
আশীষ লাহিড়ী
মিডিয়ার লাগাতার যুদ্ধ-উন্মাদনা তৈরি করার চেষ্টা আর পাশাপাশি ভারতীয় সেনাবাহিনীর এই সংযত, পেশাদার ‘non-escalatory approach’— এই বৈপরীত্য স্পষ্ট করে দেয় যে, আমাদের রাষ্ট্রব্যবস্থার অভ্যন্তরে কোথাও একটা দ্বন্দ্ব রয়েছে। একদিকে যখন গণমাধ্যম, শাসকদল ও রাজনৈতিক নেতারা যুদ্ধকে ঘিরে একপ্রকার হিন্দুত্ববাদী উন্মাদনায় ইন্ধন জোগাচ্ছেন, তখন রাষ্ট্রেরই এক গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ— ভারতীয় সেনাবাহিনী— সেই চরমপন্থী ভাষ্য থেকে দূরত্ব বজায় রেখে চলেছে। এই সমগ্র ঘটনাক্রমে এটিই একটি ব্যতিক্রমী ও প্রশংসাযোগ্য দিক
সবার আগে একটি কথা দ্ব্যর্থহীন ভাষায় বলা জরুরি। পহেলগাঁওয়ে সন্ত্রাসবাদীরা যে বর্বরতম ঘটনাটি ঘটিয়েছে, তার পেছনে পাকিস্তানের মদত আছে— এ একেবারে নির্জলা সত্য। সুতরাং রাষ্ট্র হিসেবে পাকিস্তান এক অত্যন্ত জঘন্য কাজ করেছে, এক দুষ্কর্ম, যার জন্য সারা বিশ্বের সুস্থ চিন্তাধারার মানুষের নিন্দা তার প্রাপ্য। ‘Rogue State’ বা দুর্বৃত্ত রাষ্ট্র যাকে বলা হয়, পাকিস্তান কার্যত সেরকম একটি ধর্মভিত্তিক রাষ্ট্রে পরিণত হয়েছে।
এ-কথা ভুললে চলবে না, সমস্ত কিছুর পরেও পাকিস্তান ধারাবাহিকভাবে আমেরিকার কাছ থেকে মদত পেয়ে এসেছে, এবং সাম্প্রতিক কালে চিন থেকেও যথেষ্ট সহায়তা পাচ্ছে। এবার শোনা যাচ্ছে, তুরস্কও পাকিস্তানকে অস্ত্রশস্ত্র দিয়ে বিপুল সাহায্য করেছে। ফলে নিজেদের দেশের চরম সার্বিক দুর্দশা থেকে জনগণের দৃষ্টি ঘুরিয়ে দেওয়ার অভিপ্রায়ে ধর্মীয় সন্ত্রাসবাদের পেছনে পাকিস্তানের শাসকদের এই মদতের পিছনে একটি আন্তর্জাতিক যোগাযোগ স্পষ্ট হয়ে উঠছে।
মোদ্দা কথাটা এই— নিজেদের মধ্যে দ্বন্দ্বে জড়িত দুই মহাশক্তিধর রাষ্ট্র, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও চিন, আশ্চর্যজনকভাবে দুজনেই পাকিস্তানকে নানাভাবে সাহায্য করে চলেছে। সেইসব সহায়তা কাজে লাগিয়ে, এবং তাদেরই প্রচ্ছন্ন প্রশ্রয়ে, পাকিস্তানের শাসকরা নিজেদের এক দুর্বৃত্ত রাষ্ট্রে পরিণত করেছে।
সেই দুর্বৃত্ত রাষ্ট্রটি এবার পহেলগাঁওয়ে যে ভয়ঙ্কর কাণ্ডটি ঘটাল, তার প্রেক্ষিতে যদি আমরা ভারত রাষ্ট্রের ভূমিকা বিশ্লেষণ করি, তাহলে এক অদ্ভুত অভিমুখ উঠে আসে। সন্ত্রাসবাদের দিক থেকে কাশ্মির যে একটি অত্যন্ত স্পর্শকাতর অঞ্চল, তা সারা বিশ্বের জানা। তা সত্ত্বেও, প্রচুর প্রত্যক্ষদর্শীর বিবরণ থেকে উঠে এসেছে যে কাশ্মিরের প্রায় প্রতিটি গুরুত্বপূর্ণ অঞ্চলে সেনা মোতায়েন ছিল, শুধুমাত্র ব্যতিক্রম ছিল বৈশারন উপত্যকা— ঠিক যেখানে ঘটনাটি ঘটেছে। অর্থাৎ ঘটনাস্থলে কোনও পাহারার ব্যবস্থা ছিল না। পহেলগাঁওয়ের এই নয়নাভিরাম উপত্যকাটি এমন এক স্থান, যেখানে পায়ে হেঁটে কিংবা ঘোড়ার পিঠে চেপেই পর্যটকদের পৌঁছতে হয়; মোটরগাড়ি যাওয়ার উপযুক্ত রাস্তা সেখানে নেই। সেদিন হামলার এক ঘণ্টা পরে সেনা পৌঁছায়। তার আগেই ঘোড়াচালক ও স্থানীয় বাসিন্দারা আহতদের হাসপাতালে নিয়ে যেতে শুরু করে দিয়েছিলেন। প্রশ্ন উঠবেই— এই ধরনের একটি অরক্ষিত ও দূরবর্তী অঞ্চলে পর্যাপ্ত নিরাপত্তা ব্যবস্থা ছাড়াই পর্যটকদের যাওয়ার অনুমতি কেন দেওয়া হয়েছিল?
এটা তো বহুদিনের জানা কথা— দুর্বৃত্ত রাষ্ট্র পাকিস্তান ধর্মের নামে আত্মত্যাগের খোলস পরিয়ে জঙ্গিদের ব্যবহার করে বারবার এই ধরনের জঘন্য হামলা ঘটিয়েছে, এবং ভবিষ্যতেও ঘটাতে পারে। সেক্ষেত্রে এই ধরনের হঠকারী সিদ্ধান্ত কি সন্ত্রাসবাদকে আমন্ত্রণ জানানো নয়?
হামলা হতে পারে— এই নিয়ে কোনও ন্যূনতম পূর্বাভাস ভারতীয় গোয়েন্দা দপ্তরের কাছে ছিল না এ-কথা বিশ্বাস করা কঠিন। তা হলে প্রশ্ন হচ্ছে— এই ঘটনাটি কি এড়ানো গেল না, না কি ইচ্ছাকৃতভাবে এড়ানো হল না? এটিকে শুধুই গোয়েন্দা ব্যর্থতা বলে কি এড়িয়ে যাওয়া যায়? না কি এর পেছনে কোনও অজানা বা অস্বীকারযোগ্য কারণ লুকিয়ে রয়েছে? ঘটনার দিন বা তার আগে কিছুদিন ধরেই বৈশারন উপত্যকা প্রহরাহীন ছিল কেন— এই প্রশ্নের নিরপেক্ষ তদন্ত হওয়া একান্ত জরুরি।
পাশাপাশি, সন্ত্রাসবাদীরা ২৬টি পরিবারের পুরুষ সদস্যদের ধর্ম জিজ্ঞাসা করে করে গুলি করেছে— সিনেমা-ধর্মী এই ঘটনা অভূতপূর্ব। আর এমন কাজ সম্পন্ন করতে নিশ্চয়ই তাদের বেশ খানিকটা সময় লেগেছে। অন্যান্য ঘটনার মতো তারা ঘটনাস্থলে এসে এলোপাথাড়ি গুলি চালিয়ে মানুষ খুন করে সরে পড়েনি; বরং রীতিমতো পরিকল্পিতভাবে, একটি নির্দিষ্ট উদ্দেশ্য নিয়ে তারা সেখানে এসেছে এবং সময় নিয়েই সেই উদ্দেশ্য বাস্তবায়ন করেছে। অর্থাৎ, ওই অঞ্চলের ভৌগোলিক অবস্থান, নিরাপত্তার নিদারুণ শৈথিল্য এবং সেনাবাহিনীর গতিবিধি সম্পর্কে সম্পূর্ণ ওয়াকিবহাল না হয়ে সন্ত্রাসবাদীরা এমন দুঃসাহসিক অভিযান চালিয়েছে— এই ধারণা নিছকই বাতুলতা।
তর্কের খাতিরে যদি এই ঘটনাটিকে ভারত রাষ্ট্রের গোয়েন্দা দপ্তরের গাফিলতি হিসেবে মেনেও নিই, তাহলেও এই ত্রুটি নিঃসন্দেহে অমার্জনীয়। দেশের মানুষের প্রতি ন্যূনতম মানবিক দায়িত্ববোধ থাকলে রাষ্ট্রনেতাদের উচিত এই ২৬টি পরিবারের কাছে মাথা নত করে ক্ষমা চাওয়া।
এই তথাকথিত “ত্রুটি”ই দুর্বৃত্ত রাষ্ট্র পাকিস্তানকে এই ঘৃণ্যতম ঘটনাটি ঘটানোর একটি সুবর্ণ সুযোগ এনে দিয়েছে। আর যখন আজকের দুনিয়ায় কোনও কিছুই রাজনৈতিক উদ্দেশ্য ছাড়া ঘটছে না, তখন প্রশ্নটা জোর গলায় তোলা একান্ত প্রাসঙ্গিক— এই ঘটনায় আমরা কি কোনও গোপন রাজনৈতিক উদ্দেশ্য দেখতে পাচ্ছি না?
ব্যাপারটা যেন অনেকটা এমন— আমি আমার বাড়ির নিরাপত্তা এমন শিথিল করে রাখলাম যাতে চুরি হয়, চোরের সঙ্গেই আমার গোপন ষড় রইল, সে ধরা পড়ল না, আর তারপর ইন্সিওরেন্স কোম্পানি থেকে মোটা টাকার ক্ষতিপূরণ আদায় করলাম।
দুই.
আমরা দেখলাম, পহেলগাঁও সন্ত্রাসের কয়েকদিনের মধ্যেই একের পর এক এমন কিছু ঘটনা ঘটল, যার ফলে দেশের প্রায় নব্বই শতাংশ মানুষকে এক ধরনের যুদ্ধ-উন্মাদনায় খেপিয়ে তোলা হল। শুধু তাই নয়, এই যুদ্ধ-উন্মাদনাকে হিন্দুত্ববাদী জাতীয়তাবাদের সঙ্গে মিলিয়ে দেওয়া হল। পহেলগাঁওয়ে সন্ত্রাসবাদীরা ধর্মপরিচয় জেনে হিন্দুদের হত্যা করেছে— এই ঘটনাকে কেন্দ্র করে নাটকীয়ভাবে ইসলামোফোবিয়াকে দেশের এক বৃহৎ জনগোষ্ঠীর মনে গেঁথে দেওয়ার নিপুণ চেষ্টা করা হল।
বিগত কয়েক দশক ধরে আমেরিকা ও ইজরায়েল একযোগে ইসলামোফোবিয়া ছড়িয়ে এসেছে। সেই ইসলামোফোবিয়ার সুযোগেই গাজায় প্রতিদিন অসংখ্য মুসলমানকে হত্যা করা হচ্ছে, রোহিঙ্গাদের ঘরছাড়া করা হচ্ছে। পহেলগাঁও সন্ত্রাস সেই ইসলামোফোবিয়াকে ভারতের মাটিতেও প্রোথিত করতে সহায়ক হল। এই প্রসঙ্গে লক্ষ করার বিষয়, পহেলগাঁওয়ের ঘটনার পর ভারতের প্রতি সহানুভূতির প্রথম বার্তা আসে ইজরায়েল থেকে— একটি সন্ত্রাসবাদী রাষ্ট্র, যে প্রতিদিন প্যালেস্টাইনের মুসলিম জনগণকে হত্যা করে চলেছে।
এবার যদি আমরা ঘটনাপ্রবাহগুলো ধাপে ধাপে দেখি, তাহলে একটার সঙ্গে আরেকটার সংযোগ এতটাই স্পষ্ট হয়ে ওঠে যে, সবকিছুই নিছক ‘সমাপতন’ বলে মেনে নেওয়া দুষ্কর হয়ে দাঁড়ায়। মনে হয়, এর পেছনে কোথাও যেন একটি সুসংগঠিত কার্য-কারণ সম্পর্ক কাজ করছে। তবে কেউ যদি এই অভিযোগ প্রমাণ করতে বলেন, আমি অকপটে স্বীকার করব যে রাষ্ট্রবিজ্ঞান বা সমরবিজ্ঞানে আমার তেমন প্রাতিষ্ঠানিক জ্ঞান নেই। কিন্তু কাণ্ডজ্ঞানের নিরিখে বিচার করলে এতগুলি ঘটনার মধ্যে এক ধরনের আন্তঃসম্পর্ক যে আছে, তা অস্বীকার করা কঠিন।
পাকিস্তানকে দুর্বৃত্ত রাষ্ট্র বলা এবং তার এই বর্বর কাজের জন্য আন্তর্জাতিক নিন্দা দাবি করা এক বিষয়; আর পহেলগাঁওয়ে ইসলামি জঙ্গিরা হামলা চালিয়েছে বলে সমস্ত মুসলিম ধর্মাবলম্বীকেই সন্ত্রাসবাদী ধরে নেওয়া সম্পূর্ণ ভিন্ন বিষয়। এই দুয়ের মধ্যকার তফাতটা ভারতের বহু মানুষের মন থেকে মুছে দেওয়ার জন্য এক পরিকল্পিত প্রচেষ্টা হয়েছে। দুঃখজনকভাবে, সেই প্রচেষ্টা অনেকখানি সফলও হয়েছে। একটি রাষ্ট্র চরম অন্যায় করেছে, তার বিরুদ্ধে আত্মরক্ষামূলক প্রত্যাঘাতের কথা ভাবা যেতেই পারে। কিন্তু সেই প্রত্যাঘাতের রূপ ও পদ্ধতি নিয়ে ভিন্নমত থাকা অস্বাভাবিক নয়। ‘অপারেশন সিঁদুর’-এর মাধ্যমে যে পথে ভারত সরকার এগিয়েছে, সেটাই একমাত্র পথ— এই দাবিও প্রশ্নাতীত নয়। তবে আত্মরক্ষার স্বার্থে প্রতিক্রিয়া জানানোর অধিকার অবশ্যই ভারত রাষ্ট্রের আছে।
তবে দুটি রাষ্ট্রের দ্বন্দ্বকে হিন্দু বনাম মুসলিমের দ্বন্দ্বে নামিয়ে আনা— এটা নিছক অন্যায় নয়, একেবারে চরম আপত্তিকর বলে আমি মনে করি।
অল্পদিনের মধ্যেই নির্বাচন আসছে। আমরা জানি, ইদানীং আমাদের দেশের নির্বাচনগুলিতে হিন্দুত্ববাদ কীভাবে ইসলামোফোবিয়াকে একটি কার্যকর হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করে। আর পহেলগাঁওয়ের ঘটনার প্রেক্ষিতে যদি ইসলামোফোবিয়া আরও বিস্তৃত করা যায়, তাহলে নির্বাচনে কাদের লাভ হবে— তা-ও আমরা বুঝি।
অতএব, এই প্রতিটি বিষয়কে যদি আমি সূত্রাকারে সাজাই, তাহলে এক ধরনের প্যাটার্ন, এক ধরনের কার্য-কারণ সম্পর্কের ইঙ্গিত পাওয়া অসম্ভব কিছু নয়। জানি না, এটা আমার অতি-সন্দেহবাতিক কি না। হতে পারে আমি ভুল। তবু, এই সন্দেহটা আমি মন থেকে কিছুতেই সরাতে পারছি না।
এই প্রসঙ্গে একটি ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার কথা বলি। আমার পরিচিত এক যুবক, খুবই সচেতন, পহেলগাঁওয়ের ঘটনার দিন রাতে আমাকে ফোন করে বলল, আশীষদা, আজকের ঘটনার পর আমি কিন্তু কিছুটা হলেও মুসলিমবিরোধী হয়ে পড়লাম। আমি অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলাম, কেন বলো তো? আমাকে একটু বুঝিয়ে বলো, কেন তুমি এই ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে মুসলিমবিরোধী হয়ে পড়লে? হ্যাঁ, যারা ওই জঘন্য কাণ্ডটা ঘটিয়েছে তারা একটি ইসলামি মৌলবাদী সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত। কিন্তু ধরো, যদি কোনও র্যাডিকাল হিন্দু সংগঠন মুসলিমদের ধরে ধরে খুন করে, তাহলে আমরা কি গোটা হিন্দু সম্প্রদায়ের ওপর ক্রোধান্বিত হব? তা তো আমরা হব না। সাধারণ মানুষের সঙ্গে গোঁড়াবাদী সংগঠনের কী সম্পর্ক? গোঁড়াবাদী সংগঠনকে আমরা অবশ্যই ঘৃণা করব, তাদের প্রতি বিরূপ হব, কারণ তারা একটি চরম অন্যায় কাজ করেছে। ইসলামি সংহতির নাম করেই তারা কাজটা করেছে, অথচ সারা পৃথিবীর প্রায় প্রতিটি সংখ্যাগুরু মুসলিম ধর্মাবলম্বী দেশের সরকারই এর তীব্র নিন্দা করেছে, একমাত্র তুরস্ক ছাড়া। তাও, সেখানকার সাধারণ মানুষ কী ভাবেন, তা-ও আমরা কতটুকু জানি? ভারতবর্ষে পাকিস্তানের চেয়ে বেশি সংখ্যক মুসলমান বাস করেন, তাঁরাও এই ঘটনার বিরুদ্ধে সর্বসমক্ষে নিন্দা জানিয়েছেন। অতএব ইসলাম বা ইসলামি সংহতির সঙ্গে এই ঘটনার কোনও সম্পর্ক নেই। অর্থাৎ পহেলগাঁও ঘটনার নিন্দা করতে গিয়ে আমরা যদি মুসলিমবিদ্বেষে আক্রান্ত হয়ে পড়ি, তাহলে আমরা অজান্তেই ইসলামোফোবিয়ার খপ্পরে পড়ে গেলাম। কতিপয় ইসলামি মৌলবাদীর সঙ্গে গোটা মুসলিম সমাজকে এক করে দেখা মোটেই ঠিক নয়। সন্ত্রাসবাদীদের হাতে নিহত ভারতীয় পরিবারের সদস্যরা তো দেখেননি!
ছেলেটি আশা করি আমার কথা বুঝেছিল। কিন্তু এখন যে পরিস্থিতি তৈরি করা হয়েছে, তাতে এই সহজ কথাটা সাধারণ মানুষকে বোঝানো সত্যিই খুব কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছে।
পরে ভাবছিলাম, এই যুক্তিবাদী ছেলেটি যদি কিছুমাত্র ভাবনাচিন্তা না করেই মুসলিমবিরোধিতাকে এভাবে বরণ করে নিতে পারে, তাহলে তো আমাদের দেশের অনেক সাধারণ হিন্দুই এই প্রোপাগান্ডার শিকার হতে পারেন। গোটা দেশের কথা না ভেবে যদি আমি কেবল আমার প্রতিবেশী শহুরে নাগরিক মধ্যবিত্ত বাঙালি হিন্দুদের কথাই ভাবি, তা হলেও দেখি— পহেলগাঁওয়ের ঘটনার পর অনেকের কথাতেই মুসলমানদের প্রতি একপ্রকার খোলাখুলি বিরূপতার সুর।
আসলে আমাদের মনের মধ্যে আগে থেকেই একটি সুপ্ত মুসলিমবিদ্বেষের বীজ লুকিয়ে ছিল, আজ সুযোগ বুঝে নানা ঘটনায় সেই বিদ্বেষ মাথাচাড়া দিয়ে উঠছে। অথচ আমাদের একবারও মনে পড়ছে না— পহেলগাঁওয়ে যখন বর্বর জঙ্গিরা গুলি চালাচ্ছিল, তখন তাঁদের হাত থেকে বন্দুক কেড়ে নেওয়ার চেষ্টা করে যে সামান্য টাট্টুওয়ালা প্রাণ হারালেন, তিনিও ধর্মপরিচয়ে একজন মুসলমান। তিনি অসীম সাহসের সঙ্গে সহনাগরিকদের বাঁচাতে এগিয়ে এসে তাঁর মানবিক দায়িত্ব পালন করছিলেন।
আরেকটু ভালো করে পরিস্থিতি বিচার করলে দেখা যাবে, দেশের অধিকাংশ সাধারণ মানুষ ঠিক সেটাই ভাবছে, যা গণমাধ্যম তাদের ভাবাতে চাইছে। এই গোটা ঘটনা বা দুর্ঘটনার একটি বড় দিক হল ভারতীয় গণমাধ্যম— বিশেষত ইলেকট্রনিক মিডিয়ার— চরম দেউলিয়াপনা। মাঝে মাঝে মনে হচ্ছে, সন্ত্রাসবাদীদের আক্রমণের মতোই ঘৃণ্য এই ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে ভারতীয় মিডিয়ার আচরণ।
আমাদের মূল ধারার মিডিয়ার প্রায় সমস্তটাই এই মুহূর্তে বিষাক্ত। শুধু ‘বিষাক্ত’ বললে পুরো ছবিটা বোঝানো যায় না; এদের এমন ভূমিকার পেছনে যে গোপন স্বার্থ কাজ করছে, সেটাও সামনে আনা দরকার। মিডিয়া যে কীভাবে ও কত টাকার বিনিময়ে নিজেকে বিকিয়ে দিয়েছে, তার প্রকৃত মাত্রা আমরা আন্দাজও করতে পারি না। বিজেপি-আরএসএস লবি, অর্থাৎ বর্তমান সরকার, মিডিয়াকে কেনার জন্য বিপুল অঙ্কের টাকা ব্যয় করেছে— এবং তা হয়েছে শাসক-ঘনিষ্ঠ দুর্নীতিগ্রস্ত শিল্পপতিদের হাত ধরে। সাংবাদিকেরা বিপুল অর্থের বিনিময়ে নিজেদের বিবেক বিকিয়ে দিয়েছেন। তাঁরা ব্যক্তিগতভাবে সবাই ঘোর হিন্দুধর্মাবলম্বী— এমনটা মনে করার কোনও কারণ নেই। এঁরা শুধুই অর্থ-ধর্মে বিশ্বাসী। ফলে ভারতীয় মিডিয়ার একটি বড় অংশ আসলে দেশদ্রোহী।
সন্ত্রাসবাদীরা সীমানা পেরিয়ে পাকিস্তান থেকে এসেছিল, কিন্তু এইসব নীতিহীন সাংবাদিক ও মিডিয়া-মালিকেরা আমাদেরই দেশের বাসিন্দা, আমাদের সহনাগরিক। পাকিস্তানের চেয়ে বড় বিপদ আজ আমাদের ঘরের মধ্যে— এই মিডিয়া। বন্দুকধারী সন্ত্রাসবাদীদের আমরা চিনে নিয়েছি, কিন্তু প্রাইমটাইমে ফিটফাট বেশভূষায় সেজে-থাকা জনগণের শত্রু এই সাংবাদিকদের যদি আমরা চিনে না নিতে পারি, এদের মুখোশ খুলে না দিতে পারি, তাহলে আমাদের মুক্তি নেই।
শুধুমাত্র টিআরপি বাড়িয়ে মুনাফা অর্জনের লক্ষ্যে এরা মিথ্যে, অর্ধসত্য ও বানানো তথ্য পরিবেশন করে চলেছে— হিন্দু ও মুসলমানের মধ্যে সাম্প্রদায়িক বিভাজন বাড়ানোর রাজনৈতিক খেলায় অবলীলায় যোগ দিচ্ছে। ভারতবর্ষে সংবাদমাধ্যমের নৈতিকতার মান এত নিচে নেমে যেতে এর আগে কখনও দেখেছি বলে মনে পড়ে না।
পাশাপাশি এটাও ভাবার বিষয়, মিডিয়া যা ইচ্ছে বলছে, আর দেশের সাধারণ মানুষ বিনা প্রশ্নেই সেসব বিশ্বাস করে হিস্টিরিয়ায় ভুগছে কেন? নাৎসি জমানায় ঠিক একই ঘটনা ঘটেছিল জার্মানিতে। জার্মানির মতো এত উচ্চশিক্ষিত একটি দেশ, ইউরোপের সবচেয়ে শিক্ষিত দেশ বলা যেতে পারে, সেখানে হিটলার যখন ইহুদিবিদ্বেষ ছড়াচ্ছিলেন, হাজার হাজার মানুষ সেই প্রচারে বিশ্বাস করেছিল। এটাই প্রচারের ক্ষমতা— একটি মিথ্যাকে বারবার নানা ভঙ্গিতে বললে তা ধীরে ধীরে ‘সত্যি’ হয়ে ওঠে। সাধারণ মানুষের মনস্তত্ত্বের জটিলতা ও দ্বিধাকে কাজে লাগিয়েই গেস্টাপোরা জনগণকে প্রতারিত করতে পেরেছিল। আর আজ তো প্রযুক্তি আরও অনেক বেশি শক্তিশালী। নানারকম ডিজিটাল মাধ্যম মানুষের মননের আরও গভীর স্তরে পৌঁছে তাকে প্রভাবিত করছে।
আমরা অপপ্রচারের প্রসঙ্গ তুললেই গোয়েবেলসের কথা বলি। কিন্তু আজকের মিডিয়া এমন সব মনস্তাত্ত্বিক অস্ত্র ব্যবহার করছে, যে গোয়েবেলসকেও আজ এদের কাছে শিশু বলে মনে হয়। আমরা যারা নিজেদের সচেতন, যুক্তিবাদী মানুষ বলে ভাবি, তারাও কার্যত এই পরিস্থিতির বিরুদ্ধে কোনও কার্যকর প্রতিরোধ গড়ে তুলতে পারছি না। আমাদের মতো সংখ্যালঘু কণ্ঠস্বর আজ ভীষণভাবে অসহায়। আমরা যা বলছি তা পৌঁছচ্ছে আমাদেরই মতো অল্প কয়েকজনের কাছে, নিজেদের গণ্ডির মধ্যেই ঘুরপাক খাচ্ছে, বৃহত্তর সমাজে তার কোনও বাস্তব প্রভাব ফেলতে পারছে না।
তিন.
অন্যদিকে, ভারতীয় মিডিয়ার এই আবোল-তাবোল প্রচারের মাঝেও যখন আমি ভারতীয় সেনার প্রেস ব্রিফিংগুলোর দিকে তাকাই, তখন তাদের অনেক বেশি পেশাদার মনে হয়। অপারেশন সিঁদুর-এর সময় প্রতিদিন ভারতের বিদেশ মন্ত্রক ও সেনাবাহিনী যৌথভাবে সাংবাদিকদের সামনে প্রেস ব্রিফিং করেছে। তারা নিজেরা সরাসরি যুদ্ধক্ষেত্রে থাকলেও, কখনও মনে হয়নি যে তারা যুদ্ধ-উন্মাদনায় বিন্দুমাত্র ইন্ধন দিচ্ছে। বরং, একদিন এক সাংবাদিক যখন প্রশ্ন করলেন, ভারতীয় সেনা কি কিরানা হিলসে পাকিস্তানের পারমাণবিক অস্ত্রভাণ্ডারে আঘাত হেনেছে, তখন এক নৌসেনা কর্মকর্তা হাস্যরসের সঙ্গে উত্তর দিলেন— পাকিস্তানের পারমাণবিক অস্ত্রভাণ্ডার কোথায় আছে, তা তাঁদের জানা ছিল না; সাংবাদিককে এই তথ্য দেওয়ার জন্য ধন্যবাদ। তবে না, তাঁরা সেসব জায়গায় কোনও আঘাত করেননি।
মিডিয়ার লাগাতার যুদ্ধ-উন্মাদনা তৈরি করার চেষ্টা আর পাশাপাশি ভারতীয় সেনাবাহিনীর এই সংযত, পেশাদার ‘non-escalatory approach’— এই বৈপরীত্য স্পষ্ট করে দেয় যে, আমাদের রাষ্ট্রব্যবস্থার অভ্যন্তরে কোথাও একটা দ্বন্দ্ব রয়েছে। একদিকে যখন গণমাধ্যম, শাসকদল ও রাজনৈতিক নেতারা যুদ্ধকে ঘিরে একপ্রকার হিন্দুত্ববাদী উন্মাদনায় ইন্ধন জোগাচ্ছেন, তখন রাষ্ট্রেরই এক গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ— ভারতীয় সেনাবাহিনী— সেই চরমপন্থী ভাষ্য থেকে দূরত্ব বজায় রেখে চলেছে। এই সমগ্র ঘটনাক্রমে এটিই একটি ব্যতিক্রমী ও প্রশংসাযোগ্য দিক।
পাশাপাশি লক্ষ করার মতো বিষয়, ভারতীয় সেনার এই সাংবাদিক সম্মেলন পরিচালনা করেছেন দুই মহিলা অফিসার— সেনাবাহিনীর লেফটেন্যান্ট কর্নেল সোফিয়া কুরেশি এবং বায়ুসেনার উইং কম্যান্ডার ভূমিকা সিংহ। অপারেশন সিঁদুরের প্রতিদিনের ঘটনাপ্রবাহের বিবরণ আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমের সামনে তুলে ধরেছেন এই দুই সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের নারী— একজন জন্মসূত্রে মুসলিম, অন্যজন দলিত ও শিখ। মনে হয়, সেনা কর্তৃপক্ষ এই দুই অফিসারকে সচেতনভাবেই বেছে নিয়েছেন। যখন দেশের মিডিয়ায় হিন্দুত্ববাদী প্রচারের ঝড় চলছে, তখন সেনার পক্ষ থেকে এটি কি একপ্রকার সূক্ষ্ম রাজনৈতিক বার্তা নয়? অর্থাৎ রাষ্ট্রের একটি স্তম্ভ, সংকটকালে যে ভাষায় কথা বলছে, তা ‘ন্যাশনাল ন্যারেটিভ’ বলে প্রতিষ্ঠিত প্রচারের সঙ্গে সাযুজ্য রাখছে না।
গত এক দশক ধরে একদিকে মিথ্যাচার আর ধর্মীয় উন্মাদনার মাধ্যমে আমাদের গণতান্ত্রিক কাঠামোয় যে ধারাবাহিক ফাটল ধরানোর চেষ্টা চলছে, সুখের কথা, সেখান থেকে ভারতীয় সেনাবাহিনী এখনও নিজেদের দূরে রেখেছে। তাদের এক নিজস্ব অবস্থান আছে, যা শাসকের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। আরএসএস-নিয়ন্ত্রিত বিজেপি সরকারের কাছে এটি নিশ্চয়ই কোনও সুখবর নয়। আমাদের দেশে এরকম কোনও ঘটনা আগে ঘটেছে বলে মনে করতে পারছি না। আমার মতে, বর্তমান পরিস্থিতিতে এটাই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ইঙ্গিত।
উপসংহার
পরিশেষে বলা যায়, অস্ত্রব্যবসা আজকের পৃথিবীর সবচেয়ে মুনাফাজনক শিল্পক্ষেত্রগুলির একটি। এটি এমন একটি ব্যবসা, যেখানে পণ্যের দাম বা নৈতিকতা নিয়ে খুব একটা প্রশ্ন ওঠে না। ফলে উপমহাদেশে ভারত-পাকিস্তান সংঘাতের মতো যে-কোনও যুদ্ধপরিস্থিতি ইজরায়েল, চিন, আমেরিকা, ফ্রান্স কিংবা রাশিয়ার মতো অস্ত্রপ্রস্তুতকারক দেশগুলির কাছে এক বিরাট লাভের সম্ভাবনা তৈরি করে। সামান্য সামরিক উত্তেজনাই তাদের অস্ত্র বিক্রির পথ প্রশস্ত করে দেয়— যুদ্ধ শুরু হলে তো তাদের জন্য তা স্বর্গীয় পরিস্থিতি।
এই যুদ্ধের ফলে শুধু মুনাফা নয়, এইসব দেশ অস্ত্রের একটা লাইভ টেস্টিং গ্রাউন্ড-ও পেয়ে যায়— নতুন প্রযুক্তি ও অস্ত্রের কার্যকারিতা মাঠে প্রয়োগ করে দেখে নেওয়ার এক কার্যত বিনামূল্যে সুযোগ। অপারেশন সিঁদুর শুরু হতেই প্রথম প্রতিক্রিয়া আসে ইজরায়েলের কাছ থেকে— যে নিজেই একটি সন্ত্রাসবাদী রাষ্ট্র। তাদের ‘নৈতিক সমর্থন’-এর অন্তরালে থাকে অস্ত্রবিক্রেতার হাসি।
অতএব, ভারত-পাকিস্তান সংঘাত বা বিশ্বের যে-কোনও রাষ্ট্রের সামরিক দ্বৈরথকে আজকের জটিল পুঁজিবাদী বিশ্ববাস্তবতায় বিচার করা জরুরি। যুদ্ধ কেবল ‘রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত’ নয়, এটি এক বৃহৎ বাণিজ্যচক্রের কেন্দ্রে থাকা প্রণোদনাও বটে।
যুদ্ধ কখনওই কাম্য নয়। আশার কথা, ভারত সরকারের ‘ঘোষিত অবস্থান’ এখন পর্যন্ত তেমনটাই বলছে— সরকার জানিয়েছে, ভারত যুদ্ধ চায় না। আমরাও এই সন্ত্রাসবাদী আক্রমণকে হিন্দু-মুসলমানের দ্বন্দ্ব হিসেবে না দেখে, বরং ভারত রাষ্ট্রের ওপর একটি ব্যর্থ রাষ্ট্রের মদতপুষ্ট সন্ত্রাসী আক্রমণ হিসেবে দেখতে চাই। তবে এই আবেগ যেন কোনওভাবেই যুদ্ধোন্মাদনায় রূপ না নেয়। রবীন্দ্রনাথ আমাদের বারবার স্মরণ করিয়ে দেন— দেশপ্রেম ভালো জিনিস, কিন্তু জাতীয়তাবাদী উন্মাদনা মোটেই ভালো জিনিস নয়।
এক্ষেত্রে দেশের তথাকথিত বামপন্থীদের দায়িত্ব ছিল এই উন্মাদনার বিরুদ্ধে যুক্তিনিষ্ঠ রাজনৈতিক প্রতিরোধ গড়ে তোলা। কিন্তু তাঁরা সেই ভূমিকায় প্রায় অনুপস্থিত। তাঁদের কাছ থেকে কার্যকর প্রতিবাদ বা প্রতিরোধের প্রত্যাশা প্রায় ছেড়েই দিয়েছি।
আজকের এই চরম দক্ষিণপন্থী পরিবেশে দায়িত্ববান, বিবেকী প্রতিস্পর্ধী বিরুদ্ধ কণ্ঠস্বর আর খুঁজে পাই না— এই আক্ষেপ রয়ে গেল।
আশীষ বাবু আপনার লেখাটা খুবই সুচিন্তিত। একদম ঠিক বলেছেন। রাজনৈতিক নেতারা বিপাকে পড়লে যুদ্ধ যুদ্ধ খেলেন এটাও যেমন সত্য সেনাবাহিনীও সুযোগ বুঝে কোপমেরে ক্ষমতা দখল করে সেটাও সত্য। কিন্তু আমাদের দেশে প্রাগ্য সেনা নায়করা বার বার দেখিয়েছেন কখন যুদ্ধে যেতে হয় আর কখন থামতে হয়। এবারের যুদ্ধে জেনারেল চৌহানের ক্ষয় ক্ষতি নিয়ে বক্তব্য খুবই সুচিন্তিত।
আপনি প্রশ্ন তুলেছেন আমাদের অন্তরদেশীয় সুরক্ষা এই রকম একটা দৃষ্টিনন্দন স্থানে কি করে এরকম বেহাল অবস্থায় ছিলো। ধর্মের কম্বল দিয়ে কি সব ঢাকা যায়।