ধর্ষকের নাম সমাজ, ধর্ষক সংসার, ইতিহাস বড় করুণ— দুই

অম্লান চক্রবর্ত্তী

 

পূর্বকথা

পৃথিবীর কিছু দেশে ‘জেনিটাল মিউটিলেশান’ প্রথা চালু আছে। এই প্রথা অনুযায়ী, বয়ঃসন্ধির আগে বালিকাদের, এমনকী শিশুদের যোনিপথে একটি অপারেশন করে ক্লিটোরিস, ইনার ল্যাবিয়া, আউটার ল্যাবিয়া বাদ দেওয়া হয়। এর বিভিন্ন ভাগ আছে। কোথাও হয়তো শুধু ক্লিটোরাল হুড বাদ দেওয়া হয়, কোথাও বা যে-কটি নাম বললাম, সবকটিই বাদ দেওয়া হয়। এর কারণ, নারীর মধ্যে যাতে কোনও যৌন উদ্দীপনা সৃষ্টি না হয়। শুধুমাত্র পুরুষের ইচ্ছায় নারী যৌনতায় লিপ্ত হবেন, এবং তা একটি সন্তান উৎপাদনের প্রক্রিয়া হিসাবেই বিবেচিত হবে। অর্থাৎ, নারীর জন্ম শুধুমাত্র সন্তান উৎপাদনের কারখানা হওয়ার জন্য।

এই প্রথা কোনও ধর্মগ্রন্থে লেখা নেই। কোনও দেশেই বৈধ নয়। তবু ইউনিসেফের রিপোর্ট অনুযায়ী ২০২৪ সালে সারা বিশ্বে ২৩০ মিলিয়ন মহিলা আছেন, যাঁদের জেনিটাল মিউটিলেশন হযেছে। এঁদের মধ্যে আফ্রিকায় ১৪৪ মিলিয়ন, দক্ষিণ এশিয়া-সহ বিভিন্ন এশিয়ার দেশে ৮০ মিলিয়ন এবং আরব দুনিয়ায় ৬ মিলিয়ন নারী এই বর্বর প্রথার স্বীকার। বর্তমানে পৃথিবীতে নারীর সংখ্যা ৪.০৬ বিলিয়ন। অর্থাৎ, অর্থাৎ বিশ্বের প্রতি ২০ জন নারীর মধ্যে একজন এই ভয়ঙ্কর জীবন যাপন করছেন।

তবে নারীকে কোনও বস্তু রূপে ভাবা, ইংরেজিতে যাকে বলে ‘অবজেক্টিফিকেশন’, নানা রূপে কিন্তু তৃতীয় বিশ্বে প্রবলভাবে আছে। একটি মেয়ে বড় হওয়ার সময় থেকেই তাকে ‘পরিবারের ইজ্জত’, ‘বংশের মানরক্ষা’ ইত্যাদি শুনতে হয় বা বলা ভাল, এই বোধগুলি তার মধ্যে ‘ইনজেক্ট’ করা হয়। যাতে সে নিজের ইচ্ছায় প্রেম বা সহবাস না করে। বহু বাবা-মা ছেলের বিয়ে দেন এই ইচ্ছায় যে অতি দ্রুত তাঁরা নাতি-নাতনির মুখ দেখবেন। ছেলের যৌন আনন্দ বা প্রেমময় জীবনলাভ এখানে গৌণ বা বলা চলে ভাবনাতেও আসে না। এবং ছেলের বিয়ের পর পরিবারে আগত মেয়েটিকেও শুনতে হয় ‘পরিবারের ইজ্জত’, ‘বংশের মানরক্ষা’র মতো শব্দবন্ধ।

এই অবজেক্টিফিকেশন কিন্তু পরিবারের বাইরেও প্রতিদিন, প্রতিনিয়ত অনুভব করতে হয় একটি মেয়েকে। ট্রেন-বাস-ট্রামে ঘটে চলা প্রত্যেকটি মেয়েকে কনুইয়ের অবাঞ্ছিত এবং বিরক্তিকর ধাক্কা সহ্য করতে হয়। একবার এক সহকর্মী বেশ তারিয়ে-তারিয়ে তার কনুই মারার গল্প করছিল অফিসে। তাকে আমরা জিজ্ঞাসা করেছিলাম, কনুই মেরে কী সুখ পেলি? তার উত্তর ছিল, “ভাই, একটা মেয়ের বুকে কনুই মেরে যে মজা, কী বলব! এমনিতে তো হাত দিতে দেবে না। তাই জোর করেই কনুইয়ের ধাক্কায় একটু ব্যথাও দিলাম।” অর্থাৎ, নারী মানেই একটি বস্তু, যাকে কষ্ট দিয়ে, অসম্মান করে, কিছু পুরুষ সুখ পায়। ছিনিয়ে নিয়ে, কষ্ট দেওয়ার মধ্যেই পৈশাচিক উল্লাস। ধর্ষণের প্রথম পদক্ষেপও।

এমনই একটি বীভৎস মজার ঘটনা বলি। কলকাতার একটি কম-সংখ্যক কর্মচারীর অফিসের ঘটনা এটি। মালিক-সহ জনা আষ্টেক পুরুষ কর্মচারীর অফিসে এক তরুণী কাজে যোগ দেন। সম্পূর্ণ নিজের যোগ্যতায় যোগদান করেন। তরুণী ছিলেন অত্যন্ত ব্যক্তিত্বসম্পন্ন মানুষ। কয়েকজন পুরুষ কর্মচারী তরুণীর ব্যক্তিত্বের সঙ্গে পেরে না উঠে একটি নোংরা খেলা শুরু করল। কোম্পানিতে একটিই বাথরুম ছিল। পুরুষ কর্মচারীরা কমোডের রিং ফেলে তার উপর মূত্রত্যাগ করতে শুরু করল। মেয়েটি বুঝে গেল, তাকে চাকরি ছাড়তে হবে। এই অপরাধীদের একজন সল্টলেকের এক পানশালার স্মোকিং জোনে ঘটনাটি বেশ রসিয়ে বলছিল। আমিও ঘটনাচক্রে তখনই সিগারেট খেতে গেছি। যখন তাকে জিজ্ঞাসা করা হয়, এই ইতরামির কারণ, সে বলে, “বেশ করেছি। ওই মালের এত গুমোর কিসের? আফটার অল তো মেয়ে, কোনও ছেলের ভোগেই লাগবে।”

পাঠকগণ, লক্ষ্য করুন, তিনটি ঘটনার প্রত্যেকটিতেই একজন ধর্ষকাম পুরুষের একটি মেয়েকে বস্তুরূপে চিহ্নিত করা কী ভয়ঙ্কর রূপে প্রকাশ পাচ্ছে।

এবার একটু পারিবারিক ধর্ষণের দিকে চোখ রাখা যাক।

হাসতে হাসতে বাপের দেওয়া খাটের উপর
চিৎ হয়ে তুই উগড়ে দিতিস সতীত্ব তোর

—কবীর সুমন

ভারত তথা তৃতীয় বিশ্বে বৈবাহিক জীবনের প্রথম রাতে স্ত্রীর সতীত্ব পরীক্ষা করার চল আছে। শুভরাতে সাদা চাদর বিছিয়ে রাখা হয়। এস্থেটিকস বা নন্দনবোধের জন্য হয়তো সাদা চাদরের কোনও বিকল্প নেই। কিন্তু অধিকাংশ ক্ষেত্রেই এর কারণ থাকে, প্রথম সহবাসে নারীর রক্তপাত বোঝার জন্য। এর থেকে প্রমাণ করা হয় যে মেয়েটি অক্ষতযোনি। রক্তের দাগ সাদা চাদরে না থাকায় অত্যাচার এমনকি, বধূহত্যার ঘটনাও ঘটে। অর্থাৎ, যে বংশের ইজ্জতের কথা আগের স্তবকে উল্লেখ করলাম, ঠিক সেই কারণেই এই পরীক্ষা।

সাদা চাদরে সতীত্ব পরীক্ষা কিন্তু সুনির্দিষ্ট কোনও ধর্ম বা শ্রেণিবিশেষে নয়, প্রায় সবকটি ধর্ম এবং আর্থিক শ্রেণির পরিবারেই এই প্রথার চল আছে।

এছাড়াও পারিবারিক হিংসা বা ‘ডোমেস্টিক ভায়োলেন্স’ ভারতের প্রায় প্রতিটি মেয়েকেই সহ্য করতে হয়। এর মধ্যে সবচেয়ে ভয়ঙ্কর হল, বৈবাহিক ধর্ষণ বা ‘ম্যারিটাল রেপ’। ন্যাশনাল ফ্যামিলি হেলথ সার্ভের (NFHS) একটি রিপোর্ট জানাচ্ছে, ভারতে ৮২ শতাংশ নারী ম্যারিটাল রেপের শিকার। এবং তার মধ্যে বহু ঘটনা শিউরে ওঠার মতো।

আর গৃহহিংসা? তার জন্য কষ্ট করে তথ্য সংগ্রহেরও দরকার পড়ে না। রবীন্দ্রনাথের ‘দেনাপাওনা’ থেকে শুরু হয়ে ১৯৮৩ সালের দেবযানি বণিক মামলা বা হালফিল খবরের কাগজে চোখ রাখলেই জানা যায়।

তৃতীয় বিশ্বে জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত প্রতিনিয়ত প্রতিটি মেয়ের উপর চলছে অবিরাম সামাজিক ও পারিবারিক ধর্ষণ।

একটি দম্পতি সদ্য বিয়ে করেছে। বিয়ের আগে প্রেম ছিল। একসঙ্গে একটা ঘর বাঁধার স্বপ্ন দেখেছে। বিয়ের সময় দেখা গেলো, চিরাচরিত প্রথা অনুযায়ী মেয়েটিকে নিজের বাড়ি ছেড়ে আসতে হল শ্বশুরবাড়িতে। নিজের পড়ার টেবিল, বইয়ের আলমারি, কফির কাপ, বেডরুম সব। ছেলেটিকে কিন্তু ছাড়তে হল না। মানসিক বৈবাহিক ধর্ষণের সূত্রপাত এখান থেকেই। মেয়েটিকে খেতে বসেও শাশুড়ির থেকে শুনতে হচ্ছে, “আজকাল তো আর বেড-টি পাই না।” অথচ, যে এই বাড়িতে বৌ হয়ে এল, তারও কিন্তু একটা ‘বেড টি’ পাওয়ার অভ্যাস ছিল। বিগত ২৫ বছরে পরিস্থিতি কিছুটা বদলেছে। এখন একটু সুস্থ চিন্তার ছেলেরাও বিয়ের পর আলাদা থাকতে চায়। কিন্তু তার সম্পূর্ণ দোষ গিয়ে পড়ে ছেলের বৌয়ের উপর।

এরপর শুরু হয় সন্তান ধারণের জন্য চাপ দেওয়া। ‘আমরা কবে নাতি-নাতনির মুখ দেখব’ বা ‘অমুকের বাচ্চা কী মিষ্টি হয়েছে’ জাতীয় মানসিক চাপগুলি আসতে থাকে মেয়েটির উপর। এবং অধিকাংশ ক্ষেত্রেই রাতে খাওয়ার সময় এই প্রসঙ্গগুলি উত্থাপন করা হয়। অর্থাৎ, শ্বশুরবাড়িতে খেতে বসেও শান্তি পায় না বাড়ির বৌ। আত্মীয়স্বজন এবং পাড়াপ্রতিবেশীও সাক্ষাতের সময় প্রথমিক কুশল বিনিময়ের আগেও একই প্রশ্ন করেন। মানসিক ধর্ষণ প্রতিনিয়ত চলতেই থাকে।

এ তো গেল, শিক্ষিত মধ্যবিত্ত সম্প্রদায়ের কথা। কিন্তু নিম্নবিত্ত সমাজের প্রতি একবার দৃষ্টিপাত করা যাক। সেখানে সমস্যা আরও গভীরে। ২০১৫-১৬ সালে ইউনিসেফের রিপোর্ট অনুযায়ী, ভারতে বাল্যবিবাহের হার ২৭ শতাংশ। একশো তিরিশ কোটি জনসংখ্যার দেশে এই হার যথেষ্ট ভয়াবহ। এবং এর মধ্যে পশ্চিমবঙ্গ-বিহার-ঝাড়খণ্ডেই ৪০ শতাংশ বাল্যবিবাহের ঘটনা ঘটছে। রামমমোহন-বিদ্যাসাগরের বাংলায় নাবালিকা মেয়েদের সামাজিকভাবে যৌনতায় লিপ্ত হতে বাধ্য করছে তাদের পরিবার এবং সমাজ। নাবালিকার সঙ্গে সম্মতিসূচক সহবাসও ধর্ষণ।

অধিকাংশ বাল্যবিবাহেই মেয়েরা গৃহহিংসার শিকার হয়। এই বিষয় ইন্টারন্যাশানাল সেন্টার ফর রিসার্চ অন উওম্যান (ICRW) একটি রিপোর্ট প্রকাশ করেছিল। সেখান থেকে প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী ১৮ বছরের কমবয়সি বিবাহিতাদের প্রায় প্রতিনিয়তই শারীরিক নির্যাতন সহ্য করতে হয়, এবং সম্মতির বিরুদ্ধেও যৌনতায় লিপ্ত হতে হয়। যৌননির্যাতনের ফলে বহু মেয়েই ‘ট্রমা’য় আক্রান্ত।

অল্প বয়সে বিবাহের ফলে জন্মনিরোধক ওষুধ ব্যবহার করার ধারণা গড়ে উঠছে না বিবাহিত মেয়েদের মধ্যে এবং তাঁদের স্বামীরাও প্রয়োজনীয় সতর্কতা নিতে চান না। পরিণাম, কম বয়সে গর্ভধারণ। হয় সন্তানের জন্মকালে মৃত্যু ঘটছে নাবালিকা গর্ভধারিণীর বা সন্তানদের মৃত্যু ঘটছে। ১৫ থেকে ১৯ বছরের মধ্যে গর্ভধারণ, প্রসবকালে মৃত্যুর সম্ভাবনা দ্বিগুণ করে। ১৪ বছরের নিচে সেই সম্ভাবনা হয় ৫ গুণ। আর সদ্যোজাতর মৃত্যুর সম্ভাবনাও ৬০ শতাংশ বাড়িয়ে দেয়। তবু যে সন্তানরা জন্মায়, তাদের অপুষ্টির পরিমাণ ভয়াবহ।

ভারতবর্ষের ন্যায় সংহিতায় ‘চাইল্ড ম্যারেজ রেস্ট্রিকশান অ্যাক্ট’ রয়েছে। কিন্তু তা সত্ত্বেও যখন একটি দেশে ৩০-৩৫ কোটি বাল্যবিবাহ ঘটছে, তখন প্রশ্ন থেকেই যায়, আইনকে কি আদৌ প্রত্যন্ত গ্রামে পৌঁছতে দেওয়া হচ্ছে?

The answer is blowing in the wind…

Bob Dylan

 

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 4953 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

Be the first to comment

আপনার মতামত...