জাপান, রামা কৈবর্ত এবং জিডিপির গল্প

সুমন কল্যাণ মৌলিক

 


একটি দেশের অর্থনীতি আদতে কেমন চলছে, তা বোঝা যায় সেই দেশ ক্ষুধাকে কতটা জয় করতে পেরেছে, সেই নিরিখে। অথচ পৃথিবীর ‘চতুর্থ বৃহত্তম’ অর্থনীতির ঢাকঢোল পেটানো ভারতের ৭০ শতাংশ মানুষ কোনও না কোনওভাবে খাদ্য-সংক্রান্ত নিরাপত্তাহীনতায় ভোগে। ক্ষুধা সূচকে ১২৭টি দেশের মধ্যে ভারতের অবস্থান ১০৫, যেখানে নাইজেরিয়া (১০০), কেনিয়া (৮৯), ঘানা (৭৮)— এই আফ্রিকান দেশগুলোও ভারতের চেয়ে অনেক ভালো জায়গায় রয়েছে

 

দেশপ্রেমের এই ভরা বাজারে আমরা দারুণ একটা জয় পেয়েছি। শিল্পোন্নত দেশ জাপানকে হারিয়ে ভারত এখন পৃথিবীর তৃতীয় বৃহত্তম অর্থনীতি। জিডিপি ঠিক কী বস্তু, সকালে বাজারে গেলে উন্নত অর্থনীতির অনুভব পাওয়া যায় কি না— সে প্রশ্ন অবান্তর। এখন উদযাপনের সময়। এমনটাই বলেছেন নীতি আয়োগের সিইও বিভিআর সুব্রামনিয়ম। ওনার এই সুবচনের উৎস ইন্টারন্যাশনাল মানিটারি ফান্ডের একটি অনুমান (প্রকৃত তথ্য পেতে এখনও দু-বছর বাকি)। মোদ্দা বিষয়টা হল, এই মুহূর্তে ভারতের জিডিপির সম্ভাব্য পরিমাণ ৪.১৯ ট্রিলিয়ন মার্কিন ডলার — যা জাপানের চেয়ে সামান্য বেশি। এমনকি কর্পোরেট মিডিয়াও জানাতে ভোলে না যে অর্থনীতির বহরে, দশ বছর আগের তুলনায় এখন জিডিপির পরিমাণ প্রায় দ্বিগুণ। এই সাফল্য তাই অনস্বীকার্য।

এখন দেশের অর্থনীতি যদি ভালো চলে, তবে তা নিঃসন্দেহে আনন্দের এবং স্বস্তির। কিন্তু সমস্যা হল— এই জিডিপি দিয়ে অর্থনীতির ভালোমন্দের মাপকাঠি ঠিক কতটা নির্ভরযোগ্য? এই প্রশ্ন মাথায় রেখে জিডিপি-সূচকের জনক সাইমন কুজনেটস বহুদিন আগে মন্তব্য করেছিলেন:

The welfare of a nation can scarcely be inferred from a measure of national income.

এভাবেও বলা যেতে পারে— যদি পরিপ্রেক্ষিত থেকে আলাদা করে জিডিপিকে শুধুই একটি সংখ্যা হিসাবে দেখা হয়, তবে তা নিশ্চিতভাবেই ভ্রমাত্মক। আর এই পরিসংখ্যানের খেলাটাও খুব জটিল, কারণ জিডিপির সঙ্গেই যুক্ত ‘পার ক্যাপিটা’ প্রশ্নটি— অর্থাৎ, গড়পড়তা এক ব্যক্তিমানুষের আয় কত। অর্থনীতির ভাষায়:

GDP per capita is a key economic indicator that measures the average economic output (or income) per person in a country.

স্বাভাবিকভাবেই, এই ‘পার ক্যাপিটা ইনকাম’-এর মাপকাঠিতে অর্থনীতির ভালোমন্দ বিচার করার দাবিটাও জোরদার হচ্ছে।

এই জিডিপির ইঁদুরদৌড়ে যেহেতু এই মুহূর্তে দুটি দেশের নাম ঘোরাফেরা করছে, তাই আলোচনাটা ভারত ও জাপানকে নিয়েই শুরু করা যেতে পারে। ভারতের জনসংখ্যা বর্তমানে আনুমানিক ১৪০ কোটি, আর জাপানের মেরেকেটে ১৩ কোটি। ভৌগোলিক আয়তনের দিক থেকেও পার্থক্য বিশাল— ভারতের আয়তন ৩.২৯ মিলিয়ন বর্গকিলোমিটার, আর জাপানের মাত্র ৩,৭৭,০০০ বর্গকিলোমিটার।

এই পরিসংখ্যান বলার উদ্দেশ্য হল— কোনও দেশের জনসংখ্যা ও ভৌগোলিক আয়তন যদি বেশি হয়, তবে তার মোট জিডিপির পরিমাণ বেশি হওয়াটাই অর্থনীতির সাধারণ নিয়ম। সেক্ষেত্রে বিচারটা করতে হয় ‘পার ক্যাপিটা ইনকাম’-এর ভিত্তিতে।

এইখানেই নীতি আয়োগের দেওয়া হিসাব কার্যত এলোমেলো হয়ে যায়। পৃথিবীর চতুর্থ বৃহত্তম অর্থনীতি হিসাবে ধরা ভারতের পার ক্যাপিটা ইনকাম মাত্র ২,৪৮১ মার্কিন ডলার। অন্যদিকে, নীতি আয়োগের দাবিমাফিক পঞ্চম বৃহত্তম অর্থনীতি জাপানের পার ক্যাপিটা ইনকাম ৩৪,৬৪০ মার্কিন ডলার।

অর্থাৎ, জাপানের মাথাপিছু গড় আয় ভারতের তুলনায় প্রায় ১৬ গুণ বেশি।

তাই এই তথ্যও আমাদের বিশেষ অবাক করে না যে মানব উন্নয়ন সূচকে (Human Development Index) জাপানের স্থান ২৩, আর ভারতের অবস্থান ১৩০— একেবারে নিচের সারিতে।

আমরা যদি জাপানকে বাদ দিয়ে, ইদানীং সবচেয়ে আলোচিত ব্রিকস গোষ্ঠীভুক্ত দেশগুলো (ভারত যার অন্যতম সদস্য) নিয়ে আলোচনা করি, তাহলেও ছবিটা একইরকম থেকে যাবে। ব্রিকস (ব্রাজিল, রাশিয়া, ইন্ডিয়া, চিন ও দক্ষিণ আফ্রিকা)-ভুক্ত দেশগুলোর মধ্যে অর্থনীতির বহরে ভারত দ্বিতীয় বৃহত্তম— চিনের পরেই। কিন্তু পার ক্যাপিটা ইনকামের নিরিখে দেখা যাচ্ছে ব্রাজিলের গড় আয় ১০,২৯৬ মার্কিন ডলার, রাশিয়ার ১৪,৯৫৩ ডলার, চিনের ১৩,৬৯০ মার্কিন ডলার এবং দক্ষিণ আফ্রিকার ৬,৩৭৭ মার্কিন ডলার। অঙ্কের বিচারে ভারত এই দেশগুলোর ধারেকাছেও আসছে না।

এমনকি ভারতের এই ২,৪৮১ মার্কিন ডলারের গড় আয়ের হিসেবটাও গোলমেলে। অক্সফ্যামের পরিসংখ্যান এবং বিভিন্ন আন্তর্জাতিক আর্থিক সমীক্ষা অনুযায়ী, ভারতের মোট সম্পদের ৪০ শতাংশ দেশের মাত্র ১ শতাংশ মানুষের হাতে কেন্দ্রীভূত। আমরা যদি সাদামাটা একটা হিসাব করি— যেখানে জনসংখ্যার উপরের দিকের ৫ শতাংশ মানুষের আয় বাদ দেওয়া হয়— তাহলে বাকি ৯৫ শতাংশ মানুষের পার ক্যাপিটা আয় দাঁড়ায় বছরে মাত্র ১,১৩৮ মার্কিন ডলার।

এই পরিসংখ্যানই নীতি আয়োগের তথাকথিত ‘আর্থিক সমৃদ্ধি’র বেলুনটিকে চুপসে দেয়।

এই সাম্যের সাতকাহন এই লেখার বিষয়বস্তু নয়, তবে মনে রাখতে হবে— প্রবহমান বৈষম্যের মধ্যে দাঁড়িয়ে জিডিপি দিয়ে কখনওই দেশের আমজনতার আর্থিক অবস্থা বোঝা যায় না।

ভারতের অসাম্যের আরেকটি দিক তুলনামূলকভাবে কম আলোচিত হয়— তা হল রাজ্যগুলোর মধ্যে ভীষণ বৈষম্য। দক্ষিণ ও পশ্চিম ভারতের রাজ্যগুলো মানব উন্নয়ন সূচকে তুলনামূলকভাবে ভালো অবস্থানে থাকলেও, জনবহুল মধ্যভারত (গোবলয়) ও পূর্ব ভারতের অবস্থা অত্যন্ত দুর্বল। ভৌগোলিক, সামাজিক এবং ক্ষেত্রভিত্তিক বৈষম্য— সবই এখানে প্রাসঙ্গিক।

একটি দেশের অর্থনীতি আদতে কেমন চলছে, তা বোঝা যায় সেই দেশ ক্ষুধাকে কতটা জয় করতে পেরেছে, সেই নিরিখে। অথচ পৃথিবীর ‘চতুর্থ বৃহত্তম’ অর্থনীতির ঢাকঢোল পেটানো ভারতের ৭০ শতাংশ মানুষ কোনও না কোনওভাবে খাদ্য-সংক্রান্ত নিরাপত্তাহীনতায় ভোগে। বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ প্রভাত পট্টনায়ক এক সাক্ষাৎকারে খাদ্য নিরাপত্তার প্রশ্নে ভারতকে দুর্ভিক্ষপ্রবণ সাব-সাহারান দেশগুলোর সঙ্গে তুলনা করেছিলেন। তাঁর মন্তব্য ছিল, এই সূচকে ভারতের স্কোর ২৭.৩, যেখানে সাব-সাহারান দেশগুলোর গড় স্কোর ২৬.৮— অর্থাৎ ভারতের চেয়ে ভালো। আজ সেই ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি। ক্ষুধা সূচকে ১২৭টি দেশের মধ্যে ভারতের অবস্থান ১০৫, যেখানে নাইজেরিয়া (১০০), কেনিয়া (৮৯), ঘানা (৭৮)— এই আফ্রিকান দেশগুলো ভারতের চেয়ে অনেক ভালো জায়গায় রয়েছে।

গত এক দশকে ভারতে প্রকৃত উপার্জন ১ শতাংশও বাড়েনি, কর্মহীনতা স্বাধীনতা-পরবর্তী সময়ে সর্বোচ্চ, এবং কৃষি ভয়াবহ সংকটে। এই প্রেক্ষাপটে ‘জিডিপির সংখ্যাতত্ত্ব’ এক মর্মান্তিক রসিকতার মতো শোনায়।

এই সংখ্যাতত্ত্বের অসঙ্গতি নিয়ে গুরুতর প্রশ্ন তুলেছেন জওহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক অরুণ কুমার। একথা কেউ অস্বীকার করতে পারবেন না, মোদি জমানার সবচেয়ে বড় বৈশিষ্ট্য হল তথ্য প্রকাশের ক্ষেত্রে এক ধরনের অঘোষিত নিষেধাজ্ঞা। বর্তমানে আইএমএফ যে প্রজেকশন চার্ট প্রকাশ করছে, তার ভিত্তি কিন্তু ভারত সরকারের দেওয়া তথ্য। ফলে এই তথ্যের নির্ভরযোগ্যতা নিয়ে স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন ওঠে। তার চেয়েও বড় প্রশ্ন হল— এই প্রাথমিক খসড়া তথ্যের ভিত্তিতে কি সত্যিই কোনও সিদ্ধান্তে পৌঁছনো যায়?

একটি উদাহরণ দিলেই বিষয়টি স্পষ্ট হবে। ২০২৫ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি ভারত সরকার জিডিপি-সংক্রান্ত যে সব তথ্য প্রকাশ করেছে, তার মধ্যে রয়েছে ২০২৪-২৫ সালের দ্বিতীয় পার্বিক আগাম অনুমান, ২০২৩-২৪ সালের সংশোধিত হিসাব, এবং ২০২২-২৩ সালের চূড়ান্ত হিসাব। সেই অনুযায়ী আজ ভারতীয় অর্থনীতির যে বহর দেখানো হচ্ছে, তা আদৌ সঠিক কি না, বোঝা যাবে ২০২৭ সালে। সুতরাং এই আগাম অনুমান নিয়ে সন্দেহের অবকাশ থেকেই যাচ্ছে।

একই সঙ্গে মনে রাখা দরকার, ২০২৪ সালের নভেম্বর মাসে মার্কিন রাষ্ট্রপতির আসনে ডোনাল্ড ট্রাম্প ফের ক্ষমতাসীন হওয়ার পর দুনিয়াজুড়ে যে শুল্ক-যুদ্ধ শুরু হয়েছে, তার অভিঘাতে ভারত-সহ বহু দেশ নতমস্তক হতে শুরু করেছে। এই পরিস্থিতিতে এই ধরনের কোনও অনুমানকেই চূড়ান্ত বলে ধরা যায় না।

বহু অর্থনীতিবিদ বহু বছর ধরে ভারতের জিডিপি পরিমাপের পদ্ধতি ও তথ্যের স্বচ্ছতা নিয়েও প্রশ্ন তুলে আসছেন। তবে এই প্রশ্ন তোলার মানে এই নয় যে জাপানের অর্থনীতি সঙ্কুচিত হয়নি। ৬.৬ ট্রিলিয়ন মার্কিন ডলার অর্থনীতির দেশ জাপান এখন ৪.২২ ট্রিলিয়নে নেমে এসেছে— এর পেছনে রয়েছে বৃদ্ধজনসংখ্যার বিস্তার (৩০ শতাংশের বেশি মানুষের বয়স ৬৫-এর উর্ধ্বে), উৎপাদনের শ্লথতা এবং অভ্যন্তরীণ চাহিদার ঘাটতি। কিন্তু এই সঙ্কোচনের অর্থ এই নয় যে ভারতের আমজনতার আর্থিক অবস্থার উন্নতি ঘটেছে। যে-কোনও স্কেলে বিচার করলেই দেখা যাবে, জাপানিদের আর্থিক ও মানব উন্নয়ন, এবং সামাজিক নিরাপত্তার ধারেকাছেও আমরা নেই।

জিডিপি নিয়ে চলমান বিতর্কে একটা মূল কথা হারিয়ে যাচ্ছে। আসলে আর্থিক সমৃদ্ধি ও উন্নয়ন আমরা কীভাবে বুঝব এটি কিন্তু এক মতাদর্শের প্রশ্ন।

একদল মানুষ উন্নয়ন বলতে বোঝে গগনচুম্বী অট্টালিকা, ঝাঁ চকচকে রাস্তা, শপিং মল, অফুরন্ত ভোগ্যপণ্য এবং তা কেনার মতো পকেটভর্তি টাকা। এই সক্ষমতা মুষ্টিমেয় সংখ্যক মানুষই অর্জন করতে পারে। এই মতাদর্শের মানুষের কাছে জিডিপির ঊর্ধ্বগতি একমাত্র বাস্তবতা।

অন্যদিকে, আরেক দল মনে করে উন্নয়ন ও আর্থিক প্রগতির অর্থ হল সবার পেটে ভাত, সবার হাতে কাজ, মাথার উপর ছাদ, ওষুধের ব্যবস্থা এবং শিক্ষার সুযোগ। তাদের কাছে গড় আয় বা জিডিপির বড় সংখ্যাগুলো কোনও অর্থ বহন করে না।

আর্থিক বিশ্লেষক হার্দিক জোশি সম্প্রতি বলেছিলেন, “GDP means little if it hides empty plates.” সুতরাং নীতি আয়োগের সিইওকে প্রশ্ন করা উচিত— মানব উন্নয়ন সূচক, ক্ষুধা সূচক, চিকিৎসা ও শিক্ষার সূচকে বিশ্বের শীর্ষ দশটি দেশের মধ্যে আসার জন্য রোডম্যাপ তৈরি করার ভাবনা নীতিপ্রণেতারা কবে শুরু করবেন?

 

তথ্যসূত্র:

 

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 5088 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

Be the first to comment

আপনার মতামত...