আশীষ লাহিড়ী
সঙ্ঘ পরিবারের হিন্দুত্ববাদী প্রকল্প রূপায়ণের প্রধান প্রতিপক্ষ দক্ষিণ ভারত। তাদের ভাষাগত আবেগ প্রবল। তামিল, মালায়লম, কন্নড়ের মতো প্রাচীন ভাষা কোনও শর্তেই হিন্দি ভাষার আধিপত্য স্বীকার করবে না। এইসব মানুষদের নিজেদের ভাষার প্রতি অনুরাগ এতখানি গভীর যে হিন্দি ভাষার আগ্রাসনের বিরুদ্ধে তাঁরা রুখে দাঁড়াবেন এবং দাঁড়াচ্ছেনও। সমস্যাটা হচ্ছে আমাদের, অর্থাৎ পশ্চিমবঙ্গের বাঙালিদের নিয়ে। আমরা আমাদের মাতৃভাষা নিয়ে এতটা উদাসীন বা ক্ষেত্রবিশেষে লজ্জিত, যে নিজেদের ভাষাগত পরিচয়কে রক্ষা করার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করি না। বাংলা ভাষা বাঁচল কি মরল— তাতে অধিকাংশ তথাকথিত শিক্ষিত উচ্চ ও মধ্যবিত্ত বাঙালির কিছুমাত্র এসে যায় না
বিগত কয়েক বছর ধরে আমরা টের পাচ্ছি, দেশের বিভিন্ন প্রান্তে নিম্নবিত্ত বাঙালির প্রতি বিদ্বেষ ও বিরূপতা হঠাৎ করে মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে। এই ধরনের প্রবণতা যে আগে কখনও ছিল না তা নয়। একসময়ে আসামে ‘বঙ্গালি খেদাও’ বিক্ষোভের কথা আমরা জানি। দেশভাগ, পূর্ব পাকিস্তানের মুক্তিযুদ্ধ থেকে শুরু করে একেবারে হালের বাংলাদেশে গণঅভ্যুত্থান পর্যন্ত বিভিন্ন ঘটনা-দুর্ঘটনায় ওপার থেকে ঘরছাড়া, কর্মহীন, শঙ্কিত মানুষের ঢল ধারাবাহিকভাবে এ-দেশে এসেছে। ফলে সীমান্তবর্তী রাজ্যগুলির ওপর কিছুটা হলেও জনসংখ্যার চাপ বেড়েছে, যা কিছু সংখ্যক মানুষের মনে বাংলাভাষীদের প্রতি বিরূপতার জন্ম দিয়েছে। এছাড়াও ব্রিটিশ আমল থেকেই বাংলা-সহ প্রতিবেশী রাজ্যগুলিতে বিভিন্ন সরকারি উঁচুপদে বাঙালিদের উপস্থিতি ছিল চোখের পড়ার মতো। কলকাতা ব্রিটিশ শাসনের কেন্দ্র হওয়ার দরুন দেশের তথাকথিত শিক্ষিত মধ্যবিত্ত সম্প্রদায়ের উন্মেষকালে বাঙালিরাই ছিল সর্বপ্রথম ও সংখ্যাধিক৷ কিন্তু প্রতিবেশী রাজ্যগুলিতে পরবর্তী প্রজন্ম খানিক পরে শিক্ষায় দীক্ষায় এগিয়ে এসেছে, ফলত উচ্চপদগুলি নিজগুণে দখল করে রাখা বঙ্গসন্তানেরা একসময় তাদের অসূয়ার কারণ হয়েছে। উপরে উঠে আসা ভূমিপুত্ররা ক্রমে নিজেদের অধিকার সম্বন্ধে সচেতন হয়েছেন, এবং তার ফলে বাঙালিদের সঙ্গে তাদের কিছু ক্ষেত্রে সংঘাতও ঘটেছে। এই ঐতিহাসিক তথ্যগুলি আমরা সকলে জানি।

কিন্তু বর্তমানে দেশের কোনও কোনও জায়গায় যে বাংলা-বিদ্বেষের সুর শোনা যাচ্ছে, তার প্রেক্ষাপট আলাদা এবং রাজনীতি আরও জটিল। এককথায় বলতে গেলে, আজকের এই ঘটনাগুলি রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘ ও তাদের রাজনৈতিক সংগঠন বিজেপির চির পুরনো ‘হিন্দু-হিন্দি-হিন্দুস্তান’ প্রকল্পের অংশ। এই প্রকল্প অনুযায়ী, ভারতবর্ষ হিন্দুদের দেশ, এবং হিন্দুদের প্রধানতম ভাষা হিন্দি, হিন্দুদের পবিত্র ভূমি আর্যাবর্তের ভাষা হিন্দি, তাই হিন্দুস্তানে যারা থাকবে, তাদের হিন্দুত্ব ও হিন্দি ভাষার প্রাধান্য মেনেই থাকতে হবে। বলে রাখা দরকার, এখানে হিন্দু অর্থে ভারত-ভূখণ্ডে বহুধাবিস্তৃত ও বৈচিত্র্যময় হিন্দুসমাজের সামগ্রিক রূপটি মোটেই বিবেচিত নয়, বরং তার একটি অত্যন্ত সঙ্কীর্ণ ও আবদ্ধ সংস্করণ ব্রাহ্মণ্যবাদই বিবেচ্য। আরএসএস-বিজেপি নিজের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক স্বার্থে ‘হিন্দুত্ব’ নাম দিয়ে সেটাকেই বাজারে বেচার চেষ্টা করছে। এই হিন্দুত্ববাদী প্রকল্প রূপায়ণের বিরুদ্ধে হিন্দুত্ব গোষ্ঠীর প্রধান প্রতিপক্ষ দক্ষিণ ভারত। তাদের ভাষাগত আবেগ প্রবল। তামিল, মালায়লম, কন্নড়ের মতো প্রাচীন ভাষা কোনও শর্তেই হিন্দি ভাষার আধিপত্য স্বীকার করবে না। এইসব মানুষদের নিজেদের ভাষার প্রতি অনুরাগ এতখানি গভীর যে হিন্দি ভাষার আগ্রাসনের বিরুদ্ধে তারা রুখে দাঁড়াবেন এবং দাঁড়াচ্ছেনও।
সমস্যাটা হচ্ছে আমাদের, অর্থাৎ পশ্চিমবঙ্গের বাঙালিদের নিয়ে। আমরা আমাদের মাতৃভাষা নিয়ে এতটা উদাসীন বা ক্ষেত্রবিশেষে লজ্জিত, যে নিজেদের ভাষাগত পরিচয়কে রক্ষা করার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করি না। বাংলা ভাষা বাঁচল কি মরল— তাতে অধিকাংশ তথাকথিত শিক্ষিত উচ্চ ও মধ্যবিত্ত বাঙালির কিছুমাত্র এসে যায় না। এখানে ‘শিক্ষিত’ বলতে শুধুমাত্র ডিগ্রিধারী ও সরকারি বা কর্পোরেট চাকুরিতে উচ্চপদে বহাল বাঙালিদের কথাই বলতে চাইছি। বলে রাখা দরকার, হিন্দি ভাষাকে আমি একেবারেই ছোট করছি না। হিন্দি নিজেই একটি অত্যন্ত উচ্চমানের ও সমৃদ্ধ ভাষা। যে ভাষায় মুন্সি প্রেমচন্দের মতো মানুষ লিখেছেন, সে ভাষাকে ছোট করার কোনও প্রশ্নই ওঠে না। কিন্তু অন্য ভাষিক জনগোষ্ঠীর ওপর জোর করে হিন্দি ভাষা চাপিয়ে দেওয়াটা সম্পূর্ণভাবে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত।

এবার এই ‘হিন্দু-হিন্দি-হিন্দুস্তান’ প্রকল্পের উদ্যোক্তারা দেখছেন দক্ষিণ ভারত এই প্রকল্পের বিরোধিতা করলেও, পূর্ব ভারত, যেখানকার একটি প্রধান ভাষা বাংলা, সেখানে এর বিরোধিতা সবচেয়ে কম। একটু আগেই যে শিক্ষিত বাঙালিদের কথা বললাম, যারা বড় বড় চাকুরিজীবী বা অর্থনৈতিকভাবে অনেকটা এগিয়ে থাকা, তাদের মধ্যে বাংলাভাষার চর্চা একপ্রকার উঠেই গেছে, তাদের পক্ষ থেকে ভাষিক আগ্রাসনের বিরুদ্ধে কোনও প্রতিরোধই গড়ে উঠবে না৷ ফলে এদের নিয়ে হিন্দি-হিন্দু আগ্রাসী রাজনৈতিক শিবিরের কোনও মাথাব্যথা নেই। বদলে তারা আক্রমণ শুরু করছে বাংলাভাষী দরিদ্র অভিবাসী শ্রমিকদের ওপর, যারা ধর্মপরিচয়ে মূলত মুসলমান ও নিম্নবর্গের হিন্দু, যাৱা ইংরেজি জানে না, হিন্দি অল্পস্বল্প। অর্থাৎ এখানে হিন্দুরাষ্ট্রের প্রচারকেরা এক ঢিলে দুই পাখি মারতে পারছে। প্রথমত, হিন্দি ভাষার ভাষিক আক্রমণটা নেমে আসছে নিম্নবিত্ত বাংলাভাষী মানুষদের ওপরে। দ্বিতীয়ত, একইসঙ্গে আক্রমণের লক্ষ হয়ে উঠছেন মুসলমান ও নিম্নবর্ণ ‘হিন্দু’ দলিতরা। আর্যাবর্তের হিন্দুরাষ্ট্রে এই দুই গোষ্ঠীরই কোনও স্থান নেই, বা স্থান থাকলেও তা বর্ণব্যবস্থার একদম তলায়, অন্য সকলের পায়ের নিচে। অর্থাৎ দরিদ্র বাঙালি মুসলমান ও দলিতদের ওপর আরএসএস-বিজেপির আক্রমণ ‘হিন্দু-হিন্দি-হিন্দুস্তান’ প্রকল্পের সবকটি অ্যাজেন্ডাই সফল করে তুলছে।
আর এই আক্রমণটা করতে গিয়ে খুব সুবিধেজনক এক পথ নিয়েছে হিন্দুত্ববাদীরা। বাংলাদেশ সীমান্ত দিয়ে পশ্চিমবঙ্গে অনুপ্রবেশ ঘটছে— এই মর্মে বাংলাভাষীদের বিরুদ্ধে জনমত তৈরি করা সহজ হয়েছে। অনুপ্রবেশ যে ঘটছে এটা সত্যি। বিশেষ করে, বর্তমানে বাংলাদেশের বিচিত্র রাজনৈতিক অবস্থা ও অন্যান্য অর্থনৈতিক কারণে সেখান থেকে পশ্চিমবঙ্গে অনুপ্রবেশ ঘটে চলেছে৷ এ-কথাও সত্যি, যাঁরা ওপার থেকে এদিকে আসছেন তাঁদের মধ্যে শুধু হিন্দুরা নয়, মুসলমানরাও আছেন। আমাদের মনে পড়বে, ২০১৯-এ বিজেপি সরকার সারা দেশে সিএএ আইন কার্যকর করার করা ঘোষণা করছিল, যা শুধুমাত্র এ-দেশে চলে আসা হিন্দুদের নাগরিকত্ব দেওয়ার কথা বলেছিল। বাংলাদেশে নির্যাতিত হয়ে বা চাকরি-বাকরি না পেয়ে এ-দেশে যেসব হিন্দুরা চলে আসছে, ভারত সরকার তাদের পাশে থাকবে, অথচ এই একই নীতি মুসলমানদের প্রতি কার্যকর হবে না! অবশ্য বিজেপিশাসিত রাজ্য অসম এ-দেশে আসা হিন্দুদের নাগরিকত্ব দেওয়ার বিরুদ্ধেও পথে নেমেছিল— সে অবশ্য অন্য প্রসঙ্গ। মূল কথা, প্রস্তাবিত হিন্দুরাষ্ট্রে মুসলমানদের সমান অধিকার নেই, এ-দেশে বসবাস করলেও তারা দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিক।
বিগত কয়েক বছরে এই প্রকল্প আরও একধাপ এগিয়ে গেছে। ভারতের নাগরিক-বেনাগরিক নির্বিশেষে বাংলাভাষী মুসলমানকে তারা বিচ্ছিন্ন করতে চাইছে। বাংলা ভাষায় কথা বলা গরিব মুসলমান-মাত্রেই তাকে অনুপ্রবেশকারী তকমা দিয়ে অবৈধ ঘোষণা করা হচ্ছে। এমনও ঘটনা ঘটেছে যে, অন্য রাজ্যে কর্মরত পশ্চিমবঙ্গের মুসলিম ব্যক্তিকে অনুপ্রবেশকারী হিসেবে দেগে দিয়ে বাংলাদেশে ‘পুশব্যাক’ করে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছিল, পরে আমাদের রাজ্য সরকারের হস্তক্ষেপে তাঁকে এ-দেশে ফিরিয়ে আনা হয়েছে। যেসব বাঙালি বড় চাকুরে, যে মূলত ইংরেজি বা হিন্দিতে কথা বলে, এবং হিন্দু, বাংলা প্রায় বলেই না, এমন মানুষদের আক্রমণের বাইরে রাখা হচ্ছে। বাংলা ছাড়া আর অন্য কোনও ভাষা না জানা অল্পবিত্ত বা দরিদ্র শ্রমজীবী বাঙালিরাই, যাঁদের বেশিরভাগই মুসলমান, তাঁরাই আপাতত এই আগ্রাসনের মূল লক্ষ্য।

আমাদের দুর্ভাগ্য, পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যটি বর্তমানে রাজনৈতিক অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক সমস্ত দিক থেকে অবক্ষয়ের চরম সীমায় এসে পৌঁছেছে। এ রাজ্যে গরিব মানুষের গ্রাসাচ্ছাদনের জন্য যথেষ্ট কাজকর্ম নেই, ফলত তাঁদের পেটের দায়ে পাড়ি দিতে হচ্ছে অন্য রাজ্যে, উত্তর বা পশ্চিমের অপেক্ষাকৃত স্বচ্ছল রাজ্যগুলিতে, এবং সেখানে গিয়ে বাংলাভাষায় কথা বলার ‘অপরাধে’ তাদের এহেন বিড়ম্বনার শিকার হতে হচ্ছে। আর এই পুরো প্রক্রিয়াটিই ঘটছে হিন্দুরাষ্ট্র প্রকল্পের সঙ্গে অত্যন্ত সাযুজ্যপূর্ণ উপায়ে। অর্থাৎ অনুপ্রবেশের বাস্তব সমস্যাটির সুযোগ নিয়ে দেশজুড়ে হিন্দু বনাম মুসলমান, বাংলাভাষী বনাম বাংলাদেশি, হিন্দি বনাম বাংলা ইত্যাদি বিভাজনের প্রসঙ্গ টেনে এনে পুরো বিষয়টিকে গুলিয়ে দেওয়া হচ্ছে। সবচেয়ে দুঃখের কথা, দেশের বহু সাধারণ মানুষ, এমনকি পশ্চিম বাংলার হিন্দু বাঙালিদেরও একটা অংশ, এই প্রচারে প্রভাবিত হচ্ছেন এবং পুরো ঘটনাকে ন্যায়সঙ্গত মনে করে সমর্থনও করছেন। দরিদ্র মুসলমান বাঙালির ওপর আক্রমণ হলে মধ্যবিত্ত ও উচ্চবিত্ত হিন্দু বাঙালির একটা বড় অংশ বিচলিত হয় না, দুঃখ বোধ করে না, কারণ আক্রান্তরা তো শেষ বিচারে মুসলমান, বাঙালি হিন্দুগোষ্ঠীর তো কেউ নয়। এই সাম্প্রদায়িক বিভেদ বা বিভাজনটা তথাকথিত বর্ণহিন্দুদের মনের মধ্যে বহুদিন ধরে, এমনকি স্বাধীনতার আগে থেকেই মজুত ছিল, আজ উপযুক্ত রাজনৈতিক পরিবেশে পুষ্ট হয়ে চক্ষুলজ্জার তোয়াক্কা না করে প্রকাশ্যে বেরিয়ে এসেছে। ফলে আরএসএস-বিজেপির ‘হিন্দু-হিন্দি-হিন্দুস্তান’ প্রকল্প অংশত সফল হয়েই গেছে বলা যায়।

এই প্রসঙ্গে যেটা বারবার বলা দরকার, এটা কিন্তু কোনওভাবেই বাঙালিদের সঙ্গে অবাঙালিদের দ্বন্দ্ব নয়। এই ঘটনাক্রমকে কেন্দ্র করে যদি পশ্চিমবাংলার বাঙালিদের সঙ্গে ব্যাঙ্গালোর বা কর্নাটকের কন্নড় অধিবাসীদের মধ্যে, অথবা পাটনা, দিল্লি বা চেন্নাইয়ের বাসিন্দাদের মধ্যে বিভেদের সূত্রপাত হয়, তার চেয়ে দুঃখের আর কিছু হবে না। হয়তো আরএসএস-বিজেপি এই পারস্পরিক বিভাজনটাই চাইছে। তারা চাইছে এটা ক্রমে বাঙালি উগ্র জাতীয়তাবাদে পরিণত হোক। তাতে মূলগত সমস্যাটা ধামাচাপা পড়ে যাবে, বাঙালি বনাম অবাঙালি ইস্যুটাই প্রধানতম হয়ে উঠবে, বিভাজনের রাজনীতিতে ভর করে আরও কিছু ভোট কুড়িয়ে নেওয়া যাবে। আমি ভুল হতে পারি, কিন্তু আপাতত যেটুকু তথ্য হাতে আছে, তার ভিত্তিতে এমনটাই আমার মনে হচ্ছে।
অবশ্য এখনও আমাদের দেশে অনেক মানুষ আছেন, বিশেষ করে একটা বড় অংশের সাধারণ শিক্ষিত মধ্যবিত্ত জনগণ, যাঁরা খোলা চোখে দেখেন, খোলা মনে ভাবতে পারেন। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে, তাঁদের কাছেও হিন্দুধর্মের নামে হিন্দুত্ববাদের এই আগ্রাসী রূপটি এখনও স্পষ্ট নয়। বিজেপির হিন্দুত্ববাদ যে আসলে হিন্দুধর্ম নয়, সেটা এঁদের কাছে স্পষ্ট করে বলা দরকার, যুক্তি ও তথ্য দিয়ে বুঝিয়ে দেওয়া দরকার। তা না হলে, হিন্দি-হিন্দু-হিন্দুস্তান প্রকল্পটিকে ব্যর্থ করা যাবে না। অন্যদিকে, নিম্নবিত্ত বাঙালি শ্রমজীবীরা, যাঁদের একটা বড় অংশ মুসলমান ও নিম্নবর্ণের হিন্দু, তাঁদের কাছে সমস্যাটা একেবারেই বাংলা ভাষার সংকট নয়। বরং সমস্যাটি তাঁদের কাছে পুরোপুরি অস্তিত্বের সংকট হয়ে উঠেছে। তাঁরা দেখছেন, পশ্চিমবঙ্গে থাকলে হাতে কাজ নেই, খেয়েপরে ভালোভাবে বাঁচতে পারবেন না, আবার অন্য রাজ্যে গিয়ে নানা জায়গায় বাঙালি হওয়ার কারণে যে হেনস্থার সম্মুখীন তাঁদের হতে হচ্ছে, তা প্রতিরোধ করার মতো সংগঠন এখনও পর্যন্ত নেই। মুখ বুজে সব সহ্য করে তাঁদের ওখানেই পড়ে থাকতে হচ্ছে, কারণ রুজিরুটির প্রশ্নটা তাঁদের কাছে সবচেয়ে বড়। অন্য রাজ্যে থেকে নানা কষ্ট সহ্য করেও তাঁরা যেটুকু উপার্জন করতে পারছেন, এ রাজ্যে একই কাজ থেকে সেই পরিমাণ অর্থ তাঁরা উপার্জন করতে পারতেন না। ফলে তাঁদের ওই পরিস্থিতি মেনে নিয়ে লাথিঝাঁটা সহ্য করে প্রবাসে থেকে যাওয়া ছাড়া অন্য কোনও গত্যন্তর নেই। কারণ আমাদের এই রাজ্যটি পিছিয়ে থাকা অর্থনীতির দেশ। রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী গলা ফাটিয়ে ঘোষণা করছেন, বাঙালি শ্রমিকেরা রাজ্যে ফিরে এলে তিনি তাঁদের কাজ দেবেন, অথচ যাঁরা এই রাজ্যেই বাস করছেন, তাঁদের কর্মসংস্থান করার ক্ষমতাই তাঁর নেই। সরকার সরাসরি যেটুকু চাকরির ব্যবস্থা করছে, সেখানেও প্রতিটি স্তরে চূড়ান্ত দুর্নীতি। ফলে তাঁর এইসব হাস্যকর ছেলেভোলানো কথারও কোনও মূল্য নেই। ঠিক এই মুহূর্তে যথার্থই এইসব শ্রমজীবী মানুষদের পাশে দাঁড়াতে পারতেন আমাদের দেশের ও রাজ্যের সমাজতন্ত্রবাদীরা, কিন্তু তাঁদের কথা এই মুহূর্তে যতটা কম বলা যায় ততই ভালো। সত্যি বলতে গেলে এই পরিস্থিতি থেকে আশু সমাধান কী হতে পারে আমার জানা নেই। দীর্ঘমেয়াদে রাজ্যের অর্থনৈতিক পরিস্থিতির উন্নতি ঘটলে এবং হিন্দুত্ববাদী শক্তিদের রাষ্ট্রক্ষমতা থেকে দূর করতে পারলে হয়তো এই সমস্যার কিছুটা সাময়িক সমাধানের আশা করা যেতে পারে। কিন্তু ঠিক এই মুহূর্তে এই হতাশাজনক বাস্তবতা থেকে বেরিয়ে আসার কোনও রাস্তা অন্তত আমি দেখতে পাচ্ছি না।


