মানবেন্দ্র আবস্তি

সৈয়দ আব্দুল মালিক

মূল অসমিয়া থেকে অনুবাদ: বাসুদেব দাস

 


সৈয়দ আব্দুল মালিক অসমিয়া সাহিত্যের এক বিশিষ্ট ঔপন্যাসিক, গল্পকার, নাট্যকার ও কবি। জন্ম ১৯১৯ সনের ১৫ জানুয়ারিতে অসমের গোলাঘাট জেলার নাহরনি নামক স্থানে। বর্ণাঢ্য কর্মজীবন; ছিলেন সৈনিক, আবগারি বিভাগের সাব-ইনস্পেকটর, শিক্ষক, সম্পাদক, আসাম সাহিত্যসভার সভাপতি, রাজ্যসভার সাংসদ। ২৫টির অধিক গল্পগ্রন্থ, ৫০টির অধিক উপন্যাস, ২০টিরও অধিক মঞ্চনাটক লিখেছেন। লেখকের গল্প সঙ্কলনগুলির মধ্যে পরশমণি, শিখরে শিখরে, শুকনো পাপড়ি বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। ‘অঘোরী আত্মার কাহিনি’ নামক উপন্যাসের জন্য ১৯৭২ সাহিত্য অকাদেমি পুরস্কার লাভ করেন। ‘সূর্যমুখীর স্বপ্ন’ লেখকের বহুলপঠিত উপন্যাস। পেয়েছেন সাহিত্য অকাদেমি পুরস্কার (১৯৭২), পদ্মশ্রী (১৯৮৪), পদ্মবিভূষণ (১৯৯২), অসম উপত্যকা পুরস্কার (১৯৯২), শঙ্করদেব পুরস্কার (১৯৯৯)। তাঁর মৃত্যু— ১৯ ডিসেম্বর, ২০০০

 

তাকিয়ে দেখলাম আজও তারা এসে অন্যদিনের মতোই  এক পাশের টেবিলের কাছে চেয়ার দুটোতে মুখোমুখি বসল। বৃষ্টি না দিলে তারা প্রতিদিন সেখানে বসে, হয়তো সেইজন্যই অন্য কোনও মানুষ সাধারণত সেখানে বসে না।

এখানে বৃষ্টি খুবই কম হয়। তাদের দৈনন্দিন অভ্যাসের ব্যতিক্রম ঘটে না।

রিট্রিট নামের এই হোটেলটিতে আমি দেড় মাস ধরে আছি। মহানগরের একপাশের এই হোটেলটি ছোট হলেও বড় পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন, চেঁচামেচিও কম। ষাটজন মানুষ থাকতে পারা দোতলা ছোট হোটেলটির আকর্ষণ অনেকগুলি: এখানকার নিরিবিলি নির্জনতা, বড় ফুলের বাগানটা, তার চেয়ে বড় সবুজ ঘাসে ঢাকা লনটি, এর ভদ্র পারিপার্শ্বিকতা, এবং হোটেলের কর্মচারী এবং ম্যানেজারের অমায়িক ভদ্রতা। মিষ্টিমুখের রাঁধুনি ক্ষার শুক্তো দিয়ে অতিথিকে পরিতৃপ্তি  সহকারে খাইয়ে পাঠাতে পারে, রিট্রিটের ম্যানেজারের অমায়িকতা  এবং নম্রতায় কেউ মুগ্ধ না হয়ে পারে না। আর হোটেলের কর্মচারীরাও এরকম দক্ষ এবং পটু যে সেখানে থাকা কোনও মানুষের আপত্তি অভিযোগ করার কোনও সুযোগই থাকে না। চার্জ একটু বেশি, কিন্তু হৃদ্যতা এবং শ্রদ্ধাপূর্ণ পরিচর্যার বিনিময়ে সেখানে আক্ষেপের কারণ থাকে না।

আমি হোটেলে থাকি। তারা হোটেলে থাকে না। আশেপাশের কোথাও থেকে আসে, একপ্রকার নির্দিষ্ট টেবিলটার কাছে বসে। শান্তভাবে বসে থাকে, কফি অথবা কোল্ডড্রিঙ্কস খায় এবং আস্তে আস্তে করে কথা বলতে থাকে। প্রথমে তারা আমার দৃষ্টি বা মনোযোগ আকর্ষণ করতে পারেনি। হোটেলের অন্য কাউকে বিরক্ত না করার জন্য তারা দৃঢ়সঙ্কল্প। অন্য যে-সমস্ত দম্পতি রিট্রিটে আসে, তাদের বিরক্ত না করলেও তারা আসার একটা সচেতন বিজ্ঞপ্তি না দিয়ে থাকে না— যেভাবেই হোক না কেন। কিন্তু এরা যেন সেই বিষয়ে সচেতনভাবেই ভদ্র। নীরবে এসে নীরবে বসে থাকে, নিঃশব্দে উঠে চলে যায়, আমার মনোযোগ আকর্ষণ করল এদের এই একপ্রকার অস্বাভাবিক আচরণ।

ঘড়ির কাঁটার সঙ্গে তাল মিলিয়ে তারা প্রতিদিন আসে। তাদের আসার সময় হয়ে গেলে আমার অবচেতন মন এমনিতেই সজাগ হয়ে ওঠে— তাদের আসার সময় হয়েছে। হোটেলের গেটের দিকে তাকাই—। বিন্দুমাত্র ভুল নেই— ছোট কালো গাড়িটা এসে রিট্রিটের কারপার্কে দাঁড়িয়েছে এবং তারা দুজনেই গাড়ি থেকে নেমে এসেছে। তারাই— অন্য কেউ নয়। কালো চশমা পরা সুন্দরী যুবতীটি, আর তার কাঁধে ডানহাতটা দিয়ে সামান্য লাফিয়ে লাফিয়ে হেঁটে আসা যুবকটি। তার চোখেও একজোড়া কালো চশমা, প্রতিদিনই তাদের সাজপোশাক পরিবর্তিত হওয়া ছাড়া অন্য কোনও পরিবর্তন হয় না।

ধীরে ধীরে তারা গাড়ি থেকে নেমে আসে। দুজনেরই ঠোঁটে একটা পরিতৃপ্তির বিমল হাসি লেগে থাকে। দেখলেই মনে হয় এরা বড় সুখী, আজকের দিনে এদের চেয়ে সুখী আর কেউ নেই। দর্শকদের মনের মধ্যেও এক ঝলক সুখের আলো গড়িয়ে যায়।

গাড়ি থেকে দুজনেই নেমে আসে। যুবকটির একটি পা বোধহয় ছোট, দুটো পা একসঙ্গে পড়ে না। বাঁ-পাটা একটু লাফিয়ে যায়। আর সে সবসময় যুবতীটির বাঁদিকে এসে ডানহাতটা তার কাঁধে রেখে বাঁহাতটা সবসময় ট্রাউজারের পকেটে ঢুকিয়ে রাখে।

কয়েকদিন লক্ষ করার পরে এদের এই বিশেষ কথাগুলি আমার চোখে পড়েছে, মেয়েটি বড় রূপসী, হয়তো সে এই দিল্লিরই মেয়ে। সাজসজ্জা এবং প্রসাধনে মার্জিত এবং রুচিসম্পন্ন, দেখলেই কোনও উচ্চ বংশের মেয়ে বলে মনে হয়। যত সহজভাবে কখনও সে কামিজ সালোয়ার পরে আসে, ঠিক তত সহজভাবে সে কখনও শ্লেকস এবং থ্রি-কোয়ার্টার ব্লাউজ এবং কখনও শাড়ি পরে আসে। সমস্ত ধরনের সাজপোশাকে তাকে সমান সুন্দর দেখায়।

সঙ্গের যুবকটি সাধারণত ট্রপিক্যাল স্যুট পরে। প্রায় প্রতিদিন এক-একটি নতুন করে ধোয়া ধবধবে সাদা শার্ট পরে, কখনও কখনও অ্যাশ কালারের অথবা নীল হাওয়াই শার্ট পরে। সে সব সময় জুতোমোজা পরে আসে, স্যান্ডেল পরা চোখে পড়েনি।

একটু রাত হলে যখন দুজনেই ফিরে যায়, তখন মেয়েটি কালো চশমাজোড়া খোলে, কিন্তু যুবকটি তখনও গগলসজোড়া পরে থাকে। আমার কিছুটা অস্বাভাবিক বলে মনে হয়।

স্বাভাবিকভাবে কিছু কৌতূহল জন্মেছিল যদিও, এই যুবক-যুবতীদের বিষয়ে বিশেষ কোনও কথা জানার চেষ্টা করিনি, কথাটা আমার ক্ষেত্রে ছিল অপ্রাসঙ্গিক এবং অপ্রয়োজনীয়। রিট্রিটে হয়তো আরও একমাস-দেড়মাস আমি থাকব, তারপরে এখান থেকে যেতে হবে এবং হোটেলে আসা মানুষের ব্যক্তিগত পরিচয় জানার জন্য খোঁজ করাটা খুব একটা ভাল কথা নয়।

অবশ্য এই পরিচিত বলে মনে হওয়া যুবক-যুবতীর বিষয়ে একা হলেও কিছু চিন্তা আমি না করে ছিলাম না। যুবকটি দেখতে সুন্দর, কালো নয়, ফর্সা বলা যেতেই পারে। ঢেউতোলা চুল এবং চকচকে কালো পরিষ্কারভাবে আঁচড়ানো চুলে একটা উজ্জ্বল সজীবতা রয়েছে। ছুঁচোলো নাক, সুগঠিত মুখ, কালো, ঘন মোচ আর সংযত হাসিটা— সবকিছুর মধ্যে দিয়ে একটা পৌ্রুষের ব্যক্তিত্ব প্রকাশ পাচ্ছিল, তার মুখটাতে এরকম একটি বলিষ্ঠ সরলতা ছিল যে দেখলেই তার সঙ্গে পরিচিত হওয়ার স্পৃহা জাগে। পরিচয় না হয়েও তাকে পরিচিত বলে মনে হয়। তার বয়স হয়তো ২৯-৩০ বছরের বেশি হবে না।

মেয়েটি ২২-২৩ বছরের বেশি হবে না বলে মনে হয়। চোখদুটি আর মুখের মধ্যে বড় কোমলতা রয়েছে। অবশ্য প্রতিদিন একসঙ্গে রিট্রিটে আসার জন্য তারা যে বিবাহিত দম্পতি এ-কথা বুঝতে অসুবিধা হয় না।

সেদিন আমার সামান্য একটু অসুখ ছিল। কাজ শেষ করে আমি একটু তাড়াতাড়ি হোটেলে ফিরে এসেছিলাম। আবহাওয়া খুব পরিষ্কার ছিল না। দক্ষিণ-পশ্চিম আকাশের বুকে কিছু কালো মেঘ জমা হয়েছিল।

এক পেয়ালা গরম কফি আর একটা ওমলেট খেয়ে আমি বিছানায় পড়ার কথা ভাবছিলাম কিন্তু ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখলাম তাদের এখানে আসার সময় হয়েছে। শোওয়ার কথা বাদ দিয়ে আমি লনে বেরিয়ে এলাম এবং একটা চেয়ার পেতে বসে পড়লাম।

কিছুক্ষণ পরে ছোট কালো গাড়িটা এসে দাঁড়াল।

মেয়েটি আজকে গভীর সবুজ রঙের একটি কাশ্মিরি সিল্কের শাড়ি পরেছে, যুবকটির গায়ে একজোড়া পাতলা কুসুম রঙের স্যুট।

তারা এসে বসার কিছুক্ষণ পরে এক-ফোঁটা দু-ফোঁটা করে বৃষ্টি পড়তে লাগল। দুজনেই এবার শান্তভাবে আকাশের দিকে তাকাল, যুবতীটি আস্তে করে বলল, বৃষ্টি বোধহয় জোরে আসবে—

কিছুক্ষণ দুজনেই বসে রইল। তারপর বৃষ্টি ক্রমে আরও জোরে আসতে দেখে দুজনেই হোটেলের বৈঠকখানায় উঠে এল। তার আগে আমি ঘর থেকে উঠে এসে কোর্টের রেলিঙে কনুই রেখে ক্রমশ বেড়ে চলা বৃষ্টির দিকে তাকিয়ে রইলাম।

বৃষ্টি পড়তে দেখে হোটেলের চাকরেরা তখনই চেয়ার-টেবিলগুলি লন থেকে ভেতরে নিয়ে এল।

তারা এসে আমার কাছে বসল। শিষ্টাচারের খাতিরে দুজনের দিকে তাকিয়ে হাসার চেষ্টা করে বললাম, আসুন, বৃষ্টি পড়া শুরু হয়ে গেছে। চশমা পরে থাকা চোখজোড়া  দিয়ে যুবকটি আমার দিকে তাকাল। মেয়েটিও মাথা তুলে তাকিয়ে আস্তে করে বলল— ধন্যবাদ। হোটেলের ম্যানেজার বেরিয়ে এল। নম্র এবং মিষ্টিমুখের প্রায় পঁয়তাল্লিশ বছরের মানুষটি। সে এসে মেয়েটির সামনে দাঁড়াল এবং বৃষ্টি আসার জন্য যেন সে নিজেই দায়ী এভাবে বলল, অসময়ে বৃষ্টি এল, আপনারা কিছু মনে করবেন না, এখানেই বসবেন না ভেতরে যাবেন?

ভেতরে মানে ওপরের বিশেষ রুমে। সামান্য হেসে মেয়েটি বলল, আমরা এখানে বসব, আই লাভ দি রেইন্স।

ঝরঝর বৃষ্টি পড়তে শুরু করেছে। পোর্চের কাছের লতা-ফুলগাছগুলির পাতাগুলি মধ্যে একটা মৃদু ঝিরঝির শব্দ মুখরিত হয়ে উঠেছে। ভেতরের কোনও একটি ঘরে রেডিওতে ভায়োলিনের একটা কোমল সুর বাজছে, পোর্চের উজ্জ্বল নিয়ন লাইটের পরিবর্তে একটা কোমল আলোর হালকা গোলাপি লাইট জ্বালিয়ে দেওয়া হয়েছে। বাইরে বৃষ্টির সঙ্গে সন্ধ্যার কামছায়া পৃ্থিবীতে ছড়িয়ে পড়ছে।

ম্যানেজার আমার দিকে তাকিয়ে বলল, আমি কাছে দাঁড়িয়ে তখন বৃষ্টির দিকেই তাকিয়েছিলাম, কথা শুনে ম্যানেজারের দিকে তাকালাম।

পরিচয় করিয়ে দেওয়ার জন্য অনুমতি চাওয়ার মতো ম্যানেজার উভয়কে বলল— ক্ষমা করবেন, আপনাদের পরিচয় নেই বোধহয়—

আমার দিকে তাকিয়ে মেয়েটি বলল, ওকে এখানে আজ কয়েকদিন ধরে দেখছি। পরিচয় হয়নি অবশ্য— মেয়েটির কথাবার্তায় কেন জানি না আমি একটা অকারণ হর্ষ অনুভব করলাম। আমি সঙ্গে সঙ্গেই বললাম, আমি আপনাদের দেখেছি…

ম্যানেজার যেন সাহস পেল। সে একটা দরকারি কাজ করার সুযোগ পাওয়ার মতো আনন্দের সঙ্গে বলল, মিস্টার অ্যান্ড মিসেস আবস্তি… মিস্টার মালিক।

মেয়েটিকে প্রণাম জানিয়ে ডেকার দিকে হাত এগিয়ে দিলাম এবং সঙ্গে সঙ্গে বললাম, আপনাদের সঙ্গে দেখা হয়ে খুব খুশি হলাম। কিন্তু বলার সঙ্গে সঙ্গে কিছুটা অপ্রস্তুত হলাম, যুবকটি দাঁড়িয়ে রয়েছে। হাতটা এগিয়ে দিলেও, ঠিক আমার দিকে এগিয়ে দেয়নি।

মেয়েটি তাঁর হাতটা ধরে আমার হাতে লাগিয়ে দিল এবং বলল, আমার হাজবেন্ডের চোখের অসুখ, আপনাকে হয়তো ভালভাবে দেখতে পায়নি।

তাঁর কথায় আমি মনের মধ্যে এটা আঘাত পেলাম। আমি তাঁর হাতটা মুঠোর মধ্যে নিয়ে থাকতে থাকতেই আবস্তির মুখের দিকে তাকালাম, আর হঠাৎ পাওয়া আঘাতটা লুকোবার চেষ্টা না করে বললাম, আমি দুঃখিত, আমি জানতাম না। আপনারা বসবেন না নাকি? যুবকটির হাতের স্পর্শটা আমার আত্মীয়তার মধুরতায় ভরা বলে মনে হল।

এবার যুবকটি বলল, আপনার সঙ্গে দেখা হয়ে খুশি হলাম। চলুন বসি। অমৃতা, আমরা এখানে বসছি, ঠিক আছে?

অমৃতা তাকে ধরে চেয়ারটায় বসিয়ে দিল। আমরা তিনজনেই বসলাম। পাশে অপেক্ষা করে থাকা ম্যানেজারটি যেন বড় আপ্যায়িত হল। অমৃতা তার দিকে তাকিয়ে বলল, মিস্টার চাওলা, এই নতুন বন্ধুটির সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেওয়ার জন্য ধন্যবাদ। লেট দেয়ার বি এ স্মল সেলিব্রেশন, আপনি আপত্তি করবেন না, কী বলো সুদর্শন?

সুদর্শন আবস্তি প্রফুল্ল হাসি হেসে বলল, নিশ্চয়, একজন বন্ধুর সঙ্গে দেখা হওয়াটা সৌভাগ্যের কথা। সামান্য পরিচিতিকে বন্ধুত্ব বলে গ্রহণ করতে পারার উদারতার জন্য এদের প্রতি আমার শ্রদ্ধা জাগল। লৌকিকতা না করে সরলভাবেই আমি বললাম, আপনাদের সঙ্গে পরিচিত হতে পেরে আমি সম্মানিত বোধ করছি। কথাবার্তা ইংরেজিতে হওয়ার ফলে আমাদের ভাবভঙ্গি ইংরেজদের মতো হয়ে পড়েছিল।

হৃদ্যতার সঙ্গে ম্যানেজার চাওলা বলল, আপনাদের তিনজনের জন্য ডিনারের ব্যবস্থা করব নাকি?

আমি উত্তর দেওয়ার আগেই সুদর্শন বলে উঠল, স্যার, ডিনারই হোক, নাকি অমৃতা? আমাদের নিমন্ত্রণ গ্রহণ করলে আমরা খুশি হব মিস্টার মালিক।

‘না’ বলাটা খুবই অভদ্রতা হবে। আমি বললাম, আমি এই হোটেলে থাকি। আজ আমারই আপনাদের নিমন্ত্রণ করে সেলিব্রেট করা উচিত ছিল।

আমরা চারজনেই হাসলাম।

ম্যানেজার চাওলা বলল, বৃষ্টি বেড়ে গেছে। আপনারা ভেতরে যাবেন নাকি?

অমৃতা বলল, বৃষ্টিটা আমি উপভোগ করছি, আমরা এখানেই বসব, সময়মতো যাব। মিঃ মালিক, আপনাকে আমাদের সঙ্গে বসিয়ে রেখে আপনার কাজের ক্ষতি করব না, যদি আপনার কোনও কাজ থেকে থাকে।

আমি বুঝতে পারলাম এই বর্ষামুখর সন্ধ্যাটা সুদর্শন-অমৃতারা নিবিড়ভাবে পেতে চাইছে। তৃতীয় ব্যক্তি বিরক্ত করাটা অন্যায় এবং অমার্জনীয় হবে।

আমি বললাম, সন্ধ্যাবেলা আমার পড়াশোনা করা ছাড়া অন্য বিশেষ কোনও কাজ থাকে না। একেবারেই যে কাজ নেই তা অবশ্য নয়, যদি অনুমতি দেন আমি একটু উঠছি। আমি উঠতে চাইছিলাম। হঠাৎ সুদর্শন বলে উঠল, আজ আপনি কাজ না করলেও চলবে। আপনাকে আমি চোখে দেখতে পাইনি, তবু আমার বিশ্বাস আমাদের কথাবার্তা চালিয়ে যেতে কোনও অসুবিধা হবে না।

অমৃতা হাসল।

—দেখতে না পেয়েও বন্ধুত্ব হওয়াকে প্রেম বলে জানো—?

আমি হাসলাম।

ইতিমধ্যে ম্যানেজার আমাদের কাছ থেকে বিদায় নিয়েছিল।

সুদর্শনের চোখের অসুখ— আমাকে দেখেনি, এখন রাতের বেলাতেও গগলস পরে আছে। শুধুমাত্র মুখোমুখি বসে আছি অমৃতা এবং আমি। অনেকদিনের পরিচয় থাকা, নতুন করে পরিচিত হওয়া দুজন বন্ধু।

বৃষ্টি পড়ছে।

নীরবতা ভঙ্গ করার জন্য আমরা দু-চারটে ব্যক্তিগত কথা বলতে শুরু করলাম।

মাঝখানে একবার সুদর্শন বলল, আমি আসামে অনেকবার গিয়েছি। মোহনবাড়ি, ররৈয়া, বরঝার, এই জায়গাগুলি আমার খুবই পরিচিত। ডিব্রুগড়, জোরহাট, তেজপুর, গুয়াহাটি— কিছুটা মনে করার মতো চেষ্টা  করে সুদর্শন বলল— ছোট ছোট সুন্দর শহর। এখন বোধহয় আগের চেয়ে আরও ভাল হয়েছে? খারাপ পাবেন না, আসামের শহরগুলি একটু পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন করে রাখার চেষ্টা করলে খুব একটা খারাপ হত না, নয় কি?

আমার সঙ্কোচ ঢাকার চেষ্টা করে লাভ নেই। তবু হাসলাম। আমি বললাম, আসামের শহরগুলিকে কেউ কেউ নোংরা, নতুনগ্রাম বলে থাকে। পার্থক্য এতটাই যে অসমের গ্রামগুলিতে তার শহরগুলির মতো নর্দমা, মশামাছি এবং পচাগলা জিনিস পাওয়া একটু কষ্টকর।

অমৃতা হেসে বলল— আসাম অ্যালোন শুড নট ক্লেইম দেট অনার— ইন্ডিয়া ইজ অ্যাবান্ডেন্টলি প্রসপারাস দ্যাট ওয়ে।

পুনরায় আমরা হাসলাম।

কেউ রেডিওর ভলিউম বাড়িয়ে দিল। একটা শুনতে ভাল-না-লাগা গান বাজল। কোনও নতুন গায়কের হিন্দি গান। কথাগুলি আমোদজনক বলে মনে হল। অর্থ এই ধরনের: যে আগুন কেবল আলো দেয়, তাকে আগুন বলে ধোরো না, না পোড়ে যদি কীসের আগুন? যে প্রেম কেবল আনন্দ দান করে তাকে প্রেম বলে ধোরো না। যে প্রেম দুঃখের আগুনে পোড়ানো হয় না সে কীসের প্রেম?

রেডিওর গানটা কানে পড়ার সঙ্গে সঙ্গে আমরা কেন নীরব হয়ে পড়েছিলাম, নিজেই বুঝতে পারলাম না। তখনও বৃষ্টির ছাট আসছিল।

কিছুক্ষণ পরে আমি জিজ্ঞেস করলাম, আসামে আপনি কী করতেন মিঃ আবস্তি?

সুদর্শন যেন সামান্য অপ্রস্তুত হল। কিছুক্ষণ চুপ করে থাকার পরে সে বলল— সেইসব বড় দীর্ঘ কাহিনি, আপনাকে কখনও বলব। আজ আমরা অন্য কথা বলি, না কি অমৃতা?

অমৃতা বলল, সুদর্শন পাইলট ছিল, ডাকোটা চালাত, জেট ফাইটারের পাইলট ছিল, একটা স্কোয়াড্রনের লেফটেনান্ট কমান্ডার ছিল। আপনি হয়তো জানেন না…

এই যুবকটির বিষয়ে অতীতকালের কথাগুলি বলায় পরিস্থিতিটা বিষণ্ণ হয়ে পড়েছিল। এর তাৎপর্য হল— শ্রী আবস্তি এখন পাইলট নয়।

সত্যিকারের অনুশোচনার সঙ্গে আমি বললাম, আমি জানতাম না মিসেস আবস্তি। পাইলটের জীবন এবং কেরিয়ার বড় চার্মিং, নয় কি?

—চার্মিং নো ডাউট, না হলে আজ হয়তো আমাদের এখানে দেখতে পেতেন না। অমৃতা আমার চার্মিং লাইফের কাহিনিটা মিস্টার মালিককে বলো না কেন? আওয়ার ফ্রেন্ড উইল এনজয় ইট ইমেন্সলি।

কিন্তু সে রাতে আর সুদুর্শন আবস্তির পাইলটজীবনের কাহিনি শোনা হল না। আমার আগ্রহ জন্মেছিল যদিও, কিন্তু অমৃতার সেই বিষয়ে কোনও আগ্রহ ছিল বলে মনে হল না।

ম্যানেজার চাওলাকে সুদর্শন এবং অমৃতা সম্পর্কে কিছু কথা জিজ্ঞেস করার ইচ্ছা ছিল, কিন্তু কথাটা খুব একটা শোভনীয় হবে না ভেবে জিজ্ঞেস করলাম না। পরিচয় হয়েছে যখন, তাদের কাছ থেকেই সমস্ত কথা জানতে পারব।

তথাপি চাওলার অন্যান্য কথাপ্রসঙ্গে এতটুকুই জানতে পারলাম যে অমৃতা এবং সুদর্শনের বিয়ের দুই বছরের কিছুটা বেশি হয়েছে। অমৃতার পিতা একজন কোটিপতি ব্যবসায়ী— এক্সপোর্ট-ইমপোর্টের ব্যবসা করে, ভারতের বিভিন্ন জায়গায় মিল, কারখানা এবং অন্যান্য ব্যাবসা রয়েছে। বিয়ের আগে অমৃতা পশ্চিম জার্মানিতে থাকত। ভারত থেকে সিনিয়র কেম্ব্রিজ পাশ করে গিয়ে প্রথমে সুইজারল্যান্ডে ছিল, তারপরে ছিল লন্ডনে, তারপরে ছিল জার্মানিতে। বড় মেধাবী মেয়ে, বিজ্ঞানের কোনও উচ্চ ডিগ্রির জন্য জার্মানিতে অধ্যয়ন করেছিল। সে ইউরোপের দুটি বিখ্যাত বিশ্ববিদ্যালয়ের ডক্টরেট, দুটি আলাদা আলাদা বিষয়ে। অন্য একটি বিষয়ের বিশেষ কোনও বিভাগে অধ্যয়ন করছিল কিন্তু শেষ করার সুযোগ পেল না। সুদর্শনের সঙ্গে বিয়ের জন্য চলে এল।

চাওলা বলল, তার সম্পর্কে আমি খুব ভালভাবে জানি না। বুঝতেও পারি না। কিন্তু একটা কথা নিশ্চয় আপনি লক্ষ করেছেন যে তিনি খুব নম্র। বিন্দুমাত্র অহঙ্কার নেই। আমাদের হোটেলটিকে বড় ভালবাসে। প্রতিদিন বাড়ি থেকে দশ মাইল মোটর চালিয়ে এখানে আসে এক পেয়ালা কফি খাওয়াবার জন্য, কিছুটা নিরিবিলিতে কাটানোর জন্য।

অমৃতার বিষয়ে এই কথাগুলি জেনে তার প্রতি আমার শ্রদ্ধা হল। বিদ্যা দদাতি বিনয়ং…।

সুদর্শনের বিষয়ে চাওলা খুব বেশি জানে না। মাত্র এতটুকুই জানে যে— সে একজন অতি দক্ষ পাইলট ছিল, একুশ বছর বয়সে সে এয়ারফোর্সে ঢুকেছিল। তার মতো বৈমানিক ভারতীয় বৈমানিকদের মধ্যে খুব কমই ছিল। তারও ইংল্যান্ডের কোনও একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের উচ্চ ডিগ্রি রয়েছে।

কিন্তু সুদর্শন এখন চোখের কোনও একটি অসুখে ভুগছে। খুবই কম দেখে। দৃষ্টিশক্তি কম হলে পাইলট হওয়া যায় না।

সঙ্গে ম্যানেজার চাওলা এটাও বলল, এদের লাভম্যারেজ হয়েছিল। ইংল্যান্ডে থাকতেই নাকি তাদের ভাব বিনিময় হয়েছিল।

একপ্রকার  অপ্রত্যাশিতভাবে একদিন অমৃতা এবং সুদর্শন আমাকে তাদের বাড়িতে আহার করার জন্য নিমন্ত্রণ করল। নিমন্ত্রণের উপলক্ষ হল সমাগত গণতন্ত্র দিবস— ২৬ জানুয়ারি। বিকেলে তারা একটু উৎসবের আয়োজন করবে— কিন্তু এবার তারা অন্য অতিথিকে আর নিমন্ত্রণ করবে না। সুদর্শনের দুজন বন্ধু এবং অমৃতার দুই-একটি বন্ধু মেয়েকে ডাকবে মাত্র। অমৃতার ভাষায়— ইট উইল বি এ সলেম অ্যাফেয়ার— নো নয়েজ, নো ফ্যান ফেয়ার।

নিমন্ত্রণ গ্রহণ করলাম। হোটেলের বাইরে ঘরোয়া পরিবেশের মধ্যে খাওয়ার কিছুটা লোভ যে হল না তা নয়। তার মধ্যে সুদর্শন এবং অমৃতার প্রতি আমার একটি মায়া জন্মেছিল। তাদের বাড়িটা একবার দেখে  আসার সুযোগও পাব।

২৬ জনুয়ারি তারিখে সারাটা দিন সরকার আয়োজন করা প্যারেড প্রদর্শনী ইত্যাদি দেখলাম। অভিজ্ঞতা থেকে বুঝতে পারলাম গণতন্ত্র দিবসের আয়োজনের প্রতি দিল্লিবাসীর আগ্রহ কিছুটা কমে এসেছে। অবশ্য অন্যান্য দেশের দিল্লিতে থাকা লোকদের আগ্রহ আশাতীতভাবে বেড়েছে বলে মনে হল।

সুদর্শনদের সঙ্গে সন্ধ্যাবেলা রাষ্ট্রপতি ভবন, পার্লামেন্ট হাউ্‌স, রিজার্ভ ব্যাঙ্ক ইত্যাদির মনোমুগ্ধকর ফায়ার ওয়ার্কস দেখলাম। অমৃতা গাড়ি চালাচ্ছিল। আজ অমৃতা একটি পিঙ্ক রঙের কনভার্টিবল চালিয়ে এসেছিল। গাড়িটা খুব ছোট নয়। হাতে স্টিয়ারিং ধরে অমৃতা পাশে সুদর্শন এবং তার বাঁদিকে আমি। পেছনের সিটগুলি খালি পড়েছিল। নির্দিষ্ট পথ দিয়ে ধীরে ধীরে গাড়ি চালাচ্ছিল অমৃতা।

মাঝখানে একবার সুদর্শন বলল, উৎসব দেখা এবং উৎসবে  অংশগ্রহণ করা দুটি আলাদা কথা। যখন আমরা উৎসবে অংশগ্রহণ করি তখন এটাকে আমাদের নিজের বলে মনে হয়।

অমৃতা বলল, লক্ষ লক্ষ মানুষ উৎসব দেখতে এসেছে। এভাবে দেখতে আসাটাও অংশগ্রহণ করার মতোই।

দিল্লি মহানগরের বাইরে গ্রামের মতো এক টুকরো কিছু বেঁটেখাটো পাহাড়িয়া জায়গায় সুদর্শনদের পরিচ্ছন্ন আধুনিক ডিজাইনের বেশ বড়সড় বাড়ি। দুজন মানুষের জন্য যথেষ্ট বড়। মেইন রাস্তা থেকে বাড়িটাতে একটু উঁচু রাস্তা দিয়ে উঠে যেতে হয়। দরজার সামনে পর্যন্ত গাড়ি যায়। গাড়ি গেটের সামনে পৌঁছানোর সঙ্গে সঙ্গে সেখানে দাঁড়িয়ে থাকা দারোয়ান গেট খুলে দিল।

আমরা গিয়ে সুদর্শনদের বাড়ি পৌঁছাতে রাত দশটা বেজে গিয়েছিল। কীভাবে যে এত রাত হয়ে গেল বুঝতেই পারছিলাম না। খুব ঠান্ডা পড়েছিল। আমরা মাঝখানের ঘরের চিমনির কাছে গিয়ে বসলাম।

পৌঁছানোর সঙ্গে সঙ্গে এক পেয়ালা কফি গরম করে দেওয়া হল। তারপরে আমাদের থেকে বিদায় নিয়ে অমৃতা ভেতরে গেল। বলে গেল পাঁচ মিনিটের মধ্যে আসছি। একটু বসুন।

আমি এবং সুদর্শন চিমনির পাশে বসে রইলাম।

কিছুক্ষণ নীরব থাকার পরে সুদর্শন বলল, আজকের দিনটি ভালভাবে উপভোগ করা গেল, নয় কি?

—যথেষ্ট উপভোগ করা হল, তার জন্য আমি অমৃতা এবং আপনার কাছে কৃতজ্ঞ।

সে কোনও উত্তর দিল না। চিমনির জ্বলতে থাকা অঙ্গার একটু খুঁচিয়ে দিয়ে আমি জিজ্ঞেস করলাম, আপনার কবে থেকে চোখের অসুখ হল?

—আজ থেকে চার বছর আগে। গত চার বছর পৃথিবীর কিছুই দেখিনি।
—একেবারেই দেখতে পান না কি?
—একটা চোখ একেবারে নষ্ট হয়ে গেছে। সেটা দিয়ে কিছুই দেখি না। অন্য চোখটাও নষ্ট হতে শুরু হয়েছে… ডাক্তার অনেক চেষ্টাচরিত্র করে সম্পূর্ণ নষ্ট হওয়া থেকে এখন পর্যন্ত বাঁচিয়ে রেখেছে। বেশি আলোতে ঝলমল করলে একটু দেখতে পাই, কিন্তু বিশেষভাবে কিছুই চিনতে পারি না। অমৃতা এবং আপনাকেও আমি দেখতে পাচ্ছি না। অন্ধের ফায়ার ওয়ার্কস দেখতে যাওয়ার কোনও অর্থ নেই। অমৃতার জন্যই গেলাম। অমৃতা বলে, তুমি নিজে না দেখতে পেলেও আমার চোখ দিয়েই দেখবে।

সুদর্শনের সুন্দর মুখটিতে একটি করুণ হাসির আভাস ছড়িয়ে পড়ল। আমার অসহ্য মনে হল। চোখে দেখতে পাওয়া দুজন মানুষের সঙ্গে একজন দেখতে না-পাওয়া মানুষকে নিয়ে বেড়ানোটা তাকে শাস্তি দেওয়া নয় কি?

অমৃতা চলে এল। ইতিমধ্যে সে সাজপোশাক পরিবর্তন করেছে। একটি কালো লেডিস অলস্টার, লোমের কালো টুপি এবং একজোড়া মুগারঙের হাতমোজা পড়েছে।

অমৃতা সুদর্শনকে বলল, তুমি ওঠো, কাপড়চোপড় পাল্টে নাও। আমাদের খাবার রেডি হয়ে গেছে। আপনি একটু বসুন—।

অতি আদরের সঙ্গে বগলের নিচে ধরে অমৃতা সুদর্শনকে ভেতরের একটা ঘরে নিয়ে গেল। আমি বসে রইলাম। চিমনির কাছে উষ্ণতা ছিল।

খাওয়া শেষ হতে হতে বারোটা বেজে গিয়েছিল। অমৃতা সহজ আত্মীয়তার সুরে আমাকে বলল, আপনাকে আজ রাতে আর হোটেলে ফিরে যেতে হবে না। ফিরে না গেলে কোনও অসুবিধা হবে না তো?

—অসুবিধা হবে না, কিন্তু…
—সেই কিন্তুটা আমি বুঝতে পেরেছি। আমাদের বাড়িতে খাওয়ার জন্য আপনাকে নিমন্ত্রণ করেছিলাম, রাতে থাকার জন্য নয়। তবে অনেক রাত হয়ে গেছে আর বাইরে খুব ঠান্ডা পড়েছে। না হয় আমি আজ আপনাকে জোর করেই রেখে দিলাম…। অমৃতা হাসল। মেয়েটিকে আমার ভাল লাগল।

সুদর্শন বলল, এমনিতে হট্টগোল আমার অসহ্য মনে হয়। কিন্তু একজন অন্তরঙ্গ বন্ধু পেলে সময়টা ভালভাবে কাটানো যেতে পারে। আপনি আজ থাকুন, আমরা কিছু কথাবার্তা বলব। আপনি তাড়াতাড়ি ঘুমিয়ে পড়েন, না দেরি করে ঘুমান?

আমি হেসে বললাম, একটা রাত একটু দেরি করে ঘুমোলে আমার বিন্দুমাত্র ক্ষতি হবে না। তাছাড়া খেয়ে উঠেই আমি কখনও ঘুমোই না।

পৃথিবীটা নীরব হয়ে এসেছিল। এক ঝাঁক ঠান্ডা বাতাস ঘরটার বাইরে ঘুরে বেড়াচ্ছিল। চিমনির আগুন টিম টিম করে জ্বলছিল। তিনটি ছোট চেয়ারে আমরা তিনজন বসলাম… এবার আমি আর সুদর্শন মুখোমুখি বসলাম, সুদর্শনের বাঁদিকে বসল অমৃতা।

দিনটির উৎসবের আয়োজনের বিষয়ে আমরা সাধারণভাবে কথা বলছিলাম। চুপ করে থাকতে আমারও খারাপ লাগছিল।

পুনরায় কোনওভাবে সুদর্শনের চোখ খারাপ হওয়ার প্রসঙ্গটা উত্থাপিত হল। এই বিষয়টা আমি সচেতনভাবে এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেছিলাম, তবু উত্থাপিত হল।

এইবার অমৃতা বলল, প্রতিবারই আমরা আলাদাভাবে গণতন্ত্র দিবস পালন করি জানেন? সেটা সুদর্শন এবং আমার জীবনে একটি তাৎপর্যপূর্ণ স্মরণীয় দিন। আপনি হয়তো জানেন না।

—ভারতের ইতিহাসেই তো সেটি একটি স্মরণীয় দিন। আর আপনারা দিল্লিতে থাকেন যখন…

সুদর্শন বলল, মিঃ মালিক, অদ্ভুত অভিজ্ঞতার স্মৃতিতে ভরা এই ২৬শে জানুয়ারি দিনটি আমার জন্য। চার বছর আগে— নয় কি অমৃতা?

—ঠিক চার বছর আগে আজকের দিনটিতে… অমৃতা বলল। তারপরে মনে করার চেষ্টা করার জন্য অমৃতা চার বছর আগের একটি নাতিবৃহৎ কাহিনি বলতে আরম্ভ করল…

সুদর্শন সুপরিচিত দক্ষ পাইলট। রিপাবলিক ডে-তে এয়ারফোর্সের প্রদর্শনী প্যারেড হল। সুদর্শন এই প্যারেড লিড করবে। রাষ্ট্রপতিকে স্যালুট জানাবে— আকাশ থেকে। সুদর্শন সেদিন চালাবে একটি নতুন ক্যানবেরা জেট। আকাশের বুকে বিভিন্ন খেলা দেখানো, ডাইভিং করা, স্পিডের প্রদর্শনী দেখানো ইত্যাদি বিভিন্ন কৌশল দেখাবে সুদর্শন। তাকে নিয়ে ভারতীয় এয়ারফোর্সের অন্য পাইলটরাও গর্ববোধ করে।

অমৃতা তখন জার্মানিতে ছিল, গবেষণার ছাত্রী হিসেবে। সেবারের গণতন্ত্র দিবসের উৎসবে যোগ দিতে অমৃতা বাড়ি এসেছিল। ২৬ জানুয়ারির দিন অতি প্রত্যুষে সুদর্শন অমৃতার সঙ্গে দেখা করে পালামে যাত্রা করল। যাওয়ার আগে সেদিন সন্ধ্যাবেলা ঘোরাফেরার একটা পরিকল্পনা করে গেল। বিকেল তিনটের পরে সুদর্শন সম্পূর্ণ মুক্ত হবে রাতের জন্য।

কিছুক্ষণ চিন্তিতভাবে নিজেকে বলার মতো সুদর্শন বলে গেলেন, আমরা সবাই এগিয়ে চলেছি। কিন্তু আমাদের অগ্রগতি যে অজান্তে আমাদের কখন কোথায় নিয়ে যায় আমরা নিজেরাই জানি না। অমৃতার কাছ থেকে তখনকার মতো বিদায় নিয়ে আমি এরোড্রামে পৌঁছে গেলাম… সকালে গাঢ় কুয়াশা ছিল। কিন্তু কুয়াশাকে আমার ভয় নেই। বিমানটাকে কুয়াশার ওপরে তুলে নিতে পারলে সুন্দর আলোকের মধ্যে ঢুকে যাওয়া যায়। সেই আলোর একটি নিজস্ব রূপ আছে। সামথিং লাভলি অ্যান্ড গ্লোরিয়াস।

আবার কিছুক্ষণ থেমে তিনি বলে গেলেন— আমার ডিউটি ডিটেইল করা ছিল, ঠিক নয়টার সময় আমার সঙ্গে বাকি কয়েকজন পাইলট দিল্লি শহরের ওপরে আকাশে প্যারেড করব এবং ক্রীড়াকৌশল প্রদর্শন করব, ভারতের রাষ্ট্রপতি, ভারতের জনতা এবং ভারতের জাতীয় পতাকাকে আকাশ থেকে অভিবাদন জানাব। তারপরে আধঘন্টা আকাশের বুকে থেকে আমরা পালামে ল্যান্ড করব। এয়ার ডিসপ্লে গণতন্ত্র দিবসের একটি বিশেষ আয়োজন। আর তার নেতৃত্বদান করবে সুদর্শন আবস্তি… আমি।

কথাগুলো শুনে আমার ভাল লেগেছিল। নতুন করে শোনার মতো অমৃতাও সুদর্শনের কথাগুলি বড় মনোযোগের সঙ্গে শুনে যাচ্ছিল। চিমনির আগুনটা নীরবে জ্বলতে থেকে যেন আমাদের সমর্থন জানিয়ে চলেছে।

সুদর্শন বলে চলল— পূর্বনির্ধারিত পরিকল্পনা মতো ঠিক নয়টার সময় তাদের প্লেনগুলি আকাশে উড়ল— পালাম থেকে দিল্লির রাজপথের ওপরে। নিচে লক্ষ লক্ষ জনতা, ভারতের কর্ণধাররা, উৎসবে যোগদানের জন্য সমবেত হওয়া দেশ-বিদেশের লোকেরা। সুদর্শনের দক্ষ চালনায় তার ক্যানবেরা জেটটা ক্রমে ছড়িয়ে পড়া রোদের আলোতে ঝিকমিক করে উঠল…

গণতন্ত্র দিবসের দিন ভারতের বিভিন্ন সামরিক বাহিনির লোকেরা মিলিটারি পদ্ধতি অনুসরণ করে দিনটি পালন করে। পালাম বিমানবন্দরে থাকা অন্য লোকজনদেরও প্যারেডের জন্য সমবেত করা হল— পালামের রানওয়ের ওপরে। এরোড্রামে কাজ করা প্রায় তিনশত মানুষ সেখানে প্যারেড করার জন্য সমবেত হয়েছিল। যেখানেই অল্প সৈন্য থাকে, সেখানেই এভাবে স্বাধীনতা দিবস, গণতন্ত্র দিবসের শুরুতে প্যারেড ইত্যাদি করিয়ে উৎসব উদযাপন করা হয়।

পালামে একজন ক্যাপ্টেনের অধীনে এই প্যারেডের আয়োজন করা হয়েছিল। সেই জায়গার গ্রামেগঞ্জের যে-সমস্ত মানুষ রাজধানীতে উৎসব দেখতে আসতে পারে না, তারা পালামের মিলিটারি কুচকাওয়াজ দেখার জন্য রানওয়ের কাছে সমবেত হয়েছিল। গণতন্ত্র দিবসের দিন নটা থেকে দশটা পর্যন্ত কোনও প্লেন এরোড্রামে নামবে না— এটাই ছিল ব্যবস্থা আর তা দেখে বিশাল রানওয়েটার ওপরে প্যারেডের ব্যবস্থা করা হয়েছিল। প্যারেড এক ঘণ্টার মধ্যে শেষ হবে।

আশপাশ থেকে দুই-তিন হাজার মানুষ এখানে সমবেত হয়েছিল— রাষ্ট্রপতি ভবন থেকে জনপথ এবং দিল্লি গেট পর্যন্ত রাজপথের ওপরে হয়েছে রাজকীয় উৎসবের আয়োজন এবং তার দুপাশে লক্ষ লক্ষ দর্শকের অভূতপূর্ব ভিড়।

বিচিত্র তাদের সাজপোশাক, বিচিত্র কথাবার্তা। ভারতের নবলব্ধ স্বাধীনতাকে শ্রদ্ধা জানাবার জন্য প্রত্যেকেই একত্রিত হয়েছে। আকাশ থেকে জনতার সমাবেশ কী যে অপূর্ব দেখায়। জনসমুদ্রে যেন নতুন প্রাণের জোয়ার এসেছে— ভারতের বুকে ফিরে এসেছে হাজার হাজার বছরের ঐতিহ্যের গরিমা। আর এই গরিমাকে অভিবাদন জানানোর জন্য আমরা আকাশের বুকে আমাদের ক্রিয়াকৌশল দেখিয়ে লক্ষ লক্ষ জনতার দৃষ্টি আমাদের দিকে আকর্ষণ করছি। কেউ তখন নিজেকে দেখছে না— দেখছে আমাদের, নীল আকাশের বুকে এঁকে দেওয়া স্বাধীন ভারতের  তেরঙা জাতীয় পতাকার দিকে…

কথাগুলি বলার সঙ্গে সঙ্গে যেন সুদর্শন কিছুটা উত্তেজিত হয়ে উঠল। আমি এবং অমৃতা নীরবে তার কথাগুলি মনোযোগ দিয়ে শুনে যাচ্ছিলাম।

সুদর্শন কিছুক্ষণ অপেক্ষা করল— কথাগুলি একবার ভাল করে মনে করার চেষ্টা করল যেন। তারপরে একটু উষ্ণভাবে বলে চলল। তারপরে কী হল জানেন মিঃ মালিক? আমাদের প্রদর্শনী ক্রিয়াকৌশলের সমাপ্তি হল। আধঘন্টা আকাশে থেকে আমরা জনগণকে মন্ত্রমুগ্ধ করে রাখলাম। শেষে স্বাধীন ভারতের উন্মুক্ত পতাকাকে আকাশী অভিবাদন জানিয়ে আমরা বিদায় নিলাম… বিদায় নিলাম।

সুদর্শন পুনরায় চুপ করল।

অমৃতা বলল, একটু গরম কফি খাওয়া যাক, বেশি ঠান্ডা হয়ে গেছে। আমরা আপত্তি করলাম না। রাত বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে ঠান্ডাও বেশি পড়ছিল।

শিকারি যেভাবে শিকারের অভিজ্ঞতা বলতে ভালবাসে, একজন পাইলটও তার পাইলটজীবনের কথা বলতে নিশ্চয় আনন্দ পাবে, তার মধ্যে নতুনত্ব নেই। সত্যি কথা বলতে গেলে সুদর্শনের কথাগুলি ক্রমে আমার বিশেষত্বহীন বলে মনে হচ্ছিল, কিন্তু কথাগুলি সে বড় আন্তরিকতার সুরে বলছিল। হয়তো এই সমস্ত কথা অমৃতা অনেকবার শুনেছে, তথাপি যেন আমার চেয়ে বেশি একাগ্রতা এবং শ্রদ্ধা নিয়ে অমৃতা কথাগুলি শুনে যাচ্ছিল।

কফি আনার জন্য অমৃতা উঠে গেল— একটু আসছি।

সুদর্শন হালকা হাসল, আর বলল— আচ্ছা যাও। তারপরে আগের সুরে বলতে শুরু করল, এরপরের কথাটা অমৃতা শুনতে পারে না। তাই উঠে গেছে…

কৌতূহল হল। তারপরে কী হল? আমি জিজ্ঞেস করলাম।

হাসির মতো করে সুদর্শন বলল— তারপরে? হ্যাঁ বলছি। পালামমুখো হয়েছি, হঠাৎ আমি অনুভব করলাম আমার প্লেনে কিছু একটা হয়েছে। একই সময়ে দুটো ইঞ্জিন অচল হয়ে পড়েছে। প্লেনে তখন আমি ছাড়া আর কেউ নেই। কখনও এরকম হয়, আমি ভয় পেলাম না। বাকি প্লেনগুলিতে থাকা পাইলটদের রেডিও মেসেজ পাঠালাম, আমার প্লেনের ইঞ্জিনে কিছু একটা হয়েছে। কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই ঠিক হয়ে যাবে। বাকি প্লেনগুলি চলে গেল। তারা আরও আধঘন্টা আকাশে থেকে ল্যান্ড করবে। আমার সমস্ত জ্ঞান এবং অভিজ্ঞতা দিয়ে আমি ইঞ্জিন সচল করবার চেষ্টা করলাম— এক-দেড় মিনিট লড়াই করলাম— আকাশে সেটাই অনেক সময়। কিন্তু আশা ছেড়ে দিলাম। কিছু একটা খুব বেশি খারাপ হয়ে গেছে, আকাশে ভাল করা যাবে না।

পালামের কন্ট্রোল টাওয়ারে রেডিও মেসেজ পাঠালাম— ক্রাফটের ইঞ্জিন কাজ করছে না। বিকল হয়ে গেছে। আমাকে কাইটটা নামানোর নির্দেশ দিন—

কন্ট্রোল জানাল— অসম্ভব। রানওয়ের ওপরে অনেক মানুষ রয়েছে। প্যারেডও শেষ হয়নি। প্লেনটাকে যেতে দাও। তুমি প্যারাসুট নিয়ে লাফিয়ে পড়ো।

—কিন্তু আমার প্লেনটা? আমি বললাম, প্লিজ সি, ইফ ইট ইজ পসিবল টু মেক এরোড্রাম ফর মি—।

একই সুরে কন্ট্রোল বলল— তোমার প্লেন যেতে দাও। ডোন্ট ওরি  ফর টু লাখস। নিজেকে বাঁচাও। প্যারাসুট নিয়ে লাফিয়ে পড়ো।

দুই-আড়াই লাখের একটি জেট এয়ারক্রাফ্ট ধ্বংস হওয়ার জন্য বিনা দ্বিধায় ছেড়ে দিতে পারার অবস্থা ভারতের এখনও হয়নি। আমি পুনরায় বললাম— আই মাস্ট সেভ হার। শি ইজ মাই কাইট।

কন্ট্রোল শুধু বলল, তোমার কাইটটাকে যেতে দাও। তার চেয়ে তোমার জীবনের দাম অনেক বেশি।

কন্ট্রোল ছেড়ে দিল।

রেডিও বাদ দিল।

ঠিক করলাম, আদেশ পাই বা না পা্‌ই, এরোড্রাম পাই বা না পাই, আমার প্লেনটাকে বাঁচাতেই হবে। কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে আমাকে কোথাও ল্যান্ড করতে হবে। কোনও উপায় নেই। আমার সমস্ত অভিজ্ঞতা এবং উপস্থিত বুদ্ধিতে দ্রুতগামী জেটটার বিকল ইঞ্জিন নিয়ে আমি এগোতে শুরু করলাম। কয়েক মুহূর্ত পরে দেখলাম এটা পালাম— এটা পালাম এরোড্রামের রানওয়ে।

কিন্তু রানওয়ের ওপরে আর তার দু-পাশে অনেক মানুষ দেখতে পেলাম। কয়েক হাজার মানুষ। মানুষগুলি রানওয়ের ওপরে সঙ্ঘটিত মিলিটারি প্যারেড বিভোর হয়ে দেখছে। ধীরে ধীরে নিচে নেমে আসতে চলা জেটটিকে আমি গ্লাইডার চালানোর মতো কেবল বায়ুর সাহায্যে কিছু সময় ভাসিয়ে রাখার অপ্রাণ চেষ্টা করলাম। তথাপি প্লেনটা নেমে যেতে লাগল।

আশ্চর্যের কথা, এভাবে প্লেনটিকে নেমে আসতে দেখেও মানুষগুলি রানওয়ে থেকে সরে গেল না। বরং আমার দিকে তাকিয়ে হাততালি দিচ্ছে। হয়তো সবাই ভাবছে আমি কোনও খেলা দেখাচ্ছি। আমি হতবাক হয়ে গেলাম। আর অপেক্ষা করা যাবে না, আর এভাবে আকাশে অপেক্ষা করা যাবে না। রানওয়ের ওপরে মানুষগুলির ওপরে আমার প্লেনটা ঘোরাঘুরি করছে। নিচের দিকে তাকালাম। আমি কন্ট্রোল শিথিল করে দিইনি। কিন্তু ইনার্শিয়া শেষ হয়ে এসেছে, কিছুক্ষণের মধ্যেই প্লেনের গতি রুদ্ধ হয়ে যাবে। আমার মাথা ঘুরে গেল। আমি প্যারাসুট নিয়ে লাফিয়ে পড়ে প্লেনটা হঠাৎ নামিয়ে দিলে রানওয়েতে থাকা মানুষগুলিকে পিষে ফেলবে। উৎসবে মত্ত হাজার হাজার মানুষ।

ইঞ্জিন ছাড়া কেবল মেঘের ওপরে নির্ভর করে প্লেন আর আকাশে উড়িয়ে রাখা যাবে না। কিন্তু উপায় নেই। রানওয়ের ওপরে নামাতে না পারলে প্লেন এবং আমি কেউ রক্ষা পাব না, কিন্তু রানওয়ের ওপরে মানুষগুলি আকাশের ওপরে আমার খেলা দেখে চিৎকার করছে।

এক মুহূর্তের মধ্যে সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেললাম, রানওয়ের দরকার নেই। একটা ক্যানবেরা জেট যাক, শেষ হয়ে যাক এস পাইলট সুদর্শন আবস্তি। আপনার হয়তো বিশ্বাস হবে না— হঠাৎ সেই মুহূর্তে নিচের মানুষগুলির জন্য আমার মনে ভালবাসা জাগল। ওদেরকে বাঁচাতে হবে। হোক আমার মৃত্যু— প্লেনটাকে বাঁচানোর আর কোনও উপায় নেই, আমার নিজেকে বাঁচানোর কোনও উপায় নেই। একজনের বিনিময়ে হাজারজনের জীবন রক্ষা পাবে।

কাঁধে দুটো প্যারাসুট ছিল। একবার ভাবলাম প্লেন ছেড়ে লাফিয়ে পড়ি, পরের মুহূর্তে সেই চিন্তা ছেড়ে দিলাম, প্লেনটা তখন অনেক নিচে চলে এসেছে। তখন প্লেনটাকে ল্যান্ড করতে হলে এরোড্রামে খেলা দেখতে থাকা মানুষদের কম করেও এক-দেড়শোজন নিশ্চিতভাবে মারা যাবে।

আমি প্লেনটাকে একটু ওপরে ওঠাবার চেষ্টা করলাম। প্যারাসুট নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়তে হলেও কম করে দুশো ফুট অলটিটিউড দরকার, না হলে প্যারাসুট নাও খুলতে পারে। কিন্তু গতি ক্রমে শিথিল হয়ে আসতে চলা কাইটটা ততটা উপরে ইঞ্জিন ছাড়া নিয়ে যাওয়াটা সম্ভব নয়। তথাপি কিছুটা ওপরে নিয়ে গেলাম। সেখান থেকেই একবার চারপাশে তাকালাম। কিছু দূরে দেখতে পেলাম, একটা ছোটখাটো পাহাড়, আর তার ওপরে একটি বড় উঁচু গাছ।

মুহূর্তের মধ্যে সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেললাম— নিচের মানুষগুলোকে রক্ষা করতে হবে। প্লেনটা রক্ষা করতে পারব না। আর প্লেনের সঙ্গে সঙ্গে আমিও শেষ হয়ে যাব। স্থির করলাম নিজেকে এবং প্লেনটাকে রক্ষা করার সমস্ত চেষ্টা বাদ দেওয়াই উচিত হবে।

সুদর্শন কিছুক্ষণ অপেক্ষা করল। আমার যথেষ্ট কৌতূহল হয়েছিল। আমি জিজ্ঞেস করলাম, তারপরে আপনি কী করলেন?

—আপনার বিশ্বাস হবে না, তখনও আমি ধৈর্য হারাইনি। আর কয়েকটি সেকেন্ড পরে আমি আর আমার প্লেনটা চিরদিনের জন্য নিশ্চিহ্ন হয়ে যাব। সেই মুহূর্তে একবার অমৃতার কথা মনে পড়েছিল— কিছুদিনের মধ্যে, মার্চ মাসে আমাদের বিয়ে হওয়ার কথা। কিন্তু না। আমার নিজেকে রক্ষা করতে গেলে এরোড্রামের অনেক মানুষের প্রাণ যাবে। আর চিন্তা না করে প্লেনটাকে ছোট পাহাড়টার উপরের গাছের দিকে নিয়ে যেতে লাগলাম। কয়েক সেকেন্ডের ভেতরে একটা প্রচণ্ড শব্দ করে প্লেনটা পাহাড়ের গাছটাতে ধাক্কা মেরে দিল।

ট্রে-টাতে করে তিন পেয়ালা গরম কফি নিয়ে অমৃতা এল। আর টি-পয়টা রেখে আমাদের কফি দিল। সুদর্শনের কথায় আমি বিস্মিত এবং অভিভূত হয়েছিলাম। চিমনির আগুন কিছুটা নিষ্প্রভ হয়েছিল। বেশ ঠান্ডা লাগছিল।

কফির পেয়ালা আমার দিকে এগিয়ে দিয়ে অমৃতা বলল, কফি খান, অনেক রাত হয়েছে।

কফিতে চুমুক দিয়ে আমি ধীরে ধীরে বললাম, তারপরে কী হল?

—আমি কিছুই বলতে পারি না, পরের কথা অমৃতা জানে।

অমৃতা বলল, ও, ওর অ্যাক্সিডেন্টের কাহিনি—! কয়েক মিনিটের মধ্যে খবরটা ছড়িয়ে পড়ল যে সুদর্শনের চালানো প্লেনটা একটা পাহাড়ে ক্র্যাশ করে ধুলিসাৎ হয়ে গেছে। খবর পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে একটা গাড়ি নিয়ে আমি অ্যাক্সিডেন্টের জায়গায় গেলাম। কিন্তু গিয়ে কিছুই পেলাম না, পুড়ে ছাই হয়ে যাওয়া প্লেনটার দুটো স্কেলিটন ধোঁয়ার মধ্যে বেরিয়ে আছে, আর কিছু নেই।

—কিন্তু ওর?
—পাহাড়ে ধাক্কা মেরে প্লেনটা ধ্বংস করে দেওয়ার পরে কোনও পাইলট বেঁচে থাকবে বলে আশা করা যায় না। কিন্তু ইনি যে কীভাবে বেঁচে গেলেন— সেটা কেউ বুঝতে পারল না। সেটা একটা মিস্ট্রি বলেই ধরে নিতে হবে— অমৃতা বলল।
—আপনার কিছুই মনে নেই?

সুদর্শন বলল, আমার এটাই মনে আছে যে প্লেনটা গাছে ধাক্কা মারার সঙ্গে সঙ্গে কোনওভাবে আমি কেনোপি দিয়ে বাইরে বেরিয়ে এসে কোথায় যেন ছিটকে পড়লাম। কীভাবে সেটা আমি আজও বুঝে উঠতে পারিনি।

অমৃতা বলল, ডাক্তারদের মতে জ্বলতে থাকা প্লেনের কাছে যখন ওকে খুঁজছিলেন, তখন সেখানে ওর কোনও চিহ্নই দেখতে পাননি। কিছুক্ষণ পরে কেউ একজন হঠাৎ দেখতে পেলেন, তিনশো ফুট দূরের একটি গর্তে ও অজ্ঞান হয়ে পড়ে আছে। ডান চোখে একটা মস্ত লোহার রড ঢুকে রয়েছে। রডটা তখনই টেনে বের করা হল, তারপর তখনও বেঁচে আছে বলে অনুমান করে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হল।

আমি এবার সোজাসুজি সুদর্শনের দিকে তাকালাম। পরে থাকা চশমাজোড়া হাতে নিয়ে সুদর্শন বলল, আমার এই চোখটা সঙ্গে সঙ্গে শেষ হয়ে গেল। লোকেরা দেখে ভয় পায় বলে সবসময় গগলস পরে থাকি। আমার একটা চোখ খারাপ হওয়ার জন্য অপর চোখটিও ক্রমশ দুর্বল হয়ে পড়তে শুরু করেছে। এখন খুব সামান্যই দেখতে পাই, ডাক্তার বলেছে সেই চোখটা ভাল হলেও হতে পারে।

সুদর্শনের কথা আমাকে আহত করল। যুবক মানুষটি, দুটো চোখের দৃষ্টি হারিয়ে ফেলাটা বড় দুর্ভাগ্যের কথা হবে। কিন্তু আমি এমনিতেই একটু উৎসাহ দেওয়ার জন্য বললাম, নিশ্চয় ভাল হবে। অবশ্য আপনাকে খুব সাবধানে থাকতে হবে।

—আর কী হল জানেন— এই বলে অমৃতা সুদর্শনের বাঁ হাতটা নিজের হাতে নিয়ে বলল, এই হাতটা একেবারে নষ্ট হয়ে গিয়েছিল, কনুইয়ের উপর থেকে কেটে ফেলতে হল।

এতদিন আমি কথাটা বুঝতে পারছিলাম না, আজ বুঝতে পারলাম সুদর্শন কেন বাঁ হাতটা সবসময় প্যান্টের মধ্যে ঢুকিয়ে রাখে। এই হাতটা প্লাস্টিকের হাত।

আমাদের কফি খাওয়া শেষ হয়ে গিয়েছিল। আমি বললাম, নিজের জীবনটা রক্ষা করার উপায় থাকা সত্ত্বেও আপনি কেন এরকম একটি দুঃসাহসিক কাজ করলেন মিঃ আবস্তি?

—উৎসবে আত্মহারা হয়ে থাকা একদল মানুষের জীবন ধুলোয় মিশিয়ে দেওয়ার চেয়ে নিজের জীবনটা শেষ করে দেওয়াটাই শ্রেষ্ঠতর নয় কি? সেই সময়ে আমি আর এর চেয়ে ভাল সিদ্ধান্ত নিতে পারিনি।

সুদর্শনের প্রতি একটা অকথিত শ্রদ্ধায় মাথা আপনা থেকেই নিচু হয়ে এল।

অমৃতা বলল, ওর জীবন রক্ষা পাওয়াটা সত্যিই একটা প্রভিডেন্সিয়াল কথা। খবরের কাগজগুলিও এই বিষয়ে বিস্ময় প্রকাশ করেছিল।

সুদর্শন সুন্দর করে হাসলেন, তারপরে একটা শান্ত পরিতৃপ্তির সুরে কিছুটা উচ্ছ্বসিতভাবে বললেন, কিন্তু মিঃ মালিক, তার চেয়েও বিস্ময়ের কথা, অমৃতার মতো একটি মেয়ে পড়াশোনা ছেড়ে দিয়ে, একটি অন্ধ, পঙ্গু মানুষকে স্বেচ্ছায় বিয়ে করাটা, ফর মি দ্যাট ইজ এ গ্রেটার মিরাকল। এখন তো আমি চোখে দেখতে পাই না বলে ভাবতেও ভুলে গেছি। অমৃতা ইজ মাই আই।

আমি অমৃতার দিকে তাকালাম। একটা উদার তৃপ্তিতে অমৃতার মুখটা লাল হয়ে উঠেছে। অথচ অমৃতা যেন সুদর্শনের এই কথায় আমার সামনে কিছুটা লজ্জিত বোধ করছে।

বিছানায় শুয়ে আমি কেবল একটা কথাই বোঝার চেষ্টা করছিলাম, সুদর্শন এবং অমৃতা— কার চেয়ে কার ত্যাগ বেশি?…

তিন বছর পরে দিল্লিতে গিয়েছিলাম, রিট্রিটে পুনরায় কয়েকদিন ছিলাম, খুঁজে খুঁজে সুদর্শনদের বাড়িতে গিয়ে উপস্থিত হলাম। তারা আগের জায়গায় নেই।

আমাকে দেখে অমৃতা আদর করে নিয়ে গেল। সুদর্শনও বেরিয়ে এল।

দেখলাম সুদর্শনদের মধ্যে একটি ছোট স্বর্গ রচিত হয়েছে। একটি সুন্দর সুঠাম স্বাস্থ্যবান শিশু খেলনা নিয়ে হেসে হেসে খেলছে।

অমৃতাকে জিজ্ঞেস করলাম, আপনারা ছেলেটির কী নাম রেখেছেন?

অমৃতা সলজ্জ হাসির সঙ্গে বলল, আমাদের ছেলের নাম? তার নাম মানবেন্দ্র সুদর্শন আবস্তি…

তারপর গোলগাল ছেলেটিকে এনে অমৃতা আমার কোলে তুলে দিল।

 

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 4953 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

Be the first to comment

আপনার মতামত...