সাম্প্রদায়িক হিংসা ছড়ানোর নতুন কৌশল

রাম পুনিয়ানি

 


‘আই লাভ মুহাম্মদ’–কে ঘিরে পুরো ঘটনাক্রমটি মুসলমানদের প্রতি ভীতি প্রদর্শন ও প্রান্তিকীকরণের পরিস্থিতিকে আরও গভীর করছে। নিজের ধর্মগুরুর প্রতি ভালোবাসা প্রকাশ করা একেবারেই গণতান্ত্রিক বাকস্বাধীনতার আওতায় পড়ে। যেমন পাকিস্তানে কিছু তালিবানি গোষ্ঠী ভারতের বিরুদ্ধে প্রতিটি সংঘাতকেই ‘গজওয়ায়ে হিন্দ’ বলে দাবি করে, তেমনি আমাদের দেশের প্রধানমন্ত্রীও এখন বিষয়টিকে সেই দিকেই টেনে নিচ্ছেন। পাকিস্তানের বিরুদ্ধে ক্রিকেটে ভারতের জয় উপলক্ষে তিনি বলেছিলেন— “এটি অপারেশন সিঁদুরের সম্প্রসারণ।”

 

ভারতের রাজনীতির অভিশাপ হল সাম্প্রদায়িক হিংসা— যার ইতিহাস এক শতাব্দীরও বেশি পুরনো। গবেষকদের মতে, এ ধরনের হিংসা সচরাচর আকস্মিক নয়, বরং পূর্বপরিকল্পিত। এমন ঘটনার পর সাধারণত সাম্প্রদায়িক মেরুকরণ আরও তীব্র হয়ে ওঠে।[1] তাঁদের আরও মত, “দাঙ্গা জাতিগত মেরুকরণ সৃষ্টি করে, যা কংগ্রেসের ক্ষতির বিনিময়ে জাতি-ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দলগুলিকে সুবিধা দেয়।” গবেষকদের যুক্তি, হিন্দু-মুসলিম দাঙ্গা কংগ্রেসের পক্ষে নির্বাচনীভাবে ক্ষতিকর হলেও, এই দাঙ্গাগুলিই আসলে “কংগ্রেসের মতো বহুজাতিক দলগুলির ক্ষতির বিনিময়ে জাতি-ধর্মনির্ভর দলগুলিকে শক্তিশালী করে।”[2] এই পর্যবেক্ষণ যথার্থ বলেই ক্রমে ক্রমে নতুন নতুন অজুহাত সৃষ্টি করা হচ্ছে— হিংসা উসকে দিয়ে তার রাজনৈতিক ফায়দা তোলার জন্য।

এই দীর্ঘ তালিকায় ক্রমাগত নতুন নতুন অজুহাত যুক্ত হচ্ছে— মসজিদের সামনে উচ্চস্বরে গান বাজানো, মন্দিরে গরুর মাংস ছোড়া, গুজব ছড়ানো— যা ঘৃণার রাজনীতিকে উসকে দেওয়ার কেন্দ্রীয় কৌশল হিসেবে কাজ করছে। এর সঙ্গে আরও যোগ হয়েছে মুসলিম শাসকদের সাক্ষাৎ শয়তান হিসেবে উপস্থাপন করা, তাঁদের দ্বারা মন্দির ধ্বংসের গল্প, তলোয়ারের জোরে ইসলাম বিস্তারের অভিযোগ, এবং তাঁদের বড় পরিবারকে হিন্দুদের সংখ্যালঘু হওয়ার আশঙ্কার সঙ্গে যুক্ত করার মতো ঘৃণা-সৃষ্টিকারী প্রচার। গত কয়েক দশকে এই ঘৃণার অভিধানে যুক্ত হয়েছে নতুন শব্দ ও ধারণা— গরু, গরুর মাংস খাওয়া, ‘লভ জিহাদ’, এবং আরও বহু তথাকথিত ‘জিহাদ’; যার মধ্যে সবচেয়ে প্রচারিত ছিল ‘করোনা জিহাদ’, ‘ল্যান্ড জিহাদ’, এবং সর্বশেষ সংযোজন ‘পেপার লিক জিহাদ’।

এই সমস্ত বিষয়ই নতুন করে মনে পড়ছে, কারণ বর্তমানে দেশজুড়ে যে হিংসার ঢেউ উঠেছে, তার কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছে আপাত নিরীহ এক স্লোগান— “আই লাভ মুহাম্মদ”। ঘটনাটির সূত্রপাত কানপুরে, মিলাদ-উন-নবির শোভাযাত্রা থেকে— যে শোভাযাত্রা নবি মুহাম্মদের জন্মোৎসব উদ্‌যাপন উপলক্ষে অনুষ্ঠিত হয়। শোভাযাত্রায় ‘আই লাভ মুহাম্মদ’ লেখা ব্যানার দেখে কিছু মানুষ আপত্তি তোলেন, তাঁদের বক্তব্য— ধর্মীয় উৎসবে নাকি একটি নতুন প্রথা যুক্ত করা হচ্ছে।

পুলিশের একাংশ সেই যুক্তি মেনে নিয়ে ওই ব্যানার বহনকারীদের বিরুদ্ধে এফআইআর দায়ের করে। অথচ, কোনও শান্তিপূর্ণ শোভাযাত্রা যদি তাদের শ্রদ্ধাভাজনের প্রতি শ্রদ্ধা প্রকাশ করে, তা কোনওভাবেই আইনের লঙ্ঘন নয়। তবুও এই ঘটনাকে কেন্দ্র করে হিংসা ছড়িয়ে পড়ে উত্তরপ্রদেশের একাধিক জেলায়।

কানপুরের ঘটনাই ছিল প্রথম, এবং তার পুনরাবৃত্তি দেখা যায় উত্তরপ্রদেশের বেরিলি, বরাবাঁকি ও মউ জেলায়, পাশাপাশি উত্তরাখণ্ডের উধম সিং নগর জেলার কাশীপুরেও— এবং আরও বহু স্থানে।[3] এরপর শুরু হয় পোস্টার ছেঁড়া ও হিংসার ঘটনা, আর তাতেই ক্রমে বিষাক্ত হয়ে ওঠে পরিবেশ।

অ্যাসোসিয়েশন ফর প্রোটেকশন অব সিভিল রাইটস (APCR)-এর নথি অনুযায়ী, “আই লাভ মুহাম্মদ”-সংক্রান্ত মোট ২১টি এফআইআর দায়ের হয়েছে, যার ফল ভুগছেন ১৩২৪ জন মানুষ এবং ৩৮ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।[4] বেরিলিতে ইন্টারনেট পরিষেবা কয়েকদিনের জন্য বন্ধ রাখা হয়, আর স্থানীয় মুসলিম নেতা মওলানা তাউকির রাজা খানকে এক সপ্তাহ গৃহবন্দি করে রাখা হয়। তিনি অভিযোগ করেছিলেন, মুসলমানদের নির্বিচারে হয়রানি করা হচ্ছে। কানপুর ঘটনার প্রতিবাদে একটি স্মারকলিপি জমা দেওয়ার আহ্বান জানিয়েছিলেন তিনি, কিন্তু নিজে উপস্থিত হননি— ফলে পরিস্থিতি বিশৃঙ্খল হয়ে ওঠে। তাঁর এই দায়িত্বজ্ঞানহীন আচরণের ফলে বহু মুসলমানকে গ্রেপ্তার হতে হয়।

সমগ্র ঘটনাক্রমটি আবারও উন্মোচিত করেছে মুসলমানদের প্রতি সমাজের অন্তর্নিহিত ঘৃণাকে। প্রায় সব সময়ের মতোই এবারও দেখা গেল— শীর্ষ সাম্প্রদায়িক নেতাদের ইঙ্গিতপূর্ণ মন্তব্য হিংস্র মনোভাবকে উসকে দিল, যার ফলে ঘৃণা ছড়ানোর প্রচার আরও তীব্র হয়ে উঠল এবং শেষমেশ তা হিংসায় পরিণত হল।

প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি নিজেও বারবার, বিশেষত নির্বাচনের সময়, এমন ইঙ্গিতপূর্ণ বক্তব্য দিয়ে থাকেন। এবার তাঁদের প্রচারে উঠে এসেছে একটি শব্দ— ‘ঘুসপৈঠিয়ে’ (অর্থাৎ অনুপ্রবেশকারী)। এই শব্দ এখন বিশেষ করে বিহার ও আসামের মুসলমানদের জন্য অভিশাপ হয়ে দাঁড়িয়েছে। ভয়ঙ্কর SIR (Special Intensive Registration) প্রকল্পের অন্যতম অজুহাত হিসেবেও এই ধারণাকে ব্যবহার করা হচ্ছে— যে প্রকল্প বিহারের পর সারা দেশে চালু করার পরিকল্পনা রয়েছে। বিহারেই ইতিমধ্যে প্রায় ৪৭ লক্ষ ভোটারকে ভোটাধিকার থেকে বঞ্চিত করা হয়েছে।

এইবার উত্তরপ্রদেশে, যেখানে সবচেয়ে বেশি সাম্প্রদায়িক উত্তেজনার ঘটনা ঘটেছে, রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী যোগী আদিত্যনাথ এমন কিছু মন্তব্য করেছেন যা একজন মুখ্যমন্ত্রীর পদমর্যাদার সঙ্গে মোটেও মানানসই নয়। তিনি ঘোষণা করেছেন, যারা ‘গজওয়ায়ে হিন্দ’ স্লোগান তোলার স্বপ্ন দেখছে, তাঁদের তিনি “নরকে পাঠাবেন”।

কিন্তু প্রশ্ন হল— এখানে হঠাৎ ‘গজওয়ায়ে হিন্দ’-এর প্রসঙ্গই বা এল কোথা থেকে? ভারতীয় মুসলমানদের একটি অংশ তো কেবলই ‘আই লাভ মুহাম্মদ’— এই নিরীহ স্লোগান তুলছিল, ‘গজওয়া’ নয়। ‘গজওয়ায়ে হিন্দ’ ধারণাটি ব্যবহার করে তালিবান-ধরনের উগ্র গোষ্ঠীগুলি, অথচ হিন্দুত্ববাদী ডানপন্থীরা সেটিকেই অজুহাত করে গোটা মুসলিম সমাজকে অভিযুক্ত করছে। প্রকৃতপক্ষে ‘গজওয়ায়ে হিন্দ’ শব্দটি কোরানে কোথাও নেই। একটি সন্দেহজনক হাদিসে এই শব্দের উল্লেখ পাওয়া যায়, কিন্তু সেখানে ‘হিন্দ’ বলতে বোঝানো হয়েছে বসরা অঞ্চলকে, ভারতকে নয়।[5] পাকিস্তানে অবশ্য কিছু উগ্রপন্থী দাবি করে যে ভারতের বিরুদ্ধে প্রতিটি যুদ্ধই নাকি ‘গজওয়ায়ে হিন্দ’।

যোগী আদিত্যনাথ আরও বলেন, “‘আই লাভ মুহাম্মদ’ লেখা পোস্টারগুলি বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করার জন্য ব্যবহার করা হচ্ছে।” তিনি তথাকথিত ‘অহিন্দু’ ও ‘রাষ্ট্রবিরোধী’ কর্মকাণ্ডের বিরুদ্ধে হিন্দুদের সতর্ক থাকতে বলেন।[6] এটি ভারতের বৃহত্তম সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে বিদ্বেষ সৃষ্টির এক চরম উদাহরণ। প্রশ্ন হল— এই স্লোগান কীভাবে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করতে পারে? কিংবা কীভাবে এটি ‘রাষ্ট্রবিরোধী’? এমন অভিযোগ বোঝা সত্যিই কঠিন। তাঁর এই মন্তব্য শুধু অযৌক্তিক নয়, বরং গণতান্ত্রিক আদর্শের পরিপন্থী— যে আদর্শ আমাদের শান্তিপূর্ণভাবে নিজের অনুভূতি প্রকাশ করার অধিকার দেয়।

‘আই লাভ মুহাম্মদ’–কে ঘিরে পুরো ঘটনাক্রমটি মুসলমানদের প্রতি ভীতি প্রদর্শন ও প্রান্তিকীকরণের পরিস্থিতিকে আরও গভীর করছে। নিজের ধর্মগুরুর প্রতি ভালোবাসা প্রকাশ করা একেবারেই গণতান্ত্রিক বাকস্বাধীনতার আওতায় পড়ে। যেমন পাকিস্তানে কিছু তালিবানি গোষ্ঠী ভারতের বিরুদ্ধে প্রতিটি সংঘাতকেই ‘গজওয়ায়ে হিন্দ’ বলে দাবি করে, তেমনি আমাদের দেশের প্রধানমন্ত্রীও এখন বিষয়টিকে সেই দিকেই টেনে নিচ্ছেন। পাকিস্তানের বিরুদ্ধে ক্রিকেটে ভারতের জয় উপলক্ষে তিনি বলেছিলেন— “এটি অপারেশন সিঁদুরের সম্প্রসারণ।”

এই পরিস্থিতিতে মুসলিম সম্প্রদায় কীভাবে প্রতিক্রিয়া দেখাবে? শান্তিপূর্ণ শোভাযাত্রা আয়োজন করাটা একেবারেই স্বাভাবিক, বিশেষত যখন তুলনা করা হয় রামনবমী শোভাযাত্রার সঙ্গে— যেখানে উচ্চস্বরে ডিজের মিউজিক বাজানো হয় এবং মসজিদের উপর গেরুয়া পতাকা উড়ানো হয়! আমাদের কিছু হিন্দু উৎসবকে অস্ত্রসজ্জিত করা হচ্ছে।

ইরফান ইঞ্জিনিয়ার ও নেহা দাভাদের বই Weaponization of Hindu Festivals–এ লেখকদের সরেজমিন তদন্ত দেখিয়েছে, বিশেষ করে রামনবমী শোভাযাত্রা মসজিদ এবং মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ এলাকায় বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করার জন্য ব্যবহার করা হচ্ছে।[7] এরই আরেকটি দিক হল মুসলিম উৎসবগুলিকে হীন হিসেবে উপস্থাপন করা। মিলাদ-উন-নবির সময় ‘আই লাভ মুহাম্মদ’-এর ঘটনা এরই এক জাজ্বল্যমান দৃষ্টান্ত।

মুসলিম উৎসবের প্রতি সাম্প্রদায়িক এই ধরনের বিদ্বেষপূর্ণ প্রতিক্রিয়া, যেমন সাম্প্রতিক সময়ে দেখা গেছে, মানুষের হৃদয়কে আরও ভাগ করে দেয়, সম্প্রদায়কে মেরুকরণে ঠেলে দেয় এবং আমাদের ভ্রাতৃত্বের মূল্যবোধকে ক্ষুণ্ণ করে— যা ভারতীয় সংবিধানের একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ। এছাড়া, উত্তরপ্রদেশের মুখ্যমন্ত্রীর তরফে যে ধরনের মন্তব্য করা হচ্ছে, তা সংবিধানিক নৈতিকতার সম্পূর্ণ পরিপন্থী। মুসলিম সম্প্রদায়কে বাস্তবসম্মত হতে হবে এবং হিন্দু উগ্রবাদীদের কোনও ধরনের অজুহাত না দেওয়ার চেষ্টা করতে হবে, যাতে তারা তাঁদের উপর আক্রমণ চালাতে বা তাঁদের আরও অবমাননা করতে না পারে।


[1] Bhattacharya, DP. BJP gains in polls after every riot, says Yale study. ET. Dec 5, 2014.
[2] পূর্বোক্ত।
[3] Mujtaba, Syed Ali. Anatomy of “I love Muhammad” Communal Riots in India. TIO. Sep 28, 2025.
[4] Rizvi, Asad. ‘I Love Muhammad’ Banner Controversy: How Routine Decoration in Kanpur Sparked Nationwide Protests, Crackdowns. The Wire. Sep 29, 2025.
[5] GHAZVA-E-HIND पर क्या कहते हैं इस्लाम के एक्सपर्ट? The Credible History. Youtube.com.
[6] ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস, মুম্বই সংস্করণ, ২৯ সেপ্টেম্বর, পৃষ্ঠা ৬।
[7] Weaponisation of Hindu Festivals by Irfan Engineer and Neha Dabhade Explores the Rise of Anti-Muslim Hate. Radiance News. Nov 20, 2024.


*নিবন্ধটি গত ২ অক্টোবর নিউজক্লিক-এ ইংরেজিতে প্রকাশিত

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 5222 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

Be the first to comment

আপনার মতামত...