আরেকটু কাল বেঁচেই থাকি, পড়ার আনন্দে

মধুশ্রী বন্দ্যোপাধ্যায়

 



প্রাক্তন অধ্যাপক, গবেষক ও লেখক

 

 

 

দিগন্তবিস্তারী ময়দান থেকে অস্থায়ী মিলন মেলা, সেখান থেকে সল্টলেক সেন্ট্রাল পার্ক। এই হল কলকাতা বইমেলার সাড়ে চার দশকের পথপরিক্রমা। অবশ্য সেই অর্থে বইমেলা আর কলকাতাতে নেই। চলে গেছে ডিহি কলকাতার সীমানা ছাড়িয়ে; নোনা জলের ইতিহাস গায়ে মেখে ছাঁচে ফেলা, সুসজ্জিত, নব্য ধনশালীদের জন্য যে উপনগরী গড়ে উঠেছে সেইখানে।

সে ছিল একদিন, যখন পাখির চোখে দেখা যেত এখানে-ওখানে ইট বাঁধানো রাস্তার পাশে ম্যারাপ ঢাকা বইয়ের ক্ষণস্থায়ী দোকান, সেই দোকানে চলে আগ্রহী, কচি ও তরুণ মুখের ক্রেতার সঙ্গে আশাবাদী, পরিণত বিক্রেতার দেখা-শোনা, বেচা-কেনা। সেখানে মা বাবার সঙ্গে ছেলেমেয়েরা হাঁটত আর হাঁটত, তবু ক্লান্ত হত না। তারা কিনত ‘একশ ভূতের গল্প’, দুহাতে বন্দুকের ছবি দেওয়া গোয়েন্দা গল্প, অথবা বিক্রি হত অমল দাশগুপ্তর ‘মহাকাশের ঠিকানা’, আবার কেউ কিনছে ‘টেনিদা সমগ্র’, পাগলা দাশু। সেই ফাঁকে মায়েরাও চোখ বুলিয়ে নিচ্ছেন কোনও ঐতিহাসিক উপন্যাসে। তবে কেনার রসদ ফুরিয়ে গেছে। ছেলেমেয়ের পছন্দের চার-পাঁচটা বই কিনে মধ্যবিত্ত মায়ের বাজেট শেষ।

বইমেলা বাঙালি মধ্যবিত্তের চতুর্দশ পার্বণ।

হাঁটতে গিয়ে চোখ আটকে যেত পথের পাশে বসে থাকা ছবি আঁকিয়ের স্কেচে। কবিতার পাতায়, ঝালমুড়ির ঠোঙায়। মেলা হবে— তাতে গল্প হবে না, আড্ডা থাকবে না, মুড়ি থাকবে না, পথের পাশে ছোট ম্যাগাজিন নিয়ে ছেলেমেয়েরা বসবে না, তা কি হয়? মুড়ি-বাদাম খেতে খেতেই তো বইয়ের পাতা উল্টে দেখতে হবে, তাতেই তো আমোদ। তবে বাদামের সঙ্গে দু-চারটে বইও কিনতে হবে। সেকথা বইমেলার ছোট বড় নবীন প্রবীণ আগন্তুক— সকলে জানত।

আর প্রকাশকরাও জানতেন। তাই তাঁরাও পসরা সাজাতেন। সারা বছরের একটা বড় বিক্রিবাটা হবে, তার প্রস্তুতি চলত সেই পুজোর সময় থেকেই। কলেজের ছেলেমেয়েরা যথাক্রমে দাড়ি ও শাড়ির আঁচল উড়িয়ে, সিগারেটের ধোঁয়া ছেড়ে ছোট দোকানের পাশে দাঁড়িয়ে একমনে পড়ে যেত গ্রামশির রাষ্ট্রচিন্তা বা ক্রিস্টোফার কডওয়েলের ‘ইল্যুশন অ্যান্ড রিয়ালিটি’। অথবা বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায় থেকে দেবীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায়। এই শিশু, কিশোর, তরুণরাই তো কলকাতার প্রাণস্পন্দন ছড়িয়ে দিত গ্রাম নগর মাঠ পাথার বন্দরে। শহরে ও মফস্বলে— বিদ্যালয় থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ে।

তারপরে একদিন বইমেলাকে ঠেলেঠুলে পুটলি পাকিয়ে মিলনমেলার ঘেরাটোপে ভরে ফেলা হল। অবশ্য একান্ত বাধ্য হয়েই সেসব করতে হল। তবে কংক্রিটের বাক্সে তো ময়দানের বন্ধনহীন অবরোধমুক্ত, গঙ্গার বাতাস ভেজা, যানবাহনসহায়ক মেলাপ্রাঙ্গন হতে পারে না। তাই সেখানে মেলা খুব বেশিদিন জমল না, জমা সম্ভব নয়। মেলা চলে গেল, একেবারে কলকাতা ছাড়িয়ে সল্টলেক সেন্ট্রাল পার্কে। একদিকে ভালই হল, কলকাতা ছাড়িয়ে গেল, কলকাতা ছড়িয়ে গেল। নাড়ির বাঁধন কেটে গেল। তবে সারা বাংলাই তো আজও দাঁড়িয়ে আছে কলকাতাকে কেন্দ্র করে। নাড়ি কাটলেও কোল ছাড়ল না। সেন্ট্রাল পার্ক বিরাট এক উদ্যান মাত্র। ময়দান নয়। পরিবর্তন অবধারিত। পরিবর্তন নিয়ে হাহুতাশ করা অর্থহীন। পরিবর্তন মেনে নিতে হয়, নয়তো পরিবর্তনকে পাল্টে দিতে মাঠেময়দানে নামতে হয়।

উদ্যানেও প্রকাশকরা সেজে ওঠেন নিজেদের বইয়ের পসরা নিয়ে, লেখকরা নতুন বইয়ের বিক্রি নিয়ে উদগ্রীব হয়ে ওঠেন।

ময়দানের বইমেলাতে যেতাম যখন ছিলাম স্কুল-কলেজের ছাত্র। পাড়ার লাইব্রেরির জন্য বইয়ের তালিকা তৈরি করেছি, প্রথম চাকরিতে যোগদান করে ডিপার্টমেন্টের জন্য বই কিনেছি, সন্তানকে বেছে বেছে বই কিনে দিয়েছি। সে ছিল অন্য এক আশার দিন। শুনতাম দেশি ও বিদেশি লেখকদের বক্তব্য, প্রশ্নোত্তর। জানার চাহিদা তাতে বেড়ে যেত। সেন্ট্রাল পার্কে এমন কিছু আয়োজন তো চোখে পড়ে না। লেখক ও পাঠকের মিথস্ক্রিয়ার বড় দরকার। বইমেলা ছাড়া আর কোন স্থান আছে এর চেয়ে মহত্তর? সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়, মুলকরাজ আনন্দ, অশীন দাশগুপ্ত, চিন্তামণি কর, রাজা রামান্না বা বি ডি নাগচৌধুরী অথবা নুরুল হাসান বা পল থেরক্স-এর উপস্থিতি ও উদ্বোধন যেন মহিমান্বিত করত বইমেলাকে, তার ভাবগাম্ভীর্য ছড়িয়ে পড়ত মানচিত্রের সীমানা ছাড়িয়ে, দেশে ও বিদেশে, বাঙালি মননের প্রতীক হিসাবে। সেই সুর আর বাজে না। নিভু নিভু বাঙালির মনীষার মতো?

আর নবীন পাঠক! তার ঔৎসুক্য আছে, তাকে জাগিয়ে তোলার দায়িত্ব নিতে হবে প্রাথমিকভাবে পরিবারকে, তারপরে রাষ্ট্র, বিদ্যালয়, প্রকাশক ও সমাজকে। আজও ছেলেমেয়েরা মা-বাবার সঙ্গে যায় বইমেলাতে। সেখানে তারা বই কেনে। চাঁদের পাহাড় কেনে তো? দুরন্ত ঈগল? লীলা মজুমদারের পদী পিসির বর্মী বাক্স? যে বই কেনে সেগুলো পড়ে তো? নাকি শুধুই ভূত আর ডাইনির গল্প কেনে? অথবা ইংরেজি বই? বা ইংরেজি কমিক্সের বাংলা অনুকরণ? স্রোতের মত যে উদ্ভাসিত যুবক যুবতী আসছে, দেখছে, চলে যাচ্ছে, তারা বই কিনছেন তো, নাকি বারো দিন সেন্ট্রাল পার্ক শুধুই ডেটিং স্পট? কলকাতা আন্তর্জাতিক বইমেলা থেকে বই কেনার বাধ্যবাধকতা আছে রাজ্যের গ্রন্থাগারগুলোর? ওঁচা বইয়ের পাশাপাশি কিছু ভাল বইও রাজ্যের প্রতিটি গ্রন্থাগারে বইমেলা থেকে কেনা বাধ্যতামূলক করা যায়?

বইয়ের বাজার আছে, তবে তাতে পাঠ্য বই, মানে বই, গুপ্তঘাতক মার্কা বই, ভূত পেত্নি দত্যি দানো, যৌনতা বিষয়ক হলদে বই, বাধ্যতামূলক ওঁচা বই একটা বড় অংশ দখল করে রেখেছে। তবে ভাল বইয়ের তো কোনও বিকল্প নেই। কোনও বিকল্প হয় না। এই বিষয়ে মা বাবা ও স্কুলের দিদি ও মাস্টারমশাইরা একটু যত্ন নিলে বড্ড উপকার হয়। বই তো শুধু নম্বর পাওয়ার যন্ত্র নয়। টেলি, ফোন ও অন্যান্য যন্ত্র এদের হাতে পড়ার আগে আমরা সন্তানের হাতে দিতে পারি দু-চারটে বই। সমস্ত কূপমণ্ডুকতা থেকে মুক্তি দিয়ে সেই বই এদের দিতে পারে ভিন্ন পথের সন্ধান, জাগিয়ে তুলতে পারে আলো-আঁধার ঘেরা গভীর বিস্ময়। আমাদের চেনা বৃত্তের বাইরে এই যে বিরাট পৃথিবী, তাতে আছে হরেক মানুষ হরেক ভাবনা। বিজ্ঞান, ভূগোল ও ইতিহাসের পথে সেই জীবনের স্বাদ সন্ততিকে দেওয়া পিতৃপুরুষের শ্রেষ্ঠ উপহার।

মা রে, নিভন্ত এই চুল্লিতে, একটু আগুন দে।

 

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 4664 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

Be the first to comment

আপনার মতামত...