
অভ্র বসু
সন্জীদা খাতুন ছিলেন মুক্তির সাধক— যে-কোনওরকম আরোপিত বাঁধন থেকে মুক্তি, সে ধর্মীয়, সামাজিক কিংবা রাষ্ট্রনৈতিক— যাই হোক না কেন। ধর্মগত পরিচয়ের কারণে হোক বা নারী হওয়ার কারণেই হোক, তিনি কখনও নিজের বিশ্বাস থেকে সরে আসেননি। জীবনের সজনে-বিজনে, সুখে-দুঃখে, বিপদে যে আনন্দিত তান তাঁর ‘বন্ধু’ অন্তরে বাজিয়ে গেছেন, তা বুদ্ধির মুক্তির কথাই বলে— সাম্প্রদায়িক সংকীর্ণতার নয়
গত ২৫ মার্চ ঢাকায় প্রয়াত হয়েছেন সন্জীদা খাতুন। বাঙালির সংস্কৃতির ক্ষেত্রে তিনি ছিলেন এক অসামান্য ব্যক্তিত্ব। তাঁর জন্ম ১৯৩৩ সালের ৪ এপ্রিল। ৯২ বছরের দীর্ঘ জীবন সম্পর্কে বলতে গেলে গুরুদেব রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কথাই মনে পড়ে— ‘জীবন হয়নি ফাঁকি, ফলেফুলে ছিল ঢাকি’।
সঙ্গীতসাধিকা হিসেবেই তাঁর খ্যাতি সর্বাধিক। তবে তাঁর সমগ্র জীবন এক লড়াইয়ের কথা বলে। সে-লড়াই ভাষাসন্ত্রাসের বিরুদ্ধে, মৌলবাদের বিরুদ্ধে, সে-লড়াই যে-কোনও অসাম্যের বিরুদ্ধে। একদিকে তিনি প্রতিবাদী, অন্যদিকে দক্ষ সংগঠক। তবু প্রত্যক্ষ রাজনীতি থেকে নিজেকে সব সময় দূরে রাখতে চেয়েছেন। বলেছেন,
রাজনীতি আমার ক্ষেত্র নয়, সাংস্কৃতিক আন্দোলনই আমার আসল কাজের ক্ষেত্র। বিশেষ করে, বাংলাদেশ বা বাঙালির সাংস্কৃতিক স্বাধিকার সংরক্ষণই আমার উপযুক্ত কাজের ক্ষেত্র।
সনজীদা খাতুন ছিলেন কাজী মোতাহার হোসেন ও সাজেদা খাতুনের কন্যা। কাজী মোতাহার হোসেন ছিলেন বিশিষ্ট বিজ্ঞানী; পদার্থবিদ্যা, অঙ্ক ও রাশিবিজ্ঞানে ছিল তাঁর পারদর্শিতা। বিশ শতকের তৃতীয় ও চতুর্থ দশকে ঢাকায় ‘বুদ্ধির মুক্তি’ নামে পরিচিত আন্দোলনের তিনি ছিলেন অন্যতম সংগঠক এবং ওই আন্দোলনের মুখপত্র শিখা পত্রিকার অন্যতম সম্পাদক।
‘বুদ্ধির মুক্তি’র চেতনাকে সনজীদা খাতুন জীবনের প্রতিটি পরতে ধারণ করে চলেছেন। জীবনের প্রায় শুরু থেকেই তাঁকে দেখা গেছে অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদী ভূমিকা নিতে। সেই শৈশবে শিল্পী কামরুল হাসানের নেতৃত্বে তিনি যুক্ত হয়েছিলেন ব্রতচারী আন্দোলনে, কাজ করেছেন মুকুল ফৌজেও। ১৯৫২ সালে, যখন ঢাকায় ভাষা আন্দোলন পূর্ব পাকিস্তানের বাঙালিকে স্পন্দিত করেছে, তখন তিনি ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী। অবধারিতভাবে সেখানেও তিনি আন্দোলনের সঙ্গে সক্রিয়ভাবে যুক্ত হন। এই উপলক্ষে এক স্মৃতিচারণায় তিনি বলেছিলেন, “একুশ আমাকে ভাষা দিয়েছে।”
১৯৫৪ সালে সনজীদা খাতুন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলা অনার্স নিয়ে স্নাতক হন। এরপরই তিনি শান্তিনিকেতনে চলে আসেন এবং বাংলা বিভাগে ভর্তি হন। ১৯৫৫ সালে বাংলায় প্রথম শ্রেণিতে এমএ পাশ করেন। তখন আচার্য প্রবোধচন্দ্র সেন তাঁকে পরামর্শ দেন সত্যেন্দ্রনাথ দত্তের উপর গবেষণা করতে। সে-কাজ শেষ করে তিনি ঢাকায় ফিরে যান।
এরপর বাড়ি ছেড়ে তিনি বিবাহ করেন ওয়াহিদুল হককে। ১৯৫৭ সালে তিনি অধ্যাপনায় যোগ দেন— প্রথমে ঢাকার ইডেন মহিলা কলেজে, পরে রংপুরের কারমাইকেল কলেজে। বাঙালি সংস্কৃতি নিয়ে তাঁর নিরন্তর আন্দোলনের জন্য রংপুরে এই পদায়ন কার্যত তাঁর একটি ‘punishment posting’। এই সময়েই তাঁর তিন সন্তান— অপালা, পার্থ ও রুচিরার জন্ম হয়। ওয়াহিদুল হক ও সন্জীদা খাতুন যুগ্মভাবে বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক আন্দোলনের কাজে নিবেদিত থেকেছেন। তাঁদের কর্মময় সাংস্কৃতিক জীবনকে তাঁরা ব্যক্তিগত জীবনের উত্থান-পতনের ঊর্ধ্বে তুলে রাখতে পেরেছিলেন।
১৯৬১ সালে পাকিস্তানি শাসকেরা রবীন্দ্রচর্চার বিরুদ্ধে পক্ষান্তরে নির্দেশ জারি করে। সে-নির্দেশ অগ্রাহ্য করে রবীন্দ্র-জন্মশতবর্ষ পালনের মধ্যে দিয়ে সূচিত হয় বাঙালি সংস্কৃতির সংগ্রাম। রবীন্দ্র-জন্মশতবার্ষিকী উপলক্ষে নানা অনুষ্ঠান হয়েছিল। অনুষ্ঠান পালনের পরপর সংগঠক ও শিল্পীরা একসঙ্গে কাজ করার জন্য নতুন একটি সংগঠন ‘ছায়ানট’ প্রতিষ্ঠার সিদ্ধান্ত নেন। শুরু থেকেই এই সংগঠনের সামনে ছিলেন সন্জীদা খাতুন। আমৃত্যু তিনি ছিলেন তার কর্ণধার।
ছায়ানট একটি সঙ্গীতের বিদ্যালয় মাত্র নয়। পূর্ববঙ্গে, বিশেষত স্বাধীন বাংলাদেশে, বাঙালির সংস্কৃতি গড়ে তোলার ক্ষেত্রে সন্জীদা খাতুনের নেতৃত্বে ছায়ানটের একটা বড় ভূমিকা ছিল। কিন্তু ছায়ানটের প্রথম পর্বের যাত্রা খুব সুখের ছিল না। নানাবিধ কুকথা প্রচার হয়েছে ছায়ানট সম্পর্কে। সন্জীদাকেও মুখোমুখি হতে হয়েছে নানা বিরুদ্ধতার। একের পর এক আস্তানা পরিবর্তনে বাধ্য হয়েছে ছায়ানট।
কিন্তু এই সবে থেমে থাকেনি ছায়ানট। ১৯৬৩ থেকে ১৯৬৬ সাল পর্যন্ত ছায়ানট বিদ্যায়তনে নববর্ষের অনুষ্ঠান হয়েছে নিয়মিত। প্রথমবারের সেই অনুষ্ঠানটির মধ্যে দিয়ে বিদ্যায়তনটির যাত্রা শুরু হয়। ১৯৬৭ সালের ১৫ এপ্রিল, পয়লা বৈশাখ। রমনার বটমূলে ছায়ানট আয়োজন করেছিল নববর্ষের প্রথম অনুষ্ঠান। অশ্বত্থগাছের মূলে এই অনুষ্ঠান। অশ্বত্থ পঞ্চবটের একটি। প্রসঙ্গত স্মরণীয়, শান্তিনিকেতনে ১৯২৫ সালে উত্তরায়ণ চত্বরে পঞ্চবটী রোপণের মধ্যে দিয়েই শুরু হয়েছিল প্রথম আনুষ্ঠানিক বৃক্ষরোপণ। সন্জীদা খাতুন শান্তিনিকেতনে নিজে থেকেছেন যেখানে তার নামও পঞ্চবটী। ১৯৭১ সালে এই আয়োজন করা সম্ভব হয়নি, তাছাড়া করোনা মহামারির দুটি বছর বাদ দিয়ে প্রত্যেক বছর এই অনুষ্ঠান সেখানে পালিত হয়ে এসেছে। ২০০১ সালে এই অনুষ্ঠানে এক ভয়াবহ বোমা বিস্ফোরণ ঘটে। জঙ্গিরা চেয়েছিল এই উদ্যাপনকে বন্ধ করে দিতে। কিন্তু সন্জীদা খাতুনের নেতৃত্বে ছায়ানট সেই উদ্যোগ থেকে সরে আসেনি। সন্জীদা খাতুন প্রয়াত হয়েছেন, কিন্তু এ বছরও সেই অনুষ্ঠানের উদ্যোগে রত রয়েছে ছায়ানট।
১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময়ে ভারতবর্ষে থেকে সন্জীদা খাতুন নানাভাবে চেষ্টা চালিয়ে গেছেন মুক্তিযুদ্ধকে সহায়তা করার। তাঁর সভাপতিত্বে স্থাপিত হয় মুক্তিসংগ্রামী শিল্পী সংস্থা। এই সংস্থার পক্ষ থেকে বিভিন্ন অনুষ্ঠান করেছেন কলকাতায়, দিল্লিতে, শান্তিনিকেতনে, শরণার্থী শিবিরগুলিতে।
১৯৭১ সালে বাংলাদেশ স্বাধীন হল। ১৯৭২ সালে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগ দিলেন বাংলা বিভাগে। এর পরে ১৯৭৮ সালে তিনি বিশ্বভারতী বাংলা বিভাগ থেকে পিএইচডি করেন, এবং পরে ১৯৮৫ সালে শেষ হয় তাঁর পোস্ট ডক্টরাল কাজ। সে-ও বিশ্বভারতীতে।
স্বাধীন বাংলাদেশে তাঁর কাজকর্মের প্রসার বাড়ল অনেক। একদিকে তাঁর অধ্যাপনা ও গবেষণা, অন্যদিকে ছায়ানট, জাতীয় রবীন্দ্রসঙ্গীত সম্মেলন ইত্যাদি নানা সাংগঠনিক কাজে তিনি নেতৃত্ব দিয়েছেন। জেলায় জেলায় রবীন্দ্রনাথকে ছড়িয়ে দেওয়ার কাজে ৮০টির বেশি শাখা গড়ে ওঠে বাংলাদেশে। ২০০১ সালে রমনার মাঠে জঙ্গি আক্রমণের পরে তাঁরা উপলব্ধি করেন একেবারে প্রাথমিক স্তর থেকে শিক্ষার ক্ষেত্রটিকে উন্নত না করতে পারলে পরিত্রাণ সম্ভব নয়। এই উদ্দেশ্যে তৈরি হয় নালন্দা স্কুল। এই স্কুলে শিক্ষা এবং সংস্কৃতি— দুটিকে মিলিয়ে দেখবার যে কল্পনা, নিশ্চয়ই রবীন্দ্রনাথের শিক্ষাচিন্তা তাকে পুষ্ট করেছিল।
তাঁর জীবনের মূল ব্রত ছিল বাঙালির সাংস্কৃতিক স্বাধিকার প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম। ‘ব্রত’ কথাটি সচেতনভাবেই ব্যবহার করেছি এখানে, কারণ এই শব্দটি নিয়ে তাঁকে স্বাধীন বাংলাদেশেও কম লড়াই করতে হয়নি। ব্রতচারীর প্রতি তাঁর আকৈশোর আকর্ষণ ছিল। তাঁরই উদ্যোগে বাংলাদেশের বিদ্যালয়-শিক্ষানীতিতে ব্রতচারী আন্দোলনকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছিল। ‘ব্রত’ শব্দটির হিন্দু অনুষঙ্গ অনেকের কাছেই গ্রহণযোগ্য মনে হয়নি। কিন্তু তিনি বুঝিয়েছিলেন, নিষ্ঠা নিয়ে করা যে-কোনও কাজই হল ব্রত। এই কারণেই হজযাত্রাকেও বলা হয়ে থাকে ‘হজ ব্রত’। তাঁর বেশভূষা, প্রসাধন, টিপ পরা, মাথায় ঘোমটা না নেওয়া— সবকিছুই তিনি ধারণ করেছিলেন বাঙালি সংস্কৃতির অঙ্গ হিসেবেই।
সন্জীদা খাতুন ছিলেন মুক্তির সাধক— যে-কোনওরকম আরোপিত বাঁধন থেকে মুক্তি, সে ধর্মীয়, সামাজিক কিংবা রাষ্ট্রনৈতিক— যাই হোক না কেন। ধর্মগত পরিচয়ের কারণে হোক বা নারী হওয়ার কারণেই হোক, তিনি কখনও নিজের বিশ্বাস থেকে সরে আসেননি। জীবনের সজনে-বিজনে, সুখে-দুঃখে, বিপদে যে আনন্দিত তান তাঁর ‘বন্ধু’ অন্তরে বাজিয়ে গেছেন, তা বুদ্ধির মুক্তির কথাই বলে— সাম্প্রদায়িক সংকীর্ণতার নয়।
দুই.
সন্জীদা খাতুন যখন কলেজের শিক্ষার্থী, তখনই আবৃত্তি, অভিনয় ও গানের চর্চা শুরু করেছিলেন। শুরুতে নজরুলসঙ্গীত, আধুনিক বাংলা গান ও পল্লিগীতি শিখেছিলেন সোহরাব হোসেনের কাছে। রবীন্দ্রসঙ্গীত প্রথমে শিখেছেন হুসনে বানু খানমের কাছে; পরে শৈলজারঞ্জন মজুমদার, আবদুল আহাদ, কণিকা বন্দ্যোপাধ্যায়, নীলিমা সেন প্রমুখের কাছে। কলিম শরাফির কাছে গান শেখার কথাও তিনি জানিয়েছেন।
রবীন্দ্রনাথের গানের বিষয়ে তিনি ছিলেন শুদ্ধতার সাধক। কিন্তু শুদ্ধতা বলতে কেবল স্বরলিপির আনুগত্য বোঝায় না। ‘বিশুদ্ধ রবীন্দ্রসঙ্গীতের চর্চা’ প্রবন্ধে তিনি বলছেন:
গান গাইবার সময়ে স্বরলিপিতে যেখানে থেমে পরের অংশে যাওয়ার নির্দেশ দেওয়া আছে, আমরা ঠিক সেইভাবে গাই। কিন্তু যখন একটি ছত্রের বক্তব্য শেষ হওয়ার আগেই থামবার বা পরবর্তী অংশ গাইবার নির্দেশ থাকে, তখন কিংকর্তব্য? “আষাঢ় সন্ধ্যা ঘনিয়ে এল, গেল রে দিন বয়ে” গানে “গেল রে দিন” পর্যন্ত বলে অন্তরার “একলা বসে ঘরের কোণে” এবং সঞ্চারীর “হৃদয়ে মোর ঢেউ দিয়েছে” বলবার নির্দেশ রয়েছে স্বরবিতান-এর ৩৭ নম্বর খণ্ডে। “গেল রে দিন” বললেও একরকম বিরাম হতে পারে ঠিকই, কিন্তু মন যে চায় “বাঁধনহারা বৃষ্টিধারা ঝরছে রয়ে রয়ে” পর্যন্ত গেয়ে তবে পরের অংশে যেতে। সে কি যেতে পারবই না?…
এর পরে তাঁর সিদ্ধান্তটি চমৎকার:
স্বরলিপি দেখে গাইলেও কাণ্ডজ্ঞান জাগ্রত রেখে গানের গভীরে প্রবেশ করবার সেই ধারাই, মনে হয়, বিশুদ্ধভাবে রবীন্দ্রসঙ্গীত গাইবার প্রকৃষ্ট পথ।
তাঁর গায়নে এই কাণ্ডজ্ঞানের পরিচয় স্পষ্ট ধরা পড়ে। কোথাও বাড়তি বা অনাবশ্যক বাহুল্য নেই; কিন্তু যেখানে গানের কথা কোনও বাড়তি ঝোঁক দাবি করে, দাবি করে গানের ভাবটিকে স্পষ্ট করে তুলতে কোনও অলঙ্করণ, তা ভাবের রসে সিঞ্চিত হয়ে প্রকাশ পায়। গান শেখানোর সময় তিনি বরাবরই বাণীর উপরে জোর দিতেন। প্রতিটি গান বারবার পড়তেন, বিশ্লেষণ করতেন তার ভাববস্তু।
তাঁর গাওয়া “আসা যাওয়ার পথের ধারে”, “দাঁড়িয়ে আছ তুমি আমার গানের ওপারে”, “আমায় ক্ষমো হে ক্ষমো”, “জীবন যখন শুকায়ে যায়”, “এবার দুঃখ আমার অসীম পাথার”, “বীণা বাজাও মম অন্তরে”, “কেন জাগে না জাগে না”, “আমার যা আছে”, “ঝরা পাতা গো” প্রভৃতি গান তাঁর কণ্ঠে আশ্চর্য রূপ পেয়েছে।
অবশ্য, শুধুই সঙ্গীতসাধক হিসেবে তাঁকে বিচার করা চলে না। গান, বিশেষ করে রবীন্দ্রনাথের গানকে তিনি রূপ দিয়েছিলেন একটি সংগ্রামের অস্ত্রে। কলেজজীবনে কৃশ শরীর নিয়েও তিনি পাকিস্তান উইমেন্স ন্যাশনাল গার্ডে যোগ দিতে আগ্রহী হয়েছিলেন— ট্রেনিং শেষে একটি পিস্তল পাওয়ার আশায়। ওই গার্ডে ভর্তি হওয়ার একটি শর্ত ছিল কাশ্মির সীমান্তে যুদ্ধে যেতে সম্মত হতে হবে। পিতার কাছে বিষয়টি উত্থাপন করলে তিনি আপত্তি জানান। কিন্তু মায়ের মাধ্যমে আবেদন করে শেষ পর্যন্ত তিনি বাবাকে রাজি করাতে পেরেছিলেন। তবে ট্রেনিং-এর তীব্রতা তাঁর সহ্য হয়নি। শেষ পর্যন্ত সেই পিস্তলের আশা তাঁকে ছাড়তে হয়।
কিন্তু সেই গানই হয়ে উঠেছিল অস্ত্র। মুক্তিযুদ্ধের প্রেক্ষাপটে তিনি বলেছিলেন: “‘আমরা গান নিয়ে যুদ্ধ করেছি।” সে গান ইংরেজি গান নয়, কিন্তু তার কার্যকারিতা কতটা তীব্র ছিল, তা বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস পর্যালোচনা করলেই বোঝা যায়।
তাঁর তত্ত্বাবধানে যাঁরা রবীন্দ্রসঙ্গীত সাধনা করেছেন, তাঁরা অত্যন্ত যত্নের সঙ্গে গান করে চলেছেন। আশা করা যায়, তাঁর ঐতিহ্য তাঁরা যথাযথভাবে বহন করবেন। একসঙ্গে অনেক দক্ষ উত্তরাধিকারী তৈরি করে যাওয়া নিশ্চয়ই তাঁর এক বিরাট কৃতিত্ব।
তিন.
সন্জীদা খাতুন ছিলেন বাংলা সাহিত্যের ছাত্রী এবং পরে অধ্যাপক। বাংলা সাহিত্যসমালোচনার ক্ষেত্রে তাঁর কাজের নিরিখে তাঁকে মনে রাখতে হবে। আমরা আগেই উল্লেখ করেছি, তিনি বিশ্বভারতী থেকে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি লাভ করেন। সেই সময়ে সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত বিষয়ে তাঁর যে রচনাটি ডিসার্টেশন হিসেবে পেশ করেছিলেন, পরে সেটিই গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হয়। এরপর বিশ্বভারতীতেই তিনি সম্পন্ন করেন তাঁর পিএইচডি, যার শিরোনাম ছিল রবীন্দ্রসঙ্গীতের ভাবসম্পদ (১৯৭৮)। পরে ১৯৮৩ থেকে ১৯৮৫ সালের মধ্যে রচিত হয় তাঁর পোস্টডক্টরাল অভিসন্দর্ভ। এই তিনটি রচনাই তাঁর জীবনের শ্রেষ্ঠ কীর্তিগুলির অন্যতম। ফলে তাঁর বিদ্যাচর্চার সঙ্গে শান্তিনিকেতন অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িয়ে আছে।
তাঁর গ্রন্থের সংখ্যা প্রচুর। কিন্তু সামগ্রিক সারস্বত সাধনায় এই তিনটি গ্রন্থই বিশেষ গুরুত্ব রাখে। সত্যেন্দ্রনাথ দত্তকে নিয়ে তাঁর এমএ পরীক্ষার জন্য রচিত যে ডিসার্টেশন, তা ১৯৫৮ সালে গ্রন্থরূপে প্রকাশিত হয়। শুরুতে সত্যেন্দ্রনাথকে নিয়ে গবেষণায় খুব একটা আগ্রহী ছিলেন না সন্জীদা। সত্যেন্দ্রনাথকে ছন্দের জাদুকর মনে করা হয়— কিন্তু এই ছন্দময়তা অনেকের মতোই তিনি কাব্যের সীমাবদ্ধতা বলে মনে করেছিলেন। তবে প্রবোধচন্দ্রের আদেশ শিরোধার্য করে তিনি এই গবেষণায় হাত দেন। সেই সূত্রেই তিনি উপলব্ধি করেন সত্যেন্দ্রনাথের গুরুত্ব। রবীন্দ্রনাথ নামক এক প্রতিষ্ঠানের চূড়ান্ত সার্থকতার সময়ে যে কবির জন্ম, তাঁর যথাযথ মূল্যায়ন নিঃসন্দেহে কঠিন। কারণ রবীন্দ্রপ্রভা এড়িয়ে চলা সত্যিই কঠিন। তবুও সত্যেন্দ্রনাথকে তাঁর যথার্থ পরিপ্রেক্ষিতে বিচার করেছেন সন্জীদা। কবির প্রশংসা করেও তিনি তাঁর বিশ্লেষণে সম্পূর্ণ নিরপেক্ষ থেকে সিদ্ধান্তে পৌঁছেছেন:
তবে, এই প্রকৃতির ফলে কবি হিসেবে হয়তো তিনি অমরত্বের দাবি করতে পারেন না।
সত্যেন্দ্রনাথ কবিতাই শুধু নয়, তাঁর গদ্য নিয়েও বিস্তারে আলোচনা করেছেন সন্জীদা।
রবীন্দ্রসঙ্গীতের ভাবসম্পদ নিয়ে তাঁর পিএইচডি গবেষণা। এর তত্ত্বাবধায়ক ছিলেন উপেন্দ্রনাথ দাস। সেই গ্রন্থে রবীন্দ্রনাথের গানকে তার মূল ভাবগত বিচার করেছেন সন্জীদা।
‘ধ্বনি থেকে কবিতা’ হয়তো তাঁর সবচেয়ে অভিনব এবং বিতর্কিত বই। বাংলা ভাষার ধ্বনির যে একটা অর্থগুণ আছে, সে কথা বিস্তারিতভাবে রামেন্দ্রসুন্দর ত্রিবেদী দেখিয়েছিলেন। মূলত সেই আদর্শ অনুসরণ করে বিষয়টিকে কবিতার বিশ্লেষণে প্রয়োগ করার যে প্রবণতা, তা অত্যন্ত আধুনিক একটি মনের পরিচয় বহন করে। বিষয়টিকে কবিতাপাঠের ক্ষেত্রে যখন শৈলীতাত্ত্বিকভাবে দেখা হয়, তাকে বলা হয় Phonaesthetics বা ধ্বনি নন্দনতত্ত্ব, যাতে বলা হয় যে শুধু শব্দেরই নয়, ধ্বনির কিছু অর্থ থাকে যা কবিতায় ধরা পড়ে। ‘ধ্বনির স্বকীয় গুণ’ শীর্ষক অধ্যায়ে তিনি তার বিস্তারিত পর্যালোচনা করেছেন।
ধ্বনির এই স্বকীয় গুণ কীভাবে কবিতায় ব্যবহার করা যেতে পারে তা বোঝাতে তিনি রবীন্দ্রনাথ, নজরুল, সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত, শঙ্খ ঘোষ প্রমুখের কয়েকটি কবিতা দৃষ্টান্ত হিসেবে ব্যবহার করেছেন। গ্রন্থটিতে তাঁর প্রতিপাদ্য সকলে মেনে নেননি। যেমন ‘কবির অভিপ্রায়’ গ্রন্থে নাম না করে শঙ্খ ঘোষ পদ্ধতিটির সমালোচনা করেছিলেন। কিন্তু তৎসত্ত্বেও কবিতাপাঠের ক্ষেত্রে এটা যে একটা গুরুত্বপূর্ণ উপকরণ হিসেবে ব্যবহারযোগ্য, তা এখন মোটামুটি সর্বজনগ্রাহ্য।
এই তিনটি মৌলিক গবেষণার পাশাপাশি তাঁর অনেকগুলি প্রবন্ধ সংকলন ও স্মৃতিকথা রয়েছে। প্রবন্ধ সংকলনগুলি প্রধানত রবীন্দ্রনাথ-কেন্দ্রিক। রবীন্দ্রনাথ: বিবিধ সন্ধান, রবীন্দ্রনাথ এবং রবীন্দ্রনাথ, রবীন্দ্রনাথের হাতে হাত রেখে, রবীন্দ্রনাথ: তাঁর আকাশভরা কোলে, রবীন্দ্রসঙ্গীত: মননে লালনে, রবীন্দ্রবিশ্বাসে মানব-অভ্যুদয় ইত্যাদি।
বিশেষ করে উল্লেখ করতে হয় তাঁর স্মৃতিকথাগুলি: সহজ কঠিন দ্বন্দ্ব ছন্দে, অতীত দিনের স্মৃতি, শান্তিনিকেতনের স্মৃতি ইত্যাদি। আত্মজীবনী রচনার ক্ষেত্রে তিনি অকপট। নিজে যেমন দেখেছেন, তেমনই বলেছেন। রূঢ় সত্য বলতেও তিনি কুণ্ঠিত হননি। সত্য ভাষণে তিনি অকুণ্ঠ ছিলেন; তাই অপ্রিয়ভাষণও তাঁর স্মৃতিকথায় দুর্লভ নয়। শুধু ব্যক্তিজীবনেই নয়, তাঁর সমগ্র জীবনই চালিত হয়েছে এই সত্যনিষ্ঠায়।
তাঁর বহুবিধ কর্মকাণ্ড— যাকে ‘কর্ম’ না বলে ‘কীর্তি’ বলাই শ্রেয়— তাঁর জীবনের সাধনার যে ব্যাপ্তি, তা নিশ্চয়ই পুরস্কারের মূল্যে পরিমাপযোগ্য নয়। তবু, তিনি সারা জীবনে বহু পুরস্কারে সম্মানিত হয়েছেন, যাঁদের মধ্যে কয়েকটির উল্লেখ করা যাক।
১৯৮৮ সালে পশ্চিমবঙ্গ সরকার তাঁকে ‘রবীন্দ্রস্মৃতি পুরস্কার’ প্রদান করে। একই বছরে ‘টেগোর রিসার্চ ইনস্টিটিউট’ তাঁকে ‘রবীন্দ্রতত্ত্বাচার্য’ উপাধিতে ভূষিত করে। ১৯৯০ সালে তিনি বাংলাদেশের একুশে পদকে সম্মানিত হন। ১৯৯৯ সালে বাংলাদেশের বাংলা অ্যাকাডেমি তাঁকে ‘বাংলা অ্যাকাডেমি সাহিত্য পুরস্কার’ প্রদান করে এবং ২০১০ সালে তাঁকে দেয় অ্যাকাডেমির সম্মানসূচক ফেলোশিপ।
২০০৮ সালে বিশ্বভারতী তাঁকে ‘দেশিকোত্তম’ উপাধিতে সম্মানিত করে। ২০২১ সালে তিনি ভারত সরকারের পক্ষ থেকে ‘পদ্মশ্রী’ উপাধি লাভ করেন।
বিশ্বভারতীর বাংলা বিভাগের ছাত্রী ছিলেন তিনি। শান্তিনিকেতনের প্রতি তাঁর টান ছিল গভীর। আত্মজীবনী পাঠ করলে বোঝা যায়, পুরনো স্মৃতির সঙ্গে পরিবর্তিত শান্তিনিকেতনকে মিলিয়ে নিতে তাঁর শেষ বয়সে কিছুটা অসুবিধে হয়েছিল। তা সত্ত্বেও তিনি প্রকৃত অর্থেই ‘আশ্রমকন্যা’— যাঁর সমস্ত ধ্যানজ্ঞান আবর্তিত হত রবীন্দ্রনাথকে কেন্দ্র করে। তাঁর পরিণত বয়সে জীবনাবসান যেন এক পূর্ণতারই দ্যোতনা বহন করে। তাঁর স্মৃতি ও প্রেরণা আমরা শ্রদ্ধার সঙ্গে বহন করব।
*ছবিগুলি লেখকের ব্যক্তিগত সংগ্রহ থেকে