ট্রাম্পের অভিবাসন নীতিতে লস এঞ্জেলেস রণক্ষেত্র: ছড়াচ্ছে বিক্ষোভের আঁচ

দেবাশিস মিথিয়া

 


নিজদেশে ভালোভাবে বেঁচে থাকার সুযোগের অভাবেই মানুষ নিজের জন্মভূমি ছেড়ে ভিনদেশে পাড়ি জমান। এই দেশ ছাড়ার মধ্যে রয়েছে এক গভীর অসহায়তা। মেক্সিকো থেকে জীবন ও জীবিকার সন্ধানে আমেরিকায় ছুটে আসা মানুষেরা কিংবা নিজ ভিটে থেকে বিতাড়িত হয়ে আশ্রয় খোঁজা রোহিঙ্গা শরণার্থীরা, সবাই একই বাস্তবতার শিকার। সিরিয়ার যুদ্ধবিধ্বস্ত মানুষ, যাঁরা ইউরোপের বিভিন্ন দেশে আশ্রয় খুঁজছেন, অথবা আফ্রিকার সাহেল অঞ্চলের মানুষ যারা জলবায়ু পরিবর্তন ও সংঘাতের কারণে বাস্তুচ্যুত হয়ে ভিন্ন দেশের দিকে ঝুঁকছেন, তাঁরাও একই কঠিন পরিস্থিতির মুখোমুখি। যখন বেঁচে থাকার মৌলিক অধিকারটুকু অনিশ্চিত হয়ে পড়ে, তখন অভিবাসনই হয়ে দাঁড়ায় একমাত্র পথ। এই পরিস্থিতিতে উন্নত দেশগুলোর কাছ থেকে আরও বেশি মানবিকতা আশা করা কি অন্যায়?

 

মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের কঠোর অভিবাসন নীতি বাস্তবায়ন করতে গিয়ে লস এঞ্জেলেসে শুরু হয়েছে ব্যাপক বিক্ষোভ। সেই বিক্ষোভ সামলাতে পেন্টাগন লস এঞ্জেলেসে সেনা মোতায়েন করেছে। তবে এই সিদ্ধান্ত ফেডারেল সরকার (কেন্দ্র সরকার) এবং ক্যালিফোর্নিয়ার সরকারের (রাজ্য সরকার) মধ্যে এক নজিরবিহীন সংঘাত সৃষ্টি করেছে। শুক্রবার, জুন ৬, ২০২৫-এ লস এঞ্জেলেসে অভিবাসনবিরোধী বিক্ষোভের সময় ফেডারেল কর্মকর্তাদের কাজে বাধা দেওয়ার অভিযোগে শ্রমিক নেতা ডেভিড হুয়ের্তা গ্রেপ্তার হন, যা এই বিতর্কের পারদ আরও কয়েকগুণ বাড়িয়ে দিয়েছে। ক্যালিফোর্নিয়ার গভর্নর গ্যাভিন নিউসম প্রতিরক্ষা সচিবের এই পদক্ষেপকে “বিপথগামী আচরণ” আখ্যা দিয়ে তীব্র নিন্দা করেছেন। রাজ্যের পক্ষ থেকে এই সেনা মোতায়েনকে সার্বভৌমত্বের লঙ্ঘন হিসেবে দেখা হচ্ছে এবং এর বিরুদ্ধে আইনি পদক্ষেপের প্রস্তুতি চলছে। এই ঘটনা শুধু অভিবাসন নীতির বিরোধ নয়, বরং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কেন্দ্র ও রাজ্য সরকারের ক্ষমতার ভারসাম্য নিয়ে একটি গভীর সাংবিধানিক বিতর্কের জন্ম দিয়েছে।

 

বিক্ষোভের উৎস ও বিস্তার

লস এঞ্জেলেসে এই অস্থিরতার সূত্রপাত ঘটে ৬ জুন, শুক্রবার। ওইদিন ফেডারেল অভিবাসন কর্তৃপক্ষ ৪০ জনেরও বেশি অভিবাসীকে গ্রেপ্তার করে। ট্রাম্প প্রশাসনের এই কঠোর পদক্ষেপের প্রতিবাদে বিক্ষোভকারীরা সেদিনই একটি ফেডারেল ডিটেনশন সেন্টারের বাইরে জড়ো হন এবং আটক অভিবাসীদের মুক্তির দাবিতে সোচ্চার হন। এই প্রতিবাদ দ্রুতই লস এঞ্জেলেসের অন্যান্য অংশে ছড়িয়ে পড়ে। সোমবার এই বিক্ষোভ চতুর্থ দিনে পৌঁছায়, যেখানে হাজার হাজার মানুষ সিটি হলের কাছে একটি সমাবেশে অংশ নেন। বিক্ষোভকারীদের মধ্যে একজনকে পুলিশের দিকে মলোটভ ককটেল ছুড়তে দেখা যায় এবং একজন মোটরসাইকেল আরোহী মোটরসাইকেল দিয়ে পুলিশি ব্যারিকেডে আঘাত হানছেন সে ছবিও চোখে পড়েছে। ঘটনাগুলি মানুষের ক্ষোভের তীব্র বহিঃপ্রকাশ।

 

ট্রাম্পের আমেরিকা ফার্স্টঅভিবাসন নীতি

প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের অভিবাসন নীতি তার ২০১৭ সালের প্রথম মেয়াদ থেকেই অত্যন্ত বিতর্কিত এবং আগ্রাসী। ২০১৬ সালের নির্বাচনী প্রচারণার সময় থেকেই তিনি “আমেরিকা ফার্স্ট” স্লোগানকে সামনে রেখে অভিবাসন ব্যবস্থায় আমূল পরিবর্তনের অঙ্গীকার করেছিলেন। ২০২৫ সালের ২০ জানুয়ারি তাঁর দ্বিতীয় মেয়াদ শুরু হওয়ার পর তিনি “Protecting the American People Against Invasion” এবং “Restricting The Entry of Foreign Nationals”-এর মতো নতুন নির্বাহী আদেশ জারি করে তার নীতিকে আরও কঠোর করেছেন।

 

ট্রাম্পের অভিবাসন নীতির মূল লক্ষ্য

এক. ট্রাম্পের অভিবাসন নীতির মূলে রয়েছে অবৈধ অভিবাসীদের অনুপ্রবেশ সম্পূর্ণ বন্ধ করা এবং আমেরিকায় বসবাসকারী অবৈধ অভিবাসীদের আমেরিকা থেকে বিতাড়িত করা। এই লক্ষ্য পূরণের জন্য মেক্সিকো সীমান্তে বিশাল প্রাচীর নির্মাণ এবং ডিটেনশন সেন্টারের ক্ষমতা বাড়ানোর সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। গণ-দেশত্যাগ (Mass Deportation) অভিযান চালানোর পরিকল্পনা হয় যেখানে বছরে ১০ লাখ অবৈধ অভিবাসীকে বিতাড়িত করার লক্ষ্য রেখেছেন।

দুই. ট্রাম্প দক্ষিণ সীমান্ত দিয়ে আসা অভিবাসীদের “অনুপ্রবেশকারী” (Invaders) হিসেবে দেখেন, যা তাঁর মতে দেশের জাতীয় নিরাপত্তার জন্য বিপদ। তাই তিনি চান যে-কোনও মূল্যে এই ‘অনুপ্রবেশ’ বন্ধ করতে এবং রাজ্যগুলিকে এর থেকে রক্ষা করতে।

তিন. অবৈধ অভিবাসন ছাড়াও, তিনি আইনি অভিবাসন প্রক্রিয়াতেও কঠোরতা আনতে চান। এর মধ্যে রয়েছে ভিসা যাচাইকরণ কঠোর করা, ২০২৫ সালের ১৯ ফেব্রুয়ারির পর জন্মসূত্রে নাগরিকত্ব সীমিত করা (যেখানে পিতা-মাতার বৈধ অবস্থান আবশ্যক হবে), আশ্রয় আবেদন প্রক্রিয়া কঠিন করা এবং মানবিক সহায়তার কিছু প্রোগ্রাম বাতিল করা।

চার. সংবিধানের চতুর্থ অনুচ্ছেদের, চতুর্থ ধারার উল্লেখ করে ট্রাম্প মনে করান, ফেডারেল সরকারের সাংবিধানিক দায়িত্ব রয়েছে রাজ্যগুলিকে ‘অনুপ্রবেশ’ থেকে রক্ষা করার। লস এঞ্জেলেসে সামরিক বাহিনী মোতায়েনের সিদ্ধান্ত তাঁর এই দৃষ্টিভঙ্গিরই প্রতিফলন।

 

ফেডারেল সেনা মোতায়েন বনাম ক্যালিফোর্নিয়ার সার্বভৌমত্ব

ফেডারেল সম্পত্তি বাঁচাতে ও অভিবাসন এজেন্টদের[1] রক্ষা করতে আমেরিকান সরকার লস এঞ্জেলেসে প্রায় ১০০০ ন্যাশনাল গার্ড এবং ৭০০ মেরিন সেনা মোতায়েন করেছে। মার্কিন নর্দার্ন কমান্ড জানিয়েছে, এই সেনারা আইন প্রয়োগের দায়িত্ব পালন করবে না।

তবে, ক্যালিফোর্নিয়া এই পদক্ষেপকে রাজ্যের সার্বভৌমত্বের উপর সরাসরি আক্রমণ হিসেবে দেখছে। গভর্নর গ্যাভিন নিউসম দৃঢ়ভাবে বলেছেন যে ক্যালিফোর্নিয়ার স্থানীয় আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলো পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে সম্পূর্ণ সক্ষম। কেন্দ্রীয় সরকারের অতিরিক্ত হস্তক্ষেপের কোনও প্রয়োজন নেই। লস এঞ্জেলেস পুলিশপ্রধান জিম ম্যাকডোনেল বলেছেন যে, কেন্দ্রীয় সরকার তাদের সঙ্গে কোনও আলোচনা না করে হঠাৎ করে সেনা পাঠিয়ে পরিস্থিতিকে আরও জটিল করে তুলেছে। এত পুলিশের জন্য রসদ জোগানো এবং তাদের সঠিকভাবে কাজে লাগানো দুটোই সমস্যার। কারণ এ-ব্যাপারে তাদের আগাম কোনও প্রস্তুতি বা পরিকল্পনা ছিল না। এটি কেন্দ্রীয় সরকারের একতরফা চাপিয়ে দেওয়া সিদ্ধান্ত।

ক্যালিফোর্নিয়ার অ্যাটর্নি জেনারেল রব বন্টা ইতিমধ্যেই ট্রাম্প প্রশাসনের বিরুদ্ধে মামলা করার হুমকি দিয়েছেন। ক্যালিফোর্নিয়া আরও জানিয়েছে যে এই সেনা মোতায়েনের ঘটনা রাজ্যগুলির নিজস্ব ক্ষমতা এবং অধিকারকে খর্ব করেছে, যা দশম সংশোধনী[2] দ্বারা সুরক্ষিত। ক্যালিফোর্নিয়া মনে করছে যে কেন্দ্রীয় সরকার এমন একটি পদক্ষেপ নিয়েছে যা তাদের সাংবিধানিক ক্ষমতা ছাড়িয়ে গেছে এবং রাজ্যগুলোর অধিকার কেড়ে নিয়েছে। এটি এমন একটি পরিস্থিতি যেখানে রাজ্য এবং ফেডারেল সরকারের মধ্যে ক্ষমতার সীমানা নিয়ে বিতর্ক দেখা দিয়েছে।

 

ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট ও সাংবিধানিক বিতর্ক

এই সংঘাতের গভীরে রয়েছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেল কাঠামো এবং কেন্দ্র ও রাজ্য সরকারের ক্ষমতার ভারসাম্যের এক দীর্ঘস্থায়ী বিতর্ক। ঐতিহাসিকভাবে, ১৮৭৮ সালে পাশ হওয়া “পসে কমিতাটাস অ্যাক্ট” (Posse Comitatus Act) অনুযায়ী সামরিক বাহিনীকে দেশের অভ্যন্তরে আইন প্রয়োগের ভূমিকা থেকে বিরত রাখার কথা। আমেরিকান গৃহযুদ্ধের পর পুনর্গঠন পর্বে যখন ফেডারেল সামরিক বাহিনীকে দক্ষিণি রাজ্যগুলোতে আইন প্রয়োগের কাজে ব্যবহার করা হত তখন এই আইনটি চালু হয়েছিল। সামরিক হস্তক্ষেপের অপব্যবহার রুখতে এই আইনটি আনা হয়েছিল।

তবে, “ইনস্যুরেকশন অ্যাক্ট” (Insurrection Act) এই আইনের ব্যতিক্রম হিসেবে কাজ করে, যা রাষ্ট্রপতিকে অভ্যন্তরীণ বিদ্রোহ বা অস্থিরতার পরিস্থিতিতে সামরিক বাহিনী মোতায়েনের ক্ষমতা দেয়। ট্রাম্প প্রশাসন বিক্ষোভকে ‘বিদ্রোহ’ হিসেবে আখ্যায়িত করে এই আইনের সম্ভাব্য প্রয়োগের ইঙ্গিত দিয়েছে, যদিও তিনি এখনও এটি আনুষ্ঠানিকভাবে প্রয়োগ করেননি।

ক্যালিফোর্নিয়ার মামলা এবং ট্রাম্প প্রশাসনের পাল্টা যুক্তি এই ঐতিহাসিক আইনি বিতর্ককে আবারও জনসমক্ষে নিয়ে এসেছে। এটি কেবল একটি আঞ্চলিক সংকট নয়, বরং মার্কিন সংবিধানের যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোর মধ্যে ক্ষমতা, অধিকার এবং নিয়ন্ত্রণের একটি মৌলিক পরীক্ষা।

 

টেক্সাসের ঘটনা: ফেডারেল-রাজ্য সংঘাতের আরেকটি দৃষ্টান্ত

ক্যালিফোর্নিয়ার লস এঞ্জেলেসে অভিবাসন-বিরোধী অভিযানের প্রতিবাদে যে বিক্ষোভ শুরু হয়েছিল, তার ঢেউ ৯ জুন টেক্সাসের অস্টিনেও ছড়িয়ে পড়ে। বিক্ষোভকারীরা হাতে ব্যানার ও পতাকা নিয়ে পুলিশের মুখোমুখি হয়ে “আইসিই নিপাত যাক” (Down with ICE) স্লোগান দিতে থাকে। বিক্ষোভ মিছিল ফেডারেল ভবনের কাছে পৌঁছালে সেখানে ভাঙচুরের ঘটনা ঘটে বলে জানা গেছে। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে অস্টিন পুলিশ এই সমাবেশকে “অবৈধ” ঘোষণা করে বিক্ষোভকারীদের সরে যেতে বলে। যদিও বিক্ষোভের সঠিক তীব্রতা এবং ক্ষতির পরিমাণ সম্পূর্ণ স্পষ্ট নয়, তবে এটি টেক্সাসে অভিবাসন নীতির বিরুদ্ধে ক্রমবর্ধমান জন-অসন্তোষের একটি স্পষ্ট ইঙ্গিত দেয়।

এই বিক্ষোভের নেপথ্যে রয়েছে টেক্সাসের রিপাবলিকান গভর্নর গ্রেগ অ্যাবটের চালু করা “অপারেশন লোন স্টার”। এই গভর্নর আসলে ডোনাল্ড ট্রাম্পের ‘আমেরিকা ফার্স্ট’ নীতির একজন কট্টর সমর্থক। ২০২১ সালের মার্চ মাসে শুরু হওয়া এই অপারেশনের উদ্দেশ্য ছিল মেক্সিকো সীমান্ত বরাবর নিরাপত্তা জোরদার করা এবং অবৈধ অভিবাসন ঠেকানো। অভিবাসীদের প্রবেশ ঠেকাতে টেক্সাস ন্যাশনাল গার্ড (যারা রাজ্যের সামরিক বাহিনীর অংশ) সীমান্তে কাঁটাতার বসানোর পাশাপাশি, টহল দিচ্ছে। অ্যাবট প্রশাসন অভিবাসীদের সীমান্ত দিয়ে প্রবেশে সাহায্যকারী ‘CBP One’ মোবাইল অ্যাপও বাতিল করেছে। “অপারেশন লোন স্টার”-এর মাধ্যমে নিজেদের উদ্যোগে সীমান্ত সুরক্ষায় টেক্সাস সরকার কাজ করছে, কারণ তাদের ধারণা বাইডেন সরকার (তৎকালীন) এই বিষয়ে ব্যর্থ।

বাইডেন প্রশাসন টেক্সাসের এই পদক্ষেপকে অসাংবিধানিক এবং ফেডারেল সরকারের সীমান্ত সুরক্ষা ক্ষমতাকে লঙ্ঘনকারী হিসেবে চিহ্নিত করেছিল। এমনকি সুপ্রিম কোর্টও টেক্সাসকে কাঁটাতার সরানোর নির্দেশ দিয়েছিল, কিন্তু টেক্সাস সেই নির্দেশ অমান্য করে নিজেদের অবস্থানে অনড় থেকেছে। গভর্নর অ্যাবট যুক্তি দিয়েছেন যে বাইডেন প্রশাসন সীমান্ত সুরক্ষায় ব্যর্থ, তাই রাজ্য নিজেদের নাগরিকদের সুরক্ষায় পদক্ষেপ নিতে বাধ্য হয়েছে। এখানেও ফেডারেল সরকারের সঙ্গে টেক্সাসের সংঘাত দেখা দিয়েছে।

 

লস এঞ্জেলেসের সঙ্গে সমান্তরাল পরিস্থিতি ও বৃহত্তর প্রভাব

টেক্সাসের ঘটনা লস এঞ্জেলেসের পরিস্থিতির সঙ্গে সমান্তরাল। উভয় ক্ষেত্রেই দায়ী ট্রাম্পের অভিবাসন নীতি। যা ট্রাম্পের দ্বিতীয় মেয়াদে আরও আগ্রাসী রূপ নিয়েছে। এই নীতি কেন্দ্র ও রাজ্য সরকারের মধ্যে ক্ষমতার ভারসাম্য এবং সাংবিধানিক ব্যাখ্যার উপর নতুন চাপ সৃষ্টি করছে। টেক্সাসে, যেমন রাজ্য সরকার নিজের সার্বভৌমত্ব রক্ষার জন্য ফেডারেল নির্দেশ অমান্য করছে, তেমনি লস এঞ্জেলেসে ফেডারেল সরকার রাজ্য সরকারের সম্মতি ছাড়াই সেনা মোতায়েন করে রাজ্যের সার্বভৌমত্বকে চ্যালেঞ্জ করেছে। এই পরিস্থিতি যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেল কাঠামোর জন্য এক জটিল চ্যালেঞ্জ তৈরি করেছে।

কিন্তু এইসব রাজনৈতিক ও আইনি টানাপোড়েনের আড়ালে আসলে চাপা পড়ে যায় লক্ষ লক্ষ মানুষের ব্যক্তিগত সংগ্রাম ও অসহায়তা, যাঁদের কাছে অভিবাসন কেবল বেঁচে থাকার এক শেষ আশ্রয়।

 

এক চরম মানবিক সংকট

নিজদেশে ভালোভাবে বেঁচে থাকার সুযোগের অভাবেই মানুষ নিজের জন্মভূমি ছেড়ে ভিনদেশে পাড়ি জমান। এই দেশ ছাড়ার মধ্যে রয়েছে এক গভীর অসহায়তা। মেক্সিকো থেকে জীবন ও জীবিকার সন্ধানে আমেরিকায় ছুটে আসা মানুষেরা কিংবা নিজ ভিটে থেকে বিতাড়িত হয়ে আশ্রয় খোঁজা রোহিঙ্গা শরণার্থীরা, সবাই একই বাস্তবতার শিকার। সিরিয়ার যুদ্ধবিধ্বস্ত মানুষ, যাঁরা ইউরোপের বিভিন্ন দেশে আশ্রয় খুঁজছেন, অথবা আফ্রিকার সাহেল অঞ্চলের মানুষ যারা জলবায়ু পরিবর্তন ও সংঘাতের কারণে বাস্তুচ্যুত হয়ে ভিন্ন দেশের দিকে ঝুঁকছেন, তাঁরাও একই কঠিন পরিস্থিতির মুখোমুখি। যখন বেঁচে থাকার মৌলিক অধিকারটুকু অনিশ্চিত হয়ে পড়ে, তখন অভিবাসনই হয়ে দাঁড়ায় একমাত্র পথ।

এই পরিস্থিতিতে উন্নত দেশগুলোর কাছ থেকে আরও বেশি মানবিকতা আশা করা কি অন্যায়? তবে আপনি আমি যাই আশা করি না কেন, বাস্তবতা অন্য। দুঃখজনক হলেও সত্যি— আমেরিকার মতো ক্ষমতাধর রাষ্ট্রগুলো তো বটেই, এমনকি ইউরোপের অনেক দেশও অভিবাসীদের প্রতি কঠোর নীতি গ্রহণ করছে, তাঁদের তাড়ানোর চেষ্টা করছে। আর এই প্রক্রিয়াকে আরও জটিল ও অমানবিক করে তুলেছে ডিটেনশন ক্যাম্প-এর মতো ধারণা, যা আধুনিক সমাজের এক ভয়াবহ অনুষঙ্গ হয়ে দাঁড়িয়েছে। এই ক্যাম্পগুলো যেন প্রমাণ করে, কীভাবে মানবতা ও সহানুভূতির চেয়ে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা এবং সীমান্ত সুরক্ষার অজুহাত বড় হয়ে উঠছে। অভিবাসন তাই কেবল একটি রাজনৈতিক বা অর্থনৈতিক বিষয় নয়, এটি গভীর মানবিক সংকটের এক জ্বলন্ত উদাহরণ, যা আমাদের সম্মিলিত বিবেকের কাছে প্রশ্ন ছুড়ে দেয়।

লস এঞ্জেলেসের এই ঘটনা শুধু অভিবাসন নীতি নিয়ে বিক্ষোভের প্রতিফলন নয়, এটি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় নিরাপত্তা, ফেডারেল ক্ষমতার প্রয়োগ এবং রাজ্যগুলির অধিকারের মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলির উপর আলোকপাত করে। শ্রমিক নেতা ডেভিড হুয়ের্তার মতো ব্যক্তিদের গ্রেপ্তার এবং তার প্রতিবাদে শ্রমিক ইউনিয়নের সমাবেশ, সমগ্র দেশ জুড়ে আরও বিক্ষোভের ইঙ্গিত দেয়। এই উত্তেজনা সহজে প্রশমিত হবে বলে মনে হচ্ছে না। আগামী দিনে এই আইনি ও রাজনৈতিক সংঘাত কোন দিকে মোড় নেয় এবং তা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেল ব্যবস্থায় কী ধরনের স্থায়ী প্রভাব ফেলে, সেই দিকেই বিশ্ববাসীর নজর থাকবে। তবে, এই বিতর্কের কেন্দ্রবিন্দুতে যে মানুষেরা আছেন— তাঁদের একমাত্র চাওয়া একটু নিরাপদ ও সম্মানজনক জীবন। তাঁদের প্রতি ন্যূনতম সংবেদনশীলতা ও সহমর্মিতা দেখানোই হয়তো এই সংকটের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সমাধান।

 


[1] “অভিবাসন এজেন্ট” বলতে মূলত ফেডারেল অভিবাসন কর্তৃপক্ষ বা তাদের অধীনস্থ সংস্থাগুলির কর্মীদের বোঝানো হচ্ছে। এদের মধ্যে প্রধান হল ইমিগ্রেশন অ্যান্ড কাস্টমস এনফোর্সমেন্ট (আইসিই), যাদের কাজ দেশের অভ্যন্তরে অভিবাসন আইন প্রয়োগ করা এবং অবৈধ অভিবাসীদের গ্রেপ্তার ও বিতাড়ন করা। লস এঞ্জেলসে যে গণগ্রেপ্তারগুলো হয়েছে, তার পেছনে সম্ভবত আইসিই-র এজেন্টরাই ছিলেন। এছাড়াও বর্ডার পেট্রল সীমান্ত সুরক্ষায় কাজ করে এবং সিটিজেনশিপ অ্যান্ড ইমিগ্রেশন সার্ভিসেস অভিবাসন সংক্রান্ত প্রশাসনিক দায়িত্ব পালন করে।
[2] “The powers not delegated to the United States by the Constitution, nor prohibited by it to the States, are reserved to the States respectively, or to the people.” বাংলা অনুবাদ করলে দাঁড়ায়: “যে ক্ষমতাগুলি সংবিধান দ্বারা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের (ফেডারেল সরকার) উপর অর্পণ করা হয়নি, বা রাজ্যগুলির জন্য নিষিদ্ধ করা হয়নি, সে ক্ষমতাগুলি যথাক্রমে রাজ্যগুলির জন্য বা জনগণের জন্য সংরক্ষিত।”

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 5094 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

Be the first to comment

আপনার মতামত...