
মীনা কান্ডাসামি
মীনা কান্ডাসামি একজন নারীবাদী কবি ও লেখক। গত এক দশক ধরে লিখিত তাঁর রাজনৈতিক কবিতার সংকলন Tomorrow Someone Will Arrest You সম্প্রতি প্রকাশিত হয়েছে। সোনি সোরির এই সাক্ষাৎকারটি মীনা নিয়েছিলেন হিন্দিতে, যেটি ইংরেজিতে অনুবাদ করেন দিব্যা কে, এবং সেটি ফ্রন্টলাইন পত্রিকায় প্রকাশিত হয় গত ১৫ মার্চ। বাংলা অনুবাদ আমাদের
সোনি সোরি ভারতের অভ্যন্তরীণ উপনিবেশবাদের রক্তাক্ত প্রান্তে দাঁড়িয়ে আছেন। তাঁর জীবনগাথা ছত্তিশগড়ের খনিজ-সমৃদ্ধ অরণ্যের মালিকানা নিয়ে আদিবাসীদের ও রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থার মধ্যে দীর্ঘকালীন সংঘাতকেই[1] প্রতিফলিত করে। ২০১১ সালে, যখন রাষ্ট্র তাঁকে মাওবাদী আখ্যা দেয়, তখন এটি শুধু একটি মতাদর্শকে অপরাধী হিসেবে চিহ্নিত করার পুরনো খেলাটাই খেলেনি, বরং প্রতিরোধের প্রতিটি রূপকেও দমন করার চেষ্টা করেছে। তাঁর দুই বছরের কারাবাস হয়ে ওঠে এক জীবন্ত প্রমাণ— কীভাবে ভারত তার সবচেয়ে প্রান্তিক জনগোষ্ঠীগুলিকে নিয়ন্ত্রণ করে। কারাগারের অভ্যন্তরে, সেই সময়ের জেলা পুলিশ সুপার অঙ্কিত গর্গ তাঁর উপর যৌন নির্যাতন চালিয়েছিলেন বলে অভিযোগ আছে— পরবর্তীতে এই গর্গ ‘প্রেসিডেন্ট’স পুলিশ মেডেল ফর গ্যালান্ট্রি’ পুরস্কার লাভ করেন।
কিন্তু সোরি নিজেকে একজন শিকার বা নিপীড়িত হিসেবে তুলে ধরতে দৃঢ়ভাবে প্রত্যাখ্যান করেছেন। ২০১৩ সাল থেকে তিনি নিজেকে এমন কিছুতে রূপান্তরিত করেছেন যা রাষ্ট্র সবচেয়ে ভয় পায়— একজন ক্রনিকলার, একজন সাক্ষী— যিনি কথা বলেন। ২০১৬ সালে তাঁর ওপর অ্যাসিড হামলা হয়েছিল, কিন্তু সেটাও তাঁকে আদিবাসীদের উচ্ছেদের এই রাষ্ট্রীয় মেশিনারির নথিবদ্ধকরণ থেকে বিরত করতে পারেনি। সাম্প্রতিক সাক্ষ্যপ্রমাণে তিনি ‘অপারেশন কাগার’[2]-কে আদিবাসীদের জমি ও মর্যাদাহানির লক্ষ্যে চালিত একটি প্রতারণামূলক অপারেশন হিসেবে বর্ণনা করেছেন।
সোনি তীব্রভাবে কথা বলেন, আকুতি নিয়ে কথা বলেন— উন্নয়নের কুৎসিত ঢক্কানিনাদ আর ধ্বংসযজ্ঞের অশুভ আঁতাতের মুখোশ খুলে দেন। রাষ্ট্র যেখানে রাস্তা দেখতে পায়, তিনি সেখানে দেখেন শোষণের শিরা-উপশিরা, যা জীবিকা, খনিজ, সম্পদ ও আদিবাসী রক্ত শুষে নিচ্ছে।[3] সরকারি কর্মকর্তারা যখন নিরাপত্তা শিবির ও বাহিনীর সংখ্যা বৃদ্ধির উল্লাস করেন, তিনি তখন অত্যাচার, উচ্ছেদ ও ধর্ষণের ভয়াবহতা চিত্রিত করেন। যখন কর্পোরেট মিডিয়া মিথ্যা উন্নয়নের গল্প প্রচার করে, তখন তিনি দেশের মূলবাসী জনগণকে প্রদত্ত সাংবিধানিক প্রতিশ্রুতিগুলির পরিকল্পিত ধ্বংসের নথি তৈরি করেন। এই সাক্ষাৎকারে সোরি বলেন, যখন কোনও ভূমি সম্পদে সমৃদ্ধ হয় এবং জনগণ নিজেদের অস্তিত্ব মুছে ফেলতে অস্বীকার করে, তখন গণতন্ত্র সামরিক দখলদারিত্বে রূপ নেয়। তাঁর সঙ্গে কথাবার্তার সারাংশ নিচে দেওয়া হল।
মীনা কান্ডাসামি: আমার প্রথম প্রশ্ন হল ক্রমবর্ধমান কর্মী-গ্রেপ্তার সম্পর্কে… মূলবাসী বাঁচাও মঞ্চ (MBM)-এর সাবেক প্রধান রঘু মিডিয়ামি গ্রেপ্তার হয়েছেন। গত বছর, কর্মী নেত্রী সুনীতা পোট্টাম গ্রেপ্তার হন। ২০২৪ সালের নভেম্বর মাসে ছত্তিশগড় সরকার MBM নিষিদ্ধ করে। আপনি এই দমন-পীড়ন সম্পর্কে কী ভাবছেন?
সোনি সোরি: প্রতিদিন পাঁচ থেকে দশজন আদিবাসী গ্রেপ্তার হয়; ভুয়ো এনকাউন্টার সংঘটিত হয়। এর মূল লক্ষ্য হল আদিবাসীদের জীবন শেষ করে দেওয়া। যে-ই বস্তার অঞ্চলে প্রতিরোধ করে, সে MBM-ই হোক, সোনি সোরিই হোক বা হিদমে মারকম— তাকে নকশাল আখ্যা দিয়ে নির্মূল করা হয়। একই ঘটনা সুনীতার ক্ষেত্রেও ঘটেছে।
সুনীতার জন্মস্থান বিজাপুর জেলার গঙ্গালুর (তাঁর বাড়ি পোসনার-এ), যেখানকার ভর্তি পাহাড়্গুলো সব খনি প্রকল্পের জন্য নির্ধারিত হয়ে রয়েছে। কেন্দ্রীয় ও রাজ্য সরকার যদি খনন কার্যক্রম চালাতে চায়, তারা কাকে নিশানা করবে? অবশ্যই সেখানে বসবাসরত আদিবাসীদের। জমি দখল করতে হলে, প্রথমে আদিবাসীদের নির্মূল করতে হবে। আর আদিবাসীদের নির্মূল করতে হলে, তাদের নেতাদের নিষিদ্ধ করতে হবে, গ্রেপ্তার করতে হবে। এটি একটি সুপরিকল্পিত রাষ্ট্রীয় কৌশল— আদিবাসীদের বনাঞ্চল থেকে উচ্ছেদ করা এবং খনিজ-সমৃদ্ধ পাহাড়গুলোকে বড় পুঁজিপতিদের হাতে তুলে দেওয়া। ‘নকশাল’ একটি তকমা মাত্র। প্রকৃত লড়াইটা বনাঞ্চলে বসবাসকারী আদিবাসীদের বিরুদ্ধে।

অমিত শাহ প্রকাশ্যে ঘোষণা করেছেন, ২০২৬ সালের ৩১ মার্চের মধ্যে অপারেশন কাগার মাওবাদী/নকশালবাদ নির্মূল করবে। এর আগের অভিযানটার নাম ছিল সমাধান-প্রহার; তার আগেও আরও নানা নাম এসেছে। জনসমক্ষে এই ধরনের সময়সীমা নির্ধারণের কারণ কী?
যা এখন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলছেন, তা নতুন কিছু নয়। এই কথাগুলো আগেও বলা হয়েছে। শুধু এবার তিনি এটি আরও সক্রিয়ভাবে প্রচার করছেন— এক রাজ্য থেকে আরেক রাজ্যে, আন্তর্জাতিক মঞ্চে, সর্বত্র।
এর আগে সালওয়া জুদুম ছিল। তারা সবচেয়ে বেশি নৃশংসতা কাদের ওপর দেখিয়েছিল? আদিবাসীদের ওপর। এরপর ছিল বাস্তার ব্যাটালিয়ন, দান্তেশ্বরী ফাইটার্স, কোবরা ব্যাটালিয়ন এবং অন্যান্য বিশেষ বাহিনী। পুলিশ ক্যাম্প স্থাপন করা হল, নানারকমের সেনাবাহিনী আনা হল— সবই আদিবাসীদের নির্মূল করার জন্য।
ভুয়ো এনকাউন্টারগুলো যেখানে হয়, আমাদের সেখানে যেতেও দেওয়া হয় না, প্রশ্ন করতেও দেওয়া হয় না। যখন আমরা গণমাধ্যমের সঙ্গে কথা বলে আমাদের কথা শোনাতে চাই, আমাদের কণ্ঠরোধ করা হয়। রাষ্ট্র পুরো বিশ্বের কাছে নিজের বক্তব্য রাখে, কিন্তু বস্তার অঞ্চলের সাধারণ মানুষ এবং সমাজকর্মীদের কণ্ঠস্বর চেপে রাখা হয়।
অমিত শাহ বলছেন, ২০২৬ সালের মধ্যে মাওবাদীদের নির্মূল করা হবে। এর পেছনের প্রকৃত কৌশলটা কী? যদি কাউকে মাওবাদী হিসেবে হত্যা হয়, তবে দাবি করা হয় যে তার মাথার দাম দুই লাখ, তিন লাখ, চার লাখ টাকা ছিল। আসলে, আদিবাসী কৃষকদেরই এইভাবে হত্যা করা হচ্ছে, কিন্তু তাদের মাওবাদী বলে তকমা দেওয়া হচ্ছে। এমনকি ৬০ লাখ বা ১.৫ কোটি টাকা মাথার দাম থাকার গল্পও শোনা গেছে। হত্যা করো, পুরস্কার নাও।
কিন্তু আইন অনুযায়ী কী হওয়া উচিত? প্রথমত, একজন নিহত ব্যক্তির ময়নাতদন্ত করা উচিত। নিহত ব্যক্তি যে গ্রাম পঞ্চায়েতের অন্তর্ভুক্ত, তাদের জানানো উচিত। পরিবারের সদস্যদের খবর দেওয়া উচিত। গ্রামবাসীদের মধ্যে, বিশেষ করে যারা লেখাপড়া জানে, তাদের জানানো উচিত।
কিন্তু সরকার এসব কিছুই করে না। কোনও ময়নাতদন্ত করে না। খবরের কাগজে কোনও তথ্য প্রকাশ করে না। একজন মানুষকে মারার পর তার নামে পুরস্কারের অর্থ ঘোষণা করা হয়। এ কারণেই এখানে প্রতিদিন এত রক্তপাত ঘটে। একজনকে হত্যা করো এবং অর্থ নাও। আত্মসমর্পণ করো এবং অর্থ নাও।
কেন্দ্র এবং রাজ্য সরকারের কাছে আমার প্রশ্ন হল— এই অর্থ কোথা থেকে আসে? এই টাকার কি কোনও হিসাব আছে?
এত সামরিকীকরণের মধ্যেও গুলিবর্ষণ কিন্তু বন্ধ হয়নি। যদি সত্যিই অমিত শাহ এবং কেন্দ্র সরকার মাওবাদীদের বিরুদ্ধে লড়াই করতে চায়, তাহলে নিরীহ আদিবাসীদের হত্যা না করে, জঙ্গল পাহাড় ধ্বংস না করে, পরিবেশের কোনও ক্ষতি না করে তারা তা করুক। এখন পাহাড় জ্বলছে, নদীগুলো ধ্বংস হচ্ছে, আদিবাসী শিশুদের হত্যা করা হচ্ছে। তারা বলছে, মাওবাদীদের নির্মূল করছে, কিন্তু বাস্তবে নির্মূল করা হচ্ছে আদিবাসীদের— মাওবাদীদের নয়।
এই পুরস্কারের অর্থ কি জনগণের অর্থ নয়? এর হিসাব কোথায়? কে এই অর্থ বরাদ্দ করে? কে এর নিরীক্ষা করে? কোথায় এটি করা হয়? আমি প্রস্তুত এই তথ্য বের করার জন্য। কিন্তু যদি আমি এই প্রশ্নগুলোর উত্তর খোঁজার জন্য কোনও আবেদন করি, তাহলে আমাকে নকশাল আখ্যা দিয়ে হত্যা করা হবে বা জেলে পাঠানো হবে। কিন্তু আমরা মরতে বা জেলে যেতে ভয় পাই না। কারণ আমাদের লড়াই আমাদের বনভূমির জন্য, মানবতার জন্য।

আমি পড়েছি যে একটি ২,৫০০ জনের ব্যাটালিয়ন বস্তারে আনা হচ্ছে সেখানে শিবির খোলার জন্য। আকাশ থেকে নজরদারির উদ্দেশ্যে আন্ডার ব্যারেল গ্রেনেড লঞ্চার, আনম্যানড এরিয়াল ভেহিকল এবং ড্রোনের মতো নতুন অস্ত্র ব্যবহৃত হচ্ছে। এই সমস্ত কার্যকলাপ কীভাবে গ্রামের মানুষদের জীবনকে ব্যাহত করে?
গ্রামবাসীরা ঘুমোতে পারছেন না। সেনাশিবির স্থাপনের পর, সেনাকর্মীরা গ্রামগুলিতে হামলা চালাচ্ছেন। আদিবাসী চাষিরা মাঠে যেতে পারছেন না, জল আনতে, জ্বালানি কাঠ বা তেঁতুলপাতা সংগ্রহ করতে পারছেন না। বিজাপুরে এই মুহূর্তে এটাই বাস্তব অবস্থা।
আমি সেদিন রাতটা কাটাচ্ছিলাম সিলগরের ওপারে এক গ্রামে। রাত একটার দিকে বোমার আওয়াজে ঘুম ভেঙে গেল। আমার সঙ্গে ছিলেন এক গর্ভবতী নারী, তিনি বললেন, এই ধরনের বিস্ফোরণ তো এখানে প্রতিদিনের ঘটনা— এমনকি তাঁর গর্ভস্থ সন্তানও এই আওয়াজে কেঁপে ওঠে। তিনি আমাকে তাঁর পেটের ওপর হাত রাখতে বললেন, তাহলে আমি টের পাব সন্তানটি কীভাবে ছটফট করছে। পরিবেশ ও জমির ওপর সেই বোমাবর্ষণের প্রভাবের ছবি ও ভিডিও আছে আমার কাছে। শুধু মানুষ নয়, এইভাবে পরিবেশকেও হত্যা করা হচ্ছে। তাই এই বিষয়টা শুধুমাত্র আমাদের নয়, গোটা দেশেরই গুরুত্ব দিয়ে দেখা উচিত।
এই এলাকায় আধাসেনার এমন ছড়াছড়ি কেন? এত সংখ্যক বাহিনীর আদৌ কি প্রয়োজন আছে? সরকার কেন আলোচনায় বসছে না? মাওবাদীদের সঙ্গে কথা বলার আগে কেন বাস্তারের মানুষদের সঙ্গে কথা বলা হচ্ছে না? সরকার এই আলোচনা কিছুতেই স্বচ্ছতার সঙ্গে করতে চায় না— সেটাই আসল সমস্যা।
যেদিন রাষ্ট্র এই টাকার বন্টন বন্ধ করবে, সেদিনই আদিবাসীদের ওপর চলা এই নির্যাতনও থেমে যাবে। আপনি বিশ্বাস করবেন না— মানুষের লাশ পড়ে আছে চারদিকে: আইতু, যার মাথার দাম ৪ লক্ষ টাকা; হিদমা, ৩ লক্ষ টাকা; যোগা, ২ লক্ষ টাকা। এদের মেরে ফেলার পর আধাসেনারা নাচে— ডিজে আনে, সাউন্ডবক্স বাজায়, উৎসব করে। কেন? কারণ এটা টাকার খেলা।

এটা অত্যন্ত ভয়াবহ। ভারতে সাধারণভাবে মনে করা হয়, সেনা দেশরক্ষার কাজ করে। অথচ এখানে সেনারাই আমাদের দেশের মানুষদের হত্যা করছে আর তা উদযাপন করছে। কিন্তু এই খবর বস্তারের বাইরের মানুষ জানতেই পারছেন না। আর শুধু হত্যা নয়— নারী ও শিশুরাও তো হামলার শিকার হচ্ছেন, তাই না?
শিশুরাও গুলির শিকার হচ্ছে। ইন্দ্রাবতী নদীর এলাকার চারটি শিশু গুলিবিদ্ধ হয়েছে— আমাদের কাছে তার প্রমাণ আছে।
একটি শিশুর বয়স ছিল আনুমানিক এক বছর— মায়ের বুকের দুধ খাচ্ছিল সে তখনও। আধাসামরিক বাহিনী যখন গ্রামে পৌঁছয়, তখন শিশুটির বাবা তাকে নিয়ে জঙ্গলের দিকে পালিয়ে যান। তাঁর আশঙ্কা ছিল, যদি শিশুটা কেঁদে ওঠে, তাহলে তিনি ধরা পড়ে যাবেন। তিনি শিশুকে নিয়ে লুকিয়ে পড়েন। কিন্তু তবুও তাঁকে ধরে হত্যা করা হয়। শিশুটিকে নিয়ে সৈন্যরা অন্য এক গ্রামে নিয়ে গিয়ে সেখানকার মানুষের হাতে তুলে দেয়। তারপর আমি একটি ফোন পাই— একটি শিশু ছটফট করছে, তার মাকে খুঁজছে, কারণ তার বুকের দুধ চাই।
যখন আমরা সেই শিশুদের সঙ্গে দেখা করি, যারা আধাসামরিক বাহিনীর অভিযানের সময় আহত হয়েছিল, তখন দেখেছি— ওদের ক্ষতবিক্ষত ঘায়ে পোকা ধরে গেছে। আধাসামরিক বাহিনী যখন ‘এনকাউন্টার’ করে, তখন মৃতদেহটি ক্যাম্পে নিয়ে আসে, যাতে পুরস্কারের টাকা তোলা যায়। কিন্তু যদি গুলি শিশুদের গায়ে লাগে, তাহলে তাদের ক্যাম্পে আনা হয় না— কারণ ওদের শরীরে গুলি লাগলে কোনও টাকা মেলে না।
তাহলে প্রশ্ন হল— নারী, শিশু বা বৃদ্ধদের গায়ে ‘ভুল করে’ গুলি লাগলেও, কেন তার কোনও তদন্ত হয় না? কেন কোনও প্রশ্ন তোলা হয় না?
ওরা শিশুদের মরতে ফেলে রেখে যায়, আর এই সব খবর চুপচাপ চাপা পড়ে যায়। যখন ওদের মুখোমুখি প্রশ্ন করা হয়, তখন বলে— শিশুরা ‘ক্রসফায়ারে’ মারা গেছে। কিন্তু আপনিও তো একজন অভিভাবক, আপনারও সন্তান আছে— তাদের জীবন যদি আপনার কাছে মূল্যবান হয়, তবে এদের জীবন কেন নয়?
সমস্যা হল— এই শিশুরা আদিবাসী। তাই ওদের মৃত্যু যেন কারও গায়ে লাগে না। ওদের জীবন যেন মূল্যহীন।
আইন অনুযায়ী স্পষ্ট নিয়ম রয়েছে— যদি কোনও পুলিশ সদস্য কোনও মহিলার বাড়িতে প্রবেশ করে, তবে তাঁকে স্পর্শ করার ক্ষেত্রেও নির্দিষ্ট প্রোটোকল মেনে চলতে হয়। কিন্তু এখানে সে-সব নিয়ম মানা হয় না।
সকাল সকাল আধাসামরিক বাহিনী গ্রামের ঘরে ঘরে ঢুকে পড়ে, যখন মহিলারা ধান ঝাড়ছেন, কাপড় কাচছেন কিংবা ঘরের কাজে ব্যস্ত আছেন। ওরা মহিলাদের জামাকাপড় ছিঁড়ে দেয়, শাড়ি খুলে ফেলে, নিগ্রহ করে, ধর্ষণের চেষ্টা করে। এমন অজস্র ঘটনা ঘটেছে।
সুধার ঘটনাটা দেখুন— তাঁকে আধাসামরিক বাহিনী তাঁর নিজের ঘর থেকে তুলে নিয়ে যায়। গ্রামের অন্য মহিলারা কাঁদতে কাঁদতে তাঁদের অনুরোধ করেন— যদি অপরাধ করে থাকে তবে মামলা করুন, কিন্তু দয়া করে ওঁকে নিয়ে যাবেন না। কিন্তু তারা কিছুই শোনেনি।
তাঁকে বাড়ির খুব কাছের জঙ্গলে টেনে নিয়ে গিয়ে, যতক্ষণ না তাঁর মৃত্যু হচ্ছে বারংবার ধর্ষণ করে যাওয়া হয়। একটা গুলিও ছোঁড়া হয়নি। যখন তাঁর নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে এল, তখন বলা হল— একজন নকশালকে এনকাউন্টার করা হয়েছে।
ওঁর দেহটি দান্তেওয়াড়ার হাসপাতালে আনা হয়। আমাকে বলা হল, তাঁকে গুলি করে মারা হয়েছে। আমি কর্তব্যরত চিকিৎসককে বললাম, দেহটা দেখতে চাই। দেখলাম, দেহের কোথাও একটাও গুলির চিহ্ন নেই।
আমি জিজ্ঞেস করলাম, “আপনারা যদি বলছেন এটা এনকাউন্টার, তাহলে কোনও গুলির চিহ্ন নেই কেন?”
বস্তারের মহিলারা আমাকে বলেন— “সোনি দিদি, আমরা মরার ভয় করি না। আমাদের ওপর গুলি চালাও, আমরা প্রস্তুত। কিন্তু আমাদের ধর্ষণ কোরো না। আমরা মরতে রাজি আছি, কিন্তু ধর্ষণের যন্ত্রণা সহ্য করতে রাজি নই। কারণ এখানে ধর্ষণই সবচেয়ে ভয়ঙ্কর জিনিস।”
নারীদের জীবন্ত অবস্থায় নির্যাতন করা হয়, নিগ্রহ করা হয়, আঁচড়ানো হয়, ধর্ষণ করা হয়— তারপর গুলি করে হত্যা করা হয়। আমি কত নারীর ফুলে-ওঠা ও ক্ষতবিক্ষত গোপনাঙ্গ দেখেছি! কত নারীর জখম ও ফুলে-ওঠা উরু দেখেছি!
এই ঘটনা প্রতিদিন ঘটে বস্তারে। কিন্তু এসব কথা কেউ মুখ খুলে বললে, তাঁকে মাওবাদী বলে দেগে দেওয়া হয়। মানুষকে নির্মমভাবে পেটানো হয়, তাঁদের অঙ্গচ্ছেদ করা হয়। এক নারী আমাকে বলেছিলেন, জীবন্ত অবস্থায় তাঁর স্বামী, ছেলে, ভাই— তাঁদের গোপনাঙ্গ কেটে ফেলা হয়েছিল। এখানে নারী, শিশু, ভাই, পিতা, জঙ্গল, পশু, পাখি— কিছুই নিরাপদ নয়।
ওরা গুলি চালায়, নারীদের ধর্ষণ করে— কারণ যাতে মানুষ এই এলাকা ছেড়ে পালিয়ে যায়। সালওয়া জুডুমের সময় লক্ষ লক্ষ মানুষ চলে গিয়েছিল ওয়ারাঙ্গলে। আজ যা হচ্ছে, সেটাও সেই একই উদ্দেশ্য নিয়ে— এই ভূমি খালি করে দেওয়ার জন্য। আর এই জমি খালি হলেই, তা তুলে দেওয়া হবে ওদের পছন্দের বড় পুঁজিপতিদের হাতে।
আমি যখন দুই বছর আগে বস্তারে এসেছিলাম, তখন দেখেছি— মানুষ পানীয় জল পায় না, বিদ্যুৎ নেই। স্কুল আর হাসপাতাল তো বহু দূরের ব্যাপার। কিন্তু আশ্চর্যের কথা, সেখানে তৈরি হচ্ছে বিশাল রাস্তা— আট লেনের হাইওয়ের মতো দেখতে। আধাসামরিক বাহিনী নিজেদের অনলাইন প্রচারে বলছে, তারা যে শিবির তৈরি করছে, সেগুলো আসলে ‘ইন্টিগ্রেটেড ডেভেলপমেন্ট সেন্টার’— যেখানে থাকবে ব্যাঙ্ক, রেশন দোকান (PDS), আঙ্গনওয়াড়ি কেন্দ্র, স্কুল আর হাসপাতাল। অথচ, এই সমস্ত সেবা দেওয়ার দায়িত্ব তো সরকারের। তাহলে আধাসামরিক বাহিনী এগুলো করছে কেন? আপনি কীভাবে দেখেন এই ঘটনাকে? এই শিবিরগুলি তৈরির প্রকৃত উদ্দেশ্য কী?
যেখানে গ্রামসভা আছে, যেখানে একজন সরপঞ্চ ও একজন সচিব আছেন— আইন অনুসারে তাঁরাই সর্বোচ্চ ক্ষমতাধিকারী— সেখানে আধাসামরিক বাহিনী রাস্তা তৈরি করছে কেন? আমাদের এমন রাস্তা দিন, যা দিয়ে আমাদের সন্তানরা স্কুলে যেতে পারবে আর ফিরতে পারবে; আমরা বাজারে যেতে পারব আর ফিরতে পারব। কিন্তু এই বড় বড় রাস্তা তো জঙ্গলে বসবাসকারী আদিবাসীদের জন্য বানানো হচ্ছে না। এই রাস্তাগুলো তৈরি হচ্ছে খনিজসম্পদে সমৃদ্ধ পাহাড়গুলোর সঙ্গে যোগাযোগ গড়ার জন্য। পাহাড় থেকে খনিজ উত্তোলন করার পর, সেগুলিকে এই বড় রাস্তার মাধ্যমে বাইরে নিয়ে যাওয়া হবে।
কেন্দ্রীয় সরকার বা অমিত শাহ কি লিখিতভাবে দিতে পারেন যে আদিবাসীদের এক টুকরো জমিও কাড়া হবে না? কোনও খনন চলবে না? জমিকে ছিবড়ে করা হবে না? পরিবেশ ধ্বংস করা হবে না? আমি চ্যালেঞ্জ নিতে প্রস্তুত, বস্তারের সমস্ত আদিবাসীদের একত্রিত করব, এমনকি মাওবাদীদের সঙ্গেও কথা বলব। কিন্তু তার আগে সরকার যেন আমাদের সঙ্গে কথা বলে— এই নিশ্চয়তা দিয়ে যে আদিবাসীদের এক ইঞ্চি জমিও কেড়ে নেওয়া হবে না।
সব অত্যাচারই ঘটানো হচ্ছে ‘উন্নয়ন’-এর নামে। আপনি এই তথাকথিত ‘উন্নয়ন-আলোচনার’ (development discourse) বিষয়টিকে কীভাবে দেখেন?
আমরা কোম্পানির বিরোধিতা করি। যেমন ধরুন, NMDC (ন্যাশনাল মিনারেল ডেভেলপমেন্ট কর্পোরেশন)— এটি একটি সরকার অধিগৃহীত সংস্থা— গত ৭৫ বছরেরও বেশি সময় ধরে এই এলাকায় খনন চালিয়ে আসছে। আমরা ভেবেছিলাম এতে আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মের ভালো হবে; আমাদের লোকেরা চাকরি পাবে, হাসপাতাল-স্কুল হবে; সকলের ভবিষ্যৎ সুরক্ষিত হবে। আজকে পাহাড়গুলো ফোঁপড়া হয়ে গেছে, কিন্তু যাঁরা সেই পাহাড়ের নীচে বাস করেন, তাঁদের লাল, বিষাক্ত জল খেতে হচ্ছে— যেটা বেরিয়ে আসছে লোহার খনির কারণে। শিশুরা মারা যাচ্ছে, কৃষিজমি ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে। মানুষ আজ কোনওরকমে বন থেকে আনা টুকিটাকি জিনিস বিক্রি করে বেঁচে আছে। খনিশিল্প যদি এমনটাই করে, তাহলে মানুষ তার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করবে না কেন, বলুন?
পিদিয়াতে কোনও স্কুল নেই। ওরা বলবে মাওবাদীরা স্কুল বানাতে দিচ্ছে না। কোনও হাসপাতাল নেই। ওরা বলবে মাওবাদীরা হাসপাতাল বানাতে দিচ্ছে না। লোকেদের জমির শংসাপত্র নেই। ওরা এটাও বলবে মাওবাদীরা সেই শংসাপত্র দিতে দিচ্ছে না। অঙ্গনওয়াড়ি নেই। সেটাও মাওবাদীরা করতে দিচ্ছে না। কোনও রাস্তায়, গ্রামে বিদ্যুৎ নেই। ওরা আবারও বলবে, মাওবাদীরা বিদ্যুতের খুঁটি বসাতে দিচ্ছে না।
গ্রামের সমস্ত রাস্তা বাঁধাতে হবে। বিদ্যুতের সংযোগ থাকবে, হাসপাতাল থাকবে, পানীয় জল সরবরাহের ব্যবস্থা থাকবে, থাকবে শিশুদের জন্য সবরকম সুযোগসুবিধা। উন্নয়নের এই হল সূচনাবিন্দু। এগুলি সব হওয়ার পরেই কেবলমাত্র বড় সড়কের কথা আসতে পারে। অথচ ওরা কেবল বড় সড়কের কথাই বলে।
যখন মুকেশ চন্দ্রকারের মতো সাংবাদিক রাস্তার ইস্যু তুলেছিলেন, তখন তাঁকে খুন করা হল।[4] তাঁকে কি আপনি উন্নয়নের বিরোধী বলবেন? যারা সত্যি কথা বলে, তাদের চুপ করিয়ে দেওয়া হয়। মুকেশ কেবলমাত্র সত্যিটা সামনে এনেছিলেন।
আমরাও উন্নয়ন চাই, কিন্তু ওরা যে ধরনের উন্নয়নের কথা বলে, সে উন্নয়ন আমরা চাই না। আগে আমাদের মৌলিক অধিকারগুলো দেওয়া হোক। তারপর ওরা উন্নয়ন করুক। কিন্তু তার বদলে ওরা শুধু বড় বড় কোম্পানিগুলোর সেবা করতেই ব্যস্ত।
[1] Ravi, Pragathi. How are Chhattisgarh’s Adivasis fighting back miners in central India’s densest forest? Frontline. Jun 26, 2022.
[2] ২০২৬ সালের মার্চের মধ্যে মাওবাদীদের নির্মূল করার একটি সামরিক পরিকল্পনা।
[3] Derhgawen, Shubhangi and Mohan, Deepanshu. Hasdeo Arand and the manufacturing of tribal consent. Frontline. Jan 23, 2025.
[4] Sharma, Ashutosh. Mukesh Chandrakar’s chilling murder and the unthinkable cost of being a journalist in Bastar. Frontline. Jan 8, 2025.
ওখানকার আদিবাসীদের উৎখাত না করতে পারলে জমি এবং জমির সম্পদ কর্পোরেটদের হাতে দেওয়া যাবেনা। আমরা দেখেও দেখছিনা – ধৃতরাষ্ট্রর মতো।
ভালো লেখা।
এই মৃত্যু মিছিল কীভাবে বন্ধ হবে?