কোটাসংকট ও ছাত্রদল

স্বপন ভট্টাচার্য

 


রাজ্যের ছাত্রছাত্রীদের অভিবাসী হয়ে ওঠার নানা কারণ আমরা সবাই দেখতে পাই, জানিও তা! শিল্প নেই, চাকরি নেই, এসব আমরা জানি, ছেলেমেয়েরাও জানে, কিন্তু এগুলো প্রত্যক্ষ কারণ হলে পরোক্ষ কারণও কিছু কম নয়। ভাবুন, এ-বছর মে মাসের সাত তারিখে রাজ্যে হায়ার সেকেন্ডারি পরীক্ষার ফলাফল প্রকাশিত হল আর কলেজে ভর্তির পোর্টাল খুলল মাসাধিককাল পরে। গত বছর জয়েণ্ট এন্ট্রান্সের র‍্যাঙ্ক প্রকাশিত হয়েছিল ৬ জুন, আর এ-বছর জুন মাস অতিবাহিত, এখনও পরীক্ষার্থীরা দিশা খুঁজছে, তারা জানে না কোথায় পড়বে, কী পড়বে!

 

অনেক টালবাহানার পরে পশ্চিমবঙ্গে প্রথম প্রাইভেট ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ চালু হয়েছিল ১৯৮৯ সালে। টালবাহানার পরে বলছি যে কারণে তা হল, দক্ষিণে ততদিনে বেশ ভালোরকম জাঁকিয়ে বসেছে বিভিন্ন শিক্ষাব্যবসায়ীরা ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ, মেডিক্যাল কলেজ এবং ইউনিভার্সিটি নিয়ে। এখানে ঘরের ছেলেদের একমাত্র ভরসা ছিল ওই যাদবপুর, বিই কলেজের মতো গুটিকয়েক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। ছাত্রছাত্রীরা ঘরে জায়গা না পেয়ে ব্যাঙ্গালোর, চেন্নাই যাচ্ছে, এমনকি ওড়িশায় পাড়ি জমাচ্ছে এটা দেখার পরেও অনেকদিন আমাদের এখানে, বাম আমল তখন, সরকারের ওই পথে যেতে ভালোরকম দ্বিধা ছিল। কিন্তু একবার চালু হওয়ার পরে ধীরে ধীরে অনেক প্রতিষ্ঠানই গড়ে উঠল সারা বাংলাতে। এদের খরচ সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর তুলনায় অনেক বেশি। সম্পন্ন ঘরের ছেলেমেয়ে ছাড়া সাধারণ পরিবারের বাপ-মায়েদের এগুলোতে বাচ্চাদের পাঠানোর সামর্থ্য ছিল না। এদের মধ্যে হাতে গোনা কয়েকটি ছাড়া বাকিগুলো ছাত্রাভাবে খাবি খেতে শুরু করল অচিরেই। স্থায়ী শিক্ষকের অভাব, ক্যাম্পাসিং-এর ব্যবস্থা করানোয় অদক্ষতা, নমো নমো ইন্টার্নশিপ ইত্যাদি নানা কারণে যে-সব অভিভাবকেরা পয়সা খরচ করে বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে তাঁদের ঘরের ছেলেমেয়েদের পাঠালেও পাঠাতে পারতেন তাঁরাও পিছিয়ে গেলেন। তাঁরা স্থানীয় সদ্য গজানো কলেজগুলোর চাইতে তখনও রাজ্যের বাইরের পুরনো এবং বিশ্বাস অর্জন করতে পেরেছে এমন জায়গার ওপরই ভরসা করতেন। নিম্নবিত্ত বা মধ্যবিত্ত বাপ-মায়ের অগতির গতি কিন্তু ওই জয়েন্ট-এন্ট্রান্স। ফলাফলের ভিত্তিতে নামী জায়গাগুলোতে যে-সব ছাত্রছাত্রীরা জায়গা করে নিতে পারত তারা রাজ্য ছেড়ে বাইরে যেত কেবল ভালোতর কোর্সের এবং শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ডাকে, নতুবা স্টেট জয়েন্টের র‍্যাঙ্কের ওপর নিজের সম্ভাবনা বুঝে নিয়ে তারা জেনারেল ডিগ্রি কোর্সেও আসত। আমার শিক্ষকজীবনে এমন ছাত্রছাত্রীদেরই পেয়েছি অনেক যারা সদ্য গজানো প্রাইভেট প্রতিষ্ঠানে প্রযুক্তির পাঠ না নিয়ে সরকারি ডিগ্রি কলেজে ভর্তি হয়েছে এবং জীবনে ভালোভাবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। সে-কথায় না হয় পরে আসব, কিন্তু মোদ্দা কথা হল রাজ্যের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর ওপর রাজ্যের ছাত্রছাত্রীরা উপায়ান্তরহীন হয়েই হোক বা আত্মবিশ্বাসী হয়েই হোক— ভরসা রাখত। শুধু তাই নয়, জয়েন্টের ফলাফল প্রকাশিত হওয়ার পরে দেখা যেত র‍্যাঙ্ক করা অনেক ছাত্রছাত্রী আসতে চাইছে বাইরের রাজ্যগুলি থেকে। তুলনায় এ-রাজ্যে বেসরকারি ইউনিভার্সিটির আগমন ঘটেছে দেরিতে। তবে নয়া এডুকেশন পলিসি-২০২০ চালু হওয়ার পর তাদের পালে বাতাস লেগেছে। এই প্রতিষ্ঠানগুলোতে পড়ার খরচ সরকার-পোষিত প্রতিষ্ঠানগুলোর চেয়ে অনেকটাই বেশি, যে পরিবার এই খরচ বহন করতে পারবে না, তারা এগুলোতে বাচ্চাদের পাঠানোর কথা ভাবত না। যারা তা পারত, তারাও পছন্দের সরকারি কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে জায়গা ছেড়ে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হতে দৌড়েছে এমন খুব একটা শুনিনি। কিন্তু ইদানিং, এই দুই ক্ষেত্রেই হাওয়া ঘুরছে। সারা ভারতেই শিক্ষাক্ষেত্র প্রবলভাবে প্রাইভেটমুখী হয়ে যে উঠছে, সেটা চোখ-কান খোলা রাখলেই বোঝা যায়।

মনে হতে পারে এবারের পরিস্থিতি বিশেষ, কিন্তু এর ভিত্তিভূমি তৈরি হয়েছে অনেক আগে থেকেই। এবারের পরিস্থিতি যে-কারণে বিশেষ, তার পিছনে এই রাজ্যের বর্তমান সরকারটির কতগুলো সিগনেচার প্রবণতার প্রতিফলন আছে। ওঁরা যে সিদ্ধান্তই নিচ্ছেন সেটা আদালতের দরজা খুলে রেখেই নিচ্ছেন। নতুন যে ওবিসি তালিকাটি রাজ্য সরকার বার করলেন তা নিয়ে যে মামলা হবে সেটা বুঝতে অসুবিধে ছিল, অথবা চূড়ান্ত কনফিডেন্ট ছিলেন— দুটোর একটা হবে! কিন্তু সেটা শেষ পর্যন্ত পর্বতের মূষিক প্রসবের মতো হয়ে দাঁড়াল। চূড়ান্ত ওবিসি তালিকা না এলে জয়েন্টের কোটাভিত্তিক ফলাফল প্রকাশ করা যাবে না এবং একই কারণে হায়ার সেকেন্ডারি রেজাল্ট বেরিয়ে যাওয়ার দীর্ঘদিন পরেও ভর্তির পোর্টাল খোলা সম্ভব নয়— এই ছিল যাকে বলে প্রিকনসিভড নোশন— পূর্বনির্ধারিত ধারণা। র‍্যাঙ্ক বার করতে বা পোর্টাল খুলতে সেটা যে বাধা নয়, এবং এক্সিস্টিং কোটার নিয়মেই যে সেটা করা যায় এটা পর্বতের অজানা ছিল, ফলে পথে হল দেরি! রাজ্যের ছাত্রছাত্রীদের অভিবাসী হয়ে ওঠার নানা কারণ আমরা সবাই দেখতে পাই, জানিও তা! শিল্প নেই, চাকরি নেই আর থাকলেও সেটা কমোডিটি— পণ্যস্বরূপ, এসব আমরা জানি, ছেলেমেয়েরাও জানে, কিন্তু এগুলো প্রত্যক্ষ কারণ হলে পরোক্ষ কারণও কিছু কম নয়। ভাবুন, এ-বছর মে মাসের সাত তারিখে রাজ্যে হায়ার সেকেন্ডারি পরীক্ষার ফলাফল প্রকাশিত হল আর কলেজে ভর্তির পোর্টাল খুলল মাসাধিককাল পরে। গত বছর জয়েণ্ট এন্ট্রান্সের র‍্যাঙ্ক প্রকাশিত হয়েছিল ৬ জুন, আর এ-বছর জুন মাস অতিবাহিত, এখনও পরীক্ষার্থীরা দিশা খুঁজছে, তারা জানে না কোথায় পড়বে, কী পড়বে! সত্যিই কি জানে না? তারা কি সত্যিই এতটা উপায়ান্তরহীন? কয়েকদিন আগে পুরনো ছাত্রীর সঙ্গে কথা হচ্ছিল। সে কলকাতার সেরা একটি সরকারি কলেজে হেড অফ দি ডিপার্টমেন্ট। যে বিষয়, তা শতখানেক টাকায় সর্বোচ্চ মানে পড়ানো হয় তার সরকারি প্রতিষ্ঠানে, আর প্রাইভেট ইউনিভার্সিটি ওই একই কোর্স করাতে লাখ লাখ টাকা নেয়। সে বলল, এবার পরিস্থিতি ঘুরে গেছে। ওই বিষয়ে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে সিট ফুল। এত দিন কেনই বা ছাত্রেরা অনিশ্চয়তা নিয়ে অপেক্ষায় থাকবে? হতে পারে, ভালো ফলাফল করা অনেকেই ব্যাঙ্ক লোন নিয়ে হোক, বা ঘরের পয়সা দিয়েই হোক, সেসব জায়গায় চলে গেছে। হতে পারে, এদের মধ্যে শুধু জেনারেল ডিগ্রি কোর্সে আগ্রহীরা রয়েছে তা নয়, জয়েন্ট ফলাফলের প্রতীক্ষায় বসে থেকে সময় কাটানো বৃথা অনুমানে অন্য রাজ্যে চলে গেছে বা প্রাইভেট ইউনিভার্সিটিতে ডিগ্রি কোর্সে এসেছে অনেক পোটেনশিয়াল ইঞ্জিনিয়ারিং ছাত্রও। নিজেকে প্রশ্ন করি, আমি যদি অভিভাবক হতাম নন-রিফান্ডেবল লক্ষাধিক টাকা দিয়ে ভর্তি করার পরে পছন্দের কলেজে, পছন্দের কোর্সে পেলেও টাকা জলাঞ্জলি দিয়ে ফেরত নিয়ে আসতাম? উত্তর পাই না। ফলে, বেসরকারি শিক্ষাব্যবসায়ীদের পোয়া বারো! আদতে কিছু সর্বার্থসাধক উদ্দেশ্য পূরণ হচ্ছে এবং এর পিছনে কেন্দ্রীয় শিক্ষানীতিরও একটা ভূমিকা আছে।

NEP-2020, নয়া শিক্ষানীতি-২০২০ প্রবর্তন করাই হয়েছে বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর জমি শক্ত করতে। সরকারি প্রতিষ্ঠানই থাকবে আর বেসরকারি বাতিল হবে— এমন ছেলেমানুষি দাবির দিন অস্তমিত, সুতরাং সে প্রশ্ন তোলা বাতুলতা, কিন্তু নীতির চাহিদা মেটাতে সরকারি প্রতিষ্ঠানকে যেভাবে সাহায্য করা দরকার তা করা হচ্ছে কোথায়? একটা সহজ উদাহরণ দিই: নয়া শিক্ষানীতির চাহিদা চার বছরের ডিগ্রি কোর্স, যার শেষ বছরে ছাত্র রিসার্চ উপযোগী স্কিল অর্জন করবে। ভালো কথা, কিন্তু বিজ্ঞানের ছাত্রদের জন্য কলেজের ল্যাবরেটরিগুলোকেও সেই স্তরে উন্নীত করতে হবে, কে দেবে টাকা, আর কে দেবে ম্যানপাওয়ার? বেসরকারি ইউনিভার্সিটির এই সমস্যা নেই, তারা কোর্স ফি থেকেই বাড়তি শিক্ষক নিয়োগ করতে পারে, বাড়তি যন্ত্রপাতি কিনতে পারে। সরকারি বা সরকার-পোষিত কলেজে হা-হুতাশ করেও তা মিলবে এমন নিশ্চয়তা নেই। ধরুন, জেনারেল ডিগ্রি কোর্সের জন্য নয়া নীতি আরোপিত হল— ইন্টার্নশিপ, সেটা ইন্ডাস্ট্রিতে হতে পারে, অন্য প্রতিষ্ঠানে হতে পারে। এবার পশ্চিমবঙ্গের মানচিত্রে ভাবুন— ২৫১৯টি ডিগ্রি কলেজের সবগুলিতেই এই নিরিখে কতটা সুযোগ তৈরি করা সম্ভব? বেসরকারি কলেজ বা বিশ্ববিদ্যালয়ের কাছে এটা কোনও সমস্যাই নয়, কর্পোরেট প্রতিষ্ঠান তারা, ফলে এটা তাদের কাছে সমস্যা নয়, সুযোগ। তারা এই সুযোগ কাজে লাগাচ্ছে। স্কুলশিক্ষার দিকে যদি নজর রাখা যায় তাহলে আরও প্রকট হবে কীভাবে পিছু হটছে সরকারি সাহায্যপ্রাপ্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। গ্রামেগঞ্জে খুলে যাচ্ছে প্রাইভেট স্কুল আর ছাত্রশূন্য সরকারি ক্লাসরুম অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার সংগ্রামে। বাম আমলে ইংরেজি তুলে দেওয়ার সিদ্ধান্ত এই সম্ভাবনার দ্বার উন্মুক্ত করেছিল, কিন্তু গত তেরো বছরেও তো কিছু বদলাল না। উপরন্তু শিক্ষক নিয়োগ কাণ্ডের পর অভিভাবকরা আরও প্রাইভেটমুখী হয়ে উঠলে তাঁদের দোষ কোথায়? ছাত্ররা স্কুলের পাঠ শেষ করেই যদি অভিবাসী হয়ে যায় তাহলে উচ্চ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানই বা থাকবে কীভাবে? যে কালে পড়াশুনা করেছি, সে কালে বিজ্ঞানে রাজ্যের সেরা ছাত্ররা ফিজিক্স পড়ত, আর এখন শুনি সেরা কলেজগুলিতেই জেনারেল কোর্সে সায়েন্সের সিট ফিজিক্স, কেমিস্ট্রির ছাত্র পাওয়া দুষ্কর! অর্থনীতি বিষয়টি চালু রাখাই মুশকিল একাধিক কলেজে। তাহলে এই সব ছাত্ররা গেল কোথায়? তারা কি সব দলে দলে রাজ্যের বাইরে চলে যাচ্ছে? তারা কি বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সম্পদ হয়ে উঠছে ধীরে ধীরে আর আমরা তাদের যাওয়ার পথ ত্বরান্বিত করছি? জয়েন্টের র‍্যাঙ্ক তো শুধু প্রযুক্তি নয়, আরও অনেক বিশেষায়িত শিক্ষায় ছেলেমেয়েদের নিয়ে আসে। যেমন, নার্সিং, ফার্মাসি ইত্যাদি। তারাও সবাই এতদিন অপেক্ষায় রয়েছে তা না-ও হতে পারে। সব জায়গাতেই মেধা হারাতে শুরু করলে ভরসা করার জায়গাটাই তো হারিয়ে যায়!

 

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 5094 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

Be the first to comment

আপনার মতামত...