
প্রবুদ্ধ বাগচী
প্রায় সাড়ে তিন দশক আগের এক বৈশাখী প্রভাতে আমরা তিন সহপাঠী এক রোমাঞ্চিত সিদ্ধান্তের কিনারে উপনীত হয়েছিলাম। স্বদেশ-জাগরণ বা দেশব্রত কিংবা সমাজসংস্কার এসব কিছুই নয়, স্রেফ সকালে উঠে আমরা এসে মিলিত হয়েছিলাম এসপ্ল্যানেড বাসগুমটিতে। সেখান থেকে বাস ধরে ইছামতীর তীরে টাকি। কোনও হোটেল বুকিং বা রাত্রিবাসের প্রস্তুতি নেই, কার্যত সঙ্গে সামান্য একটা মানিব্যাগ ছাড়া দ্বিতীয় কিছুও নেই, আর তার অবস্থাও যে দশ মাসের গর্ভিনীর মতো টইটম্বুর এমন নয়। সারাদিন নদীর ধারের চওড়া বসার জায়গায় আর গাছের তলায় বসে গুলতানি, কখনও বা হাতের নাগালে থাকা গাছের ডাল বেয়ে দিব্যি উঠে যাওয়া এবং সেই অবস্থায় আলতো করে শুয়ে থাকবার প্রয়াস। তিনজন টগবগে তরুণ এক জায়গায় হলে যা হতে পারে আরকি। দুপুরের খাবার পাওয়া গিয়েছিল নদীপাড়ের এক সরকারি অতিথিশালায়। তখনও ইছামতীর পাড়ে বেপরোয়া হোটেল-ব্যবসা গড়ে ওঠেনি, পর্যটকদের আনাগোনা ছিল সীমিত। ফলে শান্ত গ্রীষ্মের দুপুরে নিতান্তই গ্রাম্য জনপদের যে শিথিল চেহারা থাকে তার ছোঁয়া লাগছিল আমাদের গায়েও। প্রায় সারাদিন নদীর পাড়ে বসে থাকলেও কেউ আমাদের কোনও কিছু বাড়তি জিজ্ঞাসা করেনি বা উত্যক্ত করার চেষ্টা করেনি। কিন্তু এই কাহিনিকে ফিরে দেখার প্রসঙ্গ আসলে ভিন্ন। সকালে ধর্মতলা থেকে হাসনাবাদগামী বাস আমাদের টাকিতে নামিয়ে দিয়ে গেলেও ফেরার পথে তার কোনও হদিশ আমাদের জানা ছিল না। ফলে টাকি রোডে এসে কলকাতা ফেরার বাসের খোঁজ করতে গিয়ে দেখা গেল বেশ জটিল সমস্যায় আমরা জড়িয়ে গিয়েছি। কলকাতাগামী শেষ সরকারি বাস ততক্ষণে ছেড়ে চলে গেছে। হাতে আছে টাকি থেকে শ্যামবাজারগামী একটিমাত্র বেসরকারি বাসরুট— স্ট্যান্ডে গিয়ে জানা গেল সোয়া সাতটার আগে পরের বাস ছাড়বে না। ছাড়লও। কিন্তু এক্সপ্রেস বাসের তুলনায় এর গতি ধীর, বিভিন্ন জায়গায় অনাবশ্যক থামিয়ে থামিয়ে যাত্রী তোলার রীতি গতানুগতিক। একটা সময় আমরা বেশ গভীর দুশ্চিন্তায় পড়লাম, শ্যামবাজারে বেশি রাতে আমাদের নামিয়ে দিলে আমরা যে যার বাড়ি ফেরার বাস পাব তো? রাত সাড়ে দশটা নাগাদ মোটামুটি ফাঁকা পাঁচমাথার মোড়ে নেমে আমরা যখন আশঙ্কায় নীল ঠিক তখনই সেখানে দেখা গেল দমদম স্টেশন থেকে ছেড়ে আসা সরকারি রুটে এগারো-এ নম্বরের একটি লাল ডবলডেকার যার গন্তব্য হাওড়া স্টেশন। বাকি দুজনের বাড়ি ছিল সুদূর দক্ষিণে, আমার চকিত পরামর্শে তাদেরও ইশারা করলাম ওই বাসে উঠতে। কী আশ্চর্য যোগ, মোটামুটি ফাঁকা রাস্তায় এগারোটার মধ্যেই সেই বাস আমাদের পৌছে দিল হাওড়ায়, আর, প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই লোক্যাল ট্রেন ধরে আমাদের বাড়ি ফেরা।
এই আখ্যানের বছর খানেক পরে, সেদিন মান্না দে অনুষ্ঠান করতে এসেছিলেন যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে। ছাত্র সংসদ আয়োজিত সেই অনুষ্ঠান শুরু হল ছটার পর। প্রায় নটা নাগাদ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বেরিয়ে সরাসরি হাওড়া স্টেশন আসার বাস পেতে কোনও সমস্যা হয়নি। বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রায় চল্লিশ কিলোমিটার দূরের বাড়িতে সেদিন ফিরে এসেছিলাম সুবিধেজনক সময়েই। এই সময়ের আশেপাশেই প্রায় নিয়মিত নাটক দেখতে যেতাম অ্যাকাডেমি বা রবীন্দ্রসদনে। নটা-সাড়ে নটায় নাটক শেষে রবীন্দ্রসদনের সামনে থেকে প্রচুর বাস পাওয়া যেত সব রুটেই। আধঘণ্টার মধ্যে হাওড়া চলে আসা যেত সেখান থেকে। মনে করতেই হচ্ছে, নয়ের দশকের মাঝামাঝি যাদবপুর ঝিল রোডে এক বন্ধুর বাড়ি সান্ধ্য জমায়েত শেষে সাড়ে নটা নাগাদ সেলিমপুর বাস স্টপেজ থেকে দিব্যি বাস ধরে উত্তর শহরতলির বাসায় ফিরে আসা যেত। অন্তত এটা কোনওদিন মাথায় আসেনি যে যাতায়াতের জন্য পাবলিক বাসের ঘাটতি হবে আর তার জন্য চোরা একরকম অসোয়াস্তি ছেয়ে থাকবে ভিতরে ভিতরে। যেমনটা হল মাত্রই কিছুকাল আগে। শনিবার সন্ধেয় গিরিশ মঞ্চের নির্ধারিত নাটক শেষ হল পৌনে নটায় অথচ বাগবাজার থেকে মাত্রই তিন-চার কিলোমিটার দূরের বাড়ি ফেরার জন্য নাজেহাল হয়ে যেতে হল আমার মতো আরও অনেককে। রাত নটা বাজার আগেই রাস্তায় বেসরকারি বা সরকারি গণপরিবহন প্রায় উধাও। কোথাও বৃষ্টি নেই, বিপর্যয় নেই, জ্যামজট নেই। তবুও। দেখা গেল, সকলেই যে যার মোবাইলে অ্যাপক্যাব বুকিঙের চেষ্টা করছেন, যাঁরা নিজেরা গাড়ি নিয়ে এসেছিলেন তাঁরা হুস করে আমাদের মতো অপেক্ষমান যাত্রীদের ওপর দিয়ে পাড়ি দিলেন যে যাঁর গন্তব্যে। অ্যাপক্যাবের চেনা হিসেবই হল সব সময়েই তাদের ভাড়া ‘স্লাইটলি হায়ার দ্যান নরম্যাল’— ফলে প্রভাতে, প্রখর দিবাকালে, সায়ংভাগে বা সাঁঝবেলায় তাতে আরোহন করতে গেলে ওই ‘হায়ার দ্যান নরম্যাল’ নামক একটি আর্থিক গুঁতো আপনাদের তাড়া করে ফিরবেই। এসব ক্ষেত্রে আগে কলকাতার ‘ত্যাঁদড়’ ট্যাক্সি ড্রাইভারদের আমরা তেড়ে গাল পাড়তাম, ভয় দেখাতাম, বলতাম, পুলিশ ডাকব। কিন্তু কর্পোরেট নিয়ন্ত্রিত বহুজাতিক অ্যাপ-ক্যাব কোম্পানির ওপর এসব ধমক-চমক বা ভয় দেখানো চলে না। যেটা চলে তা হল হয় বিকল্প কোনও ব্যবস্থার দিকে সরে যাওয়া অথবা মোবাইলের পর্দায় ‘অ্যাক্সেপ্ট’ বোতামটি স্পর্শ করে তাদের বেয়াদবিকে মোলায়েম করে মেনে নেওয়া।
একটা শহরে ভাড়াগাড়ি চাপবার জন্য কিছু মানুষ থাকবেন এটা স্বাভাবিক। থাকবেন এমন সচ্ছল মানুষ যাঁদের নিজস্ব গাড়ি আছে। কিন্তু কলকাতা এমন কোনও মেট্রোপলিস নয় যেখানে এই দু-রকমের মানুষের সংখ্যাই গর্বিতভাবে এত প্রচুর যে বাকিদের জন্য কোনও গণপরিবহনের ব্যবস্থা থাকা অবান্তর। কোনওদিনই তা ছিল না। শহর কলকাতার ওপর মানুষের চাপ প্রবল, দুটি প্রধান রেলস্টেশন ও সড়কপথে প্রচুর মানুষ নিজেদের জীবিকা ব্যবসা ও নানান প্রয়োজনে প্রতিদিন শহরে আসেন— আর্থিক বিচারে তাঁদের মধ্যে নানান স্তরভেদ আছে। তাঁদের সকলেই ক্যাব ভাড়া করবেন বা নিজের গাড়ি নিয়ে কাজ সারবেন এমন সঙ্গতি বেশিরভাগ মানুষের নেই। তার দরকারও কোনওদিন হয়নি। কলকাতার একটা পোক্ত গণপরিবহন ব্যবস্থা বরাবরই ছিল। কলকাতার ওপর বাস্তুহারা জনবসতির পুনর্বাসনের চাপ সামলাতে একসময় কলকাতা রাষ্ট্রীয় পরিবহন কর্পোরেশন তৈরি করা হয়েছিল— তাদের অধীনে সারা কলকাতার নানাপ্রান্তে ছড়িয়ে ছিল প্রচুর বাসরুট। পরে বেসরকারি বাসের পরিষেবাও ছড়িয়ে পড়ে গোটা শহর ও তার এলাকা ছাড়ানো জনপদগুলিতে। সঙ্গে ছিল ঐতিহ্যবাহী ট্রাম ও পরে জলপথ পরিবহন। বেসরকারি বড় বাসের সঙ্গে এসে পড়ে মিনিবাস। কলকাতার অফিসপাড়া বলে পরিচিত বিবাদী বাগের কেন্দ্রস্থলে যে মিনিবাসের স্ট্যান্ড ছিল সেখানে সকালের কাজের সময় নিত্যযাত্রী উপুড় করে দিত মিনিবাসগুলি— সুদূর ঠাকুরপুকুর থেকে সোদপুর পর্যন্ত ছিল তাদের সীমানা। বাবুঘাট বা শহিদ মিনারের তলা থেকে প্রচুর বাস ছাড়ত উত্তরে দক্ষিণে পুবে বা পশ্চিমের হাওড়ায়। প্রায় কিংবদন্তি হয়ে যাওয়া তিন নম্বর বাস বাগবাজার থেকে পৌঁছে দিত শ্রীরামপুরে— কলকাতা, উত্তর চব্বিশ পরগণা, হাওড়া ও হুগলি জেলা ছুঁয়ে যাওয়া এই বাসের ওপর নির্ভর করতেন এইসব এলাকার প্রচুর মানুষ। হাওড়া স্টেশন থেকে ছেড়ে ‘শহর দেখাতে দেখাতে নিয়ে চলা’ এইট-বি বাস অবশেষে পৌঁছাত তার যাদবপুরের গন্তব্যে। পাইকপাড়া থেকে বালিগঞ্জের মধ্যে চলা বিখ্যাত টু-বি বাসের অপেক্ষায় থেকে শিব্রাম রসিকতা করে বলেছিলেন ‘টু বি অর নট টু বি’। উল্টোডাঙ্গা ও যাদবপুরের মধ্যে চলা ন-নম্বর রুটের ডবল ডেকারে চলাচলের সূত্রেই কবি শঙ্খ ঘোষ পেয়ে গিয়েছিলেন তাঁর এক কবিতার মুহূর্ত— ‘ভিখিরি ছেলের অভিমান’। এতটা গুরুত্বপূর্ণ না হলেও কয়েকজন নিত্যযাত্রীকে চিনতাম যারা, এসপ্ল্যানেড এলাকায় বিভিন্ন অফিসে কাজ করতেন এবং ছুটির পরে প্রাইভেট বাসের জানলার ধারে একটা সিট নিয়ে বসে বাড়ি ফিরবেন বলে উল্টোদিকের বাস ধরে টার্মিনাসে চলে যেতেন। এর কিছুটা সীমাবদ্ধ শৌখিনতা আর বাকিটা অল্প খরচের বাধ্যতা। বাসের জানলার সিটের বসার একটা অন্তর্লীন চিরকেলে মায়াময়তা আছে বইকি— উড়োজাহাজের উইন্ডো সিটের থেকে তার মোহিনী আকর্ষণ কম কিসে? নব্বই দশকের শেষ পর্যন্ত হাওড়া ও শিয়ালদহ স্টেশন থেকে সকাল নটা থেকে এগারোটা অবধি বিবাদী বাগ হয়ে এসপ্ল্যানেড পর্যন্ত ‘অফিস টাইম স্পেশ্যাল’ বাস চালাত সিএসটিসি, যাত্রীর আধিক্য সামাল দিতে তার বেশিটাই ছিল দোতলা বাস। প্রচুর নিত্যযাত্রী এইসব বাসে যাতায়াত করতেন। সরকারি বা বেসরকারি বাসের পরিষেবা চালু থাকত মোটামুটি রাত এগারোটা পর্যন্ত— সবাই ভরসা করতেন রুটের শেষ বাসটা নিশ্চিত পাওয়া যাবে, পাওয়া যেতও।
তাহলে গত আড়াই দশকে কী এমন ঘটল যে এই ছবিটা এমন আমূল পালটে গেল?
আশির দশকে রাজ্যের ক্ষমতাসীন সরকার রাষ্ট্রীয় পরিবহনকে আর্থিক বিপর্যয় থেকে বাঁচাতে সরকারি স্তরে তুলনায় বেশি ভাড়ার বাস চালু করতে থাকেন। চালু ও লাভজনক রুটে সাবেক লালরঙের একতলা বা দোতলা বাস কমিয়ে প্রচলন হয় স্পেশাল বাস বা ‘এস’ চিহ্নিত বাস যাতে ভাড়া ছিল বেশি। এটা ঠিক যে একটা সময় সমস্ত রাষ্ট্রীয় উদ্যোগেই নিছক কাজ দেওয়ার খাতিরে বেশ কিছু অনিয়মিত ও প্রয়োজনের অতিরিক্ত কর্মী নিয়োগ হয়েছিল— কলকাতা রাষ্ট্রীয় পরিবহন নিগম-ও তার বাইরে ছিল না। এর পেছনে পূর্বতন কংগ্রেস সরকারের ভূমিকাও কিছু কম ছিল না। ফলে বাসপিছু কর্মীসংখ্যা হিসেব করে নিগমের আয় ও ব্যয় সামঞ্জস্যপূর্ণ ছিল না। কিন্তু অনেকদিন পর্যন্ত এটা নিয়ে আলোচনা হয়নি। উদারনৈতিক অর্থনীতির অনুপ্রবেশের পরে সবারই যখন মনে হতে লাগল ‘ভুল, সবই ভুল’ ঠিক তখনই জানা গেল সরকারি পরিবহন সংস্থায় লোক বাড়তি, গাড়িপিছু আয়ে ভর্তুকি দেওয়া ছাড়া গতি নেই, সংস্থার লাভ প্রায় বন্ধ। বিষয় হল, এর আগে কিন্তু সরকার দেদার দামি বাস কিনে বেশি ভাড়ায় চালিয়েছেন। এল বা ‘লিমিটেড স্টপ’ বাস দিয়ে এর সূত্রপাত, পরে এসেছে এস বা ‘স্পেশ্যাল’, তার পরে এম বা ‘মিডি’, তারপরে ই বা ‘একজিকিউটিভ’, একদম শেষে এসি বা শীতাতপ-নিয়ন্ত্রিত বাস। এর পাশে পাশে প্রাইভেট বাসের পরিষেবা নিয়ে কার্যত সরকারের কোনও দায় ছিল না। তেলের দাম বাড়লে একবার ভাড়া বাড়ানো হত, কিছুদিন তাই নিয়ে রাস্তায় ক্ষোভবিক্ষোভ হত আবার নিভে যেত। সত্যি সত্যি বাসগুলির রক্ষণাবেক্ষণ কেমন হচ্ছে, যাত্রীপরিষেবার গুণমান নিয়ে কোনও কিছুই চোখে পড়েনি। বাম সরকারের শেষদিকে সাদা রঙের কিছু ভাল বাস কিনে সরকার ব্যক্তিমালিকদের লিজে চালাতে দিয়েছিলেন, এই আউটসোর্সিং-এর ফলে কী হয়েছিল আমরা জানি না। বরং পরিবহন দফতরের বদান্যতায় বাসগুলি ফিট সারটিফিকেট নেওয়ার সময় নতুন টায়ার টিউব ভাড়া করে লাগিয়ে নিত, কাজ উদ্ধার হলে আবার বাসে লাগানো হত ব্যবহৃত পুরোনো টায়ার টিউব— ভয়াবহ কিছু বাস দুর্ঘটনার পেছনে ছিল এই পুরোনো টায়ারের কাহিনি।
কার্যত গত দেড় দশকে এই অবস্থার আরও অবনমন ঘটেছে। গণপরিবহন যে একটা শিল্প আর সেই শিল্পের মালিক ও শ্রমিকদের মধ্যে একটা স্বাভাবিক দ্বন্দ্ব আছে এটা কোনও সরকারই ঠিক স্বীকার ও অনুমোদন করেনি। বাসের ড্রাইভার ও হেল্পারদের জন্য ন্যূনতম মজুরির হার আজও নেই, নেই তাদের কোনও নিয়মিত ডিউটির সময়। ভাড়া থেকে পাওয়া কমিশনই তাদের আয় আর একেকটা বাস পিছু যেহেতু পাঁচ-ছয়জন শ্রমিক থাকেন তাই সবাই সবদিন কাজ পান না। এই ব্যবস্থা নিয়ে বহু তর্জন-গর্জন হয়েছে, কিছুকাল আগে ভাড়া বাড়ানোর দাবিতে বাসমালিকরা ধর্মঘট ডাকলে তৎকালীন পরিবহন মন্ত্রী বলেছিলেন, সেনা নামিয়ে বাস হুকুমদখল করে নিজেরাই বাস চালাবেন। এরকম তোলাবাজের মতো হুমকি দিয়ে একটা এত বড় ব্যবস্থা চলে না, চলছেও না মোটেই। প্রাক-২০১১ পর্বে শোনা যেত, দলীয় সভায় সমর্থক আনার জন্য প্রাইভেট বাস ব্যবহার করা হত বলে ‘নাকি’ সরকারি দল তাদের মালিকদের প্রতি সদয় ছিলেন, তাঁদের খুশিমতো বাসভাড়া বাড়ানো হত। বাস্তব অবশ্য তা নয়। আজ পর্যন্ত যতবার জ্বালানির দাম বাড়ার জন্য ভাড়া বাড়ানো হয়েছে তাতে একবারও বাসমালিকরা খুশি হননি, বাসে চড়ার ন্যূনতম ভাড়া তাঁদের কোনওদিনই মনপসন্দ হয়নি। তাঁরা এর সঙ্গে বাসের রক্ষণাবেক্ষণ, পথকর, পুলিশি হুজ্জুতি এসব প্রসঙ্গ তুলেছেন যার সবটাই ফেলে দেওয়ার নয়। কিন্তু কোথাও কখনও একটা সুষ্ঠু সমাধান হয়নি। বেশি যাত্রী তোলার জন্য বাসের গতি শ্লথ হওয়া, রাস্তায় রেষারেষি করা এর সবকিছুতেই আমরা অভ্যস্ত হয়ে উঠেছি ক্রমশ। বাসে আমাদের চাপতেই হয়, সরকারি বাস প্রায় আর কিছুই নেই, যাও বা আছে তা চড়া দামের— ফলে যাত্রীরা যাবেন কোথায়?
এই পরিস্থিতিতে শেষ আঘাত এল কোভিডে। দীর্ঘকাল বাস বন্ধ থাকায় একদম পথে বসে গেলেন বাসের শ্রমিকরা, মালিকরা হাত গুটিয়ে নিলেন। স্মরণ করা দরকার, প্রাইভেট বাসমালিকদের প্রধান সংগঠনের নেতা এখন রাজ্যের শাসকদলের বিধায়ক। কিন্তু উত্তর-কোভিড পর্বে যা প্রকাশ্য দেখা গেল তা হল প্রচুর প্রাইভেট বাস ও মিনিবাসের রুটের অবলুপ্তি, অথচ সেগুলি যে খুব অলাভজনক রুট ছিল তাও নয়। কিন্তু কোভিডের সুযোগে বাস চালাতে না-পারার অজুহাতে মালিকরা সেইসব বাস বিক্রি করে দায় সেরেছেন। ঠিক যেভাবে বন্ধ কারখানার শ্রমিকদের অন্ধকারে রেখে, তাঁদের পাওনা-গণ্ডার বকেয়া না মিটিয়ে মিলমালিক গোপনে কারখানা হস্তান্তর করে দিয়ে ভিনরাজ্যে পালিয়ে যেতেন। এখানেও বাসের শ্রমিকরা একেবারে পথে বসেছেন, কেউ সব্জি বিক্রি করেছেন, কেউ ভাড়া নিয়ে অটো চালিয়েছেন, কেউ-বা অভিবাসী হয়ে চুপিসাড়ে রাজ্য ছেড়ে চলে গেছেন। কোভিডের পরে রাজ্যের গণপরিবহনের হাল নিয়ে কেউ কোনও সমীক্ষা করে দেখেননি, শহর কলকাতার উন্নত গণপরিবহন ব্যবস্থা কোন খাদের অতলে এসে ঠেকেছে।
আর এইখানটাতেই এলাকা দখল করেছে বহুজাতিক ওলা, উবেরের মতো যাত্রী-পরিবহন সংস্থা, যাদের ওপরের চকচকে ভাব বেশ আকর্ষণীয় কিন্তু আদপে তার আড়ালে লোকঠকানো মুনাফার শ্বদন্ত। শহরের রাস্তায় বাস কমছে, পরিবহন নিয়ে সরকারের কোনও নীতি নেই, অবস্থান নেই। প্রাইভেট বাসের ভাড়া বাড়ানো হবে না এমন চরম অবস্থান নিয়ে প্রশাসন শেষ অবধি কাদের মুখের হাসি চওড়া করছিলেন? বাসের মালিকরা এই সুযোগে নিজেরাই নিজেদের মতো ভাড়া ঠিক করে নিলেন, নিত্যদিন এই নিয়ে যাত্রী-কন্ডাক্টর হুজ্জুত চলল, আজও চলছে। বাসে উঠে বেশি ভাড়া নিলে সরকারকে জানালে নাকি সুরাহা হবে! অনেকক্ষণ অপেক্ষার পর একটা বাস তারপরে সেখানে উঠে কন্ডাক্টরের সঙ্গে ঝগড়া করে তা আবার প্রশাসনে জানাতে গেলে যাত্রীর হাতে পেন্সিল ছাড়া আর কিছুই থাকে না।
কার্যত অবস্থাটা সেটাই। হয় গাঁটের কড়ি খরচ করে অ্যাপক্যাব বুক করে চড়া ভাড়া দিয়ে পথে চলুন নয়তো হা-পিত্যেশ করে অপেক্ষা করুন কবে আপনার প্রার্থিত বাসটি আসবে— তাতে তাপ্পি লাগানো সিট আর মসৃণ হয়ে যাওয়া টায়ারে আপনার যাত্রা শুভ হবে কি না তা ঘোর অনিশ্চিত। কেমন যেন মনে হয় সবকিছু একই ছন্দে আবর্তিত হচ্ছে। সরকারি অনুমোদিত স্কুলে বাড়ির ছেলেমেয়েকে পড়তে পাঠালে সেখানে শিক্ষক নেই, শিক্ষার মান তথৈবচ— আপনার না পোষালে লাইন দিতে হবে পকেটে রেস্ত নিয়ে ঝাঁ-চকচকে প্রাইভেট বিদ্যায়তনের ভারি গ্লাসডোরের সামনে। বাড়ির স্বজন অসুস্থ হলে যদি সরকারি স্বাস্থ্য প্রতিষ্ঠানের ‘তথাকথিত’ ফ্রি বেডের ভরসায় থাকতে পারেন ভাল, নইলে টেনে হিঁচড়ে তাকে নিয়ে ফেলতে হবে বেসরকারি হাসপাতালের আইসিইউ নামক এক রক্তচোষা রাক্ষসের পেটে— এরপরে যদি পারানির কড়ি জোটাতে পারেন তাহলে প্রাণ বাঁচবে নয়তো পড়ে মরতে হবে। যে বিপন্ন মানুষটি ওই সন্ধে-পেরোনো কলকাতায় একলা দাঁড়িয়ে আছেন বাসের অপেক্ষায়, আসলে যার পকেটে ভাড়াগাড়ি চাপার মতো সঙ্গতিই নেই— তার সঙ্গে কতটুকু তফাত একজন পড়ুয়ার সাধারণ অভিভাবকের, কিংবা, মরণাপন্ন আত্মজনকে নিয়ে সরকারি হাসপাতালে হত্যে দিয়ে পড়ে থাকা পরিবারের সদস্যদের?
কোনও এক বিদ্রূপকণ্ঠ যেন তাঁদের কেবলই শুনিয়ে যাচ্ছে, ‘গরম লাগে তো তিব্বত গেলেই পারো’!