
আহমাদ মাযহার
ষাটের দশকে বাঙালির আধুনিক মধ্যবিত্ত জীবনে সংস্কৃতিচর্চা ও সাংগঠনিকতায় তিনি ছিলেন লড়াকু এক ব্যক্তিত্ব। বিশেষত মুসলিমপ্রধান সমাজে রবীন্দ্রসঙ্গীতের চর্চা ও প্রসারে তাঁর সক্রিয় ভূমিকা ঐতিহাসিক, রাজনৈতিক ও নান্দনিক— এই তিন দিক থেকেই গভীরভাবে তাৎপর্যপূর্ণ। ষাটের দশকের দ্বিতীয় ভাগে যাত্রা শুরু করা সঙ্গীতশিক্ষা ও সাংস্কৃতিক কর্মসূচিভিত্তিক প্রতিষ্ঠান ‘ছায়ানট’-এর তিনি ছিলেন প্রতিষ্ঠাতা সদস্য। সেই সূত্রেই শিক্ষকতার পাশাপাশি পথিকৃতের ভূমিকায় অবতীর্ণ হন তিনি
সন্জীদা খাতুনকে নিয়ে এখন নির্মোহভাবে কিছু লেখা খুব কঠিন। এর একটি কারণ সদ্য তাঁর জীবনাবসানে সৃষ্ট শোকের প্রভাব। দ্বিতীয় কারণ, যে জীবনবোধের অনুকূল রুচি অর্জনের জন্য ছিল তাঁর মতো মানুষের সুদীর্ঘ জীবনসংগ্রাম এবং কঠোর অনুশীলন, সেইসব মানুষের পশ্চাদপসরণ কালের বিমূঢ়তা! সন্জীদা খাতুন নিজে পশ্চাদপসরণ না করলেও, শেষ দিনগুলোতে ছিলেন এক অর্থে সেইসব মানুষদেরই প্রতিনিধি। যে জীবনবোধ ছিল তাঁর সারা জীবনের অনুশীলনের অভিমুখ, তা সাম্প্রতিককালে প্রবলভাবে আঘাতপ্রাপ্ত ও আহত। আমরা, যারা বিগত ষাট-সত্তর বছর ধরে বেড়ে উঠেছি, এই পরিস্থিতির যন্ত্রণা আমাদের কাছেও এখন দুর্বহ। অথচ আমরা বেড়ে উঠেছিলাম তাঁর মতো সংগ্রামী মানুষদের জীবনবোধানুকূল জয়-আকাঙ্ক্ষী এক সময়ে।
ইহজাগতিক ও অসাম্প্রদায়িক মনোভঙ্গির যে কল্প-আদর্শ তিনি ও তাঁর জীবনবৃত্তের মানুষরা অনুসরণীয় বলে মনে করে জীবন কাটিয়েছেন, তার প্রতি তাঁদের দৃঢ় অঙ্গীকার সন্জীদা খাতুনের মতো সদাসক্রিয় ব্যক্তিত্বকে কখনও নমনীয় হতে দেয়নি। বাংলাদেশে বসবাসরত ভিন্ন ভিন্ন জনগোষ্ঠীর আচরিত ধর্মীয় বিভিন্নতা সত্ত্বেও, তিনি জীবনচর্যায় সামগ্রিক সমন্বয়বাদী সংস্কৃতিকেই ইহজাগতিকতার অনুকূল বলে বিবেচনা করতেন। আর সেই সূত্রেই, অসাম্প্রদায়িক, মানবিক মানুষ হিসেবে প্রতিনিধিত্বের অনুশীলন ছিল সন্জীদা খাতুনের বৌদ্ধিক ও সাংস্কৃতিক দর্শনের মূল।
দুই.
সেকালে রক্ষণশীল মুসলিম পরিবারে সঙ্গীতচর্চা ছিল বিরল দৃষ্টান্ত! সেদিক থেকে সন্জীদা খাতুনের পরিবার ছিল ব্যতিক্রম। বিশ শতকে ঢাকাকেন্দ্রিক বাঙালি মুসলিম সমাজে ‘বুদ্ধির মুক্তি’ আন্দোলনের অন্যতম নেতা, শিক্ষক-সাহিত্যিক-গণিতবিদ কাজী মোতাহার হোসেনের কন্যা সন্জীদা খাতুন নিজেও সর্ব অর্থেই ছিলেন এক মেধাবী শিক্ষার্থী। সঙ্গীতচর্চার বিরল সুযোগ ছিল তাঁদের পরিবারেই। বাড়িতে শিক্ষক এসে তাঁর বড় বোনকে গান শেখাতেন। সন্জীদা খাতুনও বসে যেতেন বোনের সঙ্গে গাইতে। বড় বোন গাইতেন নানা ধরনের গান। তাঁর কণ্ঠে কিংবা বাবার কণ্ঠে গান শুনতে শুনতে বিচিত্র সঙ্গীতভাণ্ডার আত্মস্থ হয়ে গিয়েছিল তাঁর।
স্নাতকোত্তর ডিগ্রির জন্য বিশ্বভারতীতে গেলে সঙ্গীতচর্চা হয়ে ওঠে আরও বেগবান। আমাদের কৈশোরে তাঁকে চিনতাম রবীন্দ্রসঙ্গীতের একজন সমীহ জাগানিয়া শিল্পী হিসেবে। যদিও কেবল রবীন্দ্রসঙ্গীত নয়, আরও নানা ধরনের গানের চর্চাও করতেন তিনি। সত্তরের দশকের গোড়ার দিকেই রমনা বটমূলের বর্ষবরণ আয়োজনের কথা জেনেছিলাম আমিও। সে-আয়োজনে যাওয়ার অভিজ্ঞতাও ছিল; সেখানেও তাঁর সক্রিয়তা দেখেছি। কিন্তু ক্রমশ বুঝেছি, তিনি গভীর নিষ্ঠায় বাংলাদেশের সাংস্কৃতিকতার জন্য নিবেদন করেছেন নিজের জীবনকে।
সঙ্গীতচর্চা, এবং সামগ্রিকভাবে সঙ্গীতের সামগ্রিকতা— তাঁর কাছে কেবল উপভোগের আনন্দের বিষয় ছিল না, ছিল জাতীয় জীবনের উৎকর্ষের সংগ্রাম! এমন এক সত্তাকে ধারণের জন্য তাঁর ব্যক্তিত্বে ছিল এক ধরনের কঠোরতার আবহ। তাঁর এই কঠোরতা সম্পর্কে আড়ালে কিছু সমালোচনা থাকলেও আত্মনিবেদনের গভীরতার জন্য তিনি সকলের কাছেই সমীহ পেতেন। পেশাগত জীবন থেকে অবসর নেওয়ার পরও ছায়ানট কিংবা রবীন্দ্রসঙ্গীত সম্মিলন পরিষদের কাজে তিনি মনন ও শারীরিক উদ্যম নিয়ে সর্বক্ষণ ব্যস্ত থাকতেন।
তিন.
একই সঙ্গে ছিলেন গবেষক, মননশীল লেখক, সংগঠক ও শিক্ষক। জন্মেছিলেন ১৯৩৩ সালের ৪ এপ্রিল, এবং মৃত্যুবরণ করেন ২০২৫ সালের ২৫ মার্চ। কর্মজীবন শুরু হয় ইডেন কলেজে শিক্ষকতা দিয়ে। রবীন্দ্রসঙ্গীত চর্চার ‘অপরাধে’ তাঁকে বদলি করা হয় কারমাইকেল কলেজে। পরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে দীর্ঘকাল অধ্যাপনার পর সেখান থেকেই অবসর নেন।
ষাটের দশকে বাঙালির আধুনিক মধ্যবিত্ত জীবনে সংস্কৃতিচর্চা ও সাংগঠনিকতায় তিনি ছিলেন লড়াকু এক ব্যক্তিত্ব। বিশেষত মুসলিমপ্রধান সমাজে রবীন্দ্রসঙ্গীতের চর্চা ও প্রসারে তাঁর সক্রিয় ভূমিকা ঐতিহাসিক, রাজনৈতিক ও নান্দনিক— এই তিন দিক থেকেই গভীরভাবে তাৎপর্যপূর্ণ। ষাটের দশকের দ্বিতীয় ভাগে যাত্রা শুরু করা সঙ্গীতশিক্ষা ও সাংস্কৃতিক কর্মসূচিভিত্তিক প্রতিষ্ঠান ‘ছায়ানট’-এর তিনি ছিলেন প্রতিষ্ঠাতা সদস্য। সেই সূত্রেই শিক্ষকতার পাশাপাশি পথিকৃতের ভূমিকায় অবতীর্ণ হন তিনি। পরে আমৃত্যু এই প্রতিষ্ঠানের সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন।
১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের সময় তিনি সাংগঠনিক দক্ষতার পরিচয় দেন, সাংস্কৃতিক কর্মীদের ঐক্যবদ্ধ করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। নিজের শিক্ষাজীবন শেষে শিক্ষকতাকেই গ্রহণ করেছিলেন পেশা হিসেবে।
চার.
গবেষণাকর্ম দিয়েই তাঁর সাহিত্যিক অবদানের সূচনা। সেই সূত্রেই প্রকাশিত হয় কবি সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত (১৯৫৮) শিরোনামে তাঁর প্রথম বই। লেখক হিসেবেও তিনি স্বল্পপ্রসূ নন। তাঁর লেখার বড় অংশের উপজীব্য রবীন্দ্রনাথ। তাঁর রচনাবলির বিষয়ভাগকে মোটামুটি চারটি ভাগে ভাগ করা যায়— এক: সাহিত্য ও সাহিত্যিক-সম্পর্কিত; দুই: সংস্কৃতি-প্রাসঙ্গিক; তিন: দেশকাল-ভাবিত; চার: বাংলা ভাষা-কেন্দ্রিক। সন্জীদা খাতুনের মননভুবন ও সাংস্কৃতিক-সংগ্রামী সত্তার পরিচয় এই রচনাসমূহ থেকেই অনুধাবন করা সম্ভব।
তাঁর উল্লেখযোগ্য বইগুলোর উল্লেখ এখানে করা যাক— বইগুলোর নাম শুনলেই তাঁর চিন্তাভুবনের একটি স্পষ্ট রেখাচিত্র তৈরি হয়। সব বইয়ের নাম না দেওয়া গেলেও অধিকাংশ গুরুত্বপূর্ণ বইয়ের নাম নিচে তুলে ধরা হল:
রবীন্দ্রসঙ্গীতের ভাবসম্পদ (১৯৮১), ধ্বনি থেকে কবিতা (১৯৮৮), অতীত দিনের স্মৃতি (১৯৯৩), রবীন্দ্রনাথ: বিবিধ সন্ধান (১৯৯৪), তোমারি ঝরনাতলার নির্জনে (১৯৯৪), আপনজনদের স্মৃতিকথা (১৯৯৭), কাজী মোতাহার হোসেন: আপনজনদের স্মৃতিকথা (১৯৯৭) [সম্পাদিত], রবীন্দ্রনাথের হাতে হাত রেখে (২০০০), জননী জন্মভূমি (২০০৫), রবীন্দ্রনাথ: তাঁর আকাশ ভরা কোলে (২০০৭), রবীন্দ্রনাথ: মননে লালনে (২০১১), সহজ কঠিন দ্বন্দ্বে ছন্দে (২০১৩), রবীন্দ্র-বিশ্বাসে মানব-অভ্যুদয় (২০১৬), স্মৃতিপটে গুণীজন (২০১৭), নজরুল মানস (২০১৮), রবীন্দ্র কবিতার গহনে (২০১৯), সাংস্কৃতিক মুক্তিসংগ্রাম (২০২১), জীবনবৃত্ত (২০২০), আমার রবীন্দ্রনাথ, প্রথম ও দ্বিতীয় খণ্ড (২০২৩), সংস্কৃতি-কথা সাহিত্য-কথা, সংস্কৃতির বৃক্ষছায়ায়, অগ্রজজনের সৃষ্টিবীক্ষা (২০১৮), স্বদেশ সমাজ সংস্কৃতি (প্রকাশনা-সন অজ্ঞাত), ধ্বনির কথা আবৃত্তির কথা (?), বিশ্ব ভরা প্রাণ (?), জগতে আনন্দযজ্ঞে ওয়াহিদুল হক (?), রবীন্দ্রনাথ ও অন্যান্য (?), রবীন্দ্রনাথ এবং রবীন্দ্রনাথ (?), রবীন্দ্রসঙ্গীত: মননে লালনে (?), রবীন্দ্র-বিশ্বাসে মানব-অভ্যুদয় (?)।
রবীন্দ্র-বিষয়ক তাঁর সম্পাদিত বইয়ের মধ্যে রয়েছে: রইল তাহার বাণী: রইল ভরা সুরে (?), গীতবিতান: তথ্য ও ভাবসন্ধান (?), সার্ধশততম জন্মবর্ষে রবীন্দ্রনাথ (?)।
বাংলা কবিতার ব্যাখ্যা ও আস্বাদনে কোনও কোনও সমালোচক বিচ্ছিন্নভাবে ধ্বনি ও ভাবকে মেলানোর চেষ্টা করেছেন, কিন্তু ধ্বনিপ্রতীকতাতত্ত্বের সুশৃঙ্খল প্রয়োগের অনুসন্ধান তেমনভাবে দেখা যায়নি। ধ্বনি থেকে কবিতা (বিশ্বভারতী গবেষণা প্রকাশনা বিভাগ, শান্তিনিকেতন, ১৯৮৭) বইয়ে সন্জীদা খাতুন বাংলা কবিতা বিশ্লেষণে ‘ধ্বনিপ্রতীকতা’ শব্দটি উচ্চারণ না করেও ধ্বনিপ্রতীকতাতাত্ত্বিক প্রয়োগের একটি বিস্তৃত পরীক্ষা করেছেন। যদিও বইটিতে এই শব্দটি কেবল একবার ব্যবহৃত হয়েছে, তবু ধ্বনি ও কবিতার ভাবের মধ্যেকার সহজাত সম্পর্ক অনুসন্ধানে তিনি প্রবল আগ্রহ ও মনোযোগ দেখিয়েছেন।
আমরা জানি, সমকালের অন্যতম প্রধান রবীন্দ্রসঙ্গীতশিল্পী সন্জীদা খাতুনের রয়েছে ধ্বনি ও সুরের সঙ্গে গভীর এক অন্তর্লীন সম্পর্ক। ধ্বনি যে তাঁর বাস্তব ও স্বপ্নকে অনেকটাই নিয়ন্ত্রণ করেছে, সে-কথা অনুমান করা যায় আমৃত্যু তাঁর শিল্পীসত্তার নিরবচ্ছিন্ন অনুশীলনের মধ্যে দিয়ে।
পাঁচ.
সন্জীদা খাতুন মনে করতেন, রবীন্দ্রসঙ্গীতের অনন্যতা এর ভাবসম্পদে নিহিত। তাই প্রতিটি গানের ভাষা ও অলঙ্করণ, ছন্দ ও সুরের সামগ্রিক সৌন্দর্য এক অখণ্ড ভাবসম্পদরূপে শ্রোতার মনে আভাসিত হয়। তিনি লিখেছেন—
সে-সৌন্দর্যকে উল্টেপাল্টে আস্বাদন করতে চাইলে গঠনশিল্পের নানাদিক থেকে তাকে ফিরিয়ে ফিরিয়ে দেখা চলে। তাতে সৌন্দর্যের আস্বাদ বাড়ে বই কমে না। উপরন্তু, উপলব্ধি গভীরতর হয়।
সন্জীদা খাতুনের বিবেচনা এই যে—
এইরকম ধারণা থেকেই সন্ধানী চিত্ত রবীন্দ্রসঙ্গীতের ভাবসম্পদের অন্বেষণে প্রবৃত্ত হতে পারে। সকল সন্ধানেরই পরিকল্পনা থাকে। আবার সেই পরিকল্পনামতো অগ্রসর হওয়ার পূর্বে পরীক্ষামূলকভাবে তা কিছুটা নাড়াচাড়া করেও দেখা যেতে পারে।
রবীন্দ্রসংগীতের ভাবসম্পদ ও অধরা মাধুরীর ছন্দোবন্ধন বইয়ে তিনি এই প্রয়াসই করেছেন।
তাঁর লেখা প্রবন্ধের চারটি ধারা। একটি ধারাকে চিহ্নিত করা যায় সাহিত্য-সাহিত্যিক নামে। এতে রয়েছে বাংলাদেশের সাহিত্যসেবী কয়েকজন প্রধান ও অপ্রধান লেখকের গড়ে ওঠা, জীবনদর্শন, তাঁদের সাহিত্যভাবনা ও রচনাকৃতির সঙ্গে রচয়িতার আপন জীবনের নিভৃত সংযোগের পরিচয়। সন্জীদা খাতুনের এই ধরনের বিশ্লেষণে পাওয়া যায় তাঁর স্বকীয় দৃষ্টিভঙ্গি, পাঠের গভীরতা, এবং মননবুদ্ধিসংবলিত নান্দনিক বোধ; পাশাপাশি প্রতিফলিত হয় তিনি কোন ধারার সাহিত্য-সমালোচক তার পরিচয়ও। বেগম আখতার কামালের কথার সূত্র ধরে বলা যায়, সাহিত্য-সমালোচক হিসেবে তিনি ‘প্রতিফলনতত্ত্ব’ ধারার অনুগামী।
অতীত দিনের স্মৃতি (১৯৯৩) বইয়ে বঙ্গভঙ্গ তথা ১৯৪৭-এ ভারত-ভাগের মাধ্যমে যে তথাকথিত ‘স্বাধীনতা’ এসেছিল, তার স্বরূপ স্পষ্ট হয়ে উঠেছিল বাংলা ভাষার ওপর আক্রমণের প্রতিক্রিয়ায়। ক্রমে বোঝা গিয়েছিল, পাকিস্তানবাদ বাঙালির ভাষা ও সংস্কৃতিকে বিপর্যস্ত করে তাদের গোষ্ঠীগত পরিচয় মুছে দিয়ে শুধু ‘মুসলমান’ পরিচয়ে চিহ্নিত করতে চায়। এই একমাত্রিক পরিচয়ের মধ্যে দিয়েই তাঁদের ‘পাকিস্তানি’ করে তোলার অভিপ্রায়ে অগ্রসর হচ্ছিল তৎকালীন পশ্চিম পাকিস্তান-নিয়ন্ত্রিত শাসকগোষ্ঠী। এই চক্রান্তের বিরুদ্ধে বাঙালি সংস্কৃতিকে অক্ষুণ্ন রাখার প্রস্তুতি শুরু হয়েছিল ধীরে ধীরে। নানা প্রতিবন্ধকতার মধ্যেও তখন রবীন্দ্র শতবর্ষ উদ্যাপন, ছায়ানট সঙ্গীত বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা, রমনার বটমূলে বর্ষবরণ আয়োজন ইত্যাদির মাধ্যমে বাঙালির সাংস্কৃতিক জীবনকে ঋদ্ধ করার এক দৃঢ় সংকল্পে সক্রিয় হন যাঁরা, সন্জীদা খাতুন ছিলেন তাঁদেরই অগ্র-প্রতিনিধি।
ছয়.
ভাষা আন্দোলনে সন্জীদা খাতুনের ভূমিকা সর্বজনবিদিত। অধ্যাপনার সূত্রে রবীন্দ্রনাথ, নজরুল, ছন্দের জাদুকর সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত এবং ‘ধ্বনি ও ছন্দ’-এর পাঠ, বিশ্লেষণ এবং গবেষণায় নিবিষ্ট এক মননশীল চিত্ত হিসেবে তাঁর সৃষ্টিবিশ্ব বর্ণিল ও ঋদ্ধ। তাঁর রচনার মাধ্যমে আমরা জানতে পারি জানা বিষয়ের না-জানা কথাগুলি। বিষয়বস্তুর গভীরতা কখনওই তাঁর রচনাশৈলীকে দুরূহ বা দুর্বোধ্য করে তোলে না। তাঁর রয়েছে নিজস্ব এক অন্তরঙ্গ গদ্যভঙ্গি। কথা বলার ভঙ্গিতেও রয়েছে সেই নিজস্বতা।
মনে পড়ছে, নব্বইয়ের দশকে বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের পক্ষ থেকে আবদুল্লাহ আবু সায়ীদের সঙ্গে তাঁকে একটি পাঠচক্রের তরুণদের কাছে নিয়ে গিয়েছিলাম। উদ্দেশ্য ছিল, নিজের শিল্পীসত্তার যাত্রাপথ, বাংলাদেশের সঙ্গীত ও গুণী শিল্পীদের গায়কী বৈশিষ্ট্য নিয়ে তরুণদের সঙ্গে কথা বলা। তরুণদের একেবারে কাছে বসে সেদিন তিনি শান্ত অথচ দৃঢ় ভাষায় নিজস্ব ভাবনাগুলো প্রকাশ করেছিলেন। তাঁর অনন্য কথনের ভঙ্গি ও মননশীলতা আমাকে এবং উপস্থিত তরুণদের গভীরভাবে অনুরণিত করেছিল।
প্রসঙ্গত, গদ্যের মতো বা কথাবার্তার মতো, তাঁর গানেও ছিল নিজস্ব এক গায়কী। সেদিনের আয়োজনে গান পরিবেশনের কথা ছিল না, ছিল না কোনও ধ্বনিপ্রক্ষেপণ যন্ত্রের ব্যবস্থাও। কিন্তু আবদুল্লাহ আবু সায়ীদের অনুরোধে তিনি একটি মাত্র রবীন্দ্রসঙ্গীত গেয়ে শোনালেন। নিস্তব্ধ মিলনায়তনে খালি গলায় তন্ময় হয়ে অনেকটা ক্ষীণ স্বরে পরিবেশিত সেই গানটি আমার কাছে এক বিশেষ ও অসাধারণ শ্রবণ-অভিজ্ঞতা হয়ে আছে। তাঁর অনুরাগী শিক্ষার্থী কিংবা সাংগঠনিকভাবে ঘনিষ্ঠদের অনেকেই হয়তো এরকম অন্তরঙ্গ সঙ্গীত শ্রবণের অভিজ্ঞতা অর্জন করেছেন। কিন্তু আমার কাছে সেদিনের সেই মুহূর্ত ছিল একান্ত এবং বিরল। পরবর্তীকালে বহু খ্যাতিমান শিল্পীর অসাধারণ পরিবেশনার মধ্যেও সেদিন খানিকটা অনিচ্ছুক মনে পরিবেশিত তাঁর কণ্ঠের সেই রবীন্দ্রসঙ্গীত— আমার স্মৃতিতে আজও অনুরণিত হয়ে চলেছে।
সাত.
আগেও উল্লেখ করা হয়েছে, সন্জীদা খাতুনের বেশ কিছু রচনা স্মৃতিচারণভিত্তিক। অতীত দিনের স্মৃতি বইটি সেই ধারার। লেখকের নিজস্ব গদ্যশৈলীতে গড়ে ওঠা এই বই এক অসাধারণ স্মৃতিকথা। এর ঘটনাপ্রবাহ এতই প্রাঞ্জল যে, কখনও তা মনে হয় শক্তিমান লেখকের সৃষ্ট কথাসাহিত্য, স্মৃতিচারণ মাত্র নয়।
একইভাবে স্বাধীনতার অভিযাত্রা (২০০৪) তাঁর লেখা আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ স্মৃতিমূলক ও ইতিহাসধর্মী গ্রন্থ। এই বই উল্লেখযোগ্য, কারণ এর উপজীব্য ভাষা আন্দোলন, নববর্ষ, ছায়ানট এবং মুক্তিযুদ্ধ। তাঁদের প্রজন্মই প্রথম গভীরভাবে অনুভব করেছিলেন, ১৯৪৭-এ যে ‘স্বাধীনতা’ এসেছিল, তা অনেক আগেই মেকি হয়ে উঠেছিল। এই মেকিত্ব প্রকট হয়ে ওঠে বাংলা ভাষার ওপর আক্রমণের মাধ্যমে। ক্রমে স্পষ্ট হয়, শাসকেরা চায় বাঙালির ভাষা ও সংস্কৃতিকে ধ্বংস করে তাঁদের গোষ্ঠীপরিচয় ভুলিয়ে দিতে। তাদের কথামতো পাকিস্তানি হতে হলে তাদের কেবলমাত্র মুসলমান পরিচয়ে পরিচিত হতে হবে। এর বিরুদ্ধদৃষ্টির জীবনবোধের সূত্র পাওয়া যায় স্বাধীনতার অভিযাত্রা বইয়ে।
শাসকগোষ্ঠীর দর্শনবিরোধী নানা কর্মকাণ্ড— যেমন রবীন্দ্র-শতবর্ষ উদ্যাপন, ছায়ানট প্রতিষ্ঠা, রমনার বটমূলে নববর্ষের আয়োজন— এই সবকিছুর মধ্যে দিয়েই বাঙালির নাগরিক সংস্কৃতি কীভাবে ঋদ্ধ হয়ে উঠেছিল, তার পরিচয় রয়েছে সন্জীদা খাতুনের এই ধরনের রচনায়। যদিও তাঁর সক্রিয়তা মূলত ছিল নাগরিক মধ্যবিত্ত সমাজের পরিসরে, তবু তিনি চাইতেন নিজের উপলব্ধিকে সর্বস্তরের মানুষের কাছে পৌঁছে দিতে। তাঁর লেখা পড়লে বোঝা যায়, সেই সময়ে বাঙালিত্বের দৃঢ় ভিত্তি গড়ে তোলার সাধনায় নিজেকে ব্রতী করার তাগিদ অনুভব করেছিলেন বাংলাদেশের মধ্যবিত্ত সমাজের অনেকে। কিছু উদ্যমী সংস্কৃতিকর্মী সে সাধনায় নেমেও পড়েছিলেন। এঁদেরই অন্যতম নেতৃস্থানীয় ছিলেন সন্জীদা খাতুন। স্বাধীনতার অভিযাত্রা বইটিতে রয়েছে সেই সাধনায় তাঁদের অংশগ্রহণেরই প্রামাণ্য বিবরণ।
ষাটের দশকে ছায়ানট এবং পরে রবীন্দ্রসঙ্গীত সম্মিলন পরিষদ প্রতিষ্ঠার মধ্যে দিয়ে সন্জীদা খাতুনের সাংগঠনিক সক্রিয়তা যে স্তরে ছিল তা আর এক নতুন স্তরে উত্তীর্ণ হয় যখন তাঁদের সাংস্কৃতিক দর্শনকে ভিত্তি করে গড়ে ওঠে একটি প্রাক-প্রাথমিক, প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষালয়— ‘নালন্দা বিদ্যালয়’। ওয়াহিদুল হকের আগ্রহে আমাকেও এই উদ্যোগের সঙ্গে যুক্ত করা হয়েছিল। সেই সময়ই কিছুটা পরিচয় হয়েছিল তাঁর শিক্ষাচিন্তার সঙ্গে। তিনি বিশ্বাস করতেন, শিশুদের বিকাশে বিদ্যা কেবল গিলিয়ে দেওয়ার বিষয় নয়; বরং বিদ্যাচর্চা যেন হয়ে ওঠে এক আনন্দময় অভিজ্ঞতা— এই দর্শনে তিনি ছিলেন অবিচল।
পরে নিউ ইয়র্ক-বাসী হয়ে পড়ার কারণে আমার পক্ষে আর সরাসরি যুক্ত থাকা সম্ভব হয়নি, তবে মাঝেমাঝেই তাঁদের এই শিক্ষাপ্রয়াসের পথে সামাজিক নানা দৃষ্টিভঙ্গিজনিত প্রতিকূলতার কথা জানার সুযোগ হত। সেই সূত্রেই অনুভব করেছি, এই দর্শনের প্রয়োগে তাঁর মনন কতটা সক্রিয় ছিল। একটি বিদ্যায়তন পরিচালনার ক্ষেত্রে সমাজের সঙ্গে তাঁর বোঝাপড়ার প্রক্রিয়া আমার নিজের সমাজবাস্তবতা অনুধাবনেও তাৎপর্যপূর্ণ এবং গভীর স্মরণীয় উপকরণ হয়ে আছে। নিজের সেই চিন্তা-প্রক্রিয়ার কিছু কিছু কথা তিনি লিখেও গিয়েছেন, যা অন্যদের কাছেও মূল্যবান হয়ে উঠতে পারে বলে মনে হয় আমার।
তাঁর শিক্ষাচিন্তা ও তার প্রয়োগ নিয়ে আমাদের আরও গভীরভাবে ভাবার অবকাশ রয়েছে। তাঁর দৃষ্টিভঙ্গির যে কিছু সীমাবদ্ধতা দেখা যায়, তাকে কেবল ব্যক্তিগত সীমাবদ্ধতা হিসেবে না দেখে রাষ্ট্র ও সমাজে প্রবাহমান বৈচিত্র্যময় বাস্তবতার প্রতিফলন বলেই দেখা অধিক সঙ্গত।
আট.
শান্তিনিকেতনের দিনগুলি (২০২০) বইটি বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ে তাঁর স্নাতকোত্তর করতে যাওয়া সময়ের স্মৃতিচারণ। তাঁর স্বতন্ত্র ও আন্তরিক ভাষায় তা হয়ে উঠেছে বহু রং, ঘ্রাণ, রূপ ও রসে ঘন এক মনোরম আলেখ্য। রবীন্দ্র-অনুরাগ তাঁকে শান্তিনিকেতনে যেতে উদ্বুদ্ধ করেছিল। শান্তিনিকেতন কেবল তাঁর প্রিয় শিক্ষালয় ছিল না, ছিল বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ সাংস্কৃতিক ভাবনারও পরিচর্যাস্থল।
এই বইয়ে তিনি তুলে ধরেছেন সেকালের শান্তিনিকেতনের পাঠক্রম, শিক্ষকমণ্ডলী, বন্ধুবৃত্ত ও পরিপার্শ্বস্মৃতি। এই স্মৃতিকথা কেবল সেখানকার মধুরতা কণ্ডুয়ন হয়ে থাকেনি, উঠে এসেছে গোলাপকুঞ্জের কিছু কাঁটার ঘাইয়ের স্মৃতিও। এই দিক থেকে বিবেচনা করলে, সন্জীদা খাতুনের ব্যক্তিগত স্মৃতির আদলে শান্তিনিকেতনের দিনগুলি বইটি হয়ে উঠেছে মূলত বাঙালির সাংস্কৃতিক অতীতের এক বিশিষ্ট ও নির্মোহ আরশি, যা তাঁর সংস্কৃতিবোধ ও জীবনদর্শনকে গভীরভাবে প্রভাবিত করেছিল।
নয়.
স্মরণীয়, দেশে-বিদেশে তিনি কিছু উল্লেখযোগ্য পুরস্কার ও সম্মাননাও পেয়েছেন। তার সংক্ষিপ্ত তালিকা নিম্নরূপ:
- রবীন্দ্র পুরস্কার (১৯৮৮) – ভারতের পশ্চিমবঙ্গ সরকারের প্রদানকৃত,
- একুশে পদক (১৯৯১) – বাংলাদেশ সরকারের প্রদানকৃত,
- বাংলা অ্যাকাডেমি সাহিত্য পুরস্কার (১৯৯৮),
- দেশিকোত্তম (২০১২) – পশ্চিমবঙ্গের বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রদানকৃত,
- পদ্মশ্রী (২০২১) – ভারতের কেন্দ্রীয় সরকারের প্রদানকৃত।
দশ.
সন্জীদা খাতুনের মৃত্যু ঘটেছে পরিণত বয়সে পৌঁছনোর পরেই। সেদিক থেকে বিবেচনা করলে, তাঁর জীবনকে আমরা প্রেরণায় উদ্বুদ্ধ ও কর্মে ব্যাপৃত এক সার্থক জীবন বলতেই পারি। কিন্তু এত কর্মময়তা ও প্রাণিত জীবনের স্বাভাবিক পরিণতি সত্ত্বেও বহু বিষয়ে ও ক্ষেত্রে তাঁর সক্রিয় অনুপস্থিতি আমাদের ব্যথিত করে চলে, দীর্ঘস্থায়ী এক শূন্যতাবোধের অভিঘাতে। সামগ্রিকভাবে ধর্মবাদী-সাম্প্রদায়িক জীবনদৃষ্টির বিপরীতে ইহজাগতিক-সাংস্কৃতিক জীবনবোধের সংগ্রামে তাঁর মতো কর্মময় মানুষের অনুপস্থিতি যদি আমাদের চিন্তনপ্রক্রিয়াকে রুদ্ধ না করে, বরং সক্রিয় রাখে— তাহলে হয়তো তাঁর প্রতি আমাদের শ্রদ্ধা কিছুটা হলেও সার্থক হয়ে উঠবে।