ছায়াপাখি, এক আকাশের নিচে— পর্ব ৭ (দ্বিতীয়াংশ)

বিশ্বদীপ চক্রবর্তী

 

পূর্ব প্রকাশিতের পর

চড়ুইবেলা

দুই.

অজয় নদীর পাড়ে বসেছিল দুজনে। বর্ষার পর, তাই স্রোতের টান খুব। কুলকুল ধ্বনি অবিরাম। সঙ্গে কতরকম পাখির ডাক।

—পাখিদের জলসা বসেছে যেন, না রে?

স্কুলব্যাগ দুটো সাইকেলের পাশে মাটিতে শোয়ানো। সেটা দেখিয়ে রেখা বলল, বাড়িতে জানতে পারলে আস্ত রাখবে না।

—কী জানতে পারলে? শানুর মুখে বুঝতে পারছে না এরকম ভাব।
—ন্যাকামি হচ্ছে তোর? স্কুলের নামে বাড়ি থেকে বেরিয়ে চলে এলাম গড় জঙ্গলে, ভয় লাগছে না তোর?

এর আগে দুবার স্কুল পালিয়ে সিনেমা দেখেছে দুজনে। তার জন্য অনেক সাবধানতা নিতে হয়। সিনেমা হলে ঢোকার সময় দুজনে আলাদা। লাইট না নেভা অবধি ভিতরে ঢোকেইনি। ভয় করেছে তখনও, কিন্তু আজকের মতো স্কুলে একেবারেই না-যাওয়াটা আর তারপরে এতদূরে চলে আসা, এখন বুক ঢিবঢিব করছিল রেখার। ভয় আর ভালবাসা হাত ধরাধরি করে চলে।

—সিনেমা হলের থেকে এখানেই বেশি সেফ। আর কেউ নেই এখানে।

শানু আঙুল দিয়ে মাটিতে ছবি আঁকছিল। রেখা ঝুঁকে পড়ল দেখতে। রেখার চুল শানুর বুকের উপর হালকা ছোঁয়ায় লুটাচ্ছে, ভারসাম্য রাখতে ডান হাত শানুর কাঁধে। রেখার শরীর থেকে জলপাইয়ের মতো ঝাঁঝালো গন্ধের অনুভুতি শানুর রন্ধ্রে রন্ধ্রে প্রবেশ করছিল।

—এটা কাদের বাড়ি রে শানু?
—আমরা টেক্সাসে যে বাড়িটায় থাকতাম, অনেকটা এরকম দেখতে।
—তোদের বাড়িগুলো কি রূপকথার বাড়ির মতো ছিল শানু?
—কাঠের বাড়ি তো, ওইরকম ধরন। এই বাড়িটা আবার অনেক পুরনো ছিল, সত্তর-আশি বছর বয়স ছিল বাড়িটার। তাই গ্রিমস ব্রাদার্সের বাড়ির মতো লাগত আমার। বছর ছয়েক আগের ব্যাপার মোটে, তবু মনে হয় কত দূরে সেই সব দিনগুলো। ওই জীবনটা এখন রূপকথার মতো মনে হয়।
—ছেড়ে এসেছিস বলে কষ্ট হয় বুঝি? রূপকথা থাকলে রাজকন্যাও তো ছিল? ঘাসের ডাঁট দিয়ে এখন নিজের মতন ছবি আঁকছিল রেখা।

শানু হাসতে হাসতে বলল, তোর রেখাচিত্রটা কিসের রে চিত্ররেখা?

—কথা ঘোরাচ্ছিস তুই। বল না ওখানে কে তোর রাজকন্যা ছিল?
—আমার তো একটাই রাজকন্যা।

কথাটা খুশি করল রেখাকে। কিন্তু কথাটার পিছু ছাড়ল না। আহা, আমি তো তখন ছিলাম না। সেই সময়?

—আমার এক বন্ধু ছিল অ্যালিস।
—কীরকম বন্ধু ছিল? তুই ভালবাসতিস? হিংসুটে চোখে তাকাল রেখা।
—ধ্যাত! এলিমেন্টারি স্কুলে পড়ি, ভালবাসা কথাটার কী মানে তখন? রেখার চোখের দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসল শানু। তোর চোখটা এখন একদম ধারালো ছুরির মতো রেখা? আমার বুক চিরে দেখতে চাইছে।

জিভ ভেঙাল রেখা। আমি অত কঠিন কথা বুঝি না, আমি তো আর স্কুল ফাইনালে স্ট্যান্ড করা ছেলে না। আমাকে অ্যালিসের কথা বল।

—এখন কি অত মনে আছে?

মুখে বলল, তবু মনে করার চেষ্টা করল অ্যালিসকে। অ্যালবামে স্কুলের একটা ছবি আছে, মাঝে মাঝে দেখে। না হলে মুখটাই হয়তো ভুলে যেত। খুব লম্বা ছিল মেয়েটা বয়সের তুলনায়। শানুর চেয়ে লম্বা। মা অবশ্য বলেছে ওখানে বাচ্চারা যে বয়সে স্কুলে ভর্তি হয়, শানুকে তার এক বছর আগে ভর্তি করা হয়েছিল। ছোটবেলায় এক বছরের ফারাকে চেহারার বাড় অনেক বেশি থাকে।

রেখা এমনভাবে শানুর মুখের দিকে তাকিয়ে কথা শুনছে যেন চোখ দিয়ে প্রতিটা শব্দ ছুঁয়ে ছুঁয়ে দেখতে চাইছে।

—কেমন দেখতে ছিল ওকে?
—খুব ধারালো চেহারা ছিল, হয় না কাটা কাটা চোখ মুখ? বাদামী চুলের গোছা এক ঝুটিতে বাঁধা থাকত সবসময়।
—পনিটেল?
—হ্যাঁ। একটা ব্যান্ড পড়ত কপাল বরাবর। সফট বল খেলত কিনা, চোখে যাতে চুল এসে না পড়ে। খুব হাসত সবসময়, সবুজ চোখ ঝিকমিক করত অ্যালিস হাসলে।
—সবুজ চোখ, বিড়াল না কি?
—ধ্যাত, ওরা আইরিশ ছিল তো, ওদের চোখ কটা হয়। পুরনো কথা ভাবতে ভাবতে শানুর চোখটা দূরে হারিয়ে যেতে চাইছিল। অস্ফূটে বলল, খুব ভাল মেয়ে ছিল অ্যালিস।
—কেন, ভাল কেন? খুব ভাব ছিল বুঝি তোর সঙ্গে? আসলে রেখা বলতে চেয়েছিল, অ্যালিস বুঝি তোকে ভালবাসত শানু? মুখে বলল, তোর সঙ্গে টিফিন ভাগ করে খেত অ্যালিস?

এবার হো হো করে হেসে উঠল শানু। ইস তোর লাঞ্চবক্স থেকে খুলে পরোটা-মাংস খেয়ে নিলাম বলে এত রাগ?

—আমার জন্য শুধু হাড়টা রেখে দিয়েছিলি। পেটুক কোথাকার।

এরকম খুনসুটি করতে কী ভাল লাগে! সদ্য কৈশোর পেরোনো দুই প্রাণে এতেই কী শিহরণ।

—টিফিন ভাগ করত কিনা মনে নেই, তবে শাস্তি ভাগ করেছিল একদিন। সেটা বেশ মনে আছে।
—কীরকম?

অজয়ের বহতা জলের দিকে তাকিয়ে শানুর চোখ অতীতে হারিয়ে যাচ্ছিল। মেয়েটার মুখ অতটা ভাল করেও মনে নেই, মার কাছ থেকে নিয়ে স্কুলের ছবিটা দেখতে হবে একদিন।

—কী হল বল? আঙুল দিয়ে শানুর গালে টোকা মারল রেখা। ঠিক জানি কিছু ব্যাপার আছে, কিছুতেই বলতে চাইছিস না তোর সেই অ্যালিসের কথা।

রেখার চোখের ঝিলিকের দিকে তাকিয়ে শানু বলছিল। মনে আছে শীত চলে গেছে তখন, বোধহয় এপ্রিল। একদিন ক্লাসে মিস শোপ কোর্টরুম থেকে একটা সবুজ নীল ডোরাকাটা সোয়েটার রুলারের মাথায় করে ঝুলিয়ে এনে জিজ্ঞেস করলেন, গত একমাস ধরে দেখছি এটা ওখানেই পড়ে রয়েছে, কার এটা? মিস শোপকে আমি একটুও পছন্দ করতাম না। আমার সঙ্গে বিশেষ করে খিটখিট করত খুব।

সারা ক্লাস চুপ। হঠাৎ বনি বলে একটা মেয়ে উঠে দাঁড়িয়ে বলল, মিস শোপ, আমার মনে হয় এটা শানের। ওখানে আমাকে সবাই শান বলে ডাকত। সোয়েটারটা খুব বাজে দেখতে, পুরনো। রোঁয়া উঠে গেছে। কখনওই আমার ছিল না। বনি মেয়েটা এরকম কেন বলল কে জানে, কিন্তু মিস শোপের মনে হল বনিই ঠিক। আমাকেই যেন ওটা মানায়, আমার হওয়াটাই সবচেয়ে বেশি সম্ভব। রুলার থেকে সোয়েটারটা উল্টে পড়ল আমার ডেস্কে। আমি হতবাক। বলতে চাইলাম নো, এটা আমার নয়, কক্ষনও আমার ছিল না। কিন্তু কী বলব রেখা, কিচ্ছু বলতে পারলাম না। আমার চোখ ফেটে জল আসছিল, আমার গলা শুকিয়ে গিয়েছিল, একটাও শব্দ বেরোল না। মিস শোপ তার ইতিহাসের পাতায় গ্রিক হিস্ট্রি পড়াতে ঢুকে গেলেন। আমার কানে একটা শব্দও ঢুকছিল না। আমি আঙুল দিয়ে একটু একটু করে ঠেকে সোয়েটারটাকে আমার ডেস্কের উপর থেকে সরাচ্ছিলাম। ওটা যখন সরতে সরতে অর্ধেক ডেস্কের বাইরে এসে ঝুলছে, আবার মিস শোপের চোখে পড়ল। ওই সিড়িঙ্গে বুড়ি এবার তেড়ে এল আমার দিকে। এটা কী হচ্ছে শান। আমি চাই না এটা আবার এখানে পড়ে থাকুক। গায়ে পড়ে ফেলো এক্ষুনি। নাউ!

সেই মুহূর্তের অপমানের স্মৃতিটা এখনও কেমন জ্বলজ্বল করছে মনে, মনে হচ্ছিল সারা ক্লাস তার দিকে তাকিয়ে হাসছে। থরথর করে কাঁপছিল শানু, ভিতরে। ইন্ডিয়ান লোক খুব কম ওই দেশে। কালোদের সঙ্গে এক গোত্রে ফেলত না, কিন্তু তবু যেন ওদের মনে একটু বাইরের দিকেই ছিল তার জায়গা।

রেখার আঙুলগুলো আলতো করে ছুঁল শানুর কবজি। ওর কষ্টটা ভাগ করতে চেয়ে। শানু ফিকে হেসে বলল, ভাব একবার তখন টেক্সাসে গরম পড়ে গেছে। বেশ ভাল গরম পড়ত ওখানে এপ্রিল মাসে। তবু সেই ভেজা গন্ধওয়ালা বিশ্রী দেখতে সোয়েটারটা আমাকে পড়তে হবেই। মিস শোপ কঠিন মুখে আমার সামনে দাঁড়িয়ে আছে। সারা ক্লাস আমার দিকে চেয়ে। না-দেখেও বুঝতে পারি ওদের অনেকের মুখেই হাসি। আমি আমার ডান হাতটা ওই সোয়েটারটার মধ্যে ঢুকিয়েছি সবে, অ্যালিস উঠে দাঁড়াল। ওর রিনরিনে গলা ক্লাসরুমে ছড়িয়ে পড়ছিল। আমার এখন মনে পড়েছে মিস, এই সোয়েটারটা আমার। আমি শীতের পরে বাড়ি নিয়ে যেতে ভুলে গেছিলাম।

মিস শোপ অ্যালিসের দিকে অনেকক্ষণ তাকিয়েছিলেন। ক্লাসশেষের বেল পড়ে গেছিল। অ্যালিস ধীরে ধীরে উঠে এসে সোয়েটারটা নিয়ে নিজের ডেস্কে ফিরে গেল।

শানু অনেকক্ষণ চুপ করে রইল।

—ওটা অ্যালিসের ছিল?
—না।
—কী ভাল না মেয়েটা! অ্যালিস ফ্রম দ্য ওয়ান্ডারল্যান্ড! ফিসিফিস করে বলল রেখা। অ্যালিসকে খুব মিস করিস শানু? আমিও অ্যালিসের মতো হব, তোর সব কষ্ট আজ থেকে আমার হবে। বলতে বলতে রেখার ডান হাতটা শানুর বাঁ হাতের কবজি সজোরে আঁকড়ে ধরেছিল।
—তোদের কি মজা তাই না? তোর একটা ছোট বোন আছে, হীরকের একটা দিদি, এক ভাই। বাড়িতে একা থাকলে দুঃখ ভাগ করার জন্য কাউকে পাওয়া যায় না।
—ধুর লেখাটা এত্ত ছোট, ওর সঙ্গে মনের কথা ভাগ করা যায় না এখনও। সারাক্ষণ অবশ্য টরটর করে তোতাপাখির মতো। কিন্তু আমার বন্ধু কেমন করে হবে? আমিও তোর মতো একা খাটের চৌখুপিতে বেঁধে রাখা বেলুনের মতো উড়ছি শানু, আর ভাবছি কোনদিন আমার সেই প্রিয় বন্ধু আসবে আর খাটের দণ্ডি থেকে বেলুনের সুতোটা খুলে দেবে।
—আমি তোর সেই বন্ধু রেখা? শানুর মনের সব খুশি জড়ো হল মুখের হাসিতে।
—হয়তো, কে জানে। কদিনই বা চিনি আমি তোকে? আজকাল আমার জন্য কোনও কবিতাও লিখছিস না। দুষ্টু হাসি চোখে ঝিকমিক করছিল অজয়ের জলে ছিটকে পড়া রোদের মতো।

শানু মনে মনে লজ্জা পেল। সেই প্রথমদিন হিস্ট্রি নোটস দেওয়ার সময় একটা চিরকুটে এজরা পাউন্ডের কবিতার চারটে লাইন লিখে দিয়েছিল। পরদিন যখন দেখা হল রেখা জিজ্ঞেস করেছিল, তুমি কবিতা লেখো? গলার মধ্যে উপচে পরা প্রশংসাটা ধরতে পেরে শানু একটু ফাঁপড়ে পড়ে গেছিল। অশ্বথামা হত ইতি গজর ভঙ্গিতে বলেছিল, হ্যাঁ লিখি তো। কথাটা সত্যি, মাঝেমাঝে দুই-একটা কবিতা লিখেছে শানু। রতনস্যারের কাছেও তো লিখল। কিন্তু মনে মনে জানত রেখা জিজ্ঞেস করেছে এই কবিতাটা তার লেখা কিনা। এখন ভাবল বলে দেয়, ওই কবিতাটা তার লেখা ছিল না। ওরকম কবিতা লেখা তার সাধ্যের বাইরে। বলতে গিয়েও বলল না। পরে একদিন, আজ থাক।

রেখা উঠে পড়ে স্কার্টের পিছনে লেগে থাকা ঘাসের টুকরো ঝাড়ছিল। শানু বাড়ি যেতে হবে, এখান থেকে অনেক সময় লাগবে ফিরতে। সবাই যখন বাড়ি ফেরে সেই সময়ের মধ্যে না ফিরতে পারলে মা আমকে দেবে আজ!

—কী তাড়াতাড়ি দিনটা কেটে গেল রে আমাদের। আবার আসবি একদিন?
—অত খায় না। আমার বলে ভয়ে বুকের ভিতরটা কেমন করছে। বলতে বলতে গম্ভীর হয়ে গেল রেখা। তোর এখন পড়াশনায় মন দেওয়া উচিত শানু। সবাই তোর দিকে চেয়ে আছে। আমার জন্য তোর রেজাল্ট খারাপ হলে আমি আর কাউকে মুখ দেখাতে পারব না।
—উফ, তুই তো বাবার মতো কথা বলতে শুরু করলি রেখা। সারাদিন পড়া পড়া করে বাবা আমার মাথা খারাপ করে রেখেছে, তুই আবার সেটা নিয়ে পড়িস না।

সাইকেলের হ্যান্ডেলে নিজেকে বসাতে বসাতে রেখা বলল, তোর ভাল চাই বলেই বলছি শানু।

প্যাডেলে পায়ের চাপ দিতেই সাইকেল চলতে শুরু করেছিল। রেখার চুল এখন হাওয়ায় উড়ে উড়ে শানুর চোখেমুখে লাগবে। রেখার শরীরের জলপাই গন্ধে বুঁদ হয়ে চলতে থাকবে শানু। শুধু ভাল চাস রেখা? ভালবাসিস না আমাকে?

শেষ দুপুরের বাতাস চলছিল, জঙ্গলের পথে পাতার শনশন শব্দ। আর কোনও শব্দ ফিরে এল না শানুর জন্যে।

—সেদিন দেখলাম স্কুলের পাঁচিলে কে একটা লাল ইট দিয়ে লিখে দিয়েছে শানু+রেখা।

এবার চমকে উঠল রেখা। কোথায়, কে লিখেছে?

—আমি কী করে জানব? দেখবি স্কুলের বাথরুমে যাওয়ার দেওয়ালে। ছেলেদের।
—আর কেউ কী করে জানল? রেখার গলা ভয়ে কাঁপছিল। কথাটা কীভাবে ছড়াল? মা যদি জানতে পারে।
—যে লিখেছে ঠিকই তো লিখেছে। আমি তোকে ভালবাসি রেখা। তুই?

এবারও কোনও উত্তর এল না রেখার কাছ থেকে।

সব পাখির কিচিরমিচির ছাপিয়ে কাছে কোথাও একটা পাখি ডাকল। বউ কথা কও।

—শোন শোন রেখা, পাখিটা কী বলছে। কথা বল। বল আমাকে তুই ভালবাসিস।
—আমি তোর বউ নাকি যে কথা বলব?

এতক্ষণে আবার হাসি চলকে পড়ল রেখার মুখে। শানু রেখার মুখ দেখতে পাচ্ছিল না, কিন্তু হাসিটা নিজের চোখে দেখার জন্য ছটফট করে উঠল। সাইকেলের হ্যান্ডেল থেকে বাঁ হাত তুলে রেখার কাঁধ ধরে ঘুরিয়ে দিল রেখার মুখ। রেখার চোখে হাসিটা তখনও ভাসছিল। কিন্তু পড়ে যাওয়ার ভয় নিয়ে আর একটা অন্যরকমের হাসি দ্রুত আছড়ে পড়ছিল সমুদ্রের পরের ঢেউয়ের মতো। শানু অবাক হয়ে দেখল কীভাবে রেখার মুখের উপরে কতরকমের ভঙ্গি খেলা করতে থাকে। বুকের ভিতরটা কীরকম অবাক আনন্দে কেঁপে উঠল শানুর। কারও জন্যে একটা পরম আকুতি অনুভব করলেই শুধু এইরকম কাঁপুনি আসতে পারে। চোখের পাতা সম্পূর্ণ উন্মুক্ত করে রেখার দুটো চোখ শানুর চোখকে গেঁথে রেখেছে, অল্প খোলা ঠোঁটের ফাঁক দিয়ে দাঁতের সারি দেখা যাচ্ছে, দেখতে দেখতে শানু ভেসে যাচ্ছিল। মাটিতে পা রেখে সাইকেল থামিয়ে বাঁ হাত দিয়ে রেখার কাঁধ আরও কাছে টেনে চুমু খেতে চাইল শানু।

—না!

দুহাত দিয়ে ঠেলে সরিয়ে দিল রেখা। মাধুরীর এতদিনের পাখিপড়া করানো শিক্ষা কানে ঝনঝন করে উঠেছিল রেখার। জীবনের চলার রাস্তাটা অমন সোজা না রে মা, সামলেসুমলে চলতে হয়। বিকেলের পড়ন্ত আলোয় রেখার চুল টেনে বেঁধে জোড়া বিনুনি করে বলবে মাধুরী, দাঁতের ফাঁকে লাল ফিতেটা টেনে ধরে রাখা। সেইজন্য রেখা শুনবে হীবনের চলার রাস্তাটা হোজা না রে মা, হামলে হুমলে চলতে হয়। চুলের গোড়ায় টান পড়ায় ব্যাথায় চোখ কুঁচকাচ্ছিল রেখা। ঠিক সেই সময় হিমিকাকিমার সাদাকালো ডোরা গায়ের হুলোটা হয়তো গদাইলস্করি চালে উঠোন পার করছে। রেখা ব্যথা ভুলে হি হি করে হেসেছিল, ওই হুলোটার মতো মা, হামলে হুমলে?

পিঠে গুম করে একটা কিল পড়েছিল। সব তাতে ফাতরামি তোর। মেয়ে হয়ে জন্মেছ, সহবত শেখো। দিন দিন ধিরিঙ্গি হচ্ছ। মা রাগ করলে কিংবা দুরূহ কিছু বোঝাতে হলে তুমিতে চলে যায়। মনে রাখবে মেয়েদের শরীর মন্দিরের মতো। তাকে পরিচ্ছন্ন রাখতে হয়, পবিত্র রাখতে হয়।

এ তো একদিন নয়, মাধুরীর রোজকার বচন। রেখার মনের গভীরে একেবারে খোদাই হয়ে গেছে। তাই সজোরে মাথা নেড়ে হাত দিয়ে শানুর এগিয়ে আসা মুখ দূরে ঠেলে দিল রেখা। তাড়াতাড়ি সাইকেল চালা শানু। মার কথা মনে পড়তেই কখন বাড়ি গিয়ে পৌঁছাবে সেই ভাবনাটা চেপে ধরল একেবারে।

শানু খুব দমে গেল। রাগ করলি রেখা?

জোরে জোরে মাথা নাড়ল রেখা। এখন তাড়াতাড়ি চল শানু, সূর্যটা কোথায় যাচ্ছে দেখতে পাচ্ছিস? ভয়ে আমার বুক কাঁপছে একদম। স্কুলের কাছাকাছি পৌঁছানো অবধি আর বিশেষ কথা হল না। স্কুলের আগের মোড়ে আসতেই রেখা সাইকেল থেকে নেমে পড়ল। এখান থেকে হেঁটে স্কুলে যাবে। তারপর স্কুলছুটির পর অন্য সবার সঙ্গে তার মাসের ভাড়ার রিক্সায় চেপে বাড়ি।

চলতে চলতে একবার ঘুরে তাকাল রেখা। শানু তখনও ওর দিকে এক দৃষ্টে চেয়ে আছে। ইস, ওকে এরকমভাবে ফিরিয়ে না দিলেই হত। মার সবটাতেই বাড়াবাড়ি, মেয়েদের শরীর নাকি মন্দির। মানুষ কি অমন ইট কাঠ পাথরের হয় নাকি? এরপর কোনওদিন হলে আর না করবে না রেখা। এমনকি এখনই যেন ইচ্ছা করছে ছুটে যায়। শানুর মুখের বিষণ্ণতা মুছে দেয় একটা চুমুতে। কিন্তু রেখা জানে সেটা সম্ভব নয়, শুধু দূর থেকে একটা হাসিমাখা মুখ দেখানোর চেষ্টা করল। শানু এখন অনেকটা দূরে পড়ে গেছে। কে জানে, দেখতে পেল কিনা!

 

[আবার আগামী সংখ্যায়]

 

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 4998 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

1 Trackback / Pingback

  1. ছায়াপাখি, এক আকাশের নিচে— পর্ব ৭ (তৃতীয়াংশ) – ৪ নম্বর প্ল্যাটফর্ম

আপনার মতামত...