নেতানিয়াহুর অনিবার্য যুদ্ধ

বর্ণিল ভট্টাচার্য

 


ইজরায়েল আর ইরান— এই দুই প্রাচীন সভ্যতা এক সময় সহযোগী ছিল। ১৯৭৯-র আগে তারা অস্ত্র, প্রযুক্তি ও বাণিজ্যে অংশীদার ছিল। সেই সম্পর্ক ভেঙে গেছে চার দশকের শীতলতায়। কিন্তু আজ, যুদ্ধের ধোঁয়া উঠতেই, আবার এক নতুন আলো দেখা যাচ্ছে। যদি এই সংঘাত ইরানকে আলোচনার টেবিলে আনে— যদি নেতৃত্বের পরিবর্তন না হলেও নীতিতে নরম ভাব আসে— তবে হয়তো এমন এক ভবিষ্যৎ সম্ভব, যেখানে শত্রুতা নয়, সহযোগিতা গুরুত্ব পাবে

 

তেহরানের আকাশে ইজরায়েলি যুদ্ধবিমান। তেল আভিভে সাইরেন বাজছে, আকাশে ছুটছে ইরানের ক্ষেপণাস্ত্র। বহু বছর ধরে শীতল আগুনে পোড়া এই দুই দেশের মধ্যকার সংঘাত এবার প্রকাশ্য যুদ্ধে রূপ নিয়েছে। প্রথমবারের মতো, কোনও মধ্যস্থতাকারী ছাড়াই— একটি সরাসরি যুদ্ধ।

মাত্র দুই দিনের মাথায়, ইজরায়েল দখল নিয়েছে ইরানের পশ্চিমাঞ্চলীয় আকাশপথ। তাদের স্টেলথ জেটগুলো, বহুদিনের গুপ্তচরবৃত্তি আর জটিল হামলার পরিকল্পনার ফল হিসেবে, একে একে ধ্বংস করেছে রাডার সিস্টেম, ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিরক্ষা ঘাঁটি এবং সামরিক সদর দপ্তর। নিহত হয়েছেন বিপ্লবী গার্ডের শীর্ষ কমান্ডাররা। আর এবার ইরানকে আঘাত করা হয়েছে শুধু তার পারমাণবিক কর্মসূচিতে নয়, বরং শাসনব্যবস্থার হৃদপিণ্ডে।

ইরানও থেমে নেই। শত শত ড্রোন ও ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র নিক্ষেপ করেছে তারা ইজরায়েলের দিকে। অনেকগুলো পথেই আটকানো গেছে— মার্কিন সহায়তায়। তবু কিছু পৌঁছে গেছে তেল আভিভে, প্রাণহানি ঘটেছে, ধ্বংস হয়েছে ভবন, এমনকি আমেরিকান কনসুলেটের কাছেও।

 

এই উত্তপ্ত যুদ্ধের ভেতরে, এক নিঃশব্দ বার্তা ঘুরে বেড়াচ্ছে। আরব মধ্যস্থতাকারীদের মাধ্যমে তেহরান জানিয়েছে— তারা আলোচনায় ফিরতে চায়, যদি যুক্তরাষ্ট্র এই যুদ্ধে সম্পূর্ণরূপে বাইরে থাকে।

এই ইঙ্গিত শুধু কূটনীতি নয়, দুর্বলতার প্রকাশও। শীর্ষ নেতা খামেনেই এখন একা। হিজবুল্লাহ— ইরানের একসময়ের সবচেয়ে শক্তিশালী বন্ধু— এখন নিঃশব্দ। সিরিয়ার ধ্বংসস্তূপে তাদের সংযোগ ভেঙে গেছে আগেই। ইজরায়েল ধাপে ধাপে ভেঙেছে ইরানের পরমাণু সরঞ্জামের জোগান-চেইন— নাতানজ, ইসফাহান। কয়েকজন শীর্ষ বিজ্ঞানীও নিহত।

তবে ফরদো রয়ে গেছে— ইরানের পর্বতের নিচে গড়া শক্ত ঘাঁটি। সেখানে আঘাত হানতে প্রয়োজন যুক্তরাষ্ট্রের গুহাধ্বংসী বোমা। ইজরায়েলের হাতে সেসব নেই।

 

প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প শুরুতে যুদ্ধ আটকাতে চেয়েছিলেন। কিন্তু বোমা পড়ার পর তিনি সমর্থন জানান ইজরায়েলকে। বর্তমানে মার্কিন যুদ্ধজাহাজ ও বিমান ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিরোধে সক্রিয়। কিন্তু সরাসরি হামলা— তাতে এখনও সায় দেননি।

নেতানিয়াহু বারবার বলেছেন, সরকার বদলানো তার লক্ষ্য নয়। কিন্তু গত সপ্তাহে ইরানিদের উদ্দেশ্যে বলেন, “আপনাদের মুক্তির দিন আসন্ন।” দেশটির জনমতও, দুই বছর গাজা আর লেবাননে যুদ্ধে ক্লান্ত হলেও, ইরান নিয়ে যুদ্ধের পক্ষে। কারণ তারা বহুদিন ধরেই দেখেছে— ইরান কীভাবে হামাস, হিজবুল্লাহ, হুথিদের দিয়ে ঘিরে রেখেছে ইজরায়েলকে।

তেহরানের ভুল ছিল, তারা ভেবেছিল তাদের ক্ষেপণাস্ত্র আর প্রক্সি বাহিনীর জবাব হবে শুধু সীমিত হামলা। বাস্তবে তারা এখন একটি সমন্বিত, সুপরিকল্পিত আক্রমণের মুখে, যেখানে প্রতিক্রিয়া আসছে আকাশপথ, গোয়েন্দা অভিযান, এবং অর্থনৈতিক অবরোধে একযোগে।

সাম্প্রতিক সময়ে ইসরায়েল ইরানের পারমাণবিক স্থাপনাগুলোর ওপর হামলা করায়, এ লড়াইয়ে যুক্তরাষ্ট্রের সক্রিয় ভূমিকার সম্ভাবনা নিয়ে জল্পনা বেড়েছে। আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের সবচেয়ে শক্তিশালী অ-পারমাণবিক অস্ত্র—GBU-57 “Massive Ordnance Penetrator”। এই ৩০,০০০ পাউন্ড ওজনের বোমাটি বিশেষভাবে তৈরি, যাতে পাহাড় কেটে শত শত ফুট গভীরে অবস্থিত পারমাণবিক স্থাপনাকে ধ্বংস করা যায়। এ পর্যন্ত এটি কখনও ব্যবহৃত হয়নি, কিন্তু এর উপস্থিতিই ইঙ্গিত দিচ্ছে যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ইসরায়েলের পাশে দাঁড়াতে সম্পূর্ণ প্রস্তুত।

ইসরায়েল ও আমেরিকার সমন্বয় দিন দিন আরও স্পষ্ট হয়ে উঠছে। সম্প্রতি ইসরায়েল ৫০ টিরও বেশি জেট বিমান দিয়ে তেহরানের কাছে সেন্ট্রিফিউজ এবং ক্ষেপণাস্ত্র তৈরির কারখানায় হামলা চালিয়েছে। একইসঙ্গে, মার্কিন যুদ্ধজাহাজ ও বিমানগুলো নীরবে মধ্যপ্রাচ্যে জড়ো হচ্ছে। ইরানের পাল্টা ড্রোন ও ক্ষেপণাস্ত্র হামলা কিছুটা কমলেও, ট্রাম্প প্রশাসন ক্রমেই এ সংঘাতে জড়াতে আগ্রহী হয়ে উঠছে। ইরানের গুরুত্বপূর্ণ পরমাণু স্থাপনাগুলো ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার খবর এসেছে আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর কাছ থেকেও। তেলের দামে বড় কোনও অস্থিরতা না থাকায় ট্রাম্প হয়তো এটিকে একটি ‘সুযোগের মুহূর্ত’ বলে ভাবছেন।

ট্রাম্পের কৌশল নতুন নয়—তা হল, বিরুদ্ধ দেশের ওপর চাপ বাড়ানো এবং একইসঙ্গে যা কিছু সম্ভব, তার অতিরিক্ত দাবি করা। এবারও তিনি চাইছেন ইরান সম্পূর্ণভাবে তাদের ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণ কর্মসূচি বন্ধ করুক, ক্ষেপণাস্ত্র কর্মসূচিতে সীমা টানুক, এবং তাদের সমর্থিত মিলিশিয়াদের পেছন থেকে সরে আসুক। তবে এখন পর্যন্ত তিনি সরাসরি শাসক পরিবর্তনের দাবি তোলেননি। কিন্তু ইরানের কাছে এই দাবিগুলো পূরণ করা প্রায় অসম্ভব। নিজেদের পারমাণবিক সক্ষমতা বিসর্জন দেওয়ার দাবি তাদের কাছে ইসরায়েলি বোমার চেয়েও বড় হুমকি। এছাড়াও ওয়াশিংটন বা তেল আবিবের নিরাপত্তা প্রতিশ্রুতিগুলোর ওপর তাদের আস্থা খুবই কম।

এই মুহূর্তে ট্রাম্পের জন্য ঝুঁকিও অনেক। সামরিক পদক্ষেপ হয়তো ইরানের কর্মসূচিকে থামাতে পারে, আবার এর ফল হতে পারে আরও বড় আকারের সংঘর্ষ। প্রশাসনের ভেতরে কিছু বিচক্ষণ সংযত কণ্ঠ থাকলেও, তারা এই মুহূর্তে বেশ নীরব। অন্যদিকে ট্রাম্পের নিজস্ব রাজনৈতিক ঘাঁটির ভেতরেই বিভক্তি তৈরি হচ্ছে। অনেকেই বলছেন, এটি আরেকটি “চিরস্থায়ী যুদ্ধ”-এর দিকে নিয়ে যাচ্ছে। ইরানের সামনে এখন দুটি মাত্র পথ—হুমকির মুখে মাথা নত করা, অথবা দীর্ঘ সংঘাত বেছে নেওয়া। আর যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েল এমন এক কৌশলে জড়িয়ে পড়েছে, যেখানে কূটনীতির সুযোগ ক্রমেই সংকুচিত হচ্ছে।

এই পরিস্থিতিতে দু-পক্ষই জানে, চূড়ান্ত জয় আসবে কেবল সামরিক শক্তি দিয়ে নয়— বরং কূটনৈতিক অবস্থান আর ভবিষ্যৎ-কাঠামো নির্ধারণের মধ্যে দিয়ে।

আর এখানেই জন্ম নিচ্ছে এক নতুন সম্ভাবনা।

ইজরায়েল আর ইরান— এই দুই প্রাচীন সভ্যতা এক সময় সহযোগী ছিল। ১৯৭৯-র আগে তারা অস্ত্র, প্রযুক্তি ও বাণিজ্যে অংশীদার ছিল। সেই সম্পর্ক ভেঙে গেছে চার দশকের শীতলতায়। কিন্তু আজ, যুদ্ধের ধোঁয়া উঠতেই, আবার এক নতুন আলো দেখা যাচ্ছে। যদি এই সংঘাত ইরানকে আলোচনার টেবিলে আনে— যদি নেতৃত্বের পরিবর্তন না হলেও নীতিতে নরম ভাব আসে— তবে হয়তো এমন এক ভবিষ্যৎ সম্ভব, যেখানে শত্রুতা নয়, সহযোগিতা গুরুত্ব পাবে।

এই যুদ্ধ হয়তো আরেকটি নিষ্ঠুর চক্রের শুরু হতে পারত। কিন্তু যদি সঠিক সময়ে থামা যায়— তবে হয়তো এটাই হতে পারে সেই মোড়, যেখানে ইজরায়েলি ও ইরানি জনগণ আবার একে অপরকে চিনবে, ভয় নয়, সম্ভাবনার চোখে।


*মতামত ব্যক্তিগত

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 5094 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

Be the first to comment

আপনার মতামত...