
প্রবুদ্ধ বাগচী
যে বছর ভারতের সন্ন্যাসী নরেন্দ্রনাথ দত্ত ‘স্বামী বিবেকানন্দ’ হিসেবে শিকাগো ধর্ম-মহাসম্মেলনে (১৮৯৩) তাঁর ওজস্বী ভাষণে হিন্দুধর্মের ‘শ্রেষ্ঠত্ব’কে বিশ্বের মঞ্চে প্রতিষ্ঠিত করলেন, ঠিক তার আগের বছর প্রতিষ্ঠা হয় শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয় (১৮৯২)। এই ধর্মসম্মেলনে স্বামীজির বিশ্রুত বক্তৃতা ও তার সুদূরপ্রসারী প্রতিক্রিয়া নিয়ে যে তথাকথিত মিথ তার অবশ্য একটা বিকল্প ভাষ্য আছে। ওই একই সম্মেলনে এদেশ থেকে বৌদ্ধধর্মের প্রতিনিধি হয়ে গিয়েছিলেন ধর্মপাল— তাঁর বক্তব্যের অভিঘাত যে তুলনায় বেশি ছিল এটা জানা যায় ধর্ম-সম্মেলনের প্রেসিডেন্ট ডঃ ব্যারোজের লিখিত প্রতিবেদনে। কিন্তু ওসব কথা থাক। এইসব ঘটনা যখন ঘটে চলেছে বিশ্বের আধ্যাত্মিক এলাকায় ঠিক একই সময়ে শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আয়োজন করা হল আন্তর্জাতিক এক গণিত মহাসম্মেলনের, ওই একই বছর (১৮৯৩)। এই আয়োজনের নেপথ্যে ছিলেন দুই জার্মান গণিতবিদ ফেলিক্স ক্লিন ও গিয়র্গ ক্যান্টর। ঠিক এর চার বছর পরে ওই গণিত-সম্মেলনের আসর বসল জুরিখ শহরে আর সেই বছর (১৮৯৭) থেকেই এই সম্মেলনের সরকারি নাম হল ইন্টারন্যাশনাল কংগ্রেস অফ ম্যাথমেটিশিয়ানস। গত একশো সাতাশ বছর ধরে প্রায় অলিম্পিকের আসরের মতোই এই মহাসভা অনুষ্ঠিত হয়ে চলেছে সারা বিশ্বে। সর্বশেষ এই সভা আয়োজিত হয়েছিল ফিনল্যান্ডের হেলসিঙ্কি শহরে, আগস্ট ২০২২-এ, আগামী আয়োজন হবে মার্কিন দেশের ফিলাডেলফিয়া নগরে, ২০২৬-এর কোনও এক সময়ে। ধারে ও ভারে এই কংগ্রেস এখন এতটাই জরুরি যে গণিতের ‘নোবেল পুরস্কার’ হিসেবে যে ‘ফিল্ডস মেডেল’-কে সারা বিশ্বে বিবেচনা করা হয় সেই পুরস্কার দেওয়া হয় এই অনুষ্ঠানের মঞ্চ থেকে। গণিতবিদদের আরও স্বীকৃতি জোটে যেসব পুরস্কারে— ‘গস প্রাইজ’, ‘চার্ন মেডেল’ ও ‘অ্যাবাকাস মেডেল’— এর প্রতিটিই যোগ্য ব্যক্তিত্বের হাতে তুলে দেওয়া হয় ওই একই অনুষ্ঠানে। গুরুত্বে এটি নোবেল পুরস্কার আয়োজনের থেকে কিছুমাত্র কম নয়, কিন্তু এর প্রচার অনেকটাই সীমিত। আর তাই গত ২০১০ সালে হায়দ্রাবাদ শহরে যে এই মহাসম্মেলনের আয়োজন করা হয়েছিল তার বৃত্তান্ত আমরা প্রায় অনেকেই জানি না। সেবারেই প্রথম আয়োজক দেশ হিসেবে ভারত সারা দুনিয়ার দশ হাজার গণিতবিদকে টেক-সিটি আন্তর্জাতিক কনভেনশন সেন্টারে আপ্যায়িত করেছিল, নানা বিদগ্ধ আলোচনায় রঙিন হয়ে উঠেছিল বোধিচর্চার ক্যানভাস।
অবশ্য কালের হিসেবে এটাও এক যুগ আগের বাসি খবর। মাঝখানে দেড় দশক ঘটনার ঘনঘটায় অতিক্রান্ত। কিন্তু আসলে একটা অন্য খবর দেব বলেই বিছিয়ে বসেছি। হায়দ্রাবাদের ওই সম্মেলনে গণিতের যে বিবিধ বিভাগ ও ধারা নিয়ে আলোচনার আয়োজন করা হয়েছিল তার অন্যতম হল গণিতের ইতিহাস। সচরাচর যাঁরা বুনিয়াদি গণিত শেখেন এবং অন্ততপক্ষে গণিতের স্নাতকোত্তর পাঠ নেন তাঁদের এই বিষয়টি নিয়ে কোনও ধারণাই থাকে না। একেবারে ছোটবেলায় জ্যামিতি বইয়ের গোড়ায় লেখা থাকে ইউক্লিডের কথা, দু-এক কথায়। বীজগণিতের দ্বিঘাত সমীকরণের সমাধানে উল্লেখ হয় শ্রীধর আচার্য-র নাম। আর উচ্চতর গণিতে ক্যালকুলাস শিখতে গেলে শুধু জানতে হয় নিউটনের কথা, যিনি এই শিক্ষার জনক। কিন্তু মানবসভ্যতার আদি থেকে মৌলিক বিজ্ঞান হিসেবে গণিতের যে রোমাঞ্চকর অভিযান আজ সেই সভ্যতাকে উন্নতির উত্তুঙ্গ শিখরে নিয়ে এসেছে তার সবটাই আমাদের শিক্ষায় কেমন যেন আবছায়া ও ব্রাত্য— ওগুলো না জানলেও চলে যায় আর কি! কিন্তু কথাটা হল, চোদ্দ বছর আগে ঘটে যাওয়া ওই কংগ্রেসে গণিতের আরও পাঁচরকম আলোচনার পাশেপাশে এই বিষয়টাতেও সমান গুরুত্ব দিয়ে আয়োজিত হয়েছিল কয়েকটি সেশন। কথা বলেছিলেন এ-দেশের ও ইউরোপ আমেরিকার নানা গণিতবিদ। ভারতের মাটিতে গণিতের ইতিহাসের আলোচনা প্রাচীন ভারতের গণিতচর্চা অনুল্লেখে সম্পূর্ণ হওয়ার কথা নয়, হয়ওনি। কিন্তু গোল বাধল অন্য জায়গায়।
কলকাতার বরানগরে অবস্থিত ইন্ডিয়ান স্ট্যাটিস্টিক্যাল ইন্সটিটিউট এমন একটি প্রতিষ্ঠান যার খ্যাতি জগৎজোড়া। গণিতের যে উঁচুমানের গবেষণা ও চর্চা এই প্রতিষ্ঠানে হয় তা দুনিয়ার তাবড় তাবড় বিশ্ববিদ্যালয়ের থেকে এক ছটাক কম নয়। ফলে, এমন একটি আন্তর্জাতিক আয়োজনে যে স্ট্যাটিস্টিক্যাল ইন্সটিটিউটের বিজ্ঞানী ও গবেষকরা ডাক পাবেন, তা না বলে দিলেও চলে। এমনই এক ডাকসাইটে অধ্যাপক সেখানে বলছিলেন গণিতের ইতিহাস নিয়ে। কিন্তু মজার ব্যাপার, প্রাচীন ভারতের গণিতচর্চার উজ্জ্বল অধ্যায়গুলি পেরিয়েই তিনি চলে গেলেন ইউরোপের দিকে। শ্রোতাদের মধ্যে থেকে প্রশ্ন উঠল খ্রিস্টীয় সপ্তম শতক থেকে দশম শতক অবধি ভারতীয় গণিতের যে অভিযাত্রা ঘটেছিল আরব ও বাগদাদের দিকে সেই প্রসঙ্গ কেন সরিয়ে ফেলা হল? কার্যত আধুনিক ইউরোপের কাছে গণিত ও বিজ্ঞানের অনেকটাই পৌঁছে দিয়েছেন পশ্চিম এশিয়ার আরব দুনিয়া যার মধ্যে মিশর, ইরাক এগুলিও এসে যায়। গ্রিক ও আরবের আদানপ্রদানের মাধ্যমে স্পেন হয়ে গণিতের মৌলিক ধারাগুলি ইউরোপে কড়া নাড়ে। ঠিক, এর পরে ইউরোপীয় রেনেসাঁসের হাত ধরে তা আধুনিক যুগে প্রবেশ করেছে। সভায় উপস্থিত ভারতীয় অধ্যাপকরা এইসব জিজ্ঞাসা তোলা সত্ত্বেও কলকাতার বিশ্রুত গণিতজ্ঞ তার কোনও সদুত্তর দিতে পারেননি। কিন্তু ওঁর পরে বলতে উঠে এক ব্রিটিশ গণিতজ্ঞ এই খণ্ডিত ইতিহাসের মুখে ঝামা ঘষে দেন। খানিক পরে ক্যান্টিনের চা-চক্রে ওই বক্তাকে আবার শ্রোতারা একই প্রশ্নে বিদ্ধ করেন। প্রকাশ্য অধিবেশনে যা তিনি ক্রিকেটীয় পরিভাষায় ‘ডাক’ করে গিয়েছিলেন, এবারে চাপের মুখে তিনি মেনে নেন তাঁর কথায় ভুল ছিল। কিন্তু প্রকাশ্যত তিনি এটা মানতে পারলেন না কেন?
এটা ঠিক, বিজ্ঞানের কোনও দেশকাল হয় না। পৃথিবীর প্রতিটি গাণিতিক বা বৈজ্ঞানিক উদ্ভাবন মানুষের সভ্যতাকে একটা করে ধাপ এগিয়ে দেয়। শিব্রাম চক্রবর্তী তাঁর ‘মস্কো বনাম পন্ডিচেরী’-তে লিখেছিলেন, ঠাকুর রামকৃষ্ণ যে ‘আলো’ দেখেছিলেন তা তাঁর নিজস্ব আলো, কিন্তু আলভা এডিসন যে ‘আলো’ দেখলেন তা সারা বিশ্বের মানুষকে তিনি দেখাতে পেরেছেন। কিন্তু ইতিহাসের দিক দিয়ে দেখলে স্থান-কাল-পাত্রের উল্লেখ আসলে একটা ধারাবাহিকতাকে আমাদের ধরিয়ে দেয়। সপ্তম শতকের ভারতীয় গণিতবিদ ব্রহ্মগুপ্ত জ্যামিতির সঙ্গে বীজগণিতের একটি সম্পর্ক বার করে পরিচিত হন। পরে তাঁর সুবিখ্যাত ‘ব্রহ্মস্ফুটসিদ্ধান্ত’ নামের গণিত ও জ্যোতির্বিদ্যা-বিষয়ক আকরগ্রন্থটি খলিফা-আল-মনসুর অষ্টম শতকে বাগদাদে নিজের সংগ্রহে নিয়ে যান ও অনুবাদ করেন। গণিতের ইতিহাস নিয়ে যাঁরা কাজ করেন তাঁদের অনেকেরই মত, বীজগণিতের মূল উদ্গাতা আরবের বিখ্যাত গণিতজ্ঞ মুসা-আল-খারিজমি— কার্যত তাঁর গ্রন্থ ‘কিতাব-আল-জাবার’ থেকেই ‘অ্যালজেব্রা’ শব্দটির উৎপত্তি। একটা ধারাবাহিকতার পথ বেয়েই গণিত এ-দেশ থেকে ও-দেশ ছড়িয়ে পড়ে ও স্তরে স্তরে বিকশিত হতে থাকে। পনেরো শতকের লিওনার্দো ভিঞ্চি, কোপার্নিকাস থেকে ষোড়শ শতকের গ্যালিলিও, জোহান কেপলার হয়ে সতেরো শতকের নিউটন, লিবনিজ— গণিত তার নানা বিভঙ্গে প্রকাশিত হতে থাকে এইভাবেই। বিজ্ঞান কেন, যে-কোনও বিভাগের ক্ষেত্রেই ‘গৌরবময় অতীত’ শব্দের ব্যঞ্জনা আসলে খুব তরল। গৌরবগাথা-কে স্থানকালে সীমিত রাখলে তার মধ্যে ভিন্ন এক রাজনীতির গন্ধ ছড়িয়ে পড়ে। কাজেকাজেই প্রাচীন ভারতে গণিতের খুব ‘সোনালি দিন’ ছিল এই একবগগা প্রচারের আসল ভিত্তিটাই অভিসন্ধিময়। বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে স্থানীয় চর্চা যতদিন ব্যাপ্ত বিশ্বে সঞ্চারিত না হয় ততদিন তার অভিঘাত বোঝা যায় না। শব্দের বেগ নির্ণয়ের ক্ষেত্রে আইজ্যাক নিউটন একরকম হিসেব করেছিলেন, অনেকদিন পদার্থবিদরা সেটাই মেনে নিয়েছিলেন। এর পরে আরেক বিজ্ঞানী ডপলার ওই হিসেব সংশোধন করে নতুনভাবে তা হিসেব করেন। তার মানে কি নিউটন ভুল? সূর্যের চারদিকে গ্রহের গতিপথ বৃত্তাকার বলে অনেকদিন বিজ্ঞান মেনে নিয়েছিল, কেপলার বললেন, না, এই পথ উপবৃত্তাকার। বস্তুর অণুকে যে আরও ক্ষুদ্রতম এককে ভাঙা যায় তাও ছিল অজানা— পরমাণু ও তার আকারের বিষয় জানা গেছে একেবারে বিশ শতকের গোড়ায় উইলিয়াম রাদারফোর্ডের গবেষণায়। বিজ্ঞান, গণিত সবই এইরকম ধারাবাহিক বিষয়। এক দেশ থেকে অন্য দেশে পরিবাহিত হয় মেধা ও বোধির চর্চা। তাহলে গণিতের ইতিহাস নিয়ে আন্তর্জাতিক মঞ্চে বলতে এসে প্রথিতযশা গণিতবোদ্ধাকে তাঁর আলোচনাকে গ্যালপিন ট্রেনের মতো স্টেশন বাদ দিয়ে দিয়ে এগিয়ে চলতে হয় কেন?
এর একটা উত্তর আমরা এতদিনে পেয়ে গেছি। কারণ, আমাদের বিবৃত ঘটনার পরে আরও দেড় দশক কেটে গেছে। এই সময়কালে ভারতীয় ইতিহাসের এক পরিকল্পিত ‘বিকল্প ভাষ্য’ নির্মাণের পরিব্যাপ্ত প্রয়াস আজ আর কারও অজানা নয়। ইতিহাসের বইয়ে কোন অংশ থাকবে, কোন অংশ ছেঁটে ফেলা হবে এগুলো ঠিক করার জন্য সরকারি উদ্যোগে নানা কোতলখানা তৈরি হয়েছে যাদের কাটাছেঁড়ার পেছনে জাগরুক এক বিশেষ ধর্ম-সংস্কৃতি। যেহেতু এই বিনির্মাণের পেছনে কোনও অ্যাকাডেমিকসের পরিশুদ্ধতা নেই ফলে একে হুমকি, ওকে কুকথা বলা, কাউকে সামাজিক মাধ্যমে ট্রোল করা এইসব হচ্ছে তাঁদের প্রকরণ। এই ঘরানার অনিবার্যতায় আমরা কিছুকাল আগে জেনেছিলাম, ইতিহাসের দিন শেষ— এখন নাকি ‘উত্তরসত্য’ বা ‘পোস্ট ট্রুথ’-ই আমাদের একমাত্র নিয়ামক। এই প্রবণতাকেই খুব সুচারুভাবে বেঁধে ফেলা হল জাতীয় শিক্ষানীতির বিধিনিয়মে। মধ্যযুগের ইতিহাস মানেই অন্ধকার, মধ্যযুগের শাসক মানেই দুরাচারী, মধ্যযুগ মানেই সোনালি দিনের ওপর অনিবার পদপেষণ। সুতরাং ওসব কুকম্মোর আখ্যান না পড়াই ভাল। তাহলে কী পড়ানো হবে? কেন ‘ইন্ডিয়ান নলেজ সিস্টেম’— ‘কিন্তু সবার চাইতে ভাল পাউরুটি আর ঝোলাগুড়’!
কথাটা হল, এই ঝোলাগুড় আসলে বানানো হচ্ছে কোন খেজুরগাছে? এতদিন ইতিহাসের বিকলন নিয়ে যেসব বিষয় জনপরিসরে এসেছে তাতে সামাজিক-রাজনৈতিক ইতিহাসের কথাই প্রধানত এসেছে। কিন্তু বিজ্ঞান বা গণিতের ইতিহাসের ক্ষেত্রেও সেই ভাইরাসের সংক্রমণ আজ সমানভাবেই সত্যি। আজ নয়, এর সলতে পাকানো শুরু হয়েছে অনেক আগেই। আমরা যে আলোচনাচক্রের কথা বলছি তাও প্রায় পনেরো বছর আগের। সেই মঞ্চেই গণিতের সুসংবদ্ধ ইতিহাস উচ্চারণ করতে ভারতীয় গণিতজ্ঞের গলা আটকে আসে। আজ হয়তো তিনি ‘ইন্ডিয়ান নলেজে’র পুচ্ছ ধরে গণেশের মাথার প্লাস্টিক সার্জারি বা পুষ্পক রথের অ্যারোনেটিক্স নিয়ে গলাবাজি করতেই পারেন। এই বিষয়ে তাঁর ‘অনুপ্রেরণা’র ডোপামিনে তো ঘাটতি হওয়ার কথা নয়। গণিতের যে আন্তর্জাতিক মহাসম্মেলনের কথায় আমরা ছিলাম সেই অনুষ্ঠানেই হাজির ছিলেন এমন কিছু গণিতের অধ্যাপক-গবেষক যাঁরা নিজেদের আকাডেমিক জীবন অনেকটাই কাটিয়েছেন মহারাষ্ট্রে। তার মধ্যে কলকাতার সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজের এক গুণী অধ্যাপকও আছেন। এঁদের অভিজ্ঞতা হল, মহারাষ্ট্রের গণিত বা বিজ্ঞান-বিষয়ক অ্যাকাডেমিক মহলে ভারতীয় প্রাচীন গণিতের নামে একটা অতিলৌকিক চর্চা গত পঞ্চাশবছর ধরেই আস্তে আস্তে করে চালু করা হয়েছে। যার সার হল ‘প্রাচীন ভারত’ নামক এক অসংজ্ঞায়িত কালপর্বে গণিতের যা ‘উদ্ভাবন’ তাই নাকি ইউরোপীয় আধুনিক গণিতের প্রধান ভিত্তি। খানিকটা ইচ্ছাকৃতভাবেই এখানে অনুল্লিখিত থাকে আরবদুনিয়ার বৈজ্ঞানিক উৎকর্ষের কাহিনি, যেমন মধ্যযুগের রাজনৈতিক ইতিহাসকে আবছায়া করে রাখা হচ্ছে এখন। এমনকি, গণিতচর্চার ক্ষেত্রেও যে মধ্যযুগ বা তথাকথিত ‘ইসলাম শাসনকাল’ পিছিয়ে পড়েছিল (অবশ্যই তুলনাটা তথাকথিত ‘স্বর্ণযুগের’ সঙ্গেই) তারও একটা আখ্যান বিছিয়ে ধরা হয়। মুম্বাই, পুনা, নাগপুর ইত্যাদি শহরের বিশ্ববিদ্যালয় ও নানান অ্যাকাডেমিক মহলে এই চিন্তার স্রোত বা ‘স্কুল অফ থট’ খুব প্রকট। মুম্বাইয়ের সুবিখ্যাত গবেষণা প্রতিষ্ঠান টাটা ইন্সটিটিউট অফ ফান্ডামেন্টাল রিসার্চ (টিআইএফআর)-এ আয়োজিত নানা ‘জাতীয়’ সেমিনারে এই ধরনের আলোচনা খুব সাদরে আহ্বান করা হয় বলেই শোনা গেছে।
প্রত্যয়ের সঙ্গে উচ্চারণ করা প্রয়োজন, যে কোনও অ্যাকাডেমিক ডিসিপ্লিনে, এমনকি শিল্প-সাহিত্য-সঙ্গীত কোনও ক্ষেত্রেই সোনা রুপো তামা-র যুগ চিহ্নিত করা নিতান্তই একটা আহ্লাদিত নামকরণ ছাড়া আর কিছুই নয়। এর থেকে কিছুই বোঝা সম্ভব নয়। বিশেষ করে গণিতের মতো একটা বিষয়ে যেখানে ধারাবাহিক চর্চা ছাড়া তার বিকাশ সম্ভব নয় সেখানে ‘ব্যাদে সবই ছিল’ জাতীয় আপ্তবাক্যের পুচ্ছটি উচ্চে তুলে নাচানো নিছকই এক হ্যাংলাপনা এবং একই সময়ে কাঁচা বোকামি অথবা নিরতিশয় ধান্দাবাজি। একইভাবে, গণিতচর্চার ক্ষেত্রে হিন্দুযুগ বা আরবযুগ এই রকমের বিভাজন আরও তামসিকতা। কারণ গণিতের চর্চা যাঁরা করেছেন তাঁরা জ্ঞানের দীপশিখাকে প্রোজ্জ্বল করেছেন উন্নততর বোধির স্বার্থে। বেদ বা কোরানের মধ্যে যাবতীয় রহস্যের ‘সব পেয়েছির বটিকা’ আছে এটা আজকের পরিভাষায় নিতান্তই ‘বকোয়াস’— যদিও বেদ আর কোরানের সময়কাল অনেক আলাদা। কথাটা বলা দরকার, গণিত বা বিজ্ঞানচর্চায় এই খণ্ডিত মানচিত্রের ফাঁক-ফোঁকর দিয়ে আসলে বেফালতু অক্সিজেন পেয়ে যায় এক পুরনো দ্বৈরথ। একদল প্রচার করেন তাঁদের যুগই শ্রেষ্ঠ, অন্যরা ‘থ্রি চিয়ার্স’ দেন তাঁদের মসিহাকে। গেরুয়া ব্রিগেডের এসব বুকনি ইদানিং আমাদের গা-সওয়া। একইভাবে, স্বপ্নময় চক্রবর্তীর ‘ইউসুফের মা’ গল্পে পড়েছি গ্রামীণ ইসলামি মৌলবাদীরাও কেমন করে কুর-আন-কে বিজ্ঞানের আকরগ্রন্থ বলে প্রচার করেন। অথচ ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান যে আসলে বিজ্ঞানের অগ্রগতির পথে পেল্লায় প্রাকার তার সবচেয়ে বড় উদাহরণ তো ‘গ্যালিলিওর জীবন’!
একটা গোদা সত্যি কথা এই যে, নদী যদি স্রোত হারায়, শ্যাওলায় আটকে পড়া ছাড়া তার কোনও ভবিতব্য নেই। গণিতের চর্চা প্রাচীন ভারতে নিশ্চয়ই হয়েছে যা ছড়িয়ে গেছে আরব হয়ে ইউরোপ আর তারপরে আধুনিক গণিতের অধিনায়কত্ব এসে পড়েছে ইউরোপ-আমেরিকায়। প্রাচীন ভারত একসময় তার গৌরব হারিয়ে ফেলেছে, পশ্চিম এশিয়ায় সাম্রাজ্যও একসময় অস্ত গেছে। কিন্তু ইতিহাস মানে উত্থান আর পতন, অভ্যুদয় আর পড়ন্তবেলা। অথচ মজা হল, ইতিহাসের কালবিভাগে প্রাচীনযুগ, মধ্যযুগ বা আধুনিকযুগের এই ত্রিধারার মূল উদ্গাতা পাশ্চাত্যের ইতিহাসবিদরা, যাদের উদ্দিষ্ট ছিল ‘আধুনিক যুগ’-এর তকমার সঙ্গে জড়িয়ে রেখে ‘আধুনিকতার পথযাত্রী’ হিসেবে নিজেদের জাতে তোলা। অবশ্য গণিতের ইতিহাস নিয়ে ইউরোপ-আমেরিকার চর্চায় প্রাচীন ভারতীয় গণিতের চর্চার একপেশে খণ্ডিত ধারণা যে প্রামাণ্য নয়, তা এখন স্বীকার করা হয়েছে। ভারতের প্রথিতযশা গবেষক গণিত-তাত্ত্বিকরা বিদেশের আন্তর্জাতিক মঞ্চে ঘুণাক্ষরেও এসব থিওরির উল্লেখ করেন না, তাতে বেইজ্জতির ভয়। সহজ কথা সহজভাবে বোঝা ভাল। প্রাচীন ভারতীয় গণিতবিদরা নিশ্চয়ই অপাংক্তেয় নন। কিন্তু তাঁদের অধীত বিদ্যা যদি প্রসারিত না হত তাহলে কিন্তু তা মানবসভ্যতার কোনও কাজে আসত না। কথাটা আরবদুনিয়া বা পরবর্তী ইউরোপের গণিতচর্চার ক্ষেত্রেও সমান সত্যি। বিজ্ঞানে শেষ বলে কিছু হয় না। প্রাচীন ভারতীয় বিজ্ঞান যদি সত্যিই ‘প্লাস্টিক সার্জারি’-র প্রযুক্তি জানত তাহলে সেই যুগেই তা ফুরিয়ে যেত না, দেশান্তরে কালান্তরে তা ছড়িয়ে পড়ত, উন্নত হত। স্বভাবতই ‘বৈদিক বিজ্ঞান’ বা ‘বৈদিক গণিত’ আদপে একটা বুজরুকি আর খুব নিচুস্তরের একটা রাজনৈতিক প্রচার। আর্যভট্ট-বরাহমিহির-ভাস্করাচার্য-ব্রহ্মগুপ্ত এঁরা কেউই বেদের যুগে জন্মাননি, কিন্তু এঁদের জ্ঞানচর্চা শেষ অবধি বৃহত্তর বোধের কাজে লেগেছে। আর সেটা হতে পেরেছে একটা বিস্তার, একরকমের দেওয়া-নেওয়ার প্রক্রিয়ার ভিতর দিয়ে। নিজেদের রাজনৈতিক অ্যাজেন্ডার তত্ত্বায়ন করতে গিয়ে এই ইতিহাসের গায়েই ছেনি হাতুড়ি মারছে সঙ্ঘী-দর্শন। শুধু রাজনৈতিক ইতিহাস নয়, আজ গণিত বা বিজ্ঞানের ইতিহাসেও সেই আঘাত সমান প্রত্যক্ষ। আর এই নতুন আজগুবিতার পক্ষে যে তারা কিছু নিবেদিত সেনানীও বানিয়ে ফেলেছে তার একটুকরো ছবি ধরা থাকল ওই আন্তর্জাতিক গণিত কংগ্রেসের মঞ্চে।
ঋণ: আলিয়া বিশ্ববিদ্যালয় আয়োজিত আলোচনাচক্র; পঞ্চাশটি গল্প (স্বপ্নময় চক্রবর্তী); প্রাচীন ভারতে গণিতচর্চা (প্রদীপ কুমার মজুমদার)
প্রবন্ধের বক্তব্য যেমন ঠিক তেমনই আর একটি গোষ্ঠী আছে যারা ভারতের অতীত ঐতিহ্যকে অস্বীকার করে।কোনটিই ঠিক নয়।