ছায়াপাখি, এক আকাশের নিচে— পর্ব ৭ (প্রথমাংশ)

বিশ্বদীপ চক্রবর্তী

 

পূর্ব প্রকাশিতের পর

চড়ুইবেলা

এক.

সাফল্যের একটা মাদকতা আছে। সেটা পরমেশও বলেছে শানুকে। নেশা, কিন্তু আচ্ছন্ন হওয়ার জন্য নয়। আরও ভাল করার, অনেক বড় কিছু পাওয়ার আকাঙ্ক্ষা তৈরি হয়, সেরকম নেশা। হয়তো ঠিক, কিন্তু সাফল্য তো উপভোগও করতে হয়। ভাবলেও কথাটা মুখে প্রকাশ করেনি শানু। পরমেশ পইপই করে বলেছে, এটা সিঁড়ির একটা ধাপ মাত্র, এরকম অনেকগুলো ধাপ তোকে পেরোতে হবে। কোনওভাবে ঢিলে দেওয়ার সময় এটা নয়। অতএব শানুর পড়ার রুটিন আরও জোরদার হয়েছে। বই মুখে করে বসে থাকার সময় বেড়েছে। পরমেশের প্রত্যক্ষ তত্ত্বাবধানে দিন-রাত্রি এক করে পড়া শুরু হয়েছে। নিজের জন্য সময় কমতে কমতে তলানি। তবু তার মধ্যে ফাঁক পেলেই সাইকেল করে বেরিয়ে পড়ে শানু। অনির্দিষ্টের সন্ধানে। এক বিশেষ আকর্ষণ রেলের মাঠ। স্বপনের কাছে নারীরহস্যের পাঠ চুম্বকের মতো টানে। স্বপনের সঙ্গে বসে লুকিয়ে বিড়ি টানে। স্বপনকে বিড়ি লুকাতে হয় কালীপদর জন্যে। শানু জানে বাবার কানে গেলে উত্তমমধ্যম জমা থাকবে এই বয়সেও। তাই চোখকান খোলা রাখতে হয়। তার উপর সে অনেককে চেনে না, কিন্তু স্কুল ফাইনালের রেজাল্টের পর তার একটা পরিচিতি হয়েছে। সেটা এমনিতে ভালই লাগে শানুর, কিন্তু লুকিয়ে কিছু করতে হলে মনে ভয় থাকে। কেউ যদি দেখে ফেলে সাতশো ষাট-শানু একটা বস্তির ছেলের সঙ্গে বসে বিড়ি খাচ্ছে, তাহলে আর দেখতে হবে না।

শানুর আর একটা মুক্তির জায়গা হয়েছে রেখাদের বাড়ি। স্কুলফাইনালের পরেই বাবাকে বলেছিল, এবার ইংরাজিটা কারও কাছে পড়তে হবে। স্কুলফাইনালে ওটাতেই একটু কম পেয়েছিল, না হলে আরও ভাল করতে পারত। চাই কি স্টেটে ফার্স্ট আসতে পারত। পরমেশ বারণ করেনি। রেখার বাবা কলেজে ইংরেজি পড়ায়। তার কথা বলতে বাবা জিজ্ঞেস করেছিল, ওই ভদ্রলোককে চিনলি কেমন করে? আর কে পড়ে ওনার কাছে? তারা কি ভাল নম্বর পেয়েছে?

পরমেশের এইসব প্রশ্নের জন্য শানু তৈরিই ছিল। যারা রেগুলার পড়ায়, তাদের একেকজনের বড় বড় ব্যাচ বাবা, সেখানে পড়ে আমার কোনও লাভ হবে না। উনি কাউকে পড়ান না বলেই আমি আরও পড়তে চাইছি, যাতে স্পেশাল অ্যাটেনশান দিতে পারেন।

—কেউ যদি ওর কাছে না পড়ে, তুই জানলি কী করে?
—হীরকের কাছ থেকে। ওর পাড়ায় থাকে কিনা। মাঝেমাঝে হীরক গিয়ে ওনার কাছে কিছু দরকার হলে বুঝতে চলে যায়। বলল খুব ভাল পড়ায় নাকি। সাজিয়ে কথাটা বলতে পেরে শানুর ভাল লাগল।
—আচ্ছা? হীরককে ডেকে আনিস তো, কথা বলে জেনে নিই একবার।

হীরকের কথাটা শানু বানিয়ে বলেছিল। কিন্তু হীরককে মানাতে আর কী লাগে। যদিও জিজ্ঞেস করল, হঠাৎ ওর কাছে পড়ার এত উৎসাহ কেন রে তোর?

চোখ টিপল শানু। ধুর, আসল তো হল রেখা।

হীরকের বিস্ময় আরও বেড়ে গেছিল। মানে? শুধু রেখার সঙ্গে দেখা করার জন্য তুই ওর বাবার কাছে পড়বি? সোজা গিয়ে দেখা কর না তার বদলে। আমি গিয়ে বলব রেখাকে? কিছু কিছু কথা মুখ দিয়ে যত সহজে বেরোয়, বুকে ঢেউ তোলে তার চেয়ে অনেক বেশি। রেখার বিষয়ে শানুর এরকম লাগামছাড়া আকর্ষণ হীরকের জানা ছিল না। দুজনে কত সময় একসঙ্গে কাটিয়েছে, কিন্তু শানু সেরকমভাবে কিছু বলেনি কক্ষনও। হ্যাঁ, একদম শুরুতে যেদিন বাড়ি ভুল করে রেখাদের বাড়ি ঢুকে পড়েছিল তারপরে কিছু একটা যেন বলেছিল। কিন্তু সে তো কতদিন আগে! ব্যাস, তারপরে আর এই বিষয়ে কোনও কথা হয়নি।

—না, না তোকে কিছু বলতে হবে না। তুই শুধু আমার পিতৃদেবকে বলে দিস যে রেখার বাবার কাছে তুই মাঝেমাঝে ক্লাস করেছিস, উনি খুব ভাল পড়ান।

ক্লাসের কথায় চমকে উঠল হীরক। ক্লাস? আমি আবার কবে ক্লাস করলাম?

—আহা, একদিন বলেছিলি না একটা এসে কম্পিটিশানে লেখা জমা দেওয়ার আগে ওনাকে দিয়ে দেখিয়ে নিয়েছিলি।
—সে তো একবার মাত্র, অনেকদিন আগে।
—ব্যস, ব্যস তাতেই চলবে।

তাতেই চলে গেছিল। পরমেশ রতন ঘোষের সঙ্গে কথা বলে এল। প্রথমে রাজি হয়নি। কলেজের ছেলেদের পড়ায়, স্কুলের ছাত্র পড়াতে চায়নি। শানুর এত ভাল রেজাল্ট বলে নিমরাজি। কিন্তু প্রথম দিনেই রতন ঘোষ শানুকে জানিয়ে দিল, দেখো, যদি মনে করো আমি তোমাকে সিলেবাস ধরে ধরে পড়াব, সেটা পারব না। আমি তোমাকে ইংরেজিতে ভালভাবে লেখা শিখিয়ে দেব। গ্রামারটা রেন অ্যান্ড মার্টিন ধরে করো। কিছু প্রশ্ন থাকলে করবে, বলে দেব।

প্রধান উদ্দেশ্য রেখার সঙ্গে বন্ধুত্ব পাতানো হলেও, রতনের কাছে শানুর পড়তে খারাপ লাগছে না। বই ধরে ধরে পড়াচ্ছে না বলেই হয়তো। রতন ঘোষ প্রথম দিনেই জিজ্ঞেস করল, ইংরেজি ভাল লিখতে হলে ইংরেজি পড়তে হবে। পড়ো?

—হ্যাঁ। মাথা নাড়ল শানু।
—কার লেখা পড়েছ?
—টলস্টয়, ডিকেন্স তারপর সমারসেট মম।
—হুম ক্লাসিক ধরে ধরে পড়েছ। কবিতা?

কবিতা শানু খুব ভালবাসে, কিন্তু বেশি পড়েছে বাংলায়। আমেরিকা থেকে ফেরার পর ওর বাংলাটা ভাল ছিল না বলে, ওকে পরমেশ বাংলা বই বেশি বেশি করে পড়াত। বিদেশে থাকতে বাড়িতে বাংলা শিখেছে, কিন্তু বলায় টান ছিল। অ্যাকসেন্টের জন্য স্কুলে হেনস্থা হচ্ছিল শানু। সেই সময় পরমেশ ওকে বাংলা বই ধরে ধরে পড়িয়েছে। পরমেশ বলত, দেশে যখন ফিরে এসেছিস, এইবেলা বাংলাটা ভাল করে শিখে নে। আবার হয়তো কদিন বাদে পড়াশোনা করতে বিদেশে পাড়ি দিবি, বাংলা ভাল করে পড়া হবে না। উচ্চারণ ঠিক করার জন্য পরমেশ ওকে জোরে জোরে কবিতা পড়তে দিত। এইভাবে কবিতার প্রতি একটা ভালবাসা জন্মেছে শানুর। কিন্তু বেশি পড়েছে বাংলায়। বইয়ের বাইরে ইংরেজি কবিতা বেশি পড়া ছিল না শানুর। পড়তে এসে ওর এই লাভটা হল। রতন বইয়ের তাক থেকে একটা বই নামিয়ে আনল। এজরা পাউন্ড। আমি তোমাকে এর দুই-একটা কবিতা পড়ে শোনাই? না, না তুমি নিজে পড়ো। জোরে জোরে।

বইটা হাতে নিয়ে শানু জিজ্ঞেস করল কোনটা পড়ব?

—যেটা ইচ্ছা।

মোড়ার উপর পা ছড়িয়ে বসল রতন। শানু পাতা উল্টাতে উল্টাতে খেয়াল করল দরজার পর্দাটা একবার নড়ে উঠল। চোখ তুলে দেখল রেখা ঘরে ঢুকতে গিয়েই তাকে দেখে আবার বেরিয়ে গেল। প্রথম দিন, বোধহয় জানত না এখানে কেউ পড়তে এসেছে। এক মুহূর্তের একটু দেখা, শানুর বুকের ভিতর দামামা বাজছিল।

—কী হল পড়ো?

শানু থতমত খেয়ে পড়তে শুরু করল।

It is odd that you should be covered with long robes
And trailing tendrils and flowers;
It is odd that you should be changing your face and
Resembling some other woman to plague me;
It is odd that you should be hiding yourself in the cloud
Of beautiful women, who do not concern me.
And I, who follow every seed-leaf upon the wind!
They will say that I deserve this.

রতন মুচকি হাসল। কেমন লাগল? আরও কয়েকটা পড়ো। শুধু একটা কবিতা পড়ে কোনও কবিকে বোঝা যায় না।

বেশ কয়েকটা কবিতা পড়া হয়ে গেলে রতন জিজ্ঞেস করল, এবার তুমি একটা কবিতা লিখবে?

শানুর মুখটা লজ্জায় লাল হয়ে গেল। আমি তো কক্ষনও লিখিনি।

—আচ্ছা, বাড়িতে গিয়ে কবিতা লিখো না হয়। এখন তুমি প্রোজ লেখো।

রতন শানুকে লিখতে দিয়ে উঠে গেছে, শানু মাথা নিচু করে লিখছে, এমন সময় রেখা আবার ঢুকল। তুমি বাপির কাছে পড়তে এসেছ?

বড় করে হাসল শানু। হ্যাঁ।

কিছুক্ষণ একদৃষ্টে তাকিয়ে থেকে রেখা বলল, বাপি তো স্কুলের কাউকে পড়ায় না।

রেখার মুখের হাসিটা শানুকে আশ্বস্ত করল। আমি তাহলে স্পেশাল।

—হ্যাঁ, তা তো হবেই। এত ভাল রেজাল্ট করেছ।

শানুর ভাল রেজাল্টের কথা অনেকেই বলে, কিন্তু রেখার মুখে শুনে একটা অন্যরকমের শিহরণ হল।

লাফাতে লাফাতে ঢুকল রেখার বোন। দিদি, মা বলেছে বাপির পড়ানোর সময় এই ঘরে না আসতে। রেখা বোনকে মুখ ভেঙিয়ে চলে গেলেও, লেখা সেখানেই রয়ে গেল।

—তোমার নাম কী?
—লিপিলেখা ঘোষ।
—এইটুকু মেয়ে, এত বড় নাম?
—সবাই বলে লেখা। তোমার নাম কী?
—শানু।
—তুমি এত বড় ছেলে, এইটুকু নাম কেন?

লেখার সপ্রতিভতায় শানু হা হা করে হেসে উঠল। লেখা ততক্ষণে শানুর খাতাটা টেনে নিয়েছে। এ মা তোমার হাতের লেখা এত বাজে কেন? দিদি যে বলল তুমি স্কুলে ফার্স্ট হয়েছ?

শানুর ডানহাতটা একটু কাঁপে লেখার সময়, সেইজন্য হাতের লেখা অত ভাল নয়। কিন্তু সেই প্রশ্নে না গিয়ে জানতে চাইল, আমার বিষয়ে দিদি আর কী কী বলেছে?

লেখা খাতা থেকে চোখ তুলে শানুর দিকে তাকাল। না, একজনের কথা আর একজনকে বলতে নেই। মা বলেছে। বলেই একছুটে বেরিয়ে গেল। তবু রেখা ওর বিষয়ে এইটুকু ছোট বোনকে কিছু বলে থাকতে পারে, এই ভাবনাটা শানুকে আর লেখায় মন বসাতে দিল না। শুধু আফশোস রেখার সঙ্গে ভাল করে কথা বলা হল না। সপ্তাহে একদিন পড়তে আসার কথা। পুরো একটা সপ্তাহ এই চিন্তা মাথায় নিয়ে কাটানো কী দুঃসহ। সব সময় মাথায় শুধু রেখা। অঙ্ক ভুল করে পরমেশের কাছা দাবড়ানি খেতে হল কয়েকবার। উড়ু উড়ু মন কেন তোমার? এইসব অঙ্ক ভুল করছ, লজ্জা হয় না? আগে হলে দুই-একটা চড়চাপড় জুটে যেত নির্ঘাত! কিন্তু শানু এখন তার পরোয়া করে না। পরের বৃহস্পতিবার একটু আগে আগেই পৌঁছে গেল।

মাধুরী দরজা খূলে ভিতরে বসাল। ও তো এখনও কলেজ থেকে ফেরেনি, তুমি একটু বোসো।

এখন শানুর একটু লজ্জা লাগছিল। বড্ড বেশি আগে চলে এসেছে। এটা ঠিক নয়। অন্য ঘরের থেকে রেখার গান ভেসে আসছে। সন্ধ্যাবেলায় রেওয়াজ করছে। সন্ধ্যা নেমে আসছে, এখন রাস্তায় অনেক সাইকেল, রিকশা, লোকজন। তাদের সম্মিলিত আওয়াজ। সব ছাপিয়ে রেখার কণ্ঠস্বর জেগে রইল শানুর চেতনায়। বাড়ির আরেক কোণ থেকে শাঁখের আওয়াজ এল তিনবার। গান বন্ধ হল। শানু চেয়ার ছেড়ে উঠে বইয়ের তাকে বই দেখতে গেল। আগের দিন এজরা পাউন্ডের কবিতা খুব ভাল লেগেছিল ওর। স্যারের বইয়ের র‍্যাকে আরও অনেক কবিতার বই। এলিয়াট, নেরুদা, টেনিসান। টেনে নিয়ে পড়ছিল, বুঝতেও পারেনি কখন রেখা ঘরে এসেছে।

—বাপি এখনও আসেনি?

লম্বা ঝুলের গোলাপি ফ্রক পড়ে পর্দা ধরে দাঁড়িয়ে রেখা। একটু দ্বিধাগ্রস্ত, ঘরে ঢুকবে কি ঢুকবে না ভাবছে। বড় বড় চোখের দৃষ্টিতে সেই সংশয়। শানুর মনে হল জঙ্গলে ছুটতে ছুটতে যেন একটা হরিণী দাঁড়িয়ে পড়েছে। সমস্ত শরীর স্থির, কিন্তু যে-কোনও মুহূর্তে আবার কোনওদিকে ছুটে চলে যাবে। রেখাকে ওইভাবে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখতে চাইছিল আরও কিছুক্ষণ, কিন্তু ধরে রাখতে না পারলে হারিয়ে যাবে এই ভাবনায় কথায় বেঁধে ফেলার চেষ্টা করল।

—তোদের বাড়ির ছোট পুলিশটা কোথায়?

রেখার চোখে হাসি ঝিলিক মারল। এত সুন্দর হাসি কেন ঢাকতে হবে শানু জানে না। কিন্তু রেখার বাঁ হাতটা মুখের কাছে উঠে এল, আঙুলগুলো ছড়িয়ে পড়ল ঠোঁটের উপর আলগোছে। দাঁড়াও লেখিকে বলছি। চেনো না তো ওকে, বুকে বসে দাড়ি উপড়াবে তোমার।

—আমার তো দাড়ি নেই, তাহলে ওর জন্য এবার রাখতে হবে।

এবারের হাসিটা অনেক খোলামেলা হল। বাঁ হাত মুখের উপর এল না। শানু রেখার পাতলা ঠোঁটে ঘেরা দাঁত, দাঁতের ফাঁক দিয়ে জিভের ঝলক দেখতে দেখতে শিহরিত হল।

—আমাকে একটা জিনিস দিতে পারবে?
—কী?
—তোমার হিস্ট্রির নোটস? হিস্ট্রিতে লেটার পেয়েছ, নিশ্চয় খুব ভাল নোটস আছে তোমার।

রেখা যা কিছু চাইলেই দিয়ে দিতে প্রস্তুত ছিল শানু। হিস্ট্রির নোটস তো সামান্য ব্যাপার। কিন্তু প্রশ্ন করল অন্য। তোর পুরনো দিনের কথা পড়তে ভাল লাগে?

—খুব। আমি তো আয়নার সামনে ঝাঁসির রানি লক্ষ্মীবাই সাজি কত…
—আচ্ছা বল তো— প্রশ্নটা কিছুক্ষণ হাওয়ায় ঝুলিয়ে রাখল শানু— তোর সঙ্গে আমার কবে প্রথম দেখা হয়েছিল?
—আমি ভাবলাম ইতিহাসের প্রশ্ন করবে বুঝি।
—এটাও তো ইতিহাস, মানুষের কথা নিয়ে।
—আমার তো মনে নেই। স্কুলে দেখলাম নিশ্চয়। তুমি আমাদের ক্লাসে ছিলে কিছুদিন। তবে অন্য সেকশানে।

শানুর মনটা একটু দমে গেল। সেটা মুখে প্রকাশ না করে বলল, গোল্লা পেলি। আমি একদিন তোদের বাড়িতে ভুল করে চলে এসেছিলাম হীরকের খোঁজে। তুই বললি, হীরক তো এখানে থাকে না।

—ওরে বাবা, তোমার স্মৃতিশক্তি দেখছি খুব প্রখর। হবে না? স্কুল ফাইনালে স্ট্যান্ড করা ছেলে।
—হ্যাঁ, আমার মনে থাকে। তুই সেদিন একটা সবুজ কালো ছাপা স্কার্ট পরেছিলি, উপরে হলদে ম্যাগিহাতা জামা। দুটো বিনুনি সাপের মতো তোর কাঁধ ছাড়িয়ে এলিয়ে পড়েছে। রেলিং-এ হাত দিয়ে গম্ভীর মুখে বললি, হীরু এই বাড়িতে থাকে না।

রেখা অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল কিছুক্ষণ। তারপর সন্ধ্যা হয়ে গেছে, আমায় পড়তে বসতে না দেখলে মা এবার রেগে যাবে, বলে যেমন হঠাৎ এসেছিল তেমনি হঠাৎ বেরিয়ে গেল।

সেই সন্ধ্যায় শানুর মন ভরপুর হয়ে রইল। বাড়ি গিয়ে খুঁজে বের করল তার হিস্ট্রির নোটস। বুঝতে পারছিল আরও এক সপ্তাহ রেখার জন্য অপেক্ষা করা তার পক্ষে সম্ভব নয়। স্কুল ছুটির সময় ক্লাস টেনের বিল্ডিঙের বাইরে নোটস নিয়ে রেখাকে দেওয়া যায়। কিন্তু অনেকের চোখে পড়বে। সেটা এড়াতে স্কুল থেকে সোজা ওর বাড়িতেই চলে এল। বাগানে লেখা খেলছিল। শানুকে দেখেই ছুটে এল। ছোট নামের বড় ছেলে, খেলবে আমার সঙ্গে?

—কী খেলছিস তুই?
—ঝুলা, তুমি পিছন থেকে ঠেলবে।
—ঠিক আছে, ঠেলব আমি। আগে তোর দিদিকে একবার ডাক।

রেখা সদ্য স্কুল থেকে এসেছে, এখনও স্কুলের পোশাকে। শানুকে দেখে অবাক হল, কিন্তু চমকায়নি। এরকম হতে পারে তার আন্দাজ ছিল। নোটসের খাতা ভর্তি ব্যাগটা হাতে নিয়ে অবশ্য বলল, ওরে বাবা, এত পড়েছ! এ যে বড্ড ভারী।

শানু হাসল। চাইলে পড়িয়েও দিতে পারি।

রেখার চোখে এবার ঝিলিক। আর নিজের পড়াটা কে পড়বে?

ঘরে ঢুকে ব্যাগ থেকে খাতাগুলো বের করতেই গড়িয়ে পড়ল একটা চিরকুট।

Even in my dreams you have denied yourself
To me,
You have sent me only your handmaids.

কোনও সম্বোধন নেই। কে লিখেছে জানানো নেই। কিন্তু কার জন্য এই লেখা বুঝতে রেখার অসুবিধা হল না। জানালা দিয়ে শানুকে তখনও বাগানে দেখতে পাওয়া যাচ্ছিল। লেখার পিছনে দাঁড়িয়ে বেলগাছে ঝোলানো দড়ির দোলনা ঠেলছে। লেখার খিলখিল হাসি, বিকেলের নরম আলো, পড়ন্ত রোদে ঝলকানো শানুর কচি দাড়ি জড়ানো মুখ রেখার বুকের মধ্যে একটা ঘোড়াকে দৌড় করিয়ে এই শান্ত বিকেলটাকে একটা অবুঝ অবাধ্যপনায় পথভুল করিয়ে দিল।

 

[আবার আগামী সংখ্যায়]

 

 

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 4953 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

1 Trackback / Pingback

  1. ছায়াপাখি, এক আকাশের নিচে— পর্ব ৭ (দ্বিতীয়াংশ) – ৪ নম্বর প্ল্যাটফর্ম

আপনার মতামত...