
অমর্ত্য বন্দ্যোপাধ্যায়
এই লেখা প্রকাশের সময় অবধি থুনবার্গ-সহ অন্যান্য মানবাধিকার কর্মীরা মুক্ত হবেন কিনা জানা নেই। তবে মুক্ত হলেও যে আখেরে তাঁদের নিজ নিজ দেশে বলপূর্বক ফেরত পাঠানো হবে এই বিষয়টি ইজরায়েল প্রশাসনের তরফে নিশ্চিত করা হয়েছে। ফ্রিডম ফ্লোটিলার অভিযানেই যে এমন মানবাধিকার আন্দোলনের পরিসমাপ্তি ঘটল তা বলা চলে না। তবু আন্তর্জাতিক মানবাধিকার আন্দোলনের ক্ষেত্রে এই ঘটনা যে এক বিরাট পশ্চাদপসরণ তা স্বীকার করতে দ্বিধা নেই। একই সঙ্গে এই ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে বিশ্বব্যাপী বৃহত্তর নাগরিক প্রতিবাদের চূড়ান্ত অনুপস্থিতিও লক্ষণীয় এবং আশঙ্কাজনক। চলমান সমস্ত মানবাধিকার আন্দোলনের প্রসঙ্গে, এবং ভবিষ্যতে তাদের পরিধিতে উঠে আসতে চলা সম্ভাব্য প্রবল নেতিবাচক প্রভাবগুলির প্রসঙ্গেও এই বিষয়টি অন্যতম আশঙ্কার কারণ হয়ে উঠতে চলেছে— এমন পূর্বাভাসে আর ভ্রান্তি দেখি না
এর চেয়ে উপযুক্ত কোনও শিরোনাম মেলেনি। আমরা সত্যিই ক্লীব হয়ে বেঁচে আছি। ফ্রিডম ফ্লোটিলাতে ইজরায়েলি সেনার আক্রমণ, ও তৎপরবর্তীতে জাহাজে থাকা মানবাধিকার কর্মীদের অপহরণ এবং এই লেখা তৈরির সময় অবধি তাঁদের অজ্ঞাতস্থানে বন্দি করে রাখা— আজকের পৃথিবীতে দাঁড়িয়ে এক অত্যন্ত স্বাভাবিক ঘটনা। এতে বিস্মিত হওয়াটাই, বিস্ময়ের।
মানবতার সৌভাগ্য বলতে মাদলিন জাহাজের উপর সামরিক হামলা হয়নি। ক্ষেপণাস্ত্র আক্রমণ হয়নি, এমনকি সরাসরি প্রাণঘাতী বলপ্রয়োগেরও কোনও ঘটনা ঘটেনি; আর ঠিক সে-কারণেই এর প্রভাব মানবেতিহাসের নিরিখে সুদূরপ্রসারী হয়ে উঠতে চলেছে। মানবাধিকারের সমস্ত ধারণার প্রতি নিখুঁত ও শীতল অবজ্ঞা; স্বাভাবিক ও ভাবলেশহীন নীরব তাচ্ছিল্য, ও উপেক্ষার এক যুগান্তকারী উদাহরণ হয়ে থাকবে এই মাদলিন জাহাজ অপহরণের ঘটনা। অবশ্য, ইজরায়েল-প্যালেস্তাইন সংঘাতের পরিপ্রেক্ষিতে ‘মানবাধিকার’ ধারণাটিই বহুদিন এক চূড়ান্ত বদ-রসিকতায় পরিণত। নতুন করে সেই বিষয়গুলিকে স্মরণ করিয়ে দিতেও ক্লান্তি বোধ হয়। কেবল ইজরায়েল কেন— আজ ধিক এই মানবসভ্যতাকেও, সংখ্যাগরিষ্ঠের নীরবতাই এমন প্রত্যেক গণহত্যার সপক্ষে নীরব সম্মতি জানায়। নীরবতা এখানে সম্মতিরই সমতুল। এর অন্য কোনও বিকল্প ব্যাখ্যা নেই।
আমরা প্রত্যেকে নিজ নিজ পরিসরে সংখ্যালঘুর অধিকারকে পদদলিত করি। আত্মবীক্ষার প্রয়োজনে এই স্বীকারোক্তি থাকুক। সংখ্যালঘুর অপরায়ন আমাদের জিনগত বৈশিষ্ট্য। বহুযুগের ব্যবধানে, নিয়ত অভ্যাসের মাধ্যমে, এমন প্রবৃত্তি আমাদের মানসিকতায় জারিত। তাই একনায়ক, স্বৈরতন্ত্রী, যুদ্ধবাজ খলনায়কেরা যখনই কোনও কল্পিত ‘অপর’-এর ধারণার প্রতি সমাজকে প্ররোচিত করেন, তখনই দেখা যায় বুর্জোয়া মধ্যবিত্ত সমাজের বড় অংশই (যাঁরা অধিকাংশ ক্ষেত্রে আর্থ-সামাজিক পরিস্থিতির কারণে অস্তিত্ববাহী সমাজের নীতি-নির্ধারকও বটে) নিঃসঙ্কোচে সেই প্ররোচনার সপক্ষে সম্মতি যোগান। ঠিক যেমনভাবে অতীতে হিটলারের ইহুদি-বিদ্বেষ সংখ্যাগুরু জার্মান সমাজে মান্যতা পেয়েছে, আজ ইজরায়েলি জনতার সংখ্যাগুরু অংশও একই মনস্তত্ত্বে ‘ফিলিস্তিন’কে নিশ্চিহ্ন করার পক্ষে। এমনকি এর পাশাপাশি আমাদের দেশেও প্রতিবেশী দেশগুলিকে নিশ্চিহ্ন করার সপক্ষে জোরালো জনমত বড় অল্প নয়। সংখ্যালঘু মুসলমানদের প্রতি বিদ্বেষ, সে কথা আর আলাদা করে নাই বা বললাম। চোখের বদলে চোখ, দাঁতের বদলে দাঁত, এই নীতিই এখনও গড়পড়তা মানবতার বৈশিষ্ট্যকে চিহ্নিত করে।
তবু এর পরবর্তীতেও, সংখ্যালঘু মানবাধিকার কর্মী হিসেবে আমাদের প্রতিবাদ নিবন্ধনের দায় বর্তায়। যেমনভাবে গুয়াতেমালার কবি রেনে ক্যাস্তিলোর কবিতার প্রসঙ্গ টেনে সাহিত্যিক এনগুগি ওয়া থিয়োঙ্গো তাঁর প্রবন্ধে বলেছিলেন,
“আমরা যেন প্রত্যেক প্রতিকূল সংগ্রামেও, সেগুলিকে শিক্ষা ও অভিজ্ঞতার উৎস হিসাবে ব্যবহার করতে পারি। ন্যায়বিচারের সপক্ষে আন্দোলন যেন আমাদের সহজাত অভ্যাসে পরিণত হয়।”[1]
মাদলিন জাহাজ অপহরণের ঘটনা প্রতীকী। এমনকি মাদলিন জাহাজের মাধ্যমে গাজায় ত্রাণসামগ্রী পৌঁছানোর পরিকল্পনাটিও প্রতীকী উদ্যোগ ভিন্ন আর কিছু ছিল না। আর ঠিক সে-কারণেই এই প্রতীকী প্রতিবাদ ও প্রতীকী পালটা অপহরণের ঘটনা শীতল ও উদ্বেগজনক। আন্তর্জাতিক জলসীমায় মাদলিন জাহাজ অপহরণ ও নিখুঁত অবজ্ঞায় জাহাজে থাকা গ্রেটা থুনবার্গ-সহ মানবাধিকার কর্মীদের আটক করা, সমগ্র বিষয়টির এই অস্বাভাবিক ‘স্বাভাবিকতা’ই বুঝিয়ে দেয় মানবাধিকারের ধারণাটি আধুনিক পৃথিবীতে ক্রমশই কতখানি উপেক্ষার হয়ে দাঁড়িয়েছে। গুরুত্বপূর্ণ রাষ্ট্রনায়কদের একজনকেও এই ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে প্রতিবাদ জানাতে দেখা যায়নি। মাদলিন জাহাজ ত্রাণ নিয়ে গাজায় পৌঁছলে, সেই অংশের দুর্ভিক্ষতাড়িত মানুষের যন্ত্রণার যে বিরাট উপশম ঘটত তাও নয়। কেবল, গাজায় তাঁদের দখলদারির বিপক্ষে সামান্যতম প্রতিবাদও যে ইজরায়েল সহ্য করবে না, বরং নিখুঁত পেশাদারিত্বে ও ভাবলেশহীনতায় সেই প্রতিবাদকে উপেক্ষা করবে, ও একইসঙ্গে তাকে সন্তর্পণে, প্রয়োজনে বলপূর্বক অপসারণ করবে— তদুপরি এর বিরুদ্ধে সামান্যতম পালটা জনমত, বা বৃহত্তর প্রতিবাদ গড়ে তোলার কোনও সুযোগও পূর্বের প্রতিবাদীরা পাবে না— এই সমস্ত ঘটনাক্রমকেই এক অতি-স্বাভাবিক ঘটনাক্রম হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে আজ নেতানিয়াহু প্রশাসন সফল।
আমরা তো ক্লীব হয়ে বেঁচে আছি।
আমরা বহুদিন এমন ক্লীবত্ব বরণ করেছি অবলীলায়।
এই লেখা প্রকাশের সময় অবধি থুনবার্গ-সহ অন্যান্য মানবাধিকার কর্মীরা মুক্ত হবেন কিনা জানা নেই। তবে মুক্ত হলেও যে আখেরে তাঁদের নিজ নিজ দেশে বলপূর্বক ফেরত পাঠানো হবে এই বিষয়টি ইজরায়েল প্রশাসনের তরফে নিশ্চিত করা হয়েছে। ফ্রিডম ফ্লোটিলার অভিযানেই যে এমন মানবাধিকার আন্দোলনের পরিসমাপ্তি ঘটল তা বলা চলে না। তবু আন্তর্জাতিক মানবাধিকার আন্দোলনের ক্ষেত্রে এই ঘটনা যে এক বিরাট পশ্চাদপসরণ তা স্বীকার করতে দ্বিধা নেই। একই সঙ্গে এই ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে বিশ্বব্যাপী বৃহত্তর নাগরিক প্রতিবাদের চূড়ান্ত অনুপস্থিতিও লক্ষণীয় এবং আশঙ্কাজনক। চলমান সমস্ত মানবাধিকার আন্দোলনের প্রসঙ্গে, এবং ভবিষ্যতে তাদের পরিধিতে উঠে আসতে চলা সম্ভাব্য প্রবল নেতিবাচক প্রভাবগুলির প্রসঙ্গেও এই বিষয়টি অন্যতম আশঙ্কার কারণ হয়ে উঠতে চলেছে— এমন পূর্বাভাসে আর ভ্রান্তি দেখি না। নিজেকে বড় অসহায় মনে হয়।
শিশুহন্তা ইজরায়েল ও নেতানিয়াহু প্রশাসনের বিরুদ্ধে কোনও সমালোচনাই যথেষ্ট নয়। যে অকল্পনীয় নিষ্ঠুরতায় গাজা ভূখণ্ডকে কার্যত নিশ্চিহ্ন করে দেওয়া হয়েছে, একের পর এক স্কুলে-হাসপাতালে ক্ষেপণাস্ত্র হামলা হয়েছে, (সুযোগসন্ধানী কিছু গোষ্ঠীর ভুয়ো-সংবাদ ছড়ানোর ঘটনাকে মনে রেখেও বলছি), মানবাধিকার ও ইজরায়েল এই দুইটি শব্দ কোনওদিন পাশাপাশি বসতে পারে না।
আমাদের দুর্ভাগ্য সারা পৃথিবীতে দক্ষিণপন্থা তথা মানবাধিকার-বিরোধী রাজনৈতিক দল, সম্প্রদায় বা গোষ্ঠীগুলিরই এখন নিরঙ্কুশ উত্থানের সময়। এই প্রসঙ্গে ভগৎ সিংয়ের কথার সূত্র ধরেই বলব, কেবল বিপ্লব কেন— সার্থক গণতন্ত্রেরও প্রথম শর্ত হল নির্বাচকমণ্ডলীর উপযুক্ত শিক্ষায় শিক্ষিত হওয়া। সেই শিক্ষা কেবল প্রথাগত অর্থ-আহরণকারী বিদ্যায় ডিগ্রি অর্জনের মাধ্যমে স্বীকৃত নয়। সেই শিক্ষার অর্থ মানবতার শিক্ষা, মানবেতিহাসের শিক্ষা, মানবাধিকারের শিক্ষা। নির্বাচকমণ্ডলীর পাশাপাশি প্রগতিশীল, ধর্মনিরপেক্ষ মানসিকতার মানুষদেরও কোনও কোনও ক্ষেত্রে এই বিষয়ে ঘাটতি দেখা যায়। প্রবল সংকটের সময় অধিকাংশ ক্ষেত্রেই দেখা যায়, তাঁদের একজোট না হতে পারার কারণে ট্রাম্প, নেতানিয়াহু অথবা নরেন্দ্রভাইদের মতো একেকজন ক্ষমতার উচ্চাসনে বসেন। আন্দোলন, একতা, ও সংগঠন এই তিনের একত্রীকরণ ভিন্ন সামগ্রিক পৃথিবীতে ফ্রিডম ফ্লোটিলার মতো এমন একেকটি উদ্যোগ কেবল প্রতীক বা রূপকের পরিসরেই সীমাবদ্ধ থাকবে। আমাদের কোন্দলের সুযোগ নিয়ে ক্ষমতায় আসীন হবেন নেতানিয়াহুরাই।
ইজরায়েল-প্যালেস্তাইন প্রশ্নে অন্ধকারের চেয়েও অন্ধকারের অভিমুখে আমরা বহুদিনই অগ্রসর হয়েছি। আগ্রাসক ইজরায়েলের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ কেবল নাগরিক পরিসরে নয়, সরকারি পরিসরেও যাতে উঠে আসে— সেই দায় আমাদেরই উপরে বর্তায়। কারণ আমরাই এখনও সরকার নির্বাচন করি। অন্যদিকে নির্বিচার হত্যা, হাসপাতালে বোমাবর্ষণ ও শিশুহত্যার বিপরীতে, ভৌগোলিকভাবে এত দূরে অবস্থান করেও আমরা যদি হামাসের সন্ত্রাস, ইহুদি গণহত্যার ইতিহাস অথবা বাইবেল-বর্ণিত দেবস্থানের কল্পকাহিনির সপক্ষে ক্রমশ আমাদের যুক্তিজাল সাজাই— ফ্রিডম ফ্লোটিলা অপহরণের বিরুদ্ধে সৎ প্রতিবাদ জানানোর নৈতিক অধিকারও তখন আমাদের অনেকেরই আর থাকে না। নেতানিয়াহুর পাশপাশি আজ সেই সব মানুষের প্রতিও আমার ঘৃণা ও অবজ্ঞা রেখে গেলাম।
মুক্ত প্যালেস্তাইনের সপক্ষে
স্বাধীন প্যালেস্তাইনের সপক্ষে
জায়নবাদী সন্ত্রাসের বিপক্ষে
আমাদের সংগ্রাম অক্ষয় হোক!
[1] থিয়োঙ্গো, এনগুগি ওয়া। ডিকলোনাইজিং দ্য মাইন্ড। ১৯৮৬।