
মীনা কান্ডাসামি
যে সত্যটা কেন্দ্র সরকার সমানে অস্বীকার করে চলেছে— এবং যে সত্যটা সংবাদপত্রগুলো প্রযুক্তিগত বিবরণ ও অভিনন্দনমূলক প্রতিবেদনগুলোর আড়ালে লুকিয়ে রাখছে— তা হল, গাজার পরীক্ষিত অস্ত্রশস্ত্র নিজের দেশের নাগরিকদের বিরুদ্ধে ব্যবহার করা আর যাই হোক, কোনও অভ্যন্তরীণ বিদ্রোহ দমন হতে পারে না। ভারত রাষ্ট্র তার আদিবাসী জনগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেছে। তারা নিজের দেশের অভ্যন্তরে ইজরায়েলের কৌশল প্রয়োগ করছে, ভূমির মূল অধিবাসীদের শত্রুতে পরিণত করেছে— যাদের ওপর নজরদারি করতে হবে, নিয়ন্ত্রণে রাখতে হবে, এবং, সম্পূর্ণ ত্রাস সৃষ্টির জন্য নির্মূল করে দিতে হবে
ছত্তিশগড়ে নজিরবিহীন রক্তপাত ঘটিয়ে চলেছে[1] কেন্দ্রীয় সরকারের ‘অপারেশন কাগার’— স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহর বহু সাধের এই অভিযান, যার লক্ষ্য একদিকে নকশালবাদ নির্মূল করা, অন্যদিকে তাঁর রাজনৈতিক ভাবমূর্তি উজ্জ্বল করে তোলা। সাউথ এশিয়া টেররিজম পোর্টাল-এর তথ্য অনুযায়ী, ২০২৫-এর প্রথম তিন মাসেই নিরাপত্তাবাহিনী ছত্তিশগড়ে ১৪০ জন সন্দেহভাজন মাওবাদীকে হত্যা করেছে— সংখ্যাটা ২০২৪ সালের মোট মৃত্যুসংখ্যা ২৩৫-এর অর্ধেকেরও বেশি। ২০২৩ সালের দিকে তাকালে আমরা দেখতে পাই সে-বছর মাত্র ২৩ জন মাওবাদী সন্দেহে নিহত হয়েছিল, ফলে মৃত্যু-সংখ্যায় এই অস্বাভাবিক বৃদ্ধি কার্যত বিস্ময়কর। এই মৃত্যুর ঢেউ সরাসরি যুক্ত নগদ অর্থের লোভ দেখানো ব্যবস্থার সঙ্গে— প্রতি ‘মৃত নকশালের’ জন্য ২৫ লক্ষ টাকা পর্যন্ত পুরস্কার ঘোষণা করা হয়েছে— যা কার্যত মানুষের জীবনের ওপর টাকার দাম বসিয়ে দেওয়ার সামিল।
‘অপারেশন কাগার’, যার অর্থ আনুমানিকভাবে হতে পারে ‘চূড়ান্ত অভিযান’, একটি চার ধাপের কৌশলের ওপর ভিত্তি করে পরিচালিত হচ্ছে। এই ধাপগুলি হল:
- ছত্তিশগড়ের বস্তার জুড়ে ফরওয়ার্ড অপারেটিং বেস (FOB) বা সামরিক অগ্রবর্তী ঘাঁটি স্থাপন,
- তথ্য সংগ্রহের জন্য ড্রোন ও স্যাটেলাইট চিত্র ব্যবহার,
- পুনর্দখল করা এলাকায় ৬১২টিরও বেশি সুরক্ষিত পুলিশ স্টেশন গড়ে তোলা, এবং
- একটি তথাকথিত “উদার আত্মসমর্পণ নীতি” চালু করা, যার আওতায় গত এক দশকে প্রায় ৭,৫০০ জন নকশাল আত্মসমর্পণ করেছে বলে দাবি করা হয়েছে।
এই পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন গল্প— যা সেনা হেলিকপ্টারে করে নিয়ে যাওয়া অনুগত সাংবাদিকদের মুখে মুখে প্রচারিত হয়, যাঁদের দেখানো হয় বিশেষভাবে বাছাই করা প্রমাণ— তার আড়ালে যে বাস্তবতা ঢাকা পড়ে থাকে, তা হল মানবিক মাশুল।
বাড়তে থাকা মৃতদেহের সংখ্যা
ভারতীয় কমিউনিস্ট পার্টি (মাওবাদী)-র সশস্ত্র শাখা পিপলস লিবারেশন গেরিলা আর্মি (PLGA) একটি নিষিদ্ধ সংগঠন— তারা তাদের সদস্যসংখ্যা, স্কোয়াডের বিস্তারিত তথ্য বা অস্ত্রাগারের শক্তি প্রদর্শন করে না, কারণ গেরিলা যুদ্ধের মূল ভিত্তিই হল গোপনীয়তা। ফলে যেখানে প্রকৃত বা নির্ভরযোগ্য কোনও তথ্য নেই, কে বলবে বস্তারে আর কতজন নকশাল রয়ে গেছেন? সরকার প্রতিদিনের মৃতদেহের সংখ্যাকে ন্যায়বিচারের নিদর্শন হিসেবে জাহির করছে, কিন্তু সেই সংখ্যা যাচাই করতে গেলেই আপনাকে বাধা পেতে হবে।
দিনে দিনে বাড়তে থাকা মৃতদেহের সংখ্যা দুটি উদ্দেশ্য সাধন করে: এটি একদিকে ত্রাস বাড়িয়ে তোলে বহুগুণে, এবং অন্যদিকে নির্মূলীকরণকে সাফল্য হিসেবে চিহ্নিত করে— একটি নিখুঁত বৃত্তীয় লজিক। সংকট এবং তার সমাধান— দুইই তৈরি করছে রাষ্ট্র, সহিংসতাকে ন্যায্যতা দিচ্ছে এবং তীব্র সামরিকীকরণের মাধ্যমে সেই সহিংসতাকে লাগামছাড়া করে তুলছে। “নকশাল” বিষয়টা এখন বেশ একটা সুবিধাজনক ভূতে পরিণত হয়েছে— এমন একটি ভূত যার আকার রাজনৈতিক চাহিদা অনুসারে বাড়ানো বা কমানো যায়, যা আদিবাসীদের[2] বিরুদ্ধে অবিরাম যুদ্ধ চালানোর সুযোগ তৈরি করে, আর পাশ দিয়ে কর্পোরেট খননকারীরা তাদের জমিতে খাল কেটে ঢুকে পড়ছে।

এই নারকীয় ঘটনার শিকার হচ্ছেন যাঁরা, তাঁরা তো ‘প্রাইম টাইম’-এর অযোগ্য বলে নির্ধারিতই হয়ে রয়েছে, এমনকি, তাঁরা যে ভয়ঙ্কর সত্যগুলি প্রকাশ করেন সেগুলিও কখনওই টেলিভিশনের পর্দায় আসে না। শিশুরা গুলিবর্ষণের ঘটনা বা সংঘর্ষের শিকার হয়ে নিহত হচ্ছে। “মহিলাদের জীবন্ত অবস্থায় নিগ্রহ করা হয়, অত্যাচার করা হয়, কামড়ানো হয়, ধর্ষণ করা হয়, তারপর গুলি করে মেরে ফেলা হয়,”— এক সাম্প্রতিক সাক্ষাৎকারে বলছিলেন আদিবাসী অধিকারকর্মী সোনি সোরি।[3] তাঁর সেই সাক্ষাৎকারটিতে সমস্ত সামরিক পরিসংখ্যানের পিছনে থাকা বিভীষিকাময় বাস্তব চিত্র প্রকাশ্যে চলে আসে। অধিকাংশ “এনকাউন্টারড” মানুষ আসলে আদিবাসী গ্রামবাসী, যেরকমভাবে নকশাল বলে তাঁদের দাগিয়ে দেওয়া হয় তাঁরা মোটেই তা নন। নির্মমতা নথিভুক্ত, প্রমাণ সুস্পষ্ট, তবুও নারকীয়তা অব্যাহত— আমাদের ঘুমন্ত জাতীয় বিবেকের পাশে লেপ্টে থাকা ছায়ার মতো।
যদি এই ধারাবাহিক ধর্ষণ এবং হত্যা তামিলনাড়ু বা দিল্লির রাস্তায় ঘটত, তবে আমরা ন্যায়সঙ্গত ক্রোধে চিৎকার করতাম। রাস্তাগুলো প্রতিবাদীদের ভিড়ে উপচে পড়ত; আমরা আমাদের ক্ষোভ প্রকাশ করার জন্য হ্যাশট্যাগের বন্যা বইয়ে দিতাম। কিন্তু যেহেতু এটি সেই সুদূর বস্তারে ঘটছে, যেহেতু শিকার হচ্ছেন আদিবাসী জনগণ, যেহেতু এসব নিয়ে মুখ খুললে “শহুরে নকশাল” হিসেবে চিহ্নিত হওয়ার ঝুঁকি থাকে— তাই আমরা আমাদের সুবিধাজনক নীরবতা পালন করে চলেছি। আমাদের এই উদাসীনতা আসলে পরোক্ষ সহযোগিতা। এই “শহুরে নকশাল” তকমা যেমন শহুরে বিরুদ্ধতাকে নিশ্চুপ করিয়ে দেয়, তেমনই গ্রামের প্রতিরোধকেও অপরাধী বানানোর কৌশল হিসেবে ব্যবহৃত হয়। এই লেবেলের ভীতি, যা বন থেকে শহরে ছড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে, তা দিয়ে আদিবাসী জনগণেরর সম্ভাব্য সহযোগীদের পঙ্গু করে রাখা হচ্ছে— এবং এইভাবে এই সহিংসতা যেন নির্বিঘ্নে অব্যাহত থাকে তা নিশ্চিত করা হচ্ছে।
আদিবাসীদের একের বিরুদ্ধে অন্যকে দাঁড় করানো
সরকারের বহুল-প্রচারিত “সারেন্ডার পলিসি” আদিবাসীদের একে অপরের বিরুদ্ধে লড়িয়ে দেওয়ার একটি কৌশল ছাড়া আর কিছুই নয়। এই পলিসির মাধ্যমে যারা আত্মসমর্পণ করে তাদেরকে দিয়ে ডিস্ট্রিক্ট রিজার্ভ গার্ড (ডিআরজি)[4]-এর ২০ শতাংশ পদ পূরণ করা হয়। এটি আকস্মিক কোনও ঘটনা নয়, বরং এক চতুর কৌশল— সুপরিকল্পিতভাবে সম্প্রদায়গত ঐক্যকে ভাঙার প্রয়াস। ভূমি দখল করতে, সম্পদ আহরণ করতে, একটি স্থান জনশূন্য করে দিতে, একটি জনসমষ্টিকে নিশ্চিহ্ন করতে— পুঁজিবাদ রাষ্ট্রযন্ত্রকে কাজে লাগায়, তার গলার লাগাম ধরে তাকে নিজের পোষ্যের মতো ব্যবহার করে। এই নির্মূলীকরণ প্রক্রিয়ায়, যখন পুঁজিবাদ রাষ্ট্রের কাছে সহিংসতার কাজ আউটসোর্স করে, তখন রাষ্ট্রের পক্ষে গণহত্যার কাজ হস্তান্তর করা বাধ্যতামূলক হয়ে ওঠে।
এই হস্তান্তরের প্রক্রিয়া অত্যন্ত নিষ্ঠুরভাবে সরল: আদিবাসী জনগণের মধ্যে যে সম্প্রদায়গত ঐক্য রয়েছে তাকে চূর্ণ করে দাও এবং রাতারাতি এমন একটা পরিবেশ সৃষ্টি করো, যেখানে তাদেরই একাংশকে প্রশিক্ষণ দিয়ে এবং পুরস্কারের লোভ দেখিয়ে অপরাংশকে নিকেশ করার জন্য লেলিয়ে দেওয়া যাবে।
এ সেই রাষ্ট্র-সমর্থিত কুখ্যাত সশস্ত্র মিলিশিয়া বাহিনী সালওয়া জুডুমের[5] প্রেতকেই আবার ফিরিয়ে আনা। ২০০৫ থেকে ২০১১ সালে সুপ্রিম কোর্ট অসাংবিধানিক ঘোষণা করার আগে পর্যন্ত সালওয়া জুড়ুম বস্তারে ত্রাস সৃষ্টি করেছিল। এখন সেটাকেই আবার ফিরিয়ে আনা হয়েছে প্রশাসনিক ছদ্মবেশে। চাকরির অভাবে, কিংবা অনেক সময় সামান্য অপরাধের জন্য আইনি হয়রানি এড়াতে, অথবা সালওয়া জুডুমের সদস্য থাকাকালীন অপরাধের প্রতিশোধ থেকে বাঁচার জন্য আদিবাসী গ্রামবাসীরা এই “আত্মসমর্পণ” করে থাকে।
তবু, ২০২১ সালের কিছু সংবাদমাধ্যমের প্রতিবেদন বলছে, ছত্তিশগড়ে আত্মসমর্পণকারী নকশালদের মধ্যে মাত্র ৩ শতাংশই রাজ্যের নিজস্ব স্ক্রিনিং কমিটির মতে পুনর্বাসনের জন্য উপযুক্ত বলে বিবেচিত হয়েছিলেন। মানবাধিকার কর্মীরা প্রশ্ন তোলেন, এই আত্মসমর্পণগুলি আদৌ কি প্রকৃত ঘটনা, নাকি কৃত্রিমভাবে তৈরি? গ্রামবাসীদের ধরে আটকে রেখে জেল অথবা “আত্মসমর্পণ”-এর মধ্যে একটিকে বেছে নিতে বাধ্য করা হয়নি তো?
আত্মসমর্পণ করা কোনও নকশাল সহিংসতার এই বিষাক্ত চক্র থেকে মুক্তি পায় না: এককালে যে ছিল রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে বিদ্রোহী, সে-ই এখন রক্তপাতের এক অবিরাম যন্ত্র— রাষ্ট্রের ভাড়াটে সৈনিক, ছিন্নভিন্ন এক অস্তিত্বে আবদ্ধ।
এই বিকৃত চক্রটি ঘটছে সেই খনিজসমৃদ্ধ ভূভাগেই, যার খনন সম্ভাবনায় কর্পোরেট দুনিয়া লোভে জিভ চাটছে। এটি কোনও কাকতালীয় ঘটনা নয় যে, অপারেশন কাগারের তীব্রতা ঠিক সেইসব ভূতাত্ত্বিক জরিপের মানচিত্রের সঙ্গেই মিলে যাচ্ছে, যেগুলোতে সম্পদের অবস্থান চিহ্নিত করা হয়েছে (একটু আগে দেওয়া মানচিত্রটি দেখুন)।
খনিজ সম্পদের দিকে নজর
সরকারি বয়ানের বিরোধিতা করা অত্যন্ত জরুরি হয়ে ওঠে, যখন দেখা যায় ছত্তিশগড় সরকার “মাওবাদীমুক্ত” পঞ্চায়েতগুলোতেও “দলে দলে আত্মসমর্পণের” বিনিময়ে পুরস্কার ঘোষণা করছে— সেই পুরস্কারের মধ্যে এক কোটি টাকার নির্মাণচুক্তি পাইয়ে দেওয়াও আছে! মানুষকেই তথাকথিত বিদ্রোহ-দমনের বাজারের এক বিক্রয়যোগ্য পণ্য বানিয়ে তোলার নির্লজ্জ অপপ্রয়াসটা নিশ্চয়ই আর চাপা থাকে না। বাস্তবে, অপারেশন কাগর কোনও বিদ্রোহ দমনকারী অভিযান নয়, বরং খনিজ-সমৃদ্ধ ভূখণ্ডে কর্পোরেট লুটের সুবিধার্থে আদিবাসী জনগণের অস্তিত্বকে সম্পূর্ণ বিলুপ্ত করে দেওয়ার লক্ষ্যে চালিত একটি প্রক্রিয়া।
ছত্তিশগড়ের বাৎসরিক খনিজ উৎপাদনের মূল্য ২৫,০০০ থেকে ৩০,০০০ কোটি টাকা। এই রাজ্যে দেশের মোট লৌহ ও টিন আকরের প্রায় এক-তৃতীয়াংশ মজুত আছে, এবং এটি দেশের এক-চতুর্থাংশ স্টিল ও সিমেন্ট উৎপাদন করে। ভারতের মোট কয়লার প্রায় এক-পঞ্চমাংশ মজুত ছত্তিশগড়ে, যা দেশের মোট খনিজ রাজস্বের ১৫ শতাংশের জোগান দেয়। তবুও এই রাজ্য মানব উন্নয়ন সূচকে ২৮টি রাজ্যের মধ্যে ২৬তম স্থানে। এখানকার মাত্র এক-তৃতীয়াংশ ঘরে বিশুদ্ধ পানীয় জলের জোগান আছে, আর দারিদ্র্যের হার জাতীয় গড়ের দ্বিগুণ।
ছত্তিশগড়ের শিশুরা— এই কর্পোরেট লুণ্ঠনের প্রক্রিয়ায় স্রেফ কোল্যাটেরাল ড্যামেজ— তাদের ক্ষীণকায় দেহগুলিতে শোষণের জ্বলন্ত প্রমাণ নয়ে বেড়ায়। প্রতি তিনজনে একজন স্কুলছুট, কারণ গোটা ব্যবস্থাটাই তাদের পরিত্যাগ করেছে— এ এমন একটি ব্যবস্থা যার কাছে শিক্ষিত আদিবাসীদের কোনও প্রয়োজন নেই। প্রায় ৪০ শতাংশ শিশু অপুষ্টি ও খর্বাকৃতি দেহ নিয়ে বড় হচ্ছে— ঠিক সেই সময়েই যে সময়ে তাদের ভূমির খনিজ সম্পদ ট্রেনে উঠে দেশের অন্য প্রান্তে চলে যাচ্ছে।
এই তীব্র পরস্পরবিরোধী বাস্তবতাকেই অর্থনীতিবিদরা ‘সম্পদ অভিশাপ’ নাম দিয়ে সাফ-সুতরো করে উপস্থাপন করেন: ছত্তিশগড়ের খনিজ সম্পদগুলি বৃহৎ কর্পোরেশনগুলির জন্য বিপুল সম্পদ উৎপাদন করে এবং সমঝোতা করা রাষ্ট্রের জন্য রাজস্ব সংগ্রহ করে। এদিকে, আদিবাসীরা— যাঁরা এই সম্পদের মূল অধিকারী, যাঁদের ভূমিতে এসব রত্ন লুকিয়ে আছে— তাঁরা ধীরে ধীরে ক্ষুধায় পীড়িত হয়ে শাসনের কাছে আত্মসমর্পণ করে এবং তাঁদেরকেই ভয়ভীতি দেখিয়ে চুপ করিয়ে রাখা হয়।
শান্তিপূর্ণ প্রতিরোধ
কিন্তু এই শোষণের বিরুদ্ধে সবচেয়ে বিপজ্জনক প্রতিরোধ এসেছে কিন্তু অস্ত্রধারী বিদ্রোহীদের কাছ থেকে নয়, বরং সেই শান্তিপূর্ণ প্রতিবাদীদের কাছ থেকে যাঁদের হাতে রয়েছে সাংবিধানিক জ্ঞানের অস্ত্র। আদিবাসীদের ব্যাপক আন্দোলনগুলি— যেগুলি শান্তিপূর্ণ, গণতান্ত্রিক, এবং শুধুমাত্র সংবিধান-প্রদত্ত অধিকারটুকু দাবি করে— সেগুলিকে অসীম নিষ্ঠুরতায় অপরাধী হিসেবে চিহ্নিত করা হচ্ছে।
মূলবাসী বাঁচাও মঞ্চ (এমবিএম), যা বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড এবং পঞ্চম তফসিলভুক্ত এলাকায় অবৈধ সেনাশিবিরগুলির বিরুদ্ধে আন্দোলন করছে, এখন রাজ্যের সর্বশেষ লক্ষ্যবস্তু হয়ে দাঁড়িয়েছে। সিলগর গণহত্যা নিয়ে প্রতিবাদ করা, গ্রামগুলোতে বোমা হামলার নিন্দা করা, এবং মুটভেন্ডিতে ৬ মাস বয়সী এক শিশুর মৃত্যুতে শোক প্রকাশ করা— এইসব করে এই সংগঠনটি আসলে রাষ্ট্র যে তাদের অস্তিত্বকেই মুছে দিতে চাইছে তার বিরুদ্ধে দাঁড়ানোর মহাপাপটি করেছে। ২০২৪ সালের ৩০ সেপ্টেম্বর ছত্তিশগড় সরকার তাদের নিষিদ্ধ ঘোষণা করে নোটিফিকেশন জারি করেছে, তাতে পরিষ্কারভাবে বলা হয়েছে: তারা “উন্নয়ন কাজের বিরোধিতা” এবং “সেনাশিবিরগুলির বিরোধিতা” করে।
এই ব্যুরোক্র্যাটিক ভাষার নিচে একটি গভীর সত্য লুকিয়ে রয়েছে— এমবিএম-এর উপর নিষেধাজ্ঞা প্রকৃত অর্থে সাংবিধানিক প্রতিশ্রুতি এবং পুঁজির দাবির মধ্যে দ্বন্দ্বের প্রতীক। যা অনুবাদ করলে দাঁড়ায়— যারা সরকারি “উন্নয়ন”-এর সংজ্ঞা গ্রহণ করতে অস্বীকার করবে তাদের আমরা কোনওভাবেই সহ্য করব না। তারা কী সাহস— তারা আদিবাসী অঞ্চলগুলির অভ্যন্তরীণ উপনিবেশীকরণের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ করছে; এই সাহসই বা তাদের হল কীভাবে যে তারা তাদের সংবিধান-প্রদত্ত অধিকারের দাবি তুলছে— বলছে, গ্রামসভার সম্মতি ছাড়া কোনও জমি দখল করা যাবে না?
২০২২ সালের মে মাসে সিলগরে সুনিতা পট্টাম এবং রঘু মিডিয়ামির সঙ্গে দেখা হয়েছিল। ঝকঝকে তরুণ, ২০-র কোঠায় বয়স দুজনেরই— তারাই সেখানে আদিবাসী আন্দোলনের নেতৃত্ব দিচ্ছিল। তাদের বাগ্মিতা রাষ্ট্রকে ভীত করে তুলেছিল। দু-বছর হল, তাদের দুজনকেই গ্রেপ্তার করা হয়েছে এবং নকশাল বলে দাগিয়ে দেওয়া হয়েছে।[6]
এই যুবশক্তি, যারা মূলত ধরনা-জাতীয় আন্দোলনে নেতৃত্ব দিচ্ছিল, তাদের প্রতি সরকারের আচরণই দেখিয়ে দেওয়া “শান্তি চাওয়া” নিয়ে তাদের বাগাড়ম্বর কতটা ফাঁপা। শান্তি যদি সত্যিই উদ্দেশ্য হত, যদি তা শাসন ও দখলের অসদিচ্ছাগুলো আড়াল করার জন্য কোনও নাটকীয় আচ্ছাদন না হত, তাহলে যাদের অস্ত্র ছিল কেবল প্ল্যাকার্ড এবং বিদ্রোহ ছিল মাটিতে বসে প্রতিবাদ করার মতো শান্তিপূর্ণ তাদের অপরাধী সাব্যস্ত করে নির্যাতন করা হত না।
আদিবাসীদের কোনও জায়গা নেই
এই দ্বন্দ্বের মধ্যে দিয়েই রাষ্ট্রের প্রকৃত দৃষ্টিভঙ্গি প্রতিফলিত হয়। ১৯৯৬ সালের পঞ্চায়েত (তফসিলি এলাকায় সম্প্রসারণ) আইন এবং ২০০৬ সালের বন অধিকার আইন— যেগুলি রাষ্ট্রের থেকে ঐতিহাসিক সংগ্রামের মাধ্যমে আদায় করা হয়েছে— স্পষ্টভাবে বলছে পঞ্চম তফসিলভুক্ত এলাকায় গ্রামসভার সম্মতি প্রয়োজন, কিন্তু এই সাংবিধানিক বিধানগুলোর কথা বলাই হল এখন রাষ্ট্রদ্রোহিতা।
রাষ্ট্র আদিবাসী প্রতিবাদীদের অভিযোগ সমাধানের জন্য প্রতিটি বৈধ উপায় বন্ধ করে দিয়েছে এবং একটি স্পষ্ট দ্বৈত ধারণা তৈরি করেছে— চুপ করে সমস্ত শোষণ মেনে নাও অথবা মাওবাদী তকমা নিতে প্রস্তুত থাকো। এদিকে, সেই বনগুলো, যা হাজার হাজার বছর ধরে আদিবাসী জনজাতিদের ধারণ করে এসেছে, উন্নয়নের নামে তাদের ধ্বংস এবং লুণ্ঠন করা হচ্ছে। এক শীর্ষ সুরক্ষা বিশ্লেষক, যিনি দেশের এইসব বিদ্রোহ-দমনকারী অভিযান নিয়ে কাজ করেন, এই প্রতিবেদককে হাল্কা চালেই বলেছিলেন: “বিজয় ঘোষণা করা একটি বিপজ্জনক কাজ— [পূর্ববর্তী স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী] চিদম্বরম সেই পাঠ কঠিনভাবে শিখেছিলেন; অমিত শাহও তা শিখবেন। শুধু হত্যা করে মাওবাদীদের নিশ্চিহ্ন করা সম্ভব নয়।”
অমিত শাহর খেয়ালখুশিমতো নির্ধারিত ২০২৬ সালের ৩১ মার্চের মধ্যে দেশকে “নকশালমুক্ত” করার সময়সীমা শুধু যে অযৌক্তিক, তা নয়— এটি আসলে একপ্রকার রাজনৈতিক নাটক, যা কৌশলের ছদ্মবেশে উপস্থাপিত। এই সময়সীমা কোনও বাস্তব সামরিক পর্যালোচনার ভিত্তিতে নির্ধারিত হয়নি; বরং এটি নির্বাচনী ক্যালেন্ডার এবং সংবাদমাধ্যমে শিরোনাম দখলের কৌশল হিসেবেই বেছে নেওয়া হয়েছে।
যখন মাওবাদীরা তাঁদের গোটা রণনীতি গড়ে তুলেছেন “দীর্ঘস্থায়ী যুদ্ধ”-এর তত্ত্বের উপর— যে ধৈর্যের পরীক্ষায় একের পর এক সরকার আসবে যাবে, জল যেমন পাথর ক্ষয় করে তেমনই ক্ষয় করে ফেলা হবে রাষ্ট্রীয় বাহিনীকে— তখন কে-ই বা ভাবতে পারেন যে “হানা দাও আর হত্যা করো” ধাঁচের ঝটিকা অভিযানে মাওবাদ দমন হবে? এর পরিণামে সাধারণ মানুষের লাশের পাহাড় গড়ে ওঠা ছাড়া আর কীই বা হতে পারে?
উত্তরটি মর্মান্তিকভাবে স্পষ্ট— এই সময়সীমা আসলে কখনওই নকশালবাদ নির্মূল করার জন্য নির্ধারিত হয়নি; এর লক্ষ্য হল অমিত শাহর দক্ষতা নিয়ে ওঠা প্রশ্নগুলিকে নির্মূল করা। প্রতিটি আদিবাসী মৃতদেহ এখন প্রচারের অস্ত্র এবং জনমত নিয়ন্ত্রণের হাতিয়ার— প্রমাণ, যে দেশের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী “সন্ত্রাসবাদের প্রতি কঠোর”। আর সেই প্রমাণের মাঝখানে রক্তে ভেসে যাচ্ছে জঙ্গল। এর ফল, কিংবা বলা ভাল— এর আসল উদ্দেশ্য হচ্ছে, এই অঞ্চলকে আরও গভীরভাবে সামরিকীকরণ করা, যাতে খনন ও কর্পোরেট লুট আরও সহজে চালানো যায়।
বাড়তে থাকা আধাসামরিক বাহিনীর উপস্থিতি
সংবাদ প্রতিবেদন অনুযায়ী, বস্তারে আধাসামরিক বাহিনী, যেমন সেন্ট্রাল রিজার্ভ পুলিশ ফোর্স (সিআরপিএফ) ইতিমধ্যে ১৮২টি এফওবি (ফরওয়ার্ড অপারেটিং বেস) স্থাপন করেছে, এবং এই সংখ্যাটি ভয়ঙ্কর গতিতে বাড়ছে— যেখানে আগের গড় ছিল বছরে ১৫টি ক্যাম্প, শুধু ২০২৪ সালেই নতুন করে গড়ে উঠেছে ৩০টি। এই এফওবি ক্যাম্পগুলো এক ভয়ানক কায়দায় ৫ কিলোমিটার অন্তর এক-একটি নিরাপত্তা গ্রিড তৈরি করছে, যা ধীরে ধীরে আদিবাসী জনগোষ্ঠীর উপর একটি দমবন্ধ করা জাল হিসেবে নেমে আসছে।
আরও ভয়ঙ্কর দিকটি হল— এই অস্থায়ী সেনাশিবিরগুলিকে স্থায়ী “ইন্টিগ্রেটেড ডেভেলপমেন্ট সেন্টার” (আইডিসি) হিসেবে রূপান্তরিত করার জন্য রাজ্য সরকারের তৎপরতা। এই নামকরণটি একপ্রকার ডিস্টোপিয়ান ভাষাচাতুরি, যা বাস্তবে খোলা আকাশের নিচে ডিটেনশন সেন্টার স্থাপনেরই নামান্তর।
আইডিসি-গুলো নাগরিক জীবনের চরম সামরিকীকরণের প্রতীক, যাকে স্থানীয় গোন্ডি ভাষায় গালভরা নাম দেওয়া হয়েছে— ‘মানওয়া নবন নর’ (‘আমাদের নতুন গ্রাম’)। এটি একটি নির্মম ভাষাগত ছলনা, যা তাদের প্রকৃত উদ্দেশ্য লুকাতে ব্যবহৃত হচ্ছে। শক্তভাবে সুরক্ষিত সামরিক ক্যাম্পাসের মধ্যে বিদ্যালয়, হাসপাতাল, ব্যাঙ্ক এবং জনসাধারণের সরবরাহ ব্যবস্থাকে একত্রিত করা উন্নয়ন নয়; এটি কংক্রিটের দেয়ালের ভিতরে কৌশলগত নজরদারি।
সিলগরে ২০২২ সালের মে মাসে আমাকে সাক্ষাৎকার দেওয়ার সময়ে এমবিএম-এর প্রাক্তন সভাপতি রঘু মিডিয়ামি বলছিলেন, “ওরা বলে, ক্যাম্প এলে আমাদের স্কুল এবং হাসপাতাল হবে। কিন্তু যখনই কোনও ক্যাম্প আসে, সেই এলাকার মানুষদের কষ্ট হয়। তারা চলাচল করতে পারে না, জঙ্গলে বা গ্রামের বাজারে যেতে পারে না, এমনকি বন থেকে খাবারও নিতে পারে না। যদি কোনও মহিলা একা যান, তাকে পুলিশ ধরে অত্যাচার করে।”
এই সামরিকীকৃত সংযোগ নাগরিক ও রাষ্ট্রের মধ্যে এক অপ্রতিরোধ্য ফাঁদ তৈরি করে। “আধাসামরিক বাহিনীর অবাস্তব লক্ষ্য শুধুমাত্র জঙ্গলে ঢুকে পূরণ করা যায় না। তাদের প্রতিটি ধরনের সুবিধা-সহ ক্যাম্প গড়ে তুলতে হয় যাতে আদিবাসীরা কোনও না কোনও বাধ্যতামূলক কারণে সেসব ক্যাম্পে প্রবেশ করে ফাঁদে পড়েন। এভাবেই তারা আদিবাসী মানুষদের ধরে,”— ২০২৫ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে গ্রেপ্তার হওয়ার আগে বলেছিলেন মিডিয়ামি।
ক্ষমতার কেন্দ্রীভবন— জেলা কর্মকর্তারা, পুলিশ, প্যারামিলিটারি, বন বিভাগ— সবকিছু একটা একক সামরিক কমান্ডের অধীনে থাকায়, যেখানে অন্যত্র সাধারণ নাগরিক অংশগ্রহণ স্বাভাবিক, সেখানে বস্তারে তা পরিণত হয় একটি পরিকল্পিত ঝুঁকিতে। এখানে স্বাস্থ্যকেন্দ্রে যাওয়া বা রেশন থেকে চাল-আটা সংগ্রহ করাও হতে পারে রাষ্ট্রযন্ত্রের অন্ধকূপে তলিয়ে যাওয়ার কারণ।
বস্তারের সামরিকীকরণ
বস্তারের সামরিকীকরণ শুধুমাত্র একটি অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা অভিযান নয়— এটি বৈশ্বিক গেরিলা বিরোধী প্রযুক্তির পরীক্ষার ক্ষেত্র, যার গভীর আন্তর্জাতিক প্রভাব রয়েছে।
এফওবি-গুলি অত্যাধুনিক অস্ত্রশস্ত্র দিয়ে সজ্জিত, যার মধ্যে রয়েছে নেত্রা ৩ এবং ভারত ড্রোন, যা ৫ কিলোমিটার ব্যাসার্ধে একবারে ৬০ মিনিট পর্যবেক্ষণ চালাতে পারে। ছোট ছোট লঞ্চপ্যাড থেকে এই আকাশচোখগুলি রিয়েল-টাইম ছবি প্রেরণ করে, যা মানুষের সঙ্গে পশুদের পার্থক্য করতে সক্ষম বলে দাবি করা হয়। কিন্তু এটা ভাবলে ভয় লাগে— কোনও ড্রোন কি একজন বনের জিনিসপত্র সংগ্রহরত আদিবাসীর সঙ্গে একজন সন্দেহভাজন নকশালের মধ্যে পার্থক্য করতে পারে?
আরও ভয়াবহ হল বস্তারে হেরন নামক মনুষ্যবিহীন বিমান (ইউএভি)-এর ব্যবহার। এগুলি তৈরি করেছে ইজরায়েল এরোস্পেস ইন্ডাস্ট্রিজ (আইএআই), একটি রাষ্ট্র মালিকানাধীন সংস্থা। এই সংস্থাই গাজার চলমান গণহত্যায় নিজেদের “কেন্দ্রীয় ভূমিকা” উদযাপন করছে এবং সঙ্গে সঙ্গে নিজেদের রেকর্ড মুনাফা নিয়ে গর্ব করছে। ভারতীয় সশস্ত্র বাহিনী দুই দশকেরও বেশি সময় আগে এই দূরচালিত যান ব্যবহার করত, সেই সময় এগুলো সম্পূর্ণ অস্ত্রবিহীন ছিল। তারপর, সবকিছুকেই মারাত্মকভাবে প্রাণঘাতী করে তোলা হয়েছে।
হেরনের সর্বশেষ মডেলগুলো আর শুধুই পর্যবেক্ষণ যন্ত্র নয়; লয়টারিং মিউনিশনস (loitering munitions) সংযোজিত হলে এগুলো হামলার সক্ষমতা অর্জন করে, ফলে এরা একপ্রকার শীতল মৃত্যুযন্ত্রে পরিণত হয়। আইএআই-এর ওয়েবসাইটে হেরনকে “কমব্যাট-প্রুভেন” হিসেবে বিপণন করা হয়— যার মূল কথা হল এই অস্ত্রগুলো অসহায় প্যালেস্তিনীয় জনগণের ওপর পরীক্ষিত। ২০০৮-০৯ সালের অপারেশন ক্যাস্ট লিডের পর, হিউম্যান রাইটস ওয়াচ বহু গাজাবাসীর এই ড্রোন থেকে ছোড়া ক্ষেপণাস্ত্রের মাধ্যমে নিহত হওয়ার তথ্য সংগ্রহ করে। ২০১৩ সালে, তখনও ভারতীয় মিডিয়ার সাহস ছিল, জানিয়েছিল যে হেরন ড্রোনগুলো কার্যত ব্যর্থ— এগুলো গ্রামের বসতি সনাক্ত করে, নকশাল শিবির নয়।
এসব বিজেপির ক্ষমতায় আসার সময়— তখনও জাতীয় সংবাদমাধ্যম নাম না করে অপারেশনে যুক্ত থাকা কোনও অফিশিয়ালকে উদ্ধৃত করতে পারত— “জঙ্গলে ড্রোন যেটা দেখবে, সেটার ওপর সরাসরি গুলি চালানো যায় না। এটা আমাদের নিজের দেশ; আমরা আফগানিস্তানে আমেরিকান নই।”
আর আজ, তোষামুদে সংবাদমাধ্যম রিপোর্ট করে কীভাবে এই নির্যাতনের প্রমাণিত যন্ত্রগুলি দণ্ডকারণ্যের উপর ৩৫,০০০ ফুট উচ্চতায় ১০ ঘণ্টা ধরে ঘুরে বেড়ায়, ছবি তোলে এবং ওয়্যারলেস ও মোবাইল ফোনের কথোপকথন শোনে। যখন কোনও নিরাপত্তা আধিকারিক গর্ব করে বলেন, “একটি কথোপকথন, একটি ফোন কল, বা অনাবাসিক কোনও স্থান থেকে কোনও আগুনের চিহ্ন দেখা যায়, সেগুলিই বিদ্রোহীদের নিশ্চিত উপস্থিতি নির্দেশ করে,” তখন তাঁরা আসলে বনভূমিতে নেওয়া প্রতিটি অননুমোদিত শ্বাস-প্রশ্বাসের ওপরেই মৃত্যুদণ্ড ঘোষণা করছেন।
মূলবাসী জনগণের বিরুদ্ধে যুদ্ধ
যে সত্যটা কেন্দ্র সরকার সমানে অস্বীকার করে চলেছে— এবং যে সত্যটা সংবাদপত্রগুলো প্রযুক্তিগত বিবরণ ও অভিনন্দনমূলক প্রতিবেদনগুলোর আড়ালে লুকিয়ে রাখছে— তা হল, গাজার পরীক্ষিত অস্ত্রশস্ত্র নিজের দেশের নাগরিকদের বিরুদ্ধে ব্যবহার করা আর যাই হোক, কোনও অভ্যন্তরীণ বিদ্রোহ দমন হতে পারে না। ভারত রাষ্ট্র তার আদিবাসী জনগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেছে। তারা নিজের দেশের অভ্যন্তরে ইজরায়েলের কৌশল প্রয়োগ করছে, ভূমির মূল অধিবাসীদের শত্রুতে পরিণত করেছে— যাদের ওপর নজরদারি করতে হবে, নিয়ন্ত্রণে রাখতে হবে, এবং, সম্পূর্ণ ত্রাস সৃষ্টির জন্য নির্মূল করে দিতে হবে।
জাতিগত নির্মূলীকরণের এই অভিযানে, যা জাতীয় নিরাপত্তা নামক শব্দবন্ধের আড়ালে লুকিয়ে রাখা হয়েছে, অমিত শাহের আসল পরিকল্পনা স্পষ্ট হয়ে ওঠে। যে-কোনও রাজনৈতিক কৌশলবিদই বলবেন যে এটা শুধুমাত্র মাওবাদীদের দমন করার ব্যাপার নয়, বরং এটি অমিত শাহর উত্তরাধিকারীর কাহিনি নির্মাণের ব্যাপার। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ধীরে ধীরে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির পেশাদার মাসলম্যানের ভূমিকা থেকে বেরিয়ে এসে দেশের অভ্যন্তরীণ শত্রুদের বিরুদ্ধে খড়্গহস্ত এক রাষ্ট্রনায়কের ভূমিকায় নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে চাইছেন।
দ্বিতীয়ত, এই অসম্ভব সময়সীমা এবং কাউন্টডাউন গোটা দেশের সামরিকীকরণের জন্যও একটি পরিকল্পিত সুযোগ তৈরি করে দেয়। নিঃশর্ত বল প্রয়োগ, অপারেশনের জরুরি মুহূর্ত, অবশ্যম্ভাবী নজরদারি— এসব অপেক্ষা করছে আমাদের সবার জন্যই।
তৃতীয়ত, এটি ডানপন্থীদের প্রিয় প্রকল্পটিকে জলবাতাস দেয়— শত্রুকে সংজ্ঞায়িত করার। মাওবাদী হুমকিকে ফুলিয়ে ফাঁপিয়ে দেখালে “শহুরে নকশাল” শব্দটি ছড়িয়ে দিতে সুবিধা হয় এবং বেশ একটি স্লোগানে পরিণত হয়। প্রতিটি গ্রেপ্তারি, আদিবাসী জনআন্দোলনে প্রতিটি নিষেধাজ্ঞা একটি বার্তা দেয়— যে-কোনও ধরনের প্রতিরোধকেই অপরাধ হিসেবে চিহ্নিত করা হবে। এমনকি ট্রেড ইউনিয়নগুলিও ছাড় পাবে না।
চতুর্থত, এবং সর্বশেষে, অপারেশন কাগার অভিযান কর্পোরেট এবং রাষ্ট্রের মিলনকে পরিপূর্ণতা দেয়। বন্দুকধারী গেরিলারা স্কোয়াডে চলাফেরা করলেও তারা বাস্তবিক কোনও হুমকি নয়, কিন্তু কর্পোরেটরা এ-সব ঝক্কি সামলাতে চাইবে না।
গণতন্ত্রের উপর আক্রমণ
খনিজ কোম্পানিগুলোর প্রয়োজন সাফ হওয়া জমি; রাষ্ট্র, নিয়োগপ্রাপ্ত বন্দুকধারী হিসেবে, জাতীয়তাবাদে মোড়া বাহিনী পৌঁছে দেয়। আন্তর্জাতিক পুঁজিপতি নিরবচ্ছিন্ন উত্তোলন দাবি করে; অমিত শাহ তা নিশ্চিত করেন সামরিকীকৃত এলাকায়, যেখানে জনসাধারণের নজরদারি নেই। এই হত্যাকাণ্ডের মঞ্চে, বিদ্রোহ দমন কেবল এক পটভূমি, শক্তির পরীক্ষার জন্য। মাওবাদীরা একটা সুবিধাজনক হুমকি; অমিত শাহর প্রকৃত লক্ষ্যবস্তু হচ্ছে দেশের গণতান্ত্রিক পরিসরটাই, যেখানে শুধু আনুগত্য আর নীরবতা বেঁচে থাকবে।
এই অবস্থায়, বস্তারে আদিবাসীদের মৃতদেহ স্তূপীকৃত হতে থাকে সরকারি মর্গে ও অচিহ্নিত কবরে, আর আধাসামরিক বাহিনীর সদস্যরা পুরস্কার ও পদোন্নতি অর্জন করে। এই অবরুদ্ধ পরিস্থিতিতে শিশুরাও নেহাত কোল্যাটেরাল ড্যামেজ হয়ে নিহত হয়, আর আদিবাসী নারীরা গুলি খেয়ে মরার অধিকার দাবি করেন— কারণ তাঁরা আর ধর্ষণের নিপীড়ন সহ্য করতে পারেন না। এই কথাগুলি কেবল ব্যক্তিগত কোনও জওয়ানকে নয়, বরং সমগ্র দখলদার শাসনকাঠামো ও রাষ্ট্রীয় সহিংসতাকে কাঠগড়ায় দাঁড় করায়— এই তথাকথিত বিশ্বের “সবচেয়ে বড় গণতন্ত্রে”।
আজকের দণ্ডকারণ্য এক নিষ্ঠুর প্রতিশোধের অরণ্য— চোখের সামনে চলতে থাকা এক যুদ্ধাপরাধ। এই ভয়ঙ্কর অমানবিকতার মধ্যে নীরব থাকা মানে নিজেকে সেই সহিংসতার শরিক করে তোলা, এক এমন আগুনে ঘি ঢালা যা ক্রমশ সবকিছু গ্রাস করে নিচ্ছে।
[1] Sharma, Ashutosh. Chhattisgarh claims it’s winning against Naxals. But the victory comes at the cost of tribal lives and rights. Frontline. Jan 2, 2025.
[2] Sharma, Ashutosh. Chhattisgarh: No country for Adivasis. Frontline. Apr 30, 2024.
[3] কান্ডাসামি, মীনা। “আদিবাসীদের হত্যা করার পর আধাসামরিক বাহিনীর জওয়ানরা নাচে”— সোনি সোরি। চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম। এপ্রিল, ২০২৫।
[4] ডিআরজি হল একটি বিশেষ পুলিশ ইউনিট, যা ২০০৮ সালে ছত্তিশগড়ে বামপন্থী চরমপন্থা মোকাবিলা করার জন্য গঠন করা হয়েছিল।
[5] Tripathi, Purnima S. People’s war. Frontline. Mar 24, 2006.
[6] Sharma, Ashutosh. Chhattisgarh: No peace without justice. Frontline. Jul 23, 2024.
*মীনা কান্ডাসামি একজন নারীবাদী কবি ও লেখক। তাঁর এই নিবন্ধটি গত ৯ এপ্রিল ফ্রন্টলাইন পত্রিকায় ইংরেজিতে প্রকাশিত হয়। লেখার ভেতরের সমস্ত ছবি ও গ্রাফিক্স ফ্রন্টলাইন থেকে নেওয়া