখে একটা তুঘলকি ফরমান জারি করা হয়েছে। এরপর যে অল্প সময়ের মধ্যে অত্যন্ত তাড়াহুড়ো করে প্রথম পর্বটি সম্পাদিত হয়েছে তা সমস্ত বিহারে এক নৈরাজ্যের সৃষ্টি করেছে। কীভাবে ফর্ম দেওয়া ও জমা দেওয়া হচ্ছে, কীভাবে বুথলেভেল অফিসাররা উপযুক্ত পরিকাঠামোর অভাবে গোটা বিষয়টাকে সারতে চাইছেন তার একাধিক ভিডিও প্রমাণ বিশিষ্ট সাংবাদিক আঞ্জুম আমাদের সামনে রেখেছেন। এরপর জানা গেল ৬৫ লক্ষ নাম বাদ গেছে। কমিশন জানায় এর মধ্যে ২২ লক্ষ মৃত এবং ৩৬ লক্ষের কোনও খবর নেই। ধরে নেওয়া হচ্ছে এদের যেহেতু কোনও খোঁজ মেলেনি তাই হয় এরা বিহার থেকে পাকাপাকিভাবে স্থানান্তরিত বা not found। এখন স্বচ্ছতা দাবি করে যে, এই নামের তালিকা এবং কেন তাদের তালিকা থেকে নাম বাদ পড়ল, সেটা জানার অধিকার নাগরিকের থাকে। কিন্তু নির্বাচন কমিশন জানায় তারা ভোটারকে এই তালিকা দিতে বাধ্য নয়। এর জন্য একজন ভোটারকে রাজনৈতিক দলের এজেন্টের সঙ্গে যোগাযোগ করতে হবে তার নাম বাদ পড়ল কি না, তা জানার জন্যে। এটা একজন নাগরিকের সাংবিধানিক অধিকারের সরাসরি উল্লঙ্ঘন। আদালতে মামলা চলাকালীন যখন সমাজকর্মী যোগেন্দ্র যাদব একাধিক কমিশনের তালিকায় ‘মৃত’ ভোটারকে জীবিত অবস্থায় হাজির করেন তখন ব্যাপক হইচই শুরু হয়। এই অবস্থায় (১৪ আগস্ট, ২০২৫) আদালত নির্দেশ দেয় যে এই ৬৫ লাখের পূর্ণাঙ্গ তালিকা নির্বাচন কমিশনের ওয়েবসাইটে প্রকাশ করতে হবে। এমনকি বাড়ির ঠিকানা বা এই ধরনের কোনও কিছুর প্রমাণ হিসাবে আধারকে মান্যতা দেওয়ার কথাও বলা হয়েছে। গোটা বিষয়টা এই মুহূর্তে আদালতের বিচারাধীন, কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে বাবরি মসজিদ ধ্বংস-সহ বিভিন্ন মামলায় আদালতের রায়ের পর খুব বেশি আশা না রাখাই ভালো। আদালত যেভাবে ১১টি নথির তালিকাকে ভোটারবান্ধব বলেছে তা বাস্তব অবস্থার সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ নয়। বিচারপ্রক্রিয়ায় একটি গুরুত্বপূর্ণ পর্যবেক্ষণ হল এই এসআইআরের মাধ্যমে নাগরিকত্ব যাচাই করার সাংবিধানিক অধিকার কমিশনের আছে কি না, তা নিয়ে সর্বোচ্চ আদালতের প্রশ্ন! এই একটা পয়েন্টে এই মর্মে এসআইআরকে বাতিল করার দাবি তোলা দরকার।

এই বিশেষ নিবিড় সংশোধনী অবশ্যই বিজেপির রাজনৈতিক অ্যাজেন্ডার মধ্যে রয়েছে। এই অমৃতকালের বৈশিষ্ট্য হল প্রথমে শাসক দল ও তার শাখা সংগঠনের পক্ষে একটা রাজনৈতিক ন্যারেটিভ তৈরি করা হয়, তারপর সরকার তাকে সমর্থন করে। এরপর সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানগুলো আইনি পদ্ধতিতে তার উপর ন্যায্যতার সিলমোহর দেয়। দীর্ঘদিন ধরে অনুপ্রবেশকারী, বাংলাদেশি, রোহিঙ্গা, বহিরাগত (এগুলোর মূল লক্ষ্য অবশ্যই সংখ্যালঘু মুসলমান) কথাগুলোকে ভোটার তালিকার সঙ্গে যুক্ত করে রাজনৈতিক প্রচার চলেছে। বলা হচ্ছে এরা ভোটার তালিকায় বসে দেশের ক্ষতি করছে, তাই এদের তাড়াতেই হবে। এটা বিহার দিয়ে শুরু হয়েছে কারণ সামনেই সেখানে নির্বাচন। বিহারের মতো রাজ্য, যেখানে খুব কম মার্জিনে ভোটের ফয়সালা হয়, সেখানে বিধানসভা পিছু ২০-২২ হাজার ভোটারের নাম বাদ গেলে গোটা ফলাফলটাই ওলটপালট হয়ে যেতে পারে। কিন্তু মজা হল বিহারে এই তালিকা সংশোধনে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হবে সংখ্যাগুরু হিন্দুরা। খসড়া তালিকা বিশ্লেষণ করে নিউজ ওয়েব পোর্টাল স্ক্রল যে হিসাব দিয়েছে তাতে এই হিসেবটা পরিষ্কার। এরপর লক্ষ্য নির্বাচনমুখী রাজ্য পশ্চিমবঙ্গ। সেখানে এসআইআর শুরু হওয়ার আগেই বিজেপি নেতারা বলতে শুরু করেছেন যে বিহারে ৬৫ লক্ষ হলে, এ-রাজ্যে এক কোটির বেশি মানুষের নাম ভোটার তালিকা থেকে বাদ যাবে। বলা হচ্ছে এই এক কোটির বেশিটাই না কি বাংলাদেশি বা রোহিঙ্গা। এই রাজনৈতিক প্রচার ও মানুষের মধ্যে আতঙ্ক তৈরি করাটাই লক্ষ্য। ২০০২ সালে প্রকাশিত পশ্চিমবঙ্গের ভোটার তালিকা হবে মাপকাঠি, তাই গত কয়েকদিন ধরে মানুষ চেষ্টা করছেন তাদের নাম সেই তালিকায় আছে কি না, তা দেখার। আসলে এগুলোর মধ্যে দিয়ে নাগরিকত্বের প্রশ্নটি সামনে আনা হচ্ছে। এনআরসি ও সিএএ-কে ন্যায্যতা প্রদান এই সংশোধনীর একমাত্র লক্ষ্য।

পূর্বে উল্লেখিত লেখায় সন্তোষ হেগড়ে একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন তুলেছেন। তিনি মনে করিয়ে দিয়েছেন যে এই এসআইআর যদি অপরীক্ষিতভাবে চলতে থাকে, আমরা এক বিপজ্জনক অঞ্চলে প্রবেশ করব। ভোটাধিকার হয়ে উঠতে পারে নথিভুক্ত মধ্যবিত্তের— শহুরে, বেতনভোগী, প্রযুক্তিসক্ষম একটি বিশেষাধিকার, যখন দরিদ্র, বাস্তুচ্যুত এবং নথিহীনরা পিছিয়ে পড়ে থাকবে। আমরা দুটো ভারত তৈরির ঝুঁকির মধ্যে রয়েছি; একটায় ভোটাধিকার থাকবে, অন্যটায় নয়। রাজনৈতিক দলগুলো তখন কেবল তাদের জন্য কাজ করবে যাদের অংশগ্রহণ গোনা যায়— আক্ষরিক অর্থে। যাদের ভোট নেই, তারা নীতিনির্ধারণ, কল্যাণ এবং ন্যায়বিচারে উপেক্ষিত হবে। এই মুহূর্তে প্রতিরোধের প্রয়োজন— কেবল আদালত থেকে নয়, নাগরিক, সুশীল সমাজ, সংসদ এবং অবশ্যই রাস্তা থেকে। আমাদের অবশ্যই এই নীতি পুনরুদ্ধার করতে হবে যে, ভোটাধিকার জনগণের, কাগজপত্রের নয়। আমাদের নিঃসঙ্কোচে বলতে হবে, যে রাষ্ট্র নাগরিক তথা সাধারণ মানুষকে স্বস্তিতে থাকতে দেয় না, তাকে ভীত ও সন্ত্রস্ত করে তোলে, তা অমানবিক। এই ব্যবস্থার বদল চাওয়াই সময়ের দাবি।

 

ঋণস্বীকার: Nudges from the Court, silence from the Commission০. Santosh Hedge. Indian Express.


*মতামত ব্যক্তিগত

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 5217 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

Be the first to comment

আপনার মতামত...