
সোমনাথ মুখোপাধ্যায়
এই দেশটির নাম ভারতবর্ষ, যেখানে শক, হুন, মোগল, পাঠান— এই সব জাতির মিশ্রণে তৈরি হয়েছে এক অনন্য অন্তর্লীন যাপনধারা। বিভিন্ন সময়ে গদিতে আসীন মানুষেরা কখনও কখনও এই গভীর সম্পর্কের সত্যটিকেই অস্বীকার করতে চান, আর তখনই সৃষ্টি হয় বিসংবাদ।
সম্প্রদায়ের অলীক সীমারেখা ছাপিয়ে, যখন মানুষ, মনুষ্যত্ব, এবং মূল্যবোধ এক অনন্যতার স্বাদ পেয়েছে, তখনই তৈরি হয়েছে নতুন এক কাহিনি। এমনই এক কাহিনি নিয়ে আজ হাজির হয়েছি। এই কাহিনির উৎস তামিলনাড়ু রাজ্যের মাদুরাই, যেটি পৃথিবীজুড়ে পরিচিত মীনাক্ষীর সুবিশাল মন্দিরের জন্য। তবে আমার গপ্পোটা কিছুকাল আগের। মহামারি-পরবর্তী সময় এই গল্পের পটভূমি। মাদুরাইয়েরই এক মেয়ে তসলিমা নাসরিন। বয়স ২৫, ইতিহাসের স্নাতক, বিশেষভাবে সক্ষম এক উৎসাহী তরুণী। শরীরের প্রতিবন্ধকতাকে পিছনে ফেলে, সে চায় একজন শিক্ষিকা হয়ে উঠতে। তবে, চাইলেই তো আর স্বপ্নপূরণ হয় না। উদ্যোগ নিতে হয়।
কোভিড ১৯-এর সময়কালীন নিষ্ফলা বছর দুটি গভীর ক্ষত রেখে গেছে বিশ্বময়। শিক্ষার জগতে নেমে এসেছে গভীর শূন্যতা। কীভাবে এই শূন্যতাকে পূরণ করা সম্ভব, তা নিয়েই চলছে নানা পরিকল্পনা। এই সময় তামিলনাড়ুর পঞ্চায়েত বিভাগের একটি জনপ্রিয় প্রকল্প ছিল ইল্লাম থেডী কালভি (ITK) প্রকল্প, যার মুখ্য উদ্দেশ্য ছিল, যদি ছোট ছোট শিশুরা স্কুলে না পৌঁছায়, তাহলে শিক্ষাকে তাদের দুয়ারে পৌঁছে দেওয়া— এক কথায়, দুয়ারে স্কুল প্রকল্প। এই প্রকল্পের অধীনে ভেল্লারিপাত্তি পঞ্চায়েত সমিতির অধীনে ১৩ জন স্বেচ্ছাসেবী শিক্ষিকা নিযুক্ত হন, যাঁরা গ্রামে গ্রামে কোভিডের সময় স্কুলছুট অথবা স্কুলবিমুখ শিশুদের পড়াশোনার সুযোগ করে দেবেন। স্কুলের পড়া আর বাড়ির পড়ার মধ্যে সঙ্গতি স্থাপন করাই ছিল প্রকল্পটির মুখ্য উদ্দেশ্য। এই দায়িত্ব কারা নেবেন, তা ঠিক করতে একটি পরীক্ষা নেওয়া হয়। তসলিমা সেই পরীক্ষায় সসম্মানে উত্তীর্ণ হন। শিক্ষিকা হওয়ার যে স্বপ্ন তিনি একদিন দেখেছিলেন, তা সাময়িক কালের জন্য হলেও এবার বাস্তবায়িত হল।
মেলুর তালুকের মুন্নামালাইপাত্তি গ্রামের শিশুদের মধ্যে কাজ করতে হবে তসলিমাকে। এই গ্রামের মুরুগান স্বামী (কার্তিক ঠাকুর)-র মন্দিরের চাতালে চলবে তসলিমা নাসরিনের সান্ধ্য পাঠশালা। হিন্দু দেবতার মন্দিরে একজন অপর ধর্মের শিক্ষিকা পড়াবেন? গ্রামের মানুষজন কি আপত্তি জানিয়েছিল? এমন অনাচারের বিরুদ্ধে তারা প্রতিবাদ করেনি? না, তারা বরং পঞ্চায়েত কর্মকর্তাদের কাছে জানিয়ে দিয়েছে, তসলিমা আসছেন, আলো নিয়ে আসছেন, ঘনায়মান আঁধারে শিক্ষার আলো ছড়িয়ে দিতে। একজন শিক্ষিকার ধর্ম কী, তা নিয়ে প্রশ্ন তুলতে যাবে কে? শিক্ষার সঙ্গে যেমন জাতি, ধর্ম, বর্ণের কোনও সম্পর্ক নেই, ঠিক তেমনই, কে শিক্ষা দিচ্ছে, তা নিয়েও বিরোধের কোনও অবকাশ নেই। তসলিমাকে আমরা সবাই আন্তরিকভাবে স্বাগত জানাই। এটাই ভারতবর্ষের প্রকৃত চেহারা, বিভেদহীন ভারতের অমলিন সত্তার উজ্জ্বল অভিজ্ঞান।
নির্দিষ্ট দিনে মুন্নামালাইপাত্তিতে তাঁর কর্মস্থলে পৌঁছে তসলিমা রীতিমতো অবাক হয়ে গেলেন। মন্দিরের চাতালে পা রাখতেই এক অভূতপূর্ব দৃশ্যের অবতারণা হল। স্কুলের পড়ুয়ারা ছুটে এসে তাঁকে সাদরে বরণ করে নিল। তারপর সবাই মিলে সুর মিলিয়ে পাঠ করতে শুরু করল এক তামিল কবিতা। এই সম্মিলিত কবিতাপাঠের মধ্যে দিয়েই শুরু হয় তাদের সান্ধ্য পঠনপাঠনের পর্ব। তসলিমার কাছে এ যেন “এলাম, দেখলাম, জয় করলাম”-এর এক স্বপ্নিল পর্ব হয়ে উঠল।
হাসিমুখে তসলিমা শুরু করেছিলেন তাঁর স্বপ্নের শিক্ষয়িত্রী জীবনের পথচলা। আজ বেশ কয়েকটি বছর পার হয়ে গেলেও কেউ একবারও প্রশ্ন করেনি বা ঘাড় বেঁকিয়ে আপত্তি করেনি যে, কেন একজন ভিনধর্মের মানুষ হিন্দু সম্প্রদায়ের আরাধ্য দেবতার মন্দিরে প্রবেশ করবেন। আসলে এখানে উল্টোটাই ঘটেছিল। গ্রামের মানুষজন সম্মিলিতভাবে আসন পেতে দিয়েছিলেন তসলিমা নাসরিনকে, যিনি তাঁদের সন্তানদের জন্য শিক্ষার আলো, জ্ঞানের আলো, বোধ এবং বিকাশের আলোকবর্তিকা হয়ে এসেছিলেন।
কোভিড-১৯ মহামারির পর শিক্ষার্থীদের পঠনপাঠনের ধারাবাহিকতায় বড় রকমের শূন্যতা তৈরি হয়েছিল। সরকার নির্দেশ দিয়েছিল পঠনপাঠন ভার্চুয়াল মাধ্যমে করতে হবে। সরকার তো ফরমান জারি করেই খালাস, কিন্তু ভূমিস্তরের বাস্তবতা সম্পর্কে আমলাদের কোনও ধারণাই নেই। সাধারণ গরিব ঘরের ছেলেমেয়েরা পড়েছিল অথৈ সাগরে। স্কুল বন্ধ, অথচ ঠিক সেখানেই তাদের পড়াশোনা, শেখার আগ্রহ, এবং জীবনভাবনার বিকাশ ঘটছিল। যদি মহামারির জন্য তা বন্ধ রাখতে হয়, তবে যে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার ধারাবাহিকতায় ভাঁটা পড়বে, সেটা স্পষ্ট ছিল। দেশের অন্যান্য অঞ্চলের মতো তামিলনাড়ুর এই ছোট্ট জনপদেও তখন এমন টালমাটাল অবস্থা। শিক্ষার এমন বিপর্যয়ের কথা মাথায় রেখেই তামিলনাড়ু সরকার ২০২১ সালে সান্ধ্যকালীন পঠনপাঠনের আয়োজন করে, সরকারি উদ্যোগে ইল্লাম থেডী কালভি প্রকল্পের মাধ্যমে। তসলিমার নিয়োগ এই প্রকল্প অনুসারেই। তসলিমা নাসরিন এখানে পড়াতে আসার ফলে সত্যিই ব্যাপারটা “দুয়ারে শিক্ষা” প্রকল্পে পরিণত হয়েছিল। এমন সদর্থক কর্মকাণ্ডে লাভবান হয়েছে সাধারণ পরিবারের নবীন শিক্ষার্থীরা।
তসলিমাকে একদিন জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল, “আপনি তো একজন মুসলিম পরিবারের সদস্য, এক হিন্দু দেবতার মন্দিরে প্রবেশ করতে আপনার কখনও কোনও সংকোচ বা দ্বিধা হয় না?” একগাল হেসে তসলিমা জবাব দেন— “অসুবিধা হবে কেন? আমি তো এই গ্রামে থাকি না, পাশের গ্রামে আমার বাড়ি। আমি শুধু চেয়েছিলাম, আমার ছাত্রছাত্রীদের যেন নিজেদের বাড়ি ছেড়ে দূরে কোথাও পড়তে যেতে না হয়। কারণ এতে যাতায়াতের ঝক্কি ও ক্লান্তি বাড়ে, পড়াশোনার জন্য সময় কমে যায়, একসঙ্গে আনন্দ করে শেখার সুযোগও কমে যায়। আমার এই প্রস্তাব শুনে এই গ্রামের মানুষজনই আমাকে শ্রী মুরুগান স্বামীর মন্দিরে স্কুল চালু করতে অনুরোধ করেন। আমি শুধু চাইছিলাম আমার শিক্ষার্থীদের কাছে পৌঁছতে। স্বামী মুরুগানই বুঝি আমার সেই ইচ্ছে পূরণ করে দিলেন।
আর আমার এখানে আসতে সংকোচ বা দ্বিধা হবে কেন? আমরা তো এখানে ধর্ম-বর্ণ-সম্প্রদায় নির্বিশেষে স্বামী মুরুগানকে গভীর শ্রদ্ধা করি। আমাদের আপদে-বিপদে আমরা তাঁরই শরণে যাই। একবার আমি এক ভয়াবহ দুর্ঘটনার কবলে পড়েছিলাম, রীতিমতো প্রাণসংশয় হয়েছিল। সেই সময় আমার নানী মুরুগান স্বামীর কাছে মানত করে প্রার্থনা করেছিলেন আমার জন্য। আমি ধীরে ধীরে সুস্থ হয়ে উঠি। তারপর একদিন এসে আমি নিজে পুজো দিয়েছিলাম এই মন্দিরে। আমাদের পরিবারে স্বামী মুরুগানকে এক সদস্যের মতোই মান্য করা হয়। এটাই তো আমাদের কৃষ্টি, আমাদের সংস্কৃতির আসল সৌন্দর্য। এই বহুত্বের ঐতিহ্যকে ধরে রাখাটাই আমাদের প্রকৃত কর্তব্য।
এমন সব প্রশ্ন শুনে খানিকটা আবেগঘন হয়ে পড়েন তসলিমা। ইতিহাসের ছাত্রী হিসেবে নিজের জীবনবোধের আলোয় সবকিছুকে বুঝে নেওয়ার চেষ্টা করেন তিনি। এখানে সবাই মিলেমিশে থাকেন, বাইরের বিভেদের হাওয়ায় তাই মোটেই বিচলিত হন না। তসলিমার কথায়, “গরিবের আবার ধর্ম কী? এখানে মানুষকে প্রতিদিন বাঁচার জন্য লড়াই করতে হয়। তাই একসাথে থাকাটাকেই আমরা সবচেয়ে বড় ধর্ম বলে মানি। একে অপরের বিপদে পাশে দাঁড়ানোই আমাদের আসল ধর্মপালন। তাই যখন সরকারের পক্ষ থেকে জানানো হল, এই অঞ্চলের মাটি খুঁড়ে টাংস্টেন উত্তোলনের জন্য জল, জমি, ঘরবাড়ি এমনকি মুরুগান স্বামীর এই মন্দির পর্যন্ত উজাড় করে দেওয়া হবে, তখন আমরা সবাই এক হয়ে প্রতিবাদে সামিল হই। ধর্ম, জাত, পরিচয়ের সব পার্থক্য ভুলে গ্রামের স্বার্থেই আমরা এককাট্টা হয়ে দাঁড়িয়েছিলাম। তখন এই প্রতিবাদটাই ছিল আমাদের কাছে সবচেয়ে বড় ধর্ম। আমরা সেই ধর্ম পালন করেছি, পিছপা হইনি। আমি চাই আমার ছাত্রছাত্রীরাও এমন মানবিক চেতনা নিয়েই বড় হয়ে উঠুক।”
কোভিডকাল পেছনে ফেলে সময় এগিয়ে গেছে আরও কয়েকটি বছর। যে প্রকল্পের আওতায় তসলিমা সান্ধ্য পঠনপাঠনের সহায়িকা হিসেবে শিক্ষকতার সুযোগ পেয়েছিলেন, সেই ‘ইল্লাম থেডী কালভি’ প্রকল্পটি সরকার ইতিমধ্যে বন্ধ করে দিয়েছে। ফলে খাতায়-কলমে এই মুহূর্তে তসলিমা কর্মহীন।
তবে শিক্ষকতা তাঁর কাছে শুধুমাত্র একটি পেশা নয়— এটি তাঁর ভালোবাসা, স্বপ্ন এবং নিজেকে গড়ে তোলার এক ব্রত। তাই আজও তিনি পড়িয়ে চলেছেন— কখনও নিজের বাড়িতে, কখনও সেই পুরনো মন্দির চত্বরে। অভিভাবকদের কাছ থেকে পারিশ্রমিক হিসেবে যা পান, তা দিয়ে কিছু বাড়তি আয়ের সংস্থান হয়। সমাজকল্যাণ বিভাগের সহায়িকা হিসেবে তাঁর মূল কর্মজীবনের পাশাপাশি এই সাময়িক পড়ানোই হয়ে উঠেছে তাঁর প্রাণের কাজ।
বিশেষভাবে সক্ষম মানুষ হিসেবে শিক্ষাগত যোগ্যতার ভিত্তিতে সরকারি চাকরির জন্য আবেদন করেছেন তসলিমা। আর এতেই খুশি তিনি। তাঁর আশা, এই স্বপ্ন একদিন পূরণ হবেই। কারণ, যাঁর দীক্ষা প্রকৃত শিক্ষকতার মন্ত্রে, তিনি তো থেমে থাকার মানুষ নন!
তসলিমা এক সত্যের পথযাত্রী। শাশ্বত ভারতের অমলিন ইতিহাসের সন্ধানেই তাঁর পদচারণা। সমস্ত ভেদাভেদহীন, সহনশীল এক ভারতের বাস্তবতায় তিনি বিমুগ্ধ নয়নে তাকিয়ে থাকেন। শরীরের সমস্ত সীমাবদ্ধতাকে অতিক্রম করে তিনি এগিয়ে চলেছেন আলোর পথে। তাঁর নবীন শিক্ষার্থীদের জন্য রইল আন্তরিক শুভকামনা।
ঋণস্বীকার: দ্য হিন্দু
সাতসকালেই এমন মন ভরিয়ে দেওয়া খবর পড়ে খুব ভালো লাগছে। নাসরিনকে অনেক অভিনন্দন। আরও বড়ো প্রশংসা প্রাপ্য ঐ অখ্যাত গ্রাম মুন্নামালাইপাত্তির অধিবাসীদের যাঁরা শিক্ষার আলোকে সাদরে বরণ করে নিয়েছেন সমস্ত মিথ্যা আর কূপমণ্ডুকতাকে হারিয়ে দিয়ে। এক চিরকালীন স্বদেশ চিত্র।
বেঁচে থাক ভারতীয় মতাদর্শ।স্বপ্নপূরণ হোক তসলিমার।
সঙ্গে কলম চলুক লেখকের।
তসলিমার এই কাহিনি বিপন্ন ভারতাত্মার প্রাণময় দলিল। এই আত্মিক সহাবস্থানের আদর্শকে সমুন্নত রাখতে হবে আমাদের সকলকে। এমন কাহিনি আরো বেশি করে উঠে আসুক প্ল্যাটফর্মের পাতায়।