সিলভিয়া প্লাথের কবিতায় চিত্রকল্প

শৌনক দত্ত

 

যে-জগতে বসে আমি কবিতা লিখছি, সেই কবিতার জগতে আছেন এক কবি, যাঁর কবিতার সঙ্গে আমার পরিচয় ঘটেছে বিস্ময়কর চিত্রকল্পের মাধ্যমে। সাহিত্য তাঁর কাছে শুধু জীবনের নয়— মৃত্যুরও এক উদযাপন। তিনি উদযাপন করেন জীবনের সমস্ত দুঃখ, কষ্ট, ঘৃণা আর না-পাওয়ার হতাশাকেও। সেই কবি বহু আগে ছেড়েছেন পৃথিবীকে। তবে তা কোনও প্রাকৃতিক মৃত্যু নয়— স্বেচ্ছামৃত্যু। যে উৎস থেকে জীবনের উদ্ভব— অগ্নি, সেই শুদ্ধ আগুনের ভিতরে নিজেকে নিঃশেষে সমর্পণ করে দিয়েছেন তিনি।

চিরদুঃখী সেই কবি জীবনের কোথাও খুঁজে পাননি শান্তি বা সুখ। কেউ কেউ বলেন, তিনি ছিলেন দুর্বল মনের মানুষ। কিন্তু তাঁর হৃদয়ের আঘাত উপেক্ষা করার মতো নয় কখনওই। উপেক্ষা করার মতো নয় তাঁর স্বেচ্ছামৃত্যু, এবং সেই করুণ সমাপ্তির পেছনের নিঠুর গল্প।

সেই কবির নাম সিলভিয়া প্লাথ। অপূর্ব রূপসী এই ইংরেজি কবি জীবনের চেয়ে বেশি শান্তি খুঁজে পেয়েছিলেন মৃত্যুর ভিতরে। জীবনের চেয়ে বেশি স্বীকৃতিও দিয়েছিল তাঁকে মৃত্যু— তাই তো তিনিই প্রথম সাহিত্যে মরণোত্তর পুলিৎজার পুরস্কারপ্রাপ্ত কবি।

প্লাথের ঘনিষ্ঠ বন্ধু আলভারেজ লিখেছিলেন,

প্লাথের জীবন আরও জটিল এই কারণে, যে পরিণতমনস্ক হয়েও যখন তিনি লিখছেন, তখন তিনি সচেতনভাবে নিজের সৃষ্টির মধ্যে নিয়ে আসছেন রোজকার জীবনযাপনের নিত্যব্যবহার্য সব খুঁটিনাটি। যেমন— হঠাৎ করে আসা অতিথি, আচমকা টেলিফোন, অপ্রত্যাশিত শারীরিক আঘাত, কাটাছেঁড়া, কালশিটে, কিংবা হয়তো একটা রান্নাঘরের সানকি বা মোমদানি। সব কিছুই কেমন অনায়াসে জায়গা করে নিয়েছে তাঁর লেখায়— অর্থবহ হয়ে, রূপান্তরিত অস্তিত্ব নিয়ে। তাঁর কবিতায় ব্যবহৃত হয়েছে এমন সব প্রসঙ্গ ও চিত্রকল্প, যা সেই মুহূর্তে হৃদয়ঙ্গম না-ও হতে পারে; কিন্তু যে কোনও বুদ্ধিমান পাঠক— যিনি সিলভিয়ার অস্থির জীবনযাপনের খোঁজ রাখেন— তিনি কবিতার শেষে, যেন পাদটীকায়, এই কবিতার অন্তর্নিহিত বিষয় নিয়ে চমৎকার ব্যাখ্যা দিতে সক্ষম হবেন।

সিলভিয়া শুধু জীবনাচরণে নন, তাঁর লেখার মেজাজেও এক অন্ধকার জগতের বাস। তবে সে অন্ধকার এডগার অ্যালান পোর রহস্য-রোমাঞ্চঘন ছায়াজগৎ নয়; বরং সেখানে আছে বেদনা ও বিদ্রোহের গোপন সুর। তাঁর কবিতার স্বরে শোনা যায় নারীর যন্ত্রণা, বেদনা এবং মুক্তির আকাঙ্ক্ষা। তবু সিলভিয়া বিশ্বকবিতায় এমন এক শক্তিশালী কণ্ঠস্বর, যার শক্তির উৎস নারীর অহং, গর্ব, গর্ভ ও গহন বেদনা। নিজের নারী ও কবিসত্তা সম্পর্কে তিনি ছিলেন গভীরভাবে সচেতন। কবিতা লেখা ও প্রকাশের পাশাপাশি, কবিতায় জীবনযাপন এবং কবিতার মাধ্যমে খ্যাতি-বিত্তের আকাঙ্ক্ষাও ছিল তাঁর।

তাঁর কবিতায় বরাবরই থেকে গেছে এক তীব্র ঝাঁঝ— বিচ্ছিন্নতা, আত্মবিধ্বংসী মনোভাব ও আত্মহননের ধ্বনি। তীক্ষ্ণ অন্তর্দৃষ্টি, বিষাদ এবং বুদ্ধিদীপ্ত কৌতুক মিলেমিশে তৈরি করেছে তাঁর কবিতার অনন্য গহন রূপ।

চিত্রকল্পই হচ্ছে কবিতার প্রাণ। এই চিত্রকল্প কবির চেতনা থেকে উৎসারিত, তাই প্রকৃতি বা নগরচেতনা, আধুনিক বা পরাবাস্তব কবিতা কিংবা নিখাদ পল্লী-জীবনালেখ্য— সবক্ষেত্রেই চিত্রকল্পের রূপ হয়ে ওঠে স্বতন্ত্র। অবশ্য কিছু প্রচল উপকরণ প্রায় সব ধরনের কবিতায়ই দেখা যায়— যেমন নদী, সাগর, বন, বৃক্ষ, পাখি, চাঁদ, সূর্য, নক্ষত্র, ফুল ও ফল। এই উপকরণ কবি যে-কোনও বাস্তবতা বা ভাবনার প্রেক্ষাপট থেকে গ্রহণ করতে পারেন, এজন্য তাঁকে নির্দিষ্ট কোনও ছাঁচে ফেলা চলে না।

সিলভিয়া প্লাথের কথা উঠলেই বিদগ্ধ পাঠক একবাক্যে বলবেন— তাঁর কবিতার চরণে চরণে ডিলান টমাস, ইয়েটস এবং মারিয়ান মুরের প্রভাব লক্ষণীয়। তাঁর লেখায় চিত্রকল্পের এক বিস্ময়কর বৈচিত্র্য: চাঁদ, রক্ত, হাসপাতালের গন্ধ, ভ্রূণ, করোটি। চিত্রকল্পগুলো অনুভব করতে হলে প্রয়োজন এক “প্লাথ-সুলভ” অন্তর্দৃষ্টি। তাঁর কবিতায় একদিকে আছে পরাবাস্তব নিসর্গচিত্র, অন্যদিকে বন্দিত্বের অব্যক্ত যন্ত্রণা আর মৃত্যুর নিঃশব্দ পদসঞ্চার।

প্লাথের জীবনের অভিজ্ঞতা ও গভীর ব্যক্তিগত সংগ্রামের প্রতিফলন হিসেবে মৃত্যু তার লেখায় এক প্রবল প্রতীক হয়ে ওঠে। তাঁর বহু কবিতায় আত্মহননের ইঙ্গিত এবং মৃত্যুচিন্তা প্রকাশ পেয়েছে— বিশেষ করে “Lady Lazarus” ও “Daddy” কবিতায়।

কবিতার স্বতন্ত্র বিভা থাকে— ঔজ্জ্বল্য ও লাবণ্যে তা অনন্য। শব্দগঠন, প্রয়োগ এবং বাক্যবিন্যাসে স্বতন্ত্র। অনন্য এক সৃষ্টির শরীর।

সিলভিয়া প্লাথের The Colossus কবিতার নামের দিকেই তাকালে বিষয়টি স্পষ্ট হয়ে ওঠে। ‘Colossus’ শব্দটির ব্যবহার মিথ ভেঙে যেন কবির ব্যক্তিগত জীবনকেই অভিব্যক্ত করেছে। শব্দটির মধ্যে রয়েছে পুরাতাত্ত্বিক অনুষঙ্গ, কবির ব্যক্তিগত জীবন, বাবার বিশালতা ঘিরে বিস্ময়— আর তার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে মূর্তি ধ্বংসের প্রতীকী ব্যঞ্জনায় বাবার মৃত্যুদ্যোতনা। এই ভাঙা মূর্তিই হয়ে উঠেছে কবির বাবার মৃতদেহের এক প্রতীক। ‘Colossus’-এর এই বিশাল মূর্তি ও তার ধ্বংসাবশেষ স্মরণ করিয়ে দেয়, কীভাবে শৈশবে কবি তাঁর পিতাকে এক বিশাল, দুর্বোধ্য রূপে অনুভব করতেন। কবিতার চিত্রকল্পগুলি তাই কালচেতনায় উদ্ভাসিত। এই কারণেই সিলভিয়া প্লাথ হয়ে উঠেছেন সমকালের কবি হলেও মহাকালের বাণীবাহক।

তবে এই কবিতার কবি এমন এক কণ্ঠস্বর— যিনি ব্যক্তিস্বাধীনতা ও স্বতন্ত্র রুচির পথে যেন বাধা হয়ে দাঁড়ান। এমন এক মনোভাব, যা আধুনিক, আত্মসচেতন পাঠকের দীক্ষিত রুচির সঙ্গে মিল খায় না সহজে। তবে অন্যভাবে ভাবলে এই বৈপরীত্য নিজেই হয়ে ওঠে অন্যরকম এক তাৎপর্যের বাহক।

সিলভিয়া প্লাথের Lorelei কবিতার দিকে তাকালে আমরা দেখি, কবিতাজুড়ে ছড়িয়ে আছে মৎস্যকন্যা বা সাগরগন্ধর্বিণীর চিত্রকল্প। গ্রিক পুরাণ অনুযায়ী, এই রহস্যময় জলপরীরা সমুদ্রের মাঝে মোহময় গান গেয়ে নাবিকদের দিকভ্রান্ত করে এবং তাদের ডেকে নিয়ে যায় সমুদ্রতীরবর্তী কোনও পাহাড়ের গায়ে, যেখানে মৃত্যু তাদের অবশ্যম্ভাবী পরিণতি।

এই গ্রিক মিথকে প্লাথ ব্যবহার করেছেন তাঁর কবিতার চিত্রকল্পে— মৎস্যকন্যাদের আহ্বানে সাড়া দিতে চান তিনি, কারণ জলের গভীরেই তিনি খুঁজে পান শান্তিময় এক মৃত্যুর আশ্রয়। ছোটবেলা থেকেই জল ছিল তাঁর কাছে আশ্রয়ের মতো, আর মৎস্যকন্যারা হয়ে উঠেছে সেই আশ্রয়ের প্রতীক— মুক্তির ঠিকানা।

প্রাত্যহিক জীবনের যে নিগড় কবিকে আবদ্ধ করে রেখেছিল, তার প্রতিরূপ যেন ‘Terza Rima’-র অটুট বন্ধন। তবে যখন নদীর গভীরতম স্তর থেকে মৎস্যকন্যারা ভেসে ওঠে— তাদের কণ্ঠে ‘অনেক বেশি সম্পূর্ণ ও পরিশুদ্ধ জীবনের গান নিয়ে’— তখন কবিতাও ছন্দের শৃঙ্খলা ছিন্ন করে বেরিয়ে আসে মুক্তির দিকে।

…They sing
Of a world more full and clear
Than can be. Sisters, your song
Bears a burden too weighty
For the whorled ear’s listening.

মৃত্যু এবং পুনর্জন্মের চিত্রকল্প ব্যবহার করতে গিয়ে সিলভিয়া প্লাথ তাঁর বিখ্যাত কবিতা Lady Lazarus-এ নিজেকে তুলনা করেছেন ফিনিক্স পাখির সঙ্গে— যে আগুনে পুড়ে গিয়ে পুনর্জন্ম লাভ করে। এই কবিতায় প্লাথ নিজেকে দেখেছেন এক পুনর্জন্মপ্রাপ্ত নারী হিসেবে।

Out of the ash
I rise with my red hair
And I eat men like air.

তেমনি, Tulips কবিতায় আমরা দেখি, প্রকৃতির চিত্রকল্প ব্যবহার করে সিলভিয়া প্লাথ তাঁর মানসিক অবস্থা, ক্লিনিকজীবনের অভিজ্ঞতা এবং ব্যক্তিগত যন্ত্রণাকে প্রকাশ করেন টিউলিপ ফুলের মাধ্যমে। এই কবিতায় শব্দের ক্ষমতাই যেন সরীসৃপের মতো— নীরব অথচ চঞ্চল— দেওয়াল বেয়ে চলেছে। ফুলগুলোর সজীবতা, তাদের উজ্জ্বল রং ও শ্বাসপ্রশ্বাস যেন কবির অসুস্থ, নির্জীব মনকে আরও অস্থির করে তোলে।

The tulips are too excitable, it is winter here.

নারীজীবনের বিভাজন ও সংকট নিয়ে সিলভিয়া প্লাথ যে চিত্রকল্প Mirror কবিতায় ব্যবহার করেছেন, সেখানে আয়নাকে এক জীবন্ত চরিত্র হিসেবে উপস্থাপন করা হয়েছে। এই আয়না একটি নারীর চেহারা এবং বয়সের পরিবর্তন নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করে। এবং একসময় সেই আয়নাতেই এগিয়ে আসে এক নতুন মায়ের প্রতিচ্ছবি, যার প্রতি নির্ভরতা ও বিদ্বেষের এক অদ্ভুত মিশ্রণ দেখা যায়।

I am important to her. She comes and goes,
Each morning it is her face that replaces the darkness,
In me she has drowned a young girl and in me old woman.

সিলভিয়া প্লাথের কবিতায় চিত্রকল্পগুলো গভীর, জটিল এবং বেশিরভাগ সময় তীব্র মানসিক আবেগ দ্বারা পরিচালিত। তাঁর কবিতায় চিত্রকল্প প্রায়শই ব্যক্তিগত যন্ত্রণা, বিষাদ, মৃত্যু এবং আত্মপরিচয়ের সংকটের প্রতিফলন হিসেবে উঠে আসে। সিলভিয়ার সমগ্র কবিতাতেই রঙের প্রতীকী ব্যবহার দারুণভাবে করা হয়েছে। মনে রাখা দরকার, সিলভিয়া নিজেও একজন চিত্রকর ছিলেন।

 

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 5088 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

Be the first to comment

আপনার মতামত...