রঙিন মোড়ক, লুকানো বিপদ: কীভাবে তামাক শিল্প টার্গেট করছে আমাদের যুবসমাজ ও নারীদের

নির্মাল্য মুখার্জী

 


শিশু-কিশোরদের এই প্রবণতার পেছনে শুধুমাত্র কৌতূহল বা দুষ্টুমি নয়, বরং একটি বড়সড় পরিকল্পনার ছায়া রয়েছে— তামাকশিল্প সচেতনভাবে শিশু ও কিশোরদের লক্ষ্য করে তাদের পণ্য বিপণন করছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মহাপরিচালক ডঃ টেডরসের ভাষায়, “ইতিহাস আবারও নিজেকে পুনরাবৃত্তি করছে— তামাক কোম্পানিগুলি পুরনো নিকোটিনকে নতুন মোড়কে শিশুদের কাছে বিক্রি করছে।”

 

প্রতিদিন ভারতবর্ষে গড়ে প্রায় ৫৫০০ জন শিশু প্রথমবার তামাক ব্যবহার করছে। এটা শুধুই পরিসংখ্যান নয়— বস্তুত প্রতিদিন বহু শিশুর ভবিষ্যৎ তামাকের ছায়ায় ঢেকে যাওয়া। জাতীয় স্কুলভিত্তিক জরিপ বলছে, ১৩-১৫ বছর বয়সী স্কুলপড়ুয়াদের মধ্যে প্রায় ৮.৫ শতাংশ বর্তমানে তামাকজাত দ্রব্য ব্যবহার করে। অর্থাৎ এই সংখ্যাটা কয়েক লাখে গিয়ে ঠেকেছে।

কোনও একটি ছেলেমেয়ে, যারা বয়সে এখনও কিশোর, তারা প্রথম বিড়ি ধরিয়ে হয়তো ভাবছে, “একটু ট্রাই করে দেখি,” বা “বন্ধুরা সবাই করছে।” কিন্তু তারা এটা জানে না যে, তারা হয়তো এক নেশার দিকে হেঁটে যাচ্ছে, যেটা জীবনের সবচেয়ে অন্ধকারময় যাত্রা হয়ে দাঁড়াতে পারে। শুধু ব্যক্তিগত স্বাস্থ্যই নয়, তামাকের ব্যবহার ভবিষ্যতের কর্মদক্ষতা, সম্পর্ক, পরিবার, এমনকি জীবনের আশাও কেড়ে নিতে পারে।

এই প্রবণতার পেছনে শুধুমাত্র কৌতূহল বা দুষ্টুমি নয়, বরং একটি বড়সড় পরিকল্পনার ছায়া রয়েছে— তামাকশিল্প সচেতনভাবে শিশু ও কিশোরদের লক্ষ্য করে তাদের পণ্য বিপণন করছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মহাপরিচালক ডঃ টেডরসের ভাষায়,

“ইতিহাস আবারও নিজেকে পুনরাবৃত্তি করছে— তামাক কোম্পানিগুলি পুরনো নিকোটিনকে নতুন মোড়কে শিশুদের কাছে বিক্রি করছে।”

 

কিশোর মনকে টানে রঙিন মোড়ক ও মিষ্টি স্বাদের ফাঁদ

তামাক কোম্পানিগুলি জানে— যদি তারা কোনও কিশোর-কিশোরীকে ১৮ বা ২১ বছর হওয়ার আগেই তামাকে অভ্যস্ত করে তুলতে পারে, তাহলে সেই ব্যক্তি বহু বছর ধরে তাদের “গ্রাহক” হয়ে থাকবে। এজন্যই তাদের লক্ষ্য হল এই কিশোরসমাজ। তাদের জন্য প্যাকেট সাজানো হয় চকচকে রঙে— লাল মানে শক্তিশালী, নীল মানে হালকা, সবুজ মানে মিন্ট ফ্লেভার। কিছু প্যাকেট এমনভাবে ডিজাইন করা হয় যে দেখে মনে হয় কোনও চকলেট বা ক্যান্ডির মোড়ক।

অনেক ক্ষেত্রে এই পণ্যগুলো দোকানের চকলেট বা আইসক্রিমের পাশে সাজানো থাকে। এতে ছোটদের জন্য পার্থক্য করা আরও কঠিন হয়— কোনটা খাবার আর কোনটা নেশা, বোঝাই যায় না। এইসব “ফ্লেভারড” তামাক পণ্য (যেমন চকলেট, বুদবুদ, বা ফলের স্বাদযুক্ত অ-ধূমায়ী তামাক, ভ্যাপ পেন ইত্যাদি) কিশোরদের জন্য অত্যন্ত আকর্ষণীয়।

এটা শুধু শারীরিক নয়, মনস্তাত্ত্বিক কৌশল— তামাক কোম্পানিগুলি বোঝে কিশোরেরা কেমন চিন্তা করে, কীভাবে peer pressure কাজ করে, এবং সেটাকেই কাজে লাগিয়ে বিপণন করে।

 

নারীসমাজ: নতুন লক্ষ্যবস্তু

একসময় ভারতের গ্রামীণ সমাজে নারীরা তামাক ব্যবহার করতেন গুটখা বা জর্দা/দোক্তার মাধ্যমে। কিন্তু আজ তামাক কোম্পানিরা শহরাঞ্চলের তরুণী ও কর্মজীবী নারীদেরও লক্ষ্য করে তাদের পণ্যের প্রচার চালায় ব্যবহার করার জন্য। নারীদের জন্য তামাক কোম্পানিগুলি দীর্ঘদিন ধরেই “ফেমিনাইন” ব্র্যান্ড তৈরি করছে। আধুনিকতার নামে “slim”, “ultra-light” সিগারেট, ছোট প্যাকের “purse pack”, গোলাপি বা বেগুনি মোড়কে বিক্রি হচ্ছে মেয়েদের জন্য। ব্র্যান্ড নাম দেওয়া হচ্ছে এমনভাবে, যেন তা কোনও প্রসাধনী দ্রব্য বা স্বাস্থ্যকর পণ্য। এভাবে তামাককে সৌন্দর্য, স্বাধীনতা, এবং বন্ধুত্বের প্রতীক করে তোলা হয়েছে।

বিজ্ঞাপনগুলোতেও দেখা যায়— উজ্জ্বল মুখের তরুণী, বন্ধুদের সঙ্গে হাসছেন, কফিশপে বসে ধূমপান করছেন— এটা যেন “মুক্তমনা”, “স্বাধীনতা” বা “স্টাইল”-এর প্রতীক। অথচ এর আড়ালে আছে ক্যানসার, বন্ধ্যাত্ব, হৃদরোগের মতো বিপজ্জনক পরিণতি।

আমার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতায় একটি কিশোরী আমাকে জানিয়েছিল, সে প্রথমবার সিগারেট ধরেছিল কারণ তার এক বান্ধবী বলেছিল এটাতে মেয়েদের ‘cool’ দেখায়। তামাক কোম্পানির এই কৌশল যে কতটা গভীরে ঢুকে পড়েছে, সেটাই এই ঘটনার মাধ্যমে বোঝা যায়।

 

তামাকের সংস্কৃতি ও সচেতনতার অভাব

আমাদের সমাজে বহুদিন ধরে তামাককে একটি সামাজিক উপাদান হিসেবে গ্রহণ করা হয়েছে। খাবারের পরে পান খাওয়া, গুটখা চিবানো, নস্যি নেওয়া বা খৈনি খাওয়া, এমনকি শিশুদের দাঁত মাজার জন্য লাল দন্ত মাজনের ব্যবহার— সবই দীর্ঘদিনের অভ্যাস। ফলে শিশু-কিশোররা বাড়িতে দেখেই এই অভ্যাসকে স্বাভাবিক বলে মেনে নেয়।

বিরাট সংখ্যক মানুষ এখনও জানেন না, খৈনি কতটা ক্ষতিকারক হতে পারে। মুখের ক্যানসার ভারতের নারীদের মধ্যে অন্যতম প্রধান ক্যানসার— এবং এর পেছনে এই সমস্ত “স্বাভাবিক” তামাক ব্যবহার গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।

আরও উদ্বেগের বিষয় হল, নারীদের জন্য স্বাস্থ্যশিক্ষা ও তামাকবিরোধী সচেতনতায় এখনও অনেক ঘাটতি আছে। মেয়েরা হয়তো জানেই না গর্ভাবস্থায় তামাক ব্যবহার কতটা ক্ষতিকর, বা কীভাবে এটা তাদের প্রজননস্বাস্থ্যকে প্রভাবিত করে।

 

বয়স ২১ করলে কী পরিবর্তন সম্ভব?

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, যদি তামাক কেনার ন্যূনতম বয়স ১৮ থেকে বাড়িয়ে ২১ করা যায়, তাহলে অনেক কিশোর তামাকের নাগালেই পৌঁছতে পারবে না। কারণ, তখন তারা সহজে তাদের সিনিয়র বা বন্ধুদের মাধ্যমে এসব কিনতে পারবে না। গবেষণায় দেখা গেছে, অধিকাংশ ধূমপায়ী ২১ বছরের আগে তামাকে অভ্যস্ত হয়ে যায়। যদি কেউ ২১ বছর পর্যন্ত তামাক থেকে দূরে থাকে, তাহলে তার অভ্যস্ত হবার সম্ভাবনা অনেক কমে যায়।

“তামাক ২১” নিয়ম বলছে— ১৮ না, তামাক বিক্রি করা যাবে শুধুমাত্র ২১ বছরের উপরের ব্যক্তিদের। যুক্তরাষ্ট্র-সহ একাধিক দেশে এই আইন ইতিমধ্যেই কার্যকর হয়েছে, এবং গবেষণায় দেখা গেছে, এর ফলে কিশোরদের মধ্যে তামাক ব্যবহার উল্লেখযোগ্যভাবে কমে গেছে।

আমাদের দেশেও যদি এই পদক্ষেপ নেওয়া যায়, তাহলে একদিকে যেমন ছাত্রছাত্রীদের কাছ থেকে “দাদা তো কিনে দিল”— এই সহজ পাওয়ার পথ বন্ধ হবে, অন্যদিকে তাদের মস্তিষ্ক আরও পরিণত হওয়ার সময় পাবে। গবেষণায় দেখা গেছে, মস্তিষ্কের সিদ্ধান্তগ্রহণ ক্ষমতা পূর্ণতা পায় ২০ বছর বয়সের পর, এবং এই সময়ের মধ্যেই নিকোটিন অভ্যস্ততা শুরু হলে তা দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব ফেলে।

 

পরিবার, বিদ্যালয় ও সমাজ— একসঙ্গে পথ হাঁটতে হবে

শুধু সরকারের আইন করলেই হবে না। পরিবারে, পাড়ায়, বিদ্যালয়ে সচেতনতা তৈরি করতে হবে। বাবা-মা যেন নিজেদের অভ্যাসে পরিবর্তন আনেন, যাতে সন্তানদের সামনে তারা রোলমডেল হয়ে উঠতে পারেন। “তুমি কোরো না” বলার আগে নিজে না করলে সেই কথার ওজন থাকে বহু গুণ বেশি।

বিদ্যালয়ে শিক্ষকেরা তামাক-বিরোধী সপ্তাহ পালন করতে পারেন, ছাত্রদের দিয়ে দেওয়াল পত্রিকা বানানো, নাটক আয়োজন করা, বা “তামাক দূরীকরণ ক্লাব” গঠন করা যেতে পারে। শিক্ষক, চিকিৎসক বা সমাজকর্মীদের দিয়ে শিক্ষামূলক সেশন করালে ছাত্রছাত্রীদের মনে দীর্ঘস্থায়ী প্রভাব পড়ে।

আমরা কলকাতায় যাদবপুর বিদ্যাপীঠ স্কুলে দেখেছিলাম, একদল ছাত্রছাত্রী “No Tobacco Squad” বানিয়ে স্কুলের আশেপাশে থাকা দোকানে গিয়ে বলেছিল, “দাদা, স্কুলের ১০০ গজের মধ্যে বিক্রি করবেন না।” ওই দোকানদার তার ছোট দোকানে টাঙিয়ে রেখেছিলেন— “এখানে শিশুদের তামাক বিক্রি হয় না।” এর চেয়ে বড় উদাহরণ আর কী হতে পারে!

 

সহানুভূতি দিয়ে শুরু হোক প্রতিরোধ

আমরা যখন কোনও কিশোর বা নারীকে তামাক ব্যবহার করতে দেখি, অনেক সময় রেগে যাই বা বকাঝকা করি। কিন্তু মনে রাখা দরকার, এটি একটি নেশা। এদের প্রয়োজন পরামর্শ, সাহায্য, উৎসাহ। কেউ যদি বলতে পারে— “আমি ছাড়তে চাই”— তাহলে আমরা যেন বলি, “তোমার পাশে আছি।”

বর্তমানে ফোনে পরামর্শ দেওয়া হয় এমন হেল্পলাইন রয়েছে, প্রতি জেলার জেলা হাসপাতালে কাউন্সেলিংও হয়। বিদ্যালয়ে ‘Quit Corner’ বানিয়ে দেওয়া যেতে পারে, যেখানে কোনও শিক্ষার্থী গিয়ে গোপনে কাউন্সেলিং নিতে পারে।

 

ব্যক্তিগত উপলব্ধি

আমি বহুবার শুনেছি— “সিগারেট খেলে নাকি মানসিক চাপ কমে।” কিন্তু চাপ তো বাড়ে— স্বাস্থ্যের, অর্থের, পরিবারের। আমার এক ঘনিষ্ঠ সহকর্মী একসময় ধূমপান করতেন। তাঁর ছোট ছেলের ছবি সিগারেটের প্যাকেটে ঢুকিয়ে রেখেছিলেন, যেন প্রতিবার সিগারেট বার করতে গেলে ছেলে চোখে পড়ে। ধীরে ধীরে তিনি ছেড়ে দিতে পেরেছিলেন। এ ধরনের ছোট ছোট প্রয়াসই আমাদের আশার আলো। আমরা যদি সবাই একজোট হয়ে শিশু ও নারীদের রক্ষা করতে চাই, তবে সেটা একদিন সফল হবেই।

 

শেষ কথা

আমরা যারা বাবা-মা, শিক্ষক, বা সমাজের পথপ্রদর্শক— আমাদের সামনে আজ এক বড় দায়িত্ব। রঙিন মোড়কের পেছনে যে বিষ লুকিয়ে আছে, তা যেন আমাদের সন্তানদের অজানা না থাকে। তামাকের জগৎ অন্ধকার— কিন্তু আমরা আলো জ্বালাতে পারি। একসঙ্গে এগিয়ে চললে আমরা পারব— শিশু ও নারীদের তামাকের ফাঁদ থেকে রক্ষা করতে।


*লেখক টোব্যাকো ফ্রি জেনারেশান প্রকল্প-এর মুখ্য অধিকর্তা

 

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 5088 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

Be the first to comment

আপনার মতামত...