
দেবাশিস মিথিয়া
একজন সৈনিক তার জীবনের ঝুঁকি নিয়ে যুদ্ধক্ষেত্রে যায়। সে জানে না সে প্রাণ নিয়ে ফিরবে কিনা। তেমনই যুদ্ধপরবর্তী পরিস্থিতিতে দেশের গরিব মানুষ জানে না তার দুবেলা খাবার জুটবে কিনা। তাই আসুন, সকলে মিলে সেই যুদ্ধের বিভীষিকাকে ঘৃণা করি এবং শান্তির পক্ষে দাঁড়াই। আসুন সমস্বরে গেয়ে উঠি "যুদ্ধটাকে চিতায় তোলো যুদ্ধটাকেই কবর দাও।"
গত ২২ এপ্রিল, কাশ্মিরের পহেলগামে পাকিস্তান-মদতপুষ্ট জঙ্গিদের হামলায় ২৬ জন সাধারণ পর্যটক প্রাণ হারান। উপত্যকার শান্ত মাটি সেদিন নিরীহ পর্যটকদের রক্তে লাল হয়ে গিয়েছিল। ঘটনার বীভৎসতায় সারা দেশ স্তম্ভিত। এই ঘটনা জাতীয় নিরাপত্তার ক্ষেত্রে এক বড়সড় ব্যর্থতা হিসেবে চিহ্নিত হয়। এই বীভৎস ঘটনায় সাধারণ মানুষের মনে ক্ষোভের সঞ্চার হয়। দেশবাসী ভিন্ন ভিন্ন মতে বিভক্ত হয়ে পড়েন। কেউ সরকারকে দোষারোপ করেন, কেউবা সরকারের পক্ষ নিয়ে এখুনি প্রত্যাঘাতের পক্ষে ছিলেন।
জনসাধারণের ক্ষোভ প্রশমিত করতে এবং শত্রুদের সমুচিত জবাব দেওয়ার লক্ষ্যে, এই নৃশংস ঘটনার রেশ কাটতে না কাটতেই ভারতীয় সেনাবাহিনী নিয়ন্ত্রণরেখা পেরিয়ে পাকিস্তানের ন-টি জঙ্গি ঘাঁটি গুঁড়িয়ে দেয়। এই পদক্ষেপ স্বাভাবিকভাবেই ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে দীর্ঘদিনের চাপা উত্তেজনাকে এক নতুন ও বিপজ্জনক স্তরে পৌঁছে দিয়েছে। সীমান্তের নীরবতা ভেঙে এখন চাপা গুঞ্জন শোনা যাচ্ছে, যা ক্রমশ একটি অঘোষিত যুদ্ধের দামামার রূপ নিচ্ছে বলে মনে করছেন অনেকে।
পহেলগামের হামলা নিঃসন্দেহে মানবতার চরম লঙ্ঘন। সন্ত্রাসবাদীরা যুগে যুগে সাধারণ মানুষকে ভয় দেখিয়ে নিজেদের ঘৃণ্য উদ্দেশ্য চরিতার্থ করতে চেয়েছে, এবং এই হামলাও তার ব্যতিক্রম নয়। এই জঘন্য অপরাধের তীব্র নিন্দা জানানোর পাশাপাশি, ভারত সরকারের পক্ষ থেকে দ্রুত এবং কঠোর পদক্ষেপের প্রত্যাশা ছিল। জঙ্গি ঘাঁটিগুলিতে আক্রমণ সেই জন-আকাঙ্ক্ষারই প্রতিফলন।
এই প্রেক্ষাপটে, পাকিস্তানের সংবাদমাধ্যম জইশ-ই-মহম্মদ প্রধান মাসুদ আজহারকে উদ্ধৃত করে ভারতীয় সেনার প্রত্যাঘাতে তার পরিবারের দশজন সদস্য নিহত হওয়ার খবর জানিয়েছে, যার মধ্যে তার বড় বোন, তার স্বামী, স্ত্রী এবং এক ভাইপোও রয়েছে বলে উল্লেখ করা হয়েছে। এছাড়াও, তার কয়েকজন সহযোগীও নিহত হয়েছে বলে সংবাদমাধ্যমসূত্রে খবর। যদিও ভারতীয় সেনাবাহিনীর পক্ষ থেকে এই বিষয়ে সরাসরি কোনও নিশ্চিত খবর দেওয়া হয়নি, তবে বুধবার সাংবাদিক সম্মেলনে বায়ুসেনা কমান্ডার ব্যোমিকা সিং স্পষ্ট ভাষায় জানান যে পহেলগামে সন্ত্রাসী হামলার প্রত্যাঘাত হিসাবে ভারতীয় সেনা পাকিস্তানের বিভিন্ন সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর ঘাঁটি লক্ষ্য করে হামলা চালিয়েছে এবং মোট ন-টি শিবির ধ্বংস করা হয়েছে। কমান্ডার ব্যোমিকা সিং জোর দিয়ে বলেন, এই হামলা শুধুমাত্র সন্ত্রাসবাদীদের শিবির লক্ষ্য করেই চালানো হয়েছে। এই ঘটনাপ্রবাহ পরিস্থিতিকে আরও জটিল করে তুলেছে।
তবে ভারতের এই সামরিক প্রত্যাঘাতের সুদূরপ্রসারী প্রভাব নিয়ে প্রশ্ন ওঠা স্বাভাবিক। পাকিস্তান এই আক্রমণকে কীভাবে দেখবে এবং এর প্রতিক্রিয়া কী হতে পারে, তা এখন আলোচনার প্রধান বিষয়। শুধু আঞ্চলিক স্তরেই নয়, এই ঘটনাপ্রবাহ আন্তর্জাতিক মহলেও গভীর উদ্বেগের জন্ম দিয়েছে। দুই পরমাণু শক্তিধর দেশের মধ্যে ক্রমবর্ধমান সামরিক উত্তেজনা বিশ্বশান্তির জন্য এক সুস্পষ্ট হুমকি।
ভারত বরাবরই সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে ‘জিরো টলারেন্স’ নীতি অনুসরণ করে এসেছে। পহেলগামে হামলার পর সেই নীতি আরও কঠোরভাবে বাস্তবায়িত হওয়ার ইঙ্গিত স্পষ্ট। তবে প্রশ্ন হল, শুধুমাত্র সামরিক পদক্ষেপের মাধ্যমেই কি এই দীর্ঘমেয়াদি সমস্যার সমাধান সম্ভব? নাকি এর পাশাপাশি কূটনৈতিক এবং রাজনৈতিক স্তরেও আলোচনার একটি সুস্থ বাতাবরণ তৈরি করা জরুরি?
বর্তমানে অনেকের মনেই একটি প্রশ্ন বারবার প্রতিধ্বনিত হচ্ছে— ভারত কি সত্যিই যুদ্ধের পথে হাঁটছে? সীমান্তে যেভাবে সামরিক প্রস্তুতি ও তৎপরতা পরিলক্ষিত হচ্ছে, তাতে সেই আশঙ্কাকে সম্পূর্ণভাবে উড়িয়ে দেওয়া যায় না। তবে ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়, যুদ্ধ কখনওই কোনও সমস্যার স্থায়ী ও কার্যকরী সমাধান বয়ে আনতে পারেনি। বরং, যুদ্ধ উভয়পক্ষের জন্যই বিপুল প্রাণহানি ও অপূরণীয় অর্থনৈতিক বিপর্যয় ডেকে আনে। এই অবস্থায় ভারত ও পাকিস্তানের রাষ্ট্রনেতাদের দায়িত্ব অনেক। তাঁদের শান্ত মাথায় আলোচনার মাধ্যমে সমস্যার সমাধান খুঁজতে হবে। সাধারণ মানুষ শান্তি ও উন্নতি চায়, যুদ্ধের ভয়াবহতা কারও কাম্য নয়। তবে এটাও ঠিক, জঙ্গিরা সহজে হার মানবে না। যারা তাদের মদত দেয়, তাদের খুঁজে বের করে কঠিন শাস্তি দেওয়া উচিত। একই সঙ্গে কাশ্মিরের সাধারণ মানুষের বিশ্বাস ফিরিয়ে আনা এবং তাদের নিরাপত্তা দেওয়া সরকারের প্রধান কাজ।
আন্তর্জাতিক স্তরে বিভিন্ন দেশ এই ঘটনায় তাদের মতামত স্পষ্টভাবে জানিয়েছে। ভারতের পাশে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স, জার্মানি, অস্ট্রেলিয়া, ইতালি, কানাডা, ইজরায়েল, রাশিয়া ও কাতারের আমির তাদের সমর্থন ব্যক্ত করেছে এবং সন্ত্রাসবাদের নিন্দা জানিয়েছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র পাকিস্তানকে অবিলম্বে তাদের ভূখণ্ড থেকে সন্ত্রাসবাদী কার্যকলাপ নির্মূল করার জন্য জোরালো আহ্বান জানিয়েছে। ইজরায়েল সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে ভারতের লড়াইয়ে পূর্ণ সমর্থন জ্ঞাপন করে বলেছে যে সন্ত্রাসীদের কোনও নিরাপদ আশ্রয় থাকা উচিত নয়। শান্তির বার্তা দিয়েছে রাষ্ট্রসঙ্ঘ ও চিন। রাষ্ট্রসঙ্ঘের মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে ক্রমবর্ধমান সামরিক উত্তেজনা নিয়ে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন এবং উভয় রাষ্ট্রকে সর্বোচ্চ সংযম প্রদর্শনের আহ্বান জানিয়েছেন। অন্যান্য বহু রাষ্ট্রও উত্তেজনা হ্রাস এবং কূটনৈতিক আলোচনার মাধ্যমে এই সংকটের একটি স্থায়ী সমাধানের উপর জোর দিয়েছে।
এই আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়ার প্রেক্ষাপটে, পাকিস্তানের পক্ষ থেকে ভারতের এই সামরিক পদক্ষেপকে ‘আন্তর্জাতিক আইনের সুস্পষ্ট লঙ্ঘন’ এবং ‘ন্যক্কারজনক আগ্রাসন’ হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়েছে। তারা এর সমুচিত জবাব দেওয়ার হুমকি দিয়েছে এবং আন্তর্জাতিক স্তরে বিষয়টি উত্থাপন করেছে।
দেশের অভ্যন্তরেও এই স্পর্শকাতর পরিস্থিতিতে বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও বিশিষ্টজনেরা তাঁদের নিজস্ব মতামত সুস্পষ্টভাবে ব্যক্ত করেছেন। পহেলগামে নারকীয় হামলার পর দেশের রাজনৈতিক দল ও বিশিষ্টজনেরা ভিন্ন মেরুতে অবস্থান করছেন। ক্ষমতাসীন দল জঙ্গি ঘাঁটিগুলিতে প্রত্যাঘাতকে সময়োচিত পদক্ষেপ বলছে এবং পাকিস্তানকে কঠোর হুঁশিয়ারি দিয়েছে। তাদের দৃঢ় বিশ্বাস, জাতীয় নিরাপত্তা ও সার্বভৌমত্বের সুরক্ষা সুনিশ্চিত করার জন্য এই ধরনের কঠোর পদক্ষেপ অপরিহার্য ছিল। তারা পাকিস্তানকে সন্ত্রাসবাদীদের মদত দেওয়া বন্ধ করার জন্য কঠোরতম হুঁশিয়ারি দিয়েছে এবং প্রয়োজনে আরও কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণের কথা ঘোষণা করেছে। যদিও তারা সরাসরি যুদ্ধের ঘোষণা করেনি, তবে তাদের মনোভাব স্পষ্ট। প্রধান বিরোধী দল কংগ্রেস হামলার তীব্র নিন্দা জানালেও সরকারকে সংযম রাখতে এবং কূটনৈতিক সমাধানে জোর দিয়েছে। তবে জাতীয় নিরাপত্তার প্রশ্নে তারা সরকারের পাশে থাকার দৃঢ় অঙ্গীকার ব্যক্ত করেছে। আঞ্চলিক দলগুলির মধ্যে কেউ সরকারের সমর্থনে সোচ্চার, আবার কেউ শান্তির পক্ষে কথা বলছে।
বিশিষ্ট বুদ্ধিজীবী, শিক্ষাবিদ ও প্রাক্তন আমলাদের মধ্যেও দুটি স্পষ্ট ধারা দেখা যায়। একাংশ কঠোর সামরিক পদক্ষেপকে সমর্থন করছেন, মনে করছেন দুর্বলতা দেখালে শত্রুরা বাড়বে। অন্যদিকে, একটি প্রভাবশালী অংশ যুদ্ধের ভয়াবহতার কথা তুলে ধরে আলোচনার মাধ্যমে স্থায়ী সমাধানের কথা বলছেন। প্রাক্তন সামরিক ও প্রশাসনিক কর্তারা একটি সমন্বিত জাতীয় নীতির উপর জোর দিচ্ছেন।
পহেলগামের ঘটনা ও প্রত্যাঘাত একটি স্পর্শকাতর পরিস্থিতি তৈরি করেছে। আন্তর্জাতিক মহল উদ্বিগ্ন, এবং দেশের অভ্যন্তরে যুদ্ধ ও শান্তির প্রশ্নে দ্বিধাবিভক্তি স্পষ্ট। এই পরিস্থিতিতে ভারত ও পাকিস্তানের নেতৃত্বকে দায়িত্বশীল পদক্ষেপ নিতে হবে। যারা যুদ্ধের পক্ষে সওয়াল করছেন তারা কি একবার ভেবে দেখেছেন, সীমান্তের দু-পারে দুজন সৈনিক দাঁড়িয়ে, দেশভাগের রেখা তাদের দুজনকে আলাদা করেছে ঠিকই, কিন্তু তারা হয়তো জানেও না যে তাদের মধ্যে বন্ধুত্বের বীজ লুকানো আছে। আসলে, “তারা এদেশ ভাগ করেনি, দেয়নি কোথাও খড়ির দাগ”। এই বিভেদ তো তৈরি করেছে কিছু নেতা, যাদের ব্যক্তিগত স্বার্থ আর ক্ষমতার লড়াইয়ের শিকার হয়েছে সাধারণ মানুষ ও সেনারা। আমরা টেবিল-চেয়ারে বসে যুদ্ধের কারণ আর ন্যায্যতা নিয়ে অনেক তাত্ত্বিক আলোচনা করি, আন্তর্জাতিক সীমানা মানা বা না-মানার মতো গভীর দার্শনিক বিতর্কে অংশ নিই, অনেকে হয়তো মনে করি যুদ্ধ কেবলই রাজনৈতিক চাল, অস্ত্রব্যবসার একটি অজুহাত। এসব তাত্ত্বিক আলোচনা ঠান্ডা ঘরে সম্ভব। কিন্তু যারা যুদ্ধক্ষেত্রে নিজেদের জীবন বিপন্ন করছেন, তাঁরা এই ধরনের বিতর্কে অংশ নেওয়ার সুযোগ পান না। “দুই কাঁধে দুই বন্দুক আর বুলেট বেশি খাবার কম”— এই কঠিন বাস্তবতাই তাঁদের জীবনের একমাত্র সঙ্গী। দূরে বসে রাজধানীর নেতারা হয়তো হিসেব কষেন কার লাভ আর কার ক্ষতি, কিন্তু সীমান্তে পড়ে থাকে শুধু “দেশপ্রেমের নজির, এই চিতা আর ওই কবর।”
একজন সৈনিক তার জীবনের ঝুঁকি নিয়ে যুদ্ধক্ষেত্রে যায়। সে জানে না সে প্রাণ নিয়ে ফিরবে কিনা। তেমনই যুদ্ধপরবর্তী পরিস্থিতিতে দেশের গরিব মানুষ জানে না তার দুবেলা খাবার জুটবে কিনা। তাই আসুন, সকলে মিলে সেই যুদ্ধের বিভীষিকাকে ঘৃণা করি এবং শান্তির পক্ষে দাঁড়াই। আসুন সমস্বরে গেয়ে উঠি “যুদ্ধটাকে চিতায় তোলো যুদ্ধটাকেই কবর দাও।”
পরিস্থিতির উপর গোটা বিশ্ব নজর রাখছে। তাই আশা করা যায়, ভারত ও পাকিস্তান দুই দেশই বুঝে শুনে কাজ করবে। এমন কিছু করবে না যাতে পরিস্থিতি আরও খারাপ হয়। আমরা সবাই চাই যুদ্ধের বাজনা যেন না বাজে। ভবিষ্যৎ প্রজন্মের সুরক্ষার জন্য শান্তির পথই একমাত্র পথ।
*মতামত ব্যক্তিগত
ভালো লেখা। সময়োচিত।