
আহমাদ মাযহার
একটি উপন্যাসরূপের মাধ্যমে একজন লেখক কী করতে চান— এই প্রশ্নের সরল উত্তরে বলা যায়, তিনি ব্যক্তি-অন্তর্জগৎ ও বহির্জগতের টানাপড়েনের ভেতর দিয়ে এক জটিল দিনযাপনের ইতিবৃত্ত তুলে ধরেন। জীবনের কোনও একটি বিশেষ পর্যায় কিংবা সমগ্র পরিসরই হয়ে ওঠে তাঁর উপাখ্যানের ক্ষেত্র। চরিত্র ও কালের ঘূর্ণিতে তিনি নির্মাণ করেন এমন এক বাস্তবতা, যেখানে ব্যক্তিগত অনুভব আর সমাজে দীর্ঘদিন ধরে গড়ে ওঠা বিধি একসঙ্গে প্রবাহিত হয়। তিনি দেখেন জীবনকে তার নিষ্ঠুরতা ও কোমলতার পরিসরে, খুঁজে পেতে চান বাস্তবতার গভীরে লুকিয়ে থাকা সত্যকে। এই নির্মোহ অনুসন্ধানের মধ্যেই অনিবার্যভাবে প্রকাশ পায় লেখকের জীবনবোধ।
তবু প্রশ্ন থেকে যায়— ঔপন্যাসিক কি কেবল সত্যই অন্বেষণ করেন? নাকি তাঁর প্রধান দায় পড়ে নন্দন-সত্য নির্মাণে— একটি এমন বাস্তবতার বিনির্মাণ, যা হয়তো কল্পনার মধ্যেই হয়ে ওঠে আরও স্পষ্ট?
দুই.
আকিমুন রহমানের রক্তপুঁজে গেঁথে যাওয়া মাছি (১৯৯৯) উপন্যাসের কেন্দ্রীয় চরিত্র, প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক পারভীন আক্তার— ভাগ্য ও প্রত্যাশাবিড়ম্বিত, ভঙ্গুর এক মর্যাদাবোধে সংবেদ্য একজন নারী। এই উপন্যাসের কাহিনি গড়ে উঠেছে তার বয়ঃসন্ধি থেকে শুরু করে পরিণত বয়সের জীবনযাপনকে কেন্দ্র করে। আর একে আরও নির্দিষ্টভাবে বললে, তার জীবনের বিভিন্ন পর্যায়ে সমাজের পুরুষতান্ত্রিক মনোভাব, অবহেলা, নিপীড়ন এবং যৌন শোষণের শিকার হয়ে একজন নারীর আকাঙ্ক্ষা ও বাস্তবতার অসঙ্গতিময়তার মধ্যে দিয়ে এই উপন্যাস এগিয়ে চলে। জীবনের অভিজ্ঞতাগুলি তাকে এমন এক পরিণতির দিকে নিয়ে যায়, যেখানে পারভীন নিজেকে মনে করেন রক্তপুঁজে গেঁথে থাকা মাছির মতো— অর্থাৎ একটি গাঢ় সমাজিক ক্লেদে আটকে থাকা এক অস্তিত্ব। নামকরণের এই প্রতীকী অর্থে উপন্যাসের মূল ভাবনা এবং তার সমগ্রতা যেন অতি স্পষ্টভাবে প্রতিফলিত হয়।
পারভীনের জীবনে প্রায় কখনওই সফলতার দিকে উত্থানের কোনও উজ্জ্বল সম্ভাবনা দেখা যায়নি; তবে টিকে থাকার আশা তার মধ্যে ছিল। মদ্যপ ও সংসারে উদাসীন বাবার কারণে পারভীন তার উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ দেখতে পায় না। নারীর যে দৈহিক রূপ পুরুষতান্ত্রিক সমাজে সমাদৃত হয়, সে জানে, তা তার নেই; এমনকি একটি স্তন তার গঠনগত দিক থেকে সামান্য ছোট হওয়ায় সে এক ধরনের হীনম্মন্যতায়ও ভোগে। এরই মধ্যে তার দাদিই একমাত্র অভিভাবক, যিনি মুখে তিক্ততা ছড়ালেও হৃদয়ের সবটুকু বাৎসল্য দিয়ে তাকে আগলে রাখেন। জুম্মা কাক্কার মতো একজন মানুষ তার জীবনে দ্বৈত ভূমিকা পালন করে— একদিকে তার এবং তার পরিবারের শুভানুধ্যায়ী, কিন্তু অন্যদিকে তার সঙ্গে এমন সম্পর্ক, যা সমাজে লাম্পট্য বলে পরিচিত। বাংলাদেশের গ্রামীণ সামাজিক কাঠামোয় এমন ঘটনা খুবই বাস্তব।
পারভীন আক্তারকে আবার বিকশিতও হতে হয় জুম্মাকাক্কার প্রভাব ও সামর্থ্যের সূত্রে। যদিও জুম্মাকাক্কার সঙ্গে তার রক্ত-সম্পর্ক নেই, তবে যে সামাজিক সম্পর্ক রয়েছে সেই সূত্রে বাবার পীরভাই হিসেবে তাদের সম্পর্ক কাকা-ভাস্তির। কিন্তু জুম্মাকাক্কা তার সঙ্গে শরীরী সম্পর্ক স্থাপন করে। অভিভাবকত্বসূত্রে উদ্ভিন্নযৌবন পারভীনের যৌনতৃষ্ণার সুযোগ নেয়। রোগশয্যায় থেকে তার আম্মা সেটা টের পেয়ে তাকে শাস্তি দিতে চান, কিন্তু শেষ পর্যন্ত সেটা সম্ভব হয় না। শুধু তাই নয়, জুম্মাকাক্কার সঙ্গে তার যে যৌনসম্পর্ক হয়েছে সে-কথাই পারভীনের দাদিকে বিশ্বাস করাতে পারেন না তার আম্মা।
দীর্ঘ সময় পার হওয়ার পর একসময় পারভীন বুঝতে পারে জুম্মাকাক্কা তাকে বিয়ে করবে না। পরে তার সঙ্গে সুলতান আলীর বিয়ে হবে বলে ঠিক হয়; সেই সূত্রে সুলতান আলী পারভীনের শরীরও ভোগ করে, কিন্তু বিয়ে করে অন্য মেয়েকে। কাঙ্ক্ষিত বিয়ে তার শেষ পর্যন্ত হয় না। পারভীনের বাবা, মা, এবং দাদির মৃত্যুর পর তার প্রতিবন্ধী ভাইয়ের দেখভাল করতে করতে তাকে বেঁচে থাকতে হয়। উপন্যাসের কাহিনি সংগঠনে পারভীনের জীবনে নাটকীয় উত্থানের কোনও চিহ্ন নেই। এমনকি উপন্যাসের শেষে পৌঁছেও পারভীন পাঠকের কাছে কোনও ট্র্যাজেডি চরিত্রের বিয়োগাত্মক মমতা অনুভব করতে পারে না।
পারভীনের জীবনে সমাজরীতিতে বৈধ দাম্পত্য সম্পর্কের অভাব স্পষ্ট। আবার সমাজের চাপে তাকে এমন কিছু সিদ্ধান্ত নিতে হয়, যা পাঠকের মনে প্রশ্ন জাগিয়ে তোলে। যৌনতা, কামনা এবং নারীর মানসিক জটিলতা একত্রিত হয়ে এই উপন্যাসে গভীরভাবে উপস্থাপিত হয়েছে। এতে পাঠক অস্থিরতা এবং সংশয়ের মুখোমুখি হয়ে পড়ে। কৈশোর থেকে যৌবন পর্যন্ত প্রবাহিত পারভীনের জীবনের নানা দিক, তার অস্তিত্বের সংগ্রাম এবং অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব লেখক তুলে ধরেছেন। লেখকের অভিপ্রায় যদি কিছুটা চিহ্নিত করতে হয়, তবে বলা যায়, সামাজিক ও মনস্তাত্ত্বিক উপাদানে নিমজ্জিত এক নারীর গভীরতর জীবনভাবনা এবং স্বপ্ন-অভিপ্রায়ের রূপ এই উপন্যাস-চেষ্টা। লেখকের অভিপ্রায়টিকে আরও সামগ্র্য দেওয়ার চেষ্টায় হয়তো বলা যায়, সমাজে প্রবাহিত ধারণার পটভূমিতে ব্যক্তিবিশেষের জীবনের অসঙ্গতি ও মানবীয় দুর্বলতা-প্রতিকূলতা নিয়ে লেখা উপন্যাস ‘রক্তপুঁজে গেঁথে যাওয়া মাছি’।
লেখকের এই প্রয়াসে পারভীনের চেতনাপ্রবাহের মাধ্যমে মানুষের অন্তর্দ্বন্দ্ব এবং সমাজের কাঠামোগত অসামঞ্জস্যের চমৎকার বিশ্লেষণ ফুটে উঠেছে। চরিত্রগুলোর মাধ্যমে ব্যক্তিগত, সামাজিক ও রাজনৈতিক প্রশ্নগুলো উঠে আসে। উপন্যাসটি জীবনের করুণ দিক এবং সমাজে বিদ্যমান অসাম্য ও অবিচারের বাস্তবানুগ প্রতিফলন হিসেবে পাঠকের কাছে উপস্থাপিত হয়েছে।
উপন্যাসটির ভাষা যতটা না অলঙ্কারপূর্ণ, তার চেয়ে বেশি রয়েছে প্রকাশসংযম; অর্থাৎ, এর রয়েছে একটি অন্তর্গত ভার বহনকারী রূপ, যেখানে অনুভূতির স্বর গভীর অথচ সংযমী। লেখক এখানে সৌন্দর্যের প্রতি দায়বদ্ধতা প্রদর্শন করেছেন, তবে সেটা কষ্টের ভাষায়, প্রতিরোধের প্রগাঢ় প্রকাশে। পক্ষান্তরে, উপন্যাসের ঘটনাপ্রবাহে লেখক যেন অনুসন্ধান করেছেন নারীর সহ্যক্ষমতার অসীমতা। একদিকে স্কুলশিক্ষিকা পারভীনের বহুকাঙ্ক্ষিত বিয়ে হয় না, অন্যদিকে সমাজের অন্তর্স্রোত তাকে ভাসিয়ে নিয়ে যায় নানা কথার কলঙ্কে। উপন্যাসের শুরু থেকেই পারভীনকে দেখা যায় ভাগ্যবিড়ম্বিত এক সত্তা হিসেবে। তার বাস্তবতা এমনই তুচ্ছতা-নিমজ্জিত অবস্থায় আটকে থাকে যে, পাঠকের সহানুভূতি তার প্রতি প্রায় জাগতে চায় না।
তিন.
সমাজে প্রগতিশীলতার প্রভাবে নারীর অবরোধ তো একালে আর থাকবার কথা নয়! তবে, এই উপন্যাসে লেখকের সৃষ্ট চরিত্রগুলোর দিকে নজর দিলে মনে প্রশ্ন জাগে, সমাজ থেকে সত্যিই কি অবরোধ লুপ্ত হয়েছে সর্বাংশে? নারীর ওপর অবরোধ তো শুধু আক্ষরিক অর্থে নয়, এখনও তা প্রতীকী ব্যঞ্জনায় ছড়িয়ে আছে সমাজের সর্বত্র। আছে নারী ও পুরুষের সম্পর্কে, তাদের নিজস্ব কাজের জগতে, শরীরের ভাষায়, মেয়েদের প্রতি অঙ্গ-প্রত্যঙ্গে।
নারীর অন্তর্দহন ও তার প্রকৃত যন্ত্রণা সুচারুভাবে অনুধাবন করতে পারেন কেবল একজন নারীই। এ ক্ষেত্রে লেখক নিজেও একজন নারী হয়ে অবতীর্ণ হয়েছেন তার না-বলা কথাগুলো পারভীনের ভাষ্যে আমাদের শোনাতে। যেমন, পারভীন তার প্রথম জীবনে আকস্মিকভাবে তার বাবা-মাকে যৌনসম্পর্কে লিপ্ত হতে দেখেছে। মানসিক ভারসাম্যহীন তার ছোট ভাই শাহ আলমের মধ্যে শারীরবৃত্তীয় অভিজ্ঞতার আলোচনা টেনে এনেছে। নারী আজও কতটা উপেক্ষিত, কতটা অনাদরে তার বেড়ে-ওঠা— এ বিষয়গুলো বর্ণিত হয়েছে পারভীনের চৈতন্যপ্রবাহে।
পদে পদে তার বঞ্চনা আর নির্যাতনের অভিজ্ঞতা নারী ও পুরুষের প্রণয়ের সৌন্দর্যকে ম্লান করে দেয়, ভালোবাসায় মাখায় কলঙ্কের কালি। নারীর এই রূপ, এমন বাস্তবতা তীক্ষ্ণ ফলার মতো গিয়ে বিঁধে থাকে। সারাক্ষণ এফোঁড়-ওফোঁড় করতে থাকে আমাদের, আর নির্লিপ্ত হয়ে আমরা এই জীবনকে বয়ে যেতে দেখি।
ব্যক্তিমানুষ তার চৈতন্যে বহন করে তার নিজের স্মৃতি-অভিজ্ঞতা। বহন করে চলে সমকালীন বিশ্ব-পরিশ্রুত অভিজ্ঞতা ও নিজের সমাজবাহিত নৃতাত্ত্বিক অভিজ্ঞান। সমাজের নানা মিথও তার সেই নৃতাত্ত্বিক অভিজ্ঞানেরই অংশ। ফল্গুধারার মতো, পারভীনের চৈতন্যে এসবেরও তো বয়ে চলা দেখতে পাওয়া যায় এখানে।
এই উপন্যাসকে একাধারে বলা যায় মনস্তাত্ত্বিক এবং সামাজিক বাস্তবতামূলক (social-realist) রচনার উদাহরণ। লেখক সমাজের রূঢ়তা অনুপুঙ্খভাবে চিত্রিত করলেও, মূল মনোযোগ রেখেছেন চরিত্রের ভেতরের আন্দোলনে। এই দ্বৈত অভিমুখই উপন্যাসটিকে করে তোলে বিশেষভাবে তাৎপর্যপূর্ণ।
চার.
এতক্ষণের আলোচনাকে এভাবেও হয়তো সূত্রায়িত করা যায়— বাংলাদেশের যাপিত জীবনবাস্তবতায় সামাজিক কাঠামোর ভঙ্গুরতা বা সীমাবদ্ধতা এবং অত্যাচার ও নিষ্ঠুরতার বাস্তব অভিজ্ঞতা এই উপন্যাসের ভিত্তি। পারভীন আক্তার চরিত্রটির মাধ্যমে লেখক নারীজীবনের কঠোর বাস্তবতা, পারিবারিক ও সামাজিক চাপ এবং নিজের অস্তিত্বের জন্য সংগ্রামকেই গভীরভাবে উপস্থাপন করেছেন। চরিত্রটি এখানে পেয়েছে একটি জটিল এবং প্রতীকী রূপ। সত্তার গভীরে লুকানো তীক্ষ্ণ এক প্রশ্ন তুলেছে চরিত্রটি— নারী কি কেবল সমাজের আরোপিত নিয়মে বাঁধা থাকবে, নাকি নিজের পরিচিতি প্রতিষ্ঠার জন্য লড়াই করবে? অর্থাৎ, এই উপন্যাসের চরিত্রনির্মাণ বাস্তবতার সঙ্গে গভীরভাবে মিশে রয়েছে, যা পাঠককে চিন্তার জগতে নিয়ে যায় এবং নাড়িয়ে দেয়।
পারভীন আক্তার কেবল একটি নারী চরিত্রমাত্র নয়; সে এক বৃহত্তর প্রতীকেরও বাহক— সমাজে অবদমন, অবহেলা এবং নিজের অন্তর্ভূমিতে ঘটে চলা লড়াইয়ের মূর্ত রূপ। চরিত্রটির নৈঃশব্দ্য, সংবেদনশীলতা এবং হতাশা একসঙ্গে নির্মাণ করে এমন এক রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট, যেখানে নারীশরীর ও মানসিক জগৎ উভয়ের উপরই দখলচেষ্টার দীর্ঘ ইতিহাস প্রতিফলিত হয়। সুতরাং বলা যায়, কেবল সমাজবাস্তবতার রূঢ় উপস্থাপনই নয়, এর বিরুদ্ধে লেখকের স্পষ্ট অবস্থানও হয়ে উঠেছে এর বিষয়বস্তু।
পাঁচ.
আকিমুন রহমানের গল্প ও উপন্যাসে সাধারণত নারীর অভিজ্ঞতার মধ্যে দিয়ে জীবনবাস্তবতার পর্যবেক্ষণ ও উপলব্ধি তুলে ধরা হয়। এই কারণে সমালোচকেরা প্রথমত তাঁকে ‘নারীবাদী লেখক’ হিসেবে চিহ্নিত করতে পারেন। এই দৃষ্টিভঙ্গি একেবারে ভিত্তিহীন নয়; তবে তাঁকে কেবল নারীবাদী হিসেবে অভিধা দিলে তাঁর দার্শনিক অবস্থান সীমিত হয়ে যাবে। যদিও তাঁর রচনাকে প্রধানত নারীবাদী প্রেক্ষাপটে পাঠ করা সম্ভব, তবুও তা শুধু নারীর অভিজ্ঞতায় আবদ্ধ নয়— বরং সেখানে উপস্থাপিত হয় সামগ্রিকভাবে মানবিক দুর্দশা এবং সমাজের অবক্ষয়ের বিস্তৃত চিত্রও। এই কারণেই বলা যায়, আকিমুন রহমান আসলে বাংলাদেশের অবিকশিত আধুনিক সমাজে নারীর অবস্থানকে কেন্দ্র করে মানবতাবাদী লেখক হিসেবে আবির্ভূত হয়েছেন।
তাঁর উপন্যাস ‘রক্তপুঁজে গেঁথে যাওয়া মাছি’-র কেন্দ্রীয় চরিত্র পারভীন আক্তার হয়ে উঠেছে একটি প্রতীকী সত্তা, যে সমাজের ক্লেদ, রক্তপুঁজ এবং বর্জ্যের ভিতর দিয়ে জীবনযাপন করে। এই চরিত্র কেবল একজন নারী নয়, বরং একটি নির্দিষ্ট সমাজব্যবস্থায় অস্তিত্বসংকটে পড়া মানবসত্তার প্রতিনিধি। এই দৃষ্টিকোণ থেকে উপন্যাসটিকে মানবতাবাদী হিসেবে বিবেচনা করা যায়, কারণ এতে মানবজীবনের মৌলিক দুর্দশা, সামাজিক অবক্ষয় এবং অস্তিত্বের সংগ্রাম প্রধান হয়ে উঠেছে। নারীর অভিজ্ঞতা এবং সমাজে নারীর অবস্থান সম্পর্কেও উপন্যাসটি গভীর অন্তর্দৃষ্টি প্রদান করে, তাই নারীবাদী পাঠ হিসেবেও এর গুরুত্ব কম নয়।
ছয়.
বাংলা উপন্যাসে বিলডুংসরোমানের নারীকেন্দ্রিক রূপ তেমন একটা দেখা যায় না। এমনকি পাশ্চাত্যের সাহিত্যেও দীর্ঘকাল ধরে পুরুষতান্ত্রিক নায়কের বৌদ্ধিক, নৈতিক এবং মানসিক পরিপক্বতার যাত্রা হিসেবেই এই আঙ্গিকটি চিহ্নিত ছিল। তবে অনেকেরই মনে পড়তে পারে ইংরেজ নারী ঔপন্যাসিক শার্লোট ব্রন্টির ‘জেন আয়ারে’র কথা। হ্যাঁ, ‘জেন আয়ার’কেও বিলডুংসরোমান ধারার উপন্যাস হিসেবে বিবেচনা করা যায়। বিলডুংসরোমান জার্মান শব্দ, যার অর্থ “formation novel” বা “coming-of-age novel”। এই ঘরানার উপন্যাসের মূল বৈশিষ্ট্য হল, এই উপন্যাসে কেন্দ্রীয় চরিত্রটির শৈশব থেকে প্রাপ্তবয়স্ক হয়ে ওঠা পর্যন্ত সময় পরিসরে তার মানসিক, নৈতিক এবং আত্ম-উন্নয়ন বা উন্মোচনের যাত্রাকে তুলে ধরা হয়।
বাংলাদেশে আধুনিক নারীর বহির্জীবনের অভিজ্ঞতার বিস্তার অনেকটাই বেড়েছে। সেই সূত্রে বাড়ছে বিলডুংসরোমান (Bildungsroman), অর্থাৎ আত্মগঠনের উপন্যাস লেখার সম্ভাবনা। সমকালীন বিশ্বসাহিত্যে নারীর অভিজ্ঞতাভিত্তিক এই ঘরানা নতুন এক পথনির্দেশ পাচ্ছে, যেখানে শরীর, সম্পর্ক, সমাজ ও ভাষার ভেতর দিয়ে একজন নারী তার আত্মপরিচয়ের সন্ধানে পথ তৈরি করেন। এই দৃষ্টিকোণ থেকে যদি আকিমুন রহমানের রক্তপুঁজে গেঁথে যাওয়া মাছি উপন্যাসটি দেখা যায়, তাহলে দেখা যাবে— এটিও মূলত একটি নারীসত্তার আত্ম-অন্বেষণ ও রূপান্তরের উপন্যাস, যা Bildungsroman-এর দর্শনকে আত্মস্থ করে এবং নতুন অভিজ্ঞতায় পূর্ণ করে তোলে।
রক্তপুঁজে গেঁথে যাওয়া মাছি উপন্যাসে গুরুত্ব পেয়েছে নারীর শরীর, ভাষা ও আত্ম-অন্বেষণ। উপন্যাসের প্রধান নারীচরিত্রটির শরীর কেবল প্রেমের আবহই তৈরি করে না, বরং সেটি হয়ে ওঠে আত্মজিজ্ঞাসার কেন্দ্রভূমি। তার শরীরে একত্রিত থাকে স্মৃতি, অবদমন, আকাঙ্ক্ষা এবং প্রশ্ন। নারীচরিত্রটি শুধুই এক প্রেমিকার ভূমিকায় আবদ্ধ নয়, বরং শরীরের মাধ্যমেই চলে তার আত্ম-অন্বেষণ প্রক্রিয়া। প্রেমবোধ, প্রতারণা, যৌন সম্পর্ক ও পরিত্যক্ত হওয়ার অভিজ্ঞতা তার জীবনে একরৈখিক দুঃখের মতো নয়, বরং তা তার জ্ঞান ও সংবেদনের অন্তঃশীল প্রবাহ। এই প্রবাহ একসময় আত্মপরিচয়ের প্রশ্নে এসে দাঁড়ায়। এই যাত্রা, এই আত্মচেতনার উন্মোচন— একজন Bildungsroman কেন্দ্রীয় চরিত্র পারভীনের ভাষায় পরিস্ফুট হয়ে উঠতে থাকে।
পারভীন আক্তার চরিত্রটি প্রতিনিয়ত সামাজিক বিধি ও রূপান্তরের আকাঙ্ক্ষার টানাপোড়েনে অস্তিত্বশীল থাকে। এমন এক সমাজবাস্তবতায় উপন্যাসটি গড়ে উঠেছে, যেখানে নারীর কামনা, মাতৃত্ব, বিশ্বাসঘাতকতা, ধর্মীয় বোধ ও শ্রেণিগত দ্বন্দ্ব একসঙ্গে সক্রিয়। নারীচরিত্রকে কেবল প্রেমিক পুরুষই নয়, সমাজ, পরিবার এবং প্রতিষ্ঠানও আঘাত করে। এই আঘাত পারভীনকে দুর্বল করে না, বরং তাকে এগিয়ে নিয়ে যায় স্বাধীন উপলব্ধির পথে।
উপন্যাসটিতে ধর্ম ও সমাজের সঙ্গে নারীর দ্বন্দ্ব বিশেষভাবে চিহ্নিত হয়— বিশেষত গর্ভধারণ ও একাকিত্বের প্রসঙ্গে। এই অভিজ্ঞতা পারভীনকে এক নৈতিক নির্জনতায় ঠেলে দেয়, যেখান থেকে জন্ম নেয় চিন্তা, প্রতিবাদ এবং নিজের বোধের জেগে ওঠার অভিজ্ঞতা। এই প্রতিকূলতা যেমন তার ভেতরকার ভাঙনকে প্রকাশ করে, তেমনি সেই ভাঙনের মধ্যে দিয়েই গড়ে ওঠে এক আত্মনির্ভর সত্তা।
সাত.
পারভীন আক্তার চরিত্রটির চৈতন্যপ্রবাহ বাঙ্ময় হয়ে ওঠে লেখকের ভাষার কৌশলে। এই ভাষায় আছে আত্মজৈবনিক গদ্যের অনুরণন— কাব্যিক, সংবেদনশীল এবং চিন্তাশীল। সমাজের দ্বৈতনৈতিকতা, লিঙ্গবৈষম্য ও যৌনরাজনীতির বাস্তবতা রয়েছে এর পরতে পরতে। পুরো উপন্যাসের ভাষা যেন অনেকটা আত্মজৈবনিক স্বরলিপি, যেখানে এক নারীর অন্তর্জগৎ ভাষার মাধ্যমে পাঠকের কাছে আত্মপ্রকাশ করে। এখানে সংলাপ প্রচলিত অর্থে ব্যবহৃত হয়নি; বরং আত্মসংলাপই হয়ে উঠেছে মূল মাধ্যম, যা পাঠকের চৈতন্যে আঘাত হানে বারবার। এই আঘাতই পারভীনকে আত্মবীক্ষণকারী, ভাবুক এবং এক পরিণত মানবসত্তায় রূপান্তরিত করে।
লেখক পারভীন চরিত্রটির মনের গভীরে প্রবাহিত চিন্তা ও অনুভূতির ধারাবাহিকতা তুলে ধরেছেন, যা পাঠকদের চরিত্রটির মানসিক জগতের সঙ্গে সংযোগ স্থাপন করতে সাহায্য করে। পারভীনের চিন্তাপ্রবাহ কখনও কখনও এলোমেলো এবং অসংলগ্নভাবে উপস্থাপিত হয়েছে— যেমনটি ঘটে বাস্তব জীবনের অন্তর্গত চেতনায়। তার চেতনার মধ্যে বয়ে চলা সমাজ ও সংস্কৃতির নানা বলয়, যার প্রতিফলনে তার মানসিক দ্বন্দ্ব আরও তীব্র ও জটিল হয়ে ওঠে।
চরিত্রের চৈতন্যে অন্তঃশীল এই ভাষাভঙ্গি যেন চিন্তার সুরকে করে তোলে বাঙ্ময়। এর প্রতিক্রিয়ার ধরন পাঠককে Bildungsroman-এর একটি আধুনিক, নারীকেন্দ্রিক পাঠ দিতে সক্ষম হয় আমাদের। সব মিলিয়ে, উপন্যাসটির যে বৈশিষ্ট্যগুলি তুলে ধরা গেল তাতেও রক্তপুঁজে গেঁথে যাওয়া মাছি-কে একটি নারীকেন্দ্রিক Bildungsroman বলা যায়। কারণ, এটি Bildungsroman-এর ঐতিহ্যগত ‘নায়ক-ভিত্তিক’ গঠনের পথ অনুসরণ করে না। বরং এটি নারীর শরীর, প্রেম, সামাজিক নিষেধ এবং প্রত্যাখ্যানের অভিজ্ঞতার ভিতর দিয়ে এগিয়ে চলে। একজন নারী তার নিজস্ব বোধ, উপলব্ধি ও আত্মমর্যাদার দিকে যাত্রা শুরু করে; যেখানে তার ভাঙন দুর্বলতার প্রতীক নয়, বরং নিজস্বতার জন্মভূমি।
অন্যদিকে, রক্তপুঁজে গেঁথে যাওয়া মাছি উপন্যাসটি কেবল নারীপ্রেম বা নারীবাদী প্রতিক্রিয়া নয়— বরং একে একটি নারীসত্তার আত্মগঠনের উপাখ্যান বলা যেতে পারে। এই দৃষ্টিকোণ থেকে একে নির্দ্বিধায় গভীরভাবে অনুরণিত, দার্শনিকভাবে সমৃদ্ধ Bildungsroman হিসেবে চিহ্নিত করা সম্ভব। তবে ঔপন্যাসিক এখানে কেবল একজন নারীর দৃষ্টিভঙ্গিই উপস্থাপন করেননি— তিনি সমাজের পরতে পরতে ছড়িয়ে থাকা মানবিক অবমাননা, আত্মসংঘাত এবং আত্মমুক্তির আকাঙ্ক্ষাকেও ভাষা দিয়েছেন। সেই সূত্রে, হিউম্যানিস্ট পাঠে এই উপন্যাসে কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ স্তর স্পষ্টভাবে উন্মোচিত হয়।
আট.
রক্তপুঁজে গেঁথে যাওয়া মাছি উপন্যাসের লেখক কেবল একজন কথাসাহিত্যিকই নন, তিনি একজন সাহিত্য-সমালোচকও। বিশেষত বাংলাদেশে নারীবাদ সংক্রান্ত প্রচলিত প্রগতিশীল বলে বিবেচিত ধারণার চেয়ে ভিন্নতর ছিল তাঁর বৌদ্ধিক অবস্থান। এই কারণেই একজন নারী হিসেবে বিদ্যায়তনিক জগতেও তাঁকে আলাদাভাবে প্রতিকূলতা অতিক্রম করতে হয়েছে; এমনকি সমাজের প্রগতিশীল বৌদ্ধিক পরিমণ্ডলেরও প্রতিরোধের মুখে পড়তে হয়েছে নিজের স্বতন্ত্র বৌদ্ধিক অবস্থানের জন্য! তাঁর এই বৌদ্ধিকতার তাৎপর্য এই যে, তাঁর রয়েছে সমাজে বিরাজমান জীবন ও রাজনৈতিক বাস্তবতাকে ভিন্নভাবে দেখতে পারার ক্ষমতা। এই ক্ষেত্রে তাঁর সামর্থ্যের উৎস ছিল গভীর গবেষণালব্ধ সাহিত্যিক বিশ্লেষণের পদ্ধতিগত পাঠ। তাঁর বিদ্যায়তনিক গবেষণা ছিল উপন্যাসে বাস্তবতার স্বরূপ অন্বেষণ, যা তাঁকে নির্মোহ জীবনবীক্ষক হিসেবে আবির্ভূত করেছে। ফলস্বরূপ, তাঁর রচনা শেষ পর্যন্ত কোনও নির্দিষ্ট মতবাদে আবদ্ধ দৃষ্টিতে সীমাবদ্ধ হয়নি। বরং এই উপন্যাসে মানবিক দুর্ভাগ্যের জটিলতা এমনভাবে উপস্থাপিত হয়েছে, যেখানে কেবল নারীর লিঙ্গীয় নিম্নায়ন নয়, বরং সামগ্রিক জীবনবোধের দিক থেকেও এক ধরনের অস্তিত্বজিজ্ঞাসা ক্রমশ প্রবল হয়ে উঠেছে। অর্থাৎ, এই জিজ্ঞাসা সামাজিক কাঠামোর নিপীড়নকে যেমন চিহ্নিত করে, তেমনি সেই কাঠামোর মধ্যে নারীর সংবেদনশীলতা, আকাঙ্ক্ষা ও আত্মপরিচয়ের নিরন্তর সংগ্রামকেও সামনে আনে। ফলে এই পাঠ শুধু নারীবাদী দৃষ্টিকোণেই সীমাবদ্ধ থাকে না, বরং একটি নারীবাদী হিউম্যানিজমের ভিত্তি গড়ে তোলে— যেখানে মানবিক মর্যাদা, অনুভব এবং ন্যায়বোধের পুনর্মূল্যায়ন জরুরি হয়ে ওঠে। উপন্যাসটি এই মুহূর্তে আমাদের আত্ম-সমালোচনামূলক দৃষ্টিভঙ্গিকে আহ্বান জানায়, যা কেবল নারীর নয়, বরং আমাদের সবার মানবিক পরিসরকে নতুনভাবে চিনতে শেখায়। সে-জন্য, এই উপন্যাসকে নারীবাদী ও হিউম্যানিস্ট Bildungsroman বললেও, হয়তো এর পুরো গভীরতাকে ধরা সম্ভব হবে না, বিশেষ করে বাস্তবতার স্বরূপ সম্পর্কে পাঠকের প্রচলিত বোধের সীমাবদ্ধতার কারণে। গবেষক হিসেবে তাঁর অনুশীলিত তল্লাসি ক্ষমতা তাঁকে বস্তুনিষ্ঠ হতে শিখিয়েছে, ফলে পাঠককে তিনি নির্মোহ-চক্ষুষ্মান করে তুলতে সক্ষম। সম্ভবত এখানেই ঔপন্যাসিক বা কথাসাহিত্যিক হিসেবে তাঁর সাফল্য নিহিত।