পহেলগাম-সিঁদুরের পর বিদেশনীতির পর্যালোচনা জরুরি

অমর্ত্য বন্দ্যোপাধ্যায়

 


‘যুদ্ধবিরতি’র নেপথ্যে মধ্যস্থতাকারী হিসেবে মার্কিন রাষ্ট্রপতি ডোনাল্ড ট্রাম্প নিজেই সম্পূর্ণ কৃতিত্ব দাবি করলেন। এবং সেই বিষয়ে ভারত সরকারের তরফে না কোনও প্রতিবাদ জানানো হয়, না কোনও স্পষ্ট বিবৃতি দেওয়া হয়। ট্রাম্প এমনকি ভারত ও পাকিস্তানকে কার্যত এক বন্ধনীতে রেখে মন্তব্য করেন, দুটি দেশের ‘স্বভাবগত চরিত্র’ নিয়েও তিনি কোনও পার্থক্য টানতে অস্বীকার করেন। যুদ্ধ বন্ধ না করলে দু-দেশেই বাণিজ্য বন্ধ করার হুমকি দেন। এর পরদিনই তিনি অ্যাপল কোম্পানির কর্তাকে প্রকাশ্যেই ভারতে উৎপাদন বন্ধের পরামর্শ দেন। এত কিছু সত্ত্বেও ভারত সরকারের তরফে কোনও প্রতিক্রিয়া আমরা দেখতে পাইনি

 

আলোচনার পূর্বে এ-কথা বলা প্রয়োজন— গণতান্ত্রিক এই দেশে সরকারের সমালোচনা ও অপ্রিয় প্রশ্ন তোলার মাধ্যমে সরকারকে সঠিক পথে নিয়ে আসার যে সাংবিধানিক কর্তব্য এ-দেশের সাংবাদিক, সাধারণ মানুষ ও বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলির রয়েছে, তা নিয়ে অন্য কোনও দেশ— পাকিস্তান তো দূরের কথা— বাস্তবে কোনও প্রশ্ন তোলারই অধিকার রাখে না।

অন্যদিকে, আমাদের দেশের সার্বভৌমত্ব অটুট রাখতে এবং চেনা-অচেনা শত্রুর বিপরীতে আত্মরক্ষার্থে সমস্ত প্রয়োজনীয় পদক্ষেপের পাশাপাশি নিয়ন্ত্রিত সামরিক ও প্রধানত কূটনৈতিক প্রত্যাঘাত করার যে আমাদের স্পষ্ট অধিকার রয়েছে, তা নিয়েও কোনও দ্বিমতের অবকাশ নেই।

তাই ‘সিঁদুর অভিযান’ চলাকালীন ভারতীয় পররাষ্ট্রনীতির ক্ষেত্রে যে একাধিক উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন দেখা গিয়েছে, তা নিয়ে বিস্তারিত আলোচনার যথেষ্ট অবকাশ রয়েছে। মার্কিন প্রেসিডেন্ট হিসেবে ডোনাল্ড ট্রাম্পের পুনর্নির্বাচন, এবং তার পরবর্তী সময়ে বিশ্বজুড়ে তৈরি হওয়া একাধিক নতুন সামরিক ও অসামরিক সংঘাত ও তজ্জনিত রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক কৌশলগত সমীকরণ— এই প্রেক্ষাপটে, পহলগাম-সিঁদুর অভিযানের পর ভারতীয় পররাষ্ট্রনীতিকেও আজ একেবারে নতুনভাবে ভেবে দেখা জরুরি হয়ে পড়েছে।

শুরু থেকেই আমাদের প্রধানমন্ত্রীর বারবার বিদেশ সফর এবং সেই প্রেক্ষিতে সংশ্লিষ্ট রাজনৈতিক দলের তরফে তাঁকে ‘বিশ্বগুরু’-সহ নানা অভিধায় অকৃপণ ঔদার্যে ভূষিত করা— এই প্রচার ও সরকারি আড়ম্বর বিগত প্রায় এক দশকে আমাদের চোখ-সওয়া হয়ে গিয়েছে। কাজেই ‘সিঁদুর’ অভিযানের পর যখন দেখা যায়, গুচ্ছ দেশের রাষ্ট্রপ্রধান, বিদেশমন্ত্রী বা দূতাবাস-প্রতিনিধিদের সঙ্গে উচ্চপর্যায়ের প্রশাসনিক বৈঠক সত্ত্বেও, একটি গুরুত্বপূর্ণ দেশও আমাদের এই সংঘাতে প্রকাশ্যে পাশে দাঁড়ায় না— বরং পাকিস্তানের সঙ্গে এখনই ‘মিটমাট’ না করলে ‘বন্ধু-দেশ’ আমেরিকার তরফে বাণিজ্য-বিরোধের হুমকি পর্যন্ত আন্তর্জাতিক মঞ্চে আমাদের সহ্য করতে হয়— তখন স্বভাবতই ‘নয়া ভারতের’ এই তথাকথিত নতুন ‘বিদেশনীতি’র সাফল্য ও কার্যকারিতা নিয়েও প্রশ্ন উঠতে শুরু করে।

ভারত-পাকিস্তান দ্বন্দ্বে একপাক্ষিক কূটনৈতিক সাফল্যের ক্ষেত্রে ভারতের কৃতিত্ব প্রশ্নাতীত। ১৯৭১ সালের বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময়ে, মার্চের ২৫ তারিখে বাংলাদেশের একতরফা ও সাহসিকতাপূর্ণ স্বাধীনতা ঘোষণা এবং যুদ্ধের সূচনা— এই ঘটনাক্রমের পর পশ্চিম পাকিস্তানের সঙ্গে সরাসরি যুদ্ধে নামার আগে, তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধি দীর্ঘ সময় ধরে একাধিক বিদেশ সফরের মাধ্যমে আন্তর্জাতিক মঞ্চে বাংলাদেশের বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে তুলে ধরেন।

সামরিক বিজয়ে তাঁর আত্মবিশ্বাসে কোনও ঘাটতি ছিল না। তবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র আগ বাড়িয়ে যখন সেই সংঘাতে নাক গলানোর চেষ্টা করে, তখন মার্কিন রাষ্ট্রপতি নিক্সনকে মুখের উপর কঠিন সত্য স্মরণ করিয়ে দেওয়ার স্পষ্ট দুঃসাহসও ইন্দিরার ছিল।

একইসঙ্গে, তাঁর দক্ষ কূটনীতির ফলেই— যখন মার্কিন নৌবহর বঙ্গোপসাগরে এসে পৌঁছয়, তখন সোভিয়েত নৌবাহিনীও কৌশলে সেই জায়গায় এসে উপস্থিত হয়, যেন এক অনুচ্চারিত পালটা প্রতিক্রিয়া। জোট-নিরপেক্ষ আন্দোলনের সদস্য হয়েও, কঠিন প্রেক্ষাপটে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধাচরণ করে ‘গরিব’ ভারতের এই ব্যতিক্রমী কূটনৈতিক সাফল্য আজও জাতীয় ও আন্তর্জাতিক স্তরে আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু হয়ে আছে।

ইন্দিরার পরবর্তী সময়েও ভারতের কূটনৈতিক সাফল্য ও মার্জিত ঔদ্ধত্য বজায় থাকে। ১৯৯৯ সালে ভারত সফরের আগে, মার্কিন রাষ্ট্রপতি বিল ক্লিন্টন এক ভাষণে কাশ্মিরকে ‘নিউক্লিয়ার ফ্ল্যাশপয়েন্ট’ এবং ভারতীয় উপমহাদেশকে ‘পৃথিবীর অন্যতম বিপজ্জনক এলাকা’ বলে উল্লেখ করেন। এর প্রতিবাদে, ক্লিন্টনের সম্মানে আয়োজিত এক বিশেষ নৈশভোজে— যার আয়োজক ছিলেন তৎকালীন রাষ্ট্রপতি কেআর নারায়ণন— তিনি অতিথির উদ্দেশে ‘টোস্ট’ জ্ঞাপনের সময় নিজের বক্তব্যে স্পষ্টভাবে বলেন, “এ ধরনের আশঙ্কার প্রকাশ, প্রকৃতপক্ষে, সন্ত্রাসবাদী শক্তিকেই উৎসাহিত করে যারা শান্তি চায় না।” তিনি আরও বলেন, “বিপদ আমাদের তরফে নয়, কারণ আমরা বরাবরই পরমাণু অস্ত্রের ক্ষেত্রে ‘নো ফার্স্ট স্ট্রাইক’ নীতি মেনে চলেছি। বরং বিপদ তাদের তরফে, যারা এই নীতি মানতে অস্বীকার করেছে।” এই ঘটনার পরদিনই প্রথমসারির মার্কিন সংবাদপত্রগুলিতে নয়াদিল্লির রাষ্ট্রীয় ভোজসভায় রাষ্ট্রপতি নারায়ণনের এই উষ্মা প্রকাশ গুরুত্ব সহকারে প্রতিবেদন আকারে প্রকাশিত হয়।[1]

লক্ষণীয় যে একই সফরে যৌথ সাংবাদিক সম্মেলনে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী অটলবিহারি বাজপেয়ি ক্লিন্টনের বিরুদ্ধে এতটা স্পষ্ট সুরে কথা বলেননি। তিনি কেবল মৃদুস্বরে বলেছিলেন, “আশা করব সফর শেষে ফিরে গিয়ে মার্কিন রাষ্ট্রপতি বুঝবেন, অবস্থা তিনি যতটা ভয়ঙ্কর ভেবেছিলেন, আসলে ততটা নয়।” আরএসএস-প্রাক্তনীদের মেরুদণ্ডের অভাব— সে তো সর্বজনবিদিত।

২৬/১১-র পরবর্তী সময়ে ভারত সফরে এসে মার্কিন রাষ্ট্রপতি বারাক ওবামা তাঁর ভাষণে সন্ত্রাসবাদের মদতদাতা হিসেবে পাকিস্তানের নাম সরাসরি উল্লেখ করেছিলেন। অথচ পহলগাম ও সিঁদুর-প্রত্যাঘাতের পরে, ‘যুদ্ধবিরতি’র নেপথ্যে অন্যতম মধ্যস্থতাকারী হিসেবে মার্কিন রাষ্ট্রপতি ডোনাল্ড ট্রাম্প নিজেই সম্পূর্ণ কৃতিত্ব দাবি করলেন।

এই বিষয়ে ভারত সরকারের তরফে না কোনও প্রতিবাদ জানানো হয়, না কোনও স্পষ্ট বিবৃতি দেওয়া হয়। এমনকি যুদ্ধ নিয়ে সাংবাদিক সম্মেলনে ট্রাম্প ভারত ও পাকিস্তানকে কার্যত এক বন্ধনীতে রেখে মন্তব্য করেন, দুটি দেশের ‘স্বভাবগত চরিত্র’ নিয়েও তিনি কোনও পার্থক্য টানতে অস্বীকার করেন। যুদ্ধ বন্ধ না করলে দু-দেশেই বাণিজ্য বন্ধ করার হুমকি দেন। এর পরদিনই তিনি অ্যাপল কোম্পানির কর্তাকে প্রকাশ্যেই ভারতে উৎপাদন বন্ধের পরামর্শ দেন।[2] কাঁধ ঝাঁকিয়ে স্বভাবসিদ্ধ ভঙ্গিতে আরও তাচ্ছিল্যের সঙ্গে বলেন, “ভারতের বিষয় ওরা নিজেরাই বুঝে নিতে পারবে বলে মনে করছি।”

এত কিছু সত্ত্বেও ভারত সরকারের তরফে কোনও প্রতিক্রিয়া দেখা যায়নি। উলটে, ট্রাম্পের এই মন্তব্যের বিরুদ্ধে বিজেপি সাংসদ কঙ্গনা রানাওয়াত সামাজিক মাধ্যমে একটি পোস্ট করায়, বিজেপির সর্বভারতীয় সভাপতি জেপি নাড্ডা স্বয়ং তাঁর সঙ্গে যোগাযোগ করে সেই পোস্ট মুছে ফেলতে বাধ্য করেন।[3]

একই সময়ে, ভূমিকম্প-পরবর্তী ‘অপারেশন দোস্ত’ কর্মসূচির মাধ্যমে ভারতের কাছ থেকে মানবিক সহায়তা পাওয়া তুর্কিও এই সংঘাতপর্বে সরাসরি পাকিস্তানের পক্ষে অবস্থান নেয়। এবং সেই সময়েই, মার্কিন সরকারের সঙ্গে তুর্কির নতুন সমরাস্ত্র-প্রযুক্তি সরবরাহ সংক্রান্ত চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়।[4]

এর বিপরীতে, বিস্ময়ের সঙ্গে দেখা যায়, ভারতের বিদেশমন্ত্রী এস জয়শঙ্কর ‘সন্ত্রাস-দমনের এই সংগ্রামে’ একমাত্র ‘বন্ধু’ হিসেবে আফগানিস্তানের তালিবান-সরকারের এক প্রতিনিধির সঙ্গে উচ্চপর্যায়ের বৈঠকে মিলিত হন।[5]

বিদেশনীতির আলোচনায় ‘কাঁটা দিয়ে কাঁটা তোলা’র এমন প্রয়োগ— একে অতি-সরলীকরণ বলেই মনে করছেন না তো কেউ?


[1] Sahu, SN. What the Modi Govt Can Learn From an Indian President’s Rebuttal to Bill Clinton 25 Years Ago. The Wire. May 15, 2025.
[2] এই লেখা পাঠানোর সময় অবধি ট্রাম্প অন্তত আরও দুবার প্রকাশ্য অনুষ্ঠানে ভারতে উৎপাদন বন্ধের বিষয়ে অ্যাপলকে হুঁশিয়ারি দিয়েছেন।
[3] ‘I regret…’: Kangana Ranaut deletes post on Donald Trump after Nadda’s directive. The Indian Express. May 16, 2025.
[4] US approves $304Mn missile deal with Turkey, Why Trump’s move to sell AMRAAM to Istanbul alarms India. ET Online. May 16, 2025.
[5] Bhattacherjee, Kallol. In a first, External Affairs Minister Jaishankar talks to Taliban’s acting Foreign Minister Muttaqi. The Hindu. May 16, 2025.


*মতামত ব্যক্তিগত

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 5088 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

Be the first to comment

আপনার মতামত...