ভারতে ‘বাংলাদেশি’ বিতর্ক: একটি বিশ্বজনীন দক্ষিণপন্থী রাজনৈতিক প্রবণতা

আশিস গুপ্ত

 


'বাংলাদেশি' বিতর্ক একটি সুপরিকল্পিত রাজনৈতিক প্রকল্প, যার মূল উদ্দেশ্য হল ভোটের স্বার্থে ঘৃণা ও ভীতি ছড়ানো এবং সমস্যা-জর্জরিত বাস্তবতাকে আড়াল করা। এটি কোনও বাস্তব সমস্যার সমাধান করে না, বরং রাজনৈতিক দলগুলোর ক্ষমতা ধরে রাখার হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহৃত হয়। এর মধ্যে দিয়ে ভারতীয় রাজনীতি বৈশ্বিক দক্ষিণপন্থী প্রবণতার সঙ্গে যুক্ত হয়ে পড়েছে, যেখানে অভিবাসন-বিরোধী বয়ান ক্ষমতা কুক্ষিগত রাখার অন্যতম প্রধান কৌশল হয়ে উঠেছে

 

ব্রিটিশ যুক্তরাজ্যে অভিবাসন ও মুসলিম-বিরোধী রাজনীতির প্রতীকী মুখ টমি রবিনসন আবারও আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে। যেমন, সাম্প্রতিক দিনগুলিতে মহারাষ্ট্র থেকে উত্তরপ্রদেশ হয়ে আসাম পর্যন্ত বাংলাভাষী শ্রমিক, হকার ও সাধারণ মানুষকে “বাংলাদেশি অনুপ্রবেশকারী” হিসেবে চিহ্নিত করে প্রশাসনের দমনমূলক পদক্ষেপ নজরে আসছে। সম্প্রতি লন্ডনের কেন্দ্রস্থলে অনুষ্ঠিত টমি রবিনসনের সমাবেশে হাজার হাজার সমর্থক অংশ নেন, যাঁদের অনেকে ব্রিটিশ পতাকা ও জাতীয়তাবাদী স্লোগান নিয়ে হাজির হন। সমাবেশ ঘিরে পুলিশি সতর্কতা ছিল প্রবল, কারণ অতীতে রবিনসনের র‍্যালিগুলিতে সহিংসতা এবং পাল্টা বিক্ষোভের ইতিহাস রয়েছে। এবারের সমাবেশও তার ব্যতিক্রম ছিল না— পাল্টা বিক্ষোভকারীদের সঙ্গে সংঘর্ষে বেশ কয়েকজন আহত হন এবং ডজনাধিক মানুষকে পুলিশ গ্রেপ্তার করে।

রবিনসন, যাঁর আসল নাম স্টিফেন ইয়াক্সলি-লেনন, বহুদিন ধরেই যুক্তরাজ্যের চরম দক্ষিণপন্থী রাজনীতির পরিচিত মুখ। তিনি একসময় ইসলাম-বিরোধী সংগঠন ইংলিশ ডিফেন্স লিগ বা ইডিএল-এর প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন এবং অভিবাসী সম্প্রদায়কে লক্ষ্য করে বহু প্রচারণা চালিয়েছেন। তাঁর বক্তব্য সাধারণত একটি নির্দিষ্ট ন্যারেটিভকে ঘিরে আবর্তিত হয় যে— যুক্তরাজ্যে মুসলিম অভিবাসীরা স্থানীয় সংস্কৃতি, নিরাপত্তা এবং জীবনযাত্রার জন্য হুমকি। এবারও তিনি র‍্যালিতে অভিযোগ তোলেন, “আমরা আমাদের শহর, আমাদের সংস্কৃতি হারাচ্ছি। আজকের লড়াই কেবল একটি রাজনৈতিক আন্দোলন নয়, এটি আমাদের টিকে থাকার সংগ্রাম।” শুনে মনে হয় না, এ-ধরনের ভাষণ তো আমরা প্রতিদিনই শুনি আমাদের প্রধানমন্ত্রী, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বা তাঁদের দলের মুখ্যমন্ত্রীদের কাছ থেকে![1]

অতীতের মতো এবারও রবিনসনের বক্তব্য ছড়িয়ে পড়ে ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মে। তবে এবার আলোচনার কেন্দ্রে ছিল এক্স (পূর্বে টুইটার), যার মালিক এলন মাস্ক। ২০২২ সালে প্ল্যাটফর্মটি অধিগ্রহণ করার পর থেকে মাস্ক বারবার ঘোষণা করেছেন যে তিনি “মুক্ত মতপ্রকাশের চ্যাম্পিয়ন।” রবিনসনের বক্তব্য এক্স-এ ব্যাপকভাবে প্রচারিত হয় এবং তাঁর সমর্থকরা ভিডিও ক্লিপ শেয়ার করতে শুরু করে। সমালোচকদের দাবি, মাস্কের নীতি কার্যত চরম দক্ষিণপন্থী এবং ইসলাম-বিরোধী প্রচারণাকে বাড়তি জায়গা দিচ্ছে। দ্য গার্ডিয়ান মন্তব্য করেছে, “এক্স আজকের দিনে ইউরোপীয় চরমপন্থী ন্যারেটিভের প্রধান অনলাইন মঞ্চ হয়ে উঠেছে।”

মানবাধিকার সংস্থা Amnesty International এক বিবৃতিতে জানিয়েছে, “মুক্ত মতপ্রকাশ গুরুত্বপূর্ণ, কিন্তু যখন সেটি সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে ঘৃণাভাষণে রূপ নেয়, তখন প্ল্যাটফর্মগুলোর নৈতিক দায়িত্ব থাকে তা প্রতিরোধ করার। এক্স এই দায়িত্ব পালন করছে না।” Human Rights Watch যুক্তি দিয়েছে, রবিনসনের মতো চরমপন্থীদের কনটেন্টকে অবাধে ছড়াতে দেওয়া “বাস্তবে অনলাইন সহিংসতার বীজ বপন করছে, যার ফলশ্রুতিতে রাস্তায় সংঘর্ষ বাড়ছে।” ব্রিটেনের ডিজিটাল নিয়ন্ত্রক সংস্থা Ofcom সতর্ক করেছে, এক্স ঘৃণাভাষণ ও ভ্রান্ত তথ্য নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থ হলে তারা কঠোর পদক্ষেপ নেবে। এক কর্মকর্তা বলেছেন, “সোশাল মিডিয়া প্ল্যাটফর্ম যদি ক্রমাগতভাবে ঘৃণা ছড়ানোর হাতিয়ার হয়ে ওঠে, তবে তা গণতন্ত্র এবং সামাজিক শান্তির জন্য সরাসরি হুমকি।” গবেষক অ্যান্ড্রু হোয়াইট, যিনি ইউরোপীয় দক্ষিণপন্থী আন্দোলন নিয়ে দীর্ঘদিন কাজ করছেন, সতর্ক করে বলেন, “ডিজিটাল স্পেস এখন রাজনৈতিক র‍্যালির মতোই গুরুত্বপূর্ণ যুদ্ধক্ষেত্র। রবিনসনের বক্তব্য সরাসরি কয়েক হাজার মানুষ শুনলেও, এক্স প্ল্যাটফর্মে তা কয়েক মিলিয়ন মানুষের কাছে পৌঁছে যায়। এলন মাস্কের ‘মুক্ত মতপ্রকাশের’ ধারণা এই বিস্তারকে আরও বৈধতা দিচ্ছে।”

এদিকে ব্রিটিশ মুসলিম কাউন্সিল এক বিবৃতিতে জানিয়েছে, রবিনসনের বক্তব্য এবং তার অনলাইনে ছড়িয়ে পড়া “ঘৃণাকে প্রাতিষ্ঠানিক বৈধতা দেওয়ার সমান।” টমি রবিনসনের সাম্প্রতিক র‍্যালি কেবল ব্রিটেনের রাজনৈতিক বিভাজনকেই সামনে আনেনি, বরং ডিজিটাল যুগে ঘৃণার প্রচারের নতুন পথও দেখিয়ে দিল। এলন মাস্কের নেতৃত্বে এক্স আজ মুক্ত মতপ্রকাশ ও ঘৃণাভাষণের সীমারেখা নিয়ে নতুন বিতর্কের কেন্দ্রবিন্দু। Amnesty, HRW এবং Ofcom–এর সমালোচনা ইঙ্গিত করছে যে, ভারসাম্য রক্ষা করা এখন জরুরি— অন্যথায় মুক্ত মতপ্রকাশের আড়ালে বিভেদ আরও গভীর হতে পারে।

আমার লেখার বিষয়বস্তু টমি রবিনসন, এলন মাস্ক বা এক্স প্ল্যাটফর্ম ছিল না। আমার লেখার বিষয় ছিল ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি, কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ এবং অসমের মুখ্যমন্ত্রী হিমন্ত বিশ্বশর্মার বিভাজনের রাজনীতির আধার হিসেবে তৈরি অনুপ্রবেশের ন্যারেটিভ[2] লেখাটা শুরু করার পর আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমে পড়লাম লন্ডনের কেন্দ্রস্থল ট্রাফালগার স্কোয়ারে রবিনসনের বিশাল সমাবেশের খবর। বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় রবিনসন ও এলন মাস্কের বক্তব্য পড়ে মনে হল, ট্রাফালগার স্কোয়ারে যেন বক্তৃতা দিচ্ছেন ভারতীয় জনতা পার্টির সর্বোচ্চ নেতৃত্বের কেউ।

তাই লেখার শুরুটা বদলে দিলাম— এটা বোঝাতে যে ভারতবর্ষে প্রধান শাসকদল অনুপ্রবেশের জিগির তুলে মুসলিম-বিদ্বেষের যে ন্যারেটিভ তৈরি করে চলেছে, তা কোনও বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। গোটা বিশ্ব জুড়েই কট্টর দক্ষিণপন্থীরা এই ন্যারেটিভ তৈরি করছে ক্ষমতা দখল বা রক্ষা করার জন্য, বহুজাতিক কর্পোরেশন ও বৃহৎ পুঁজিপতিদের স্বার্থরক্ষার জন্য। বিশ্বায়ন প্রথমে পুঁজিবাদী উন্নত দেশগুলির জন্য লাভজনক ছিল, কিন্তু সময়ের সঙ্গে তার কিছু প্রভাব বুমেরাং হয়ে ফিরে এসেছে। ধনী–গরিব বৈষম্য আরও বেড়ে চলেছে।

এসবই ধামাচাপা দিতে গত আড়াই দশকেরও বেশি সময় ধরে বিশ্বজুড়ে এক নতুন ন্যারেটিভ গড়ে তোলা হচ্ছে: “আমরা আমাদের শহর, আমাদের সংস্কৃতি হারাচ্ছি। আজকের লড়াই কেবল একটি রাজনৈতিক আন্দোলন নয়, এটি আমাদের টিকে থাকার সংগ্রাম।”

এই টিকে থাকার সংগ্রামী আহ্বান–এর প্রেক্ষাপটেই সাম্প্রতিক দিনগুলিতে উত্তরপ্রদেশ থেকে আসাম পর্যন্ত বাংলাভাষী শ্রমিক, হকার ও সাধারণ মানুষকে “বাংলাদেশি অনুপ্রবেশকারী” হিসেবে চিহ্নিত করে প্রশাসনের দমনমূলক পদক্ষেপ নজরে আসছে। আটক, উচ্ছেদ, এমনকি সীমান্তের দিকে ঠেলে দেওয়ার মতো ঘটনা এখন সংবাদ শিরোনাম। এই প্রবণতা কেবল প্রশাসনিক ভুল নয়, বরং রাজনৈতিকভাবে সংগঠিত এক কৌশল বলেই ক্রমশ স্পষ্ট হয়ে উঠছে।[3]

বিভিন্ন কেস-স্টাডি ও বিশেষজ্ঞদের বক্তব্যে উঠে আসছে, এটি একটি বিস্তৃত ও পরিকল্পিত রাজনৈতিক প্রকল্প, যেখানে ভাষা ও পরিচয়ের ভিত্তিতে এক বিশেষ সম্প্রদায়কে সন্দেহভাজন হিসেবে প্রতিষ্ঠা করার চেষ্টা চলছে। ভারতে ‘বাংলাদেশি’ অনুপ্রবেশ নিয়ে বিতর্ক সাম্প্রতিক দিনগুলিতে উচ্চস্বরে চলতে থাকলেও, বছরের পর বছর ধরেই অনুপ্রবেশ ইস্যুকে জাতীয় জীবনে টেনে আনার চেষ্টা হয়েছে। কারণ, অনুপ্রবেশ কেবল একটি স্থানীয় অভিবাসন সমস্যা নয়, বরং এটি একটি গভীর রাজনৈতিক কৌশল ও ষড়যন্ত্রের ফসল, যা বর্তমান বিশ্বের দক্ষিণপন্থী রাজনৈতিক দলগুলির ক্ষমতা দখলের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। এই বিতর্ক মূলত কিছু রাজনৈতিক দলের নির্বাচনী ফায়দা হাসিলের একটি নিয়মিত কৌশলে পরিণত হয়েছে, যা ধর্মীয় ও জাতিগত বিভাজন তৈরি করে ভোটব্যাঙ্ক সুসংহত করতে সাহায্য করছে।[4]

 

বিতর্কের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট

এই বিতর্কের প্রধান রাজনৈতিক উদ্দেশ্য হল অভিবাসনকে একটি নিরাপত্তা ও জনসংখ্যা বৃদ্ধির হুমকি হিসেবে তুলে ধরা। রাজনৈতিক দলগুলি এই বিতর্কের মাধ্যমে স্থানীয় জনগণের মধ্যে এই ধারণা তৈরি করে যে, “অবৈধ বাংলাদেশি অনুপ্রবেশকারীরা” তাঁদের চাকরি, জমি এবং সম্পদের অধিকার কেড়ে নিচ্ছে। এর ফলে স্থানীয় মানুষের মধ্যে ভীতি ও ক্ষোভ তৈরি হয়, যা সহজেই রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে ব্যবহার করা যায়।[5] এটি জাতীয়তাবাদ ও দেশপ্রেমের আবেগকে কাজে লাগিয়ে একটি নির্দিষ্ট সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে জনমতকে উসকে দেয়।

আসামে বিশেষ করে “অবৈধ অভিবাসী” শনাক্তকরণ ও বিতাড়নের জন্য ন্যাশনাল রেজিস্টার অফ সিটিজেনস (এনআরসি) এবং নাগরিকত্ব (সংশোধনী) আইন (সিএএ)-এর মতো আইন প্রয়োগ করা হয়েছে। এই আইনগুলি প্রতিবেশী দেশগুলি থেকে আসা মূলত হিন্দু, শিখ, বৌদ্ধ, জৈন, পারসি ও খ্রিস্টানদের মতো ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের সুরক্ষা দেওয়ার কথা বললেও, এর আসল লক্ষ্য মুসলিম সম্প্রদায়কে “অবৈধ” প্রমাণ করা।[6]

উত্তরপ্রদেশের বস্তি জেলায় গত মাসে মুর্শিদাবাদ থেকে আসা কয়েকজন হকারকে পুলিশ হঠাৎ গ্রেপ্তার করে। অভিযোগ ছিল, তাঁরা বাংলাদেশি। অথচ পরিবারের দাবি, প্রত্যেকের ভোটার কার্ড, আধার এবং রেশন কার্ড ছিল। পুলিশ তাদের পরিচয়পত্র যাচাই না করেই থানায় নিয়ে যায়, আর স্থানীয় হিন্দি সংবাদপত্র জাগরণ মন্তব্য করে— “বাংলা ভাষায় কথা বলাই তাদের প্রধান অপরাধ হিসেবে ধরা হয়।”

এক মানবাধিকার কর্মীর পর্যবেক্ষণ ছিল, “এটা কেবল ভুল আইডেন্টিটি নয়, এটি স্পষ্ট রাজনৈতিক বার্তা— বাংলাভাষী মানেই সন্দেহভাজন।”[7] দিল্লিতেও একই প্রবণতার প্রতিধ্বনি শোনা গেছে। সম্প্রতি একটি পুলিশি নথিতে ব্যবহৃত হয়েছে “Bangladeshi language” শব্দবন্ধ, যা ব্যাপক সমালোচনার জন্ম দেয়।[8] ভাষাকে নাগরিকত্বের প্রমাণ বানানো একেবারেই অনৈতিক। বাংলা পৃথিবীর অন্যতম সমৃদ্ধ ভাষা, তাকে “অবৈধতা”র ট্যাগ দেওয়া সাংস্কৃতিক আক্রমণ।

 

রাজনৈতিক ফায়দা ও কৌশল

এই বিতর্ক থেকে যে রাজনৈতিক শক্তিগুলি সবচেয়ে বেশি ফায়দা তুলেছে, তাদের মধ্যে প্রধান হল ভারতীয় জনতা পার্টি (বিজেপি)। বিজেপি দীর্ঘদিন ধরে “বাংলাদেশি অনুপ্রবেশ”কে তাদের নির্বাচনী প্রচারণার একটি কেন্দ্রীয় ইস্যু হিসেবে ব্যবহার করে আসছে। বিশেষ করে আসামে, বিজেপি এই ইস্যুটিকে কাজে লাগিয়ে অসমিয়া জাতীয়তাবাদী ও হিন্দুত্ববাদী সমর্থক উভয়কেই নিজেদের দিকে টানতে সক্ষম হয়েছে। তাদের প্রচারে বলা হয়, এই অনুপ্রবেশকারীরা রাজ্যের “জাতিগত ও সাংস্কৃতিক পরিচয়” নষ্ট করছে। আসামের মুখ্যমন্ত্রী হিমন্ত বিশ্বশর্মার মতো নেতারা প্রকাশ্যে “অবৈধ দখলদার” এবং “বাংলাদেশি” শব্দ ব্যবহার করে জমি পুনরুদ্ধারের কথা বলেছেন, যা তাঁদের রাজনৈতিক অবস্থানকে আরও শক্তিশালী করেছে। এই বছরের ১ সেপ্টেম্বর জারি করা স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের (এমএইচএ) একটি বিজ্ঞপ্তি অনুযায়ী, আসামে ফরেনার্স ট্রাইব্যুনাল (এফটি)-কে “অবৈধ অভিবাসী” শনাক্ত করার ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে।[9] সংবাদ প্রতিবেদন অনুযায়ী, এমএইচএ-র নির্দেশে বলা হয়েছে যে, এফটি দেওয়ানি আদালতের ক্ষমতা পাবে এবং বিচারপ্রক্রিয়ায় ১৯০৮ সালের দেওয়ানি কার্যবিধি ও ২০২৩ সালের ভারতীয় নাগরিক সুরক্ষা সংহিতা অনুযায়ী প্রথম শ্রেণির বিচারিক ম্যাজিস্ট্রেটের ক্ষমতা প্রয়োগ করতে পারবে।

২০২৬ সালে অসম বিধানসভার নির্বাচন। ফলে অনুপ্রবেশ বিতর্ক আগামী দিনে আরও তীব্রভাবে রাজনৈতিক হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহৃত হওয়ার সম্ভাবনা প্রবল।[10]

পশ্চিমবঙ্গে “বাংলাদেশি অনুপ্রবেশ” ইস্যু বিজেপির রাজনৈতিক প্রচারের কেন্দ্রে অবস্থান করছে। এই ইস্যু নতুন নয়, তবে ২০১৪ সালের পর থেকে বিজেপি এটি একেবারে কৌশলগতভাবে ব্যবহার করতে শুরু করে এবং ২০১৯ সালের লোকসভা নির্বাচনের সময় থেকে তা আরও তীব্র হয়। বিষয়টিকে বোঝার জন্য কয়েকটি দিক থেকে বিশ্লেষণ করা দরকার।[11]

প্রথমত, বিজেপি তার হিন্দুত্ববাদী রাজনীতির মধ্যে অনুপ্রবেশকে একধরনের “বহিরাগত ভীতি” বা outsider threat হিসেবে দাঁড় করিয়েছে। বিজেপি নেতারা বারবার বলেন, বাংলাদেশ থেকে লক্ষ লক্ষ মুসলিম অনুপ্রবেশকারী পশ্চিমবঙ্গে ঢুকছে, যারা স্থানীয় সংস্কৃতি, অর্থনীতি এবং আইন-শৃঙ্খলার জন্য হুমকি। তারা প্রচারে দাবি করে যে এই অনুপ্রবেশকারীরা “বাংলাদেশি মুসলিম” এবং তারা পশ্চিমবঙ্গের ভোটব্যাঙ্কের সমীকরণকে বদলে দিচ্ছে। এর ফলে বিজেপি হিন্দু ভোটারদের মধ্যে একধরনের নিরাপত্তাহীনতা তৈরি করতে চায়।

দ্বিতীয়ত, বিজেপির প্রচারের একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হল তৃণমূল কংগ্রেসকে অভিযুক্ত করা। বিজেপির বক্তব্য, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ও তৃণমূল সরকার “বাংলাদেশিদের” আশ্রয় দেয়, তাদের ভুয়া ভোটার কার্ড বানিয়ে দেয়, এবং এভাবে মুসলিম ভোটব্যাঙ্ককে শক্তিশালী করে।[12] ২০১৯ সালের লোকসভা নির্বাচনে ও পরবর্তী বিধানসভা নির্বাচনের সময় বিজেপি নেতারা নিয়মিত বলেছেন, “বাংলাদেশিদের তাড়ানো হবে, নাগরিকত্ব আইন চালু হবে।” নাগরিকত্ব সংশোধনী আইন (সিএএ) এবং জাতীয় নাগরিকপঞ্জি (এনআরসি) এই প্রচারের মূল হাতিয়ার হয়ে ওঠে।

তৃতীয়ত, অর্থনৈতিক দিক থেকেও বিজেপি এই প্রচার চালায়। তারা বলে, অনুপ্রবেশকারীরা স্থানীয় শ্রমবাজার দখল করে নিচ্ছে, ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের জায়গা কেড়ে নিচ্ছে এবং সরকারি সুবিধাগুলো ব্যবহার করছে। বিশেষত নিম্নবর্গের হিন্দু শ্রমজীবী ভোটারদের মধ্যে এই যুক্তি ছড়িয়ে দেওয়ার চেষ্টা হয়।

চতুর্থত, সাংস্কৃতিক দিক থেকেও প্রচার চালানো হয় যে, বাংলার ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি “বাংলাদেশি অনুপ্রবেশকারীদের” কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। বিজেপি নেতারা এই বয়ান ব্যবহার করে পশ্চিমবঙ্গের মানুষের মধ্যে “অস্মিতা”র প্রশ্ন তোলেন, তবে তা একরকম বিভাজনমূলকভাবে: অর্থাৎ প্রকৃত পশ্চিমবঙ্গীয় বাঙালি বনাম বহিরাগত বাংলাদেশি।

তবে বাস্তবতার সঙ্গে এই প্রচারের ব্যবধান অনেক। সরকারি পরিসংখ্যান কখনওই বিজেপির দাবি করা সংখ্যার সমর্থন করে না। সীমান্ত নিরাপত্তাবাহিনী এবং কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশ থেকে সীমান্ত অতিক্রম করে অবৈধভাবে প্রবেশকারীর সংখ্যা গত দশকে বরং হ্রাস পেয়েছে।[13] বিশেষজ্ঞদের মতে, “বাংলাদেশি অনুপ্রবেশ” একটি অতিরঞ্জিত ভয়ের ছবি, যা রাজনৈতিকভাবে কাজে লাগানো হয়।[14]

এছাড়া, বিজেপি যখন আসামের এনআরসি-র অভিজ্ঞতা তুলে ধরে পশ্চিমবঙ্গে এনআরসি প্রয়োগের কথা বলে, তখন অনেক হিন্দু ভোটারও আতঙ্কিত হন, কারণ এনআরসি-তে আসামে প্রায় ১১ লক্ষ হিন্দু বাঙালির নাম বাদ পড়েছিল।[15] ফলে পশ্চিমবঙ্গে বিজেপির এই প্রচার একদিকে হিন্দু ভোট একত্র করার চেষ্টা করলেও, অন্যদিকে ভয়, সংশয় এবং বিভ্রান্তিও ছড়ায়। রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, বিজেপির এই প্রচারের তিনটি প্রধান লক্ষ্য আছে—

১. ভোটব্যাঙ্কের মেরুকরণ ঘটানো: হিন্দু বনাম মুসলিম।
২. তৃণমূলকে “বাংলাদেশি অনুপ্রবেশকারীদের রক্ষক” হিসেবে চিত্রিত করা।
৩. জাতীয় পর্যায়ে নিজেদের শক্তিশালী “সীমান্তরক্ষক” এবং “জাতীয় নিরাপত্তার অভিভাবক” হিসেবে দেখানো।[16]

ফলত, পশ্চিমবঙ্গে বিজেপির অনুপ্রবেশ-বিরোধী প্রচার মূলত বাস্তব জনসংখ্যাগত পরিবর্তনের চেয়ে বেশি একধরনের রাজনৈতিক কৌশল।[17] এতে নির্বাচনী লাভের লক্ষ্য আছে, সাংস্কৃতিক বিভাজনের কৌশল আছে, এবং একটি দীর্ঘমেয়াদি জাতীয়তাবাদী এজেন্ডার অংশ হিসেবে “বহিরাগত” ভয় দেখিয়ে নিজেদের সমর্থন মজবুত করার চেষ্টা আছে। ২০২৬ সালে পশ্চিমবঙ্গেও বিধানসভার নির্বাচন।

 

বিতর্কের ফলাফল ও বিশ্বজনীন প্রবণতা

এই ধরনের রাজনৈতিক কৌশল দেশের ভেতরে গভীর সামাজিক বিভাজন তৈরি করে। এটি কেবল অভিবাসীদের জীবনকেই ঝুঁকির মুখে ফেলে না, বরং বৈধ ভারতীয় নাগরিকদেরও— বিশেষ করে যাঁরা দেখতে বাঙালি বা মুসলিম— তাঁদেরও সন্দেহের চোখে দেখা হয়। অনেক ক্ষেত্রে বৈধ নথি থাকা সত্ত্বেও তাঁদের হেনস্থা করা হয়।[18]

আসামে ২০১৯ সালে এনআরসি-র চূড়ান্ত তালিকা থেকে প্রায় ১৯ লক্ষ মানুষের বাদ পড়ার ঘটনাটি এই সমস্যার ভয়াবহতা স্পষ্ট করে। সেখানে বহু বৈধ ভারতীয় নাগরিকও নিজেদের নাগরিকত্ব প্রমাণ করতে ব্যর্থ হন।

বর্তমান বিশ্বে অভিবাসী-বিরোধী আন্দোলন দক্ষিণপন্থী দলগুলোর ক্ষমতা দখলের হাতিয়ারে পরিণত হয়েছে। এর সঙ্গে ভারতের ‘বাংলাদেশি’ বিতর্কের কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ মিল রয়েছে—

  • অভিবাসনকে রাজনৈতিক হাতিয়ারে পরিণত করা: বিশ্বজুড়ে দক্ষিণপন্থী রাজনৈতিক দলগুলো অভিবাসনকে একটি কেন্দ্রীয় ইস্যু হিসেবে ব্যবহার করছে।[19] তারা অভিবাসীদের অর্থনৈতিক চাপ, সাংস্কৃতিক হুমকি এবং জাতীয় নিরাপত্তার বিপদ হিসেবে তুলে ধরে। ভারতেও বিজেপি একই কৌশল অবলম্বন করে স্থানীয় জনগণের মধ্যে ভয় ও উদ্বেগ সৃষ্টি করেছে।
  • ধর্মীয় ও জাতিগত বিভাজন: বিশ্বের অনেক জায়গায় অভিবাসন-বিরোধী আন্দোলন ধর্মীয় বা জাতিগত পরিচয়ের ভিত্তিতে চালানো হয়।[20] ভারতেও ‘বাংলাদেশি’ বিতর্কের মূল লক্ষ্য বাঙালি-মুসলিম জনগোষ্ঠী, যা সরাসরি ধর্মীয় বিভাজনকে উসকে দেয়।
  • জাতীয়তাবাদ ও দেশপ্রেমের ব্যবহার: দক্ষিণপন্থী দলগুলো জাতীয়তাবাদ এবং দেশপ্রেমের আবেগকে কাজে লাগিয়ে অভিবাসন-বিরোধী নীতিকে বৈধতা দেওয়ার চেষ্টা করে।[21] ভারতের ‘বাংলাদেশি’ বিতর্কও এই কাঠামোর ওপর দাঁড়িয়ে আছে, যেখানে রাজনৈতিক নেতারা নিজেদের দেশের ‘সুরক্ষক’ হিসেবে তুলে ধরেন।
  • আইনি ব্যবস্থার রাজনৈতিক ব্যবহার: অনেক দেশে অভিবাসন-বিরোধী নীতিকে আইনি কাঠামো দিয়ে শক্তিশালী করা হচ্ছে। ভারতে NRC এবং CAA-র মতো আইন এই কৌশলের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ, যা রাজনৈতিক উদ্দেশ্য সাধনের জন্য একটি শক্তিশালী হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে।[22]

 

সামগ্রিকভাবে, ‘বাংলাদেশি’ বিতর্ক একটি সুপরিকল্পিত রাজনৈতিক প্রকল্প, যার মূল উদ্দেশ্য হল ভোটের স্বার্থে ঘৃণা ও ভীতি ছড়ানো এবং সমস্যা-জর্জরিত বাস্তবতাকে আড়াল করা। এটি কোনও বাস্তব সমস্যার সমাধান করে না, বরং রাজনৈতিক দলগুলোর ক্ষমতা ধরে রাখার হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহৃত হয়। এর মধ্যে দিয়ে ভারতীয় রাজনীতি বৈশ্বিক দক্ষিণপন্থী প্রবণতার সঙ্গে যুক্ত হয়ে পড়েছে, যেখানে অভিবাসন-বিরোধী বয়ান ক্ষমতা কুক্ষিগত রাখার অন্যতম প্রধান কৌশল হয়ে উঠেছে।


[1] Norris, Pippa & Inglehart, Ronald. Cultural Backlash: Trump, Brexit and Authoritarian Populism. Cambridge University Press, 2019.
[2] Arora, Tanya. A Targeted Campaign: The orchestrated crackdown on Bengali Migrants and the rising pushback from courts, Bengal government, and civil society. CJP. Jul 17, 2025.
[3] Jaffrelot, Christophe. Modi’s India: Hindu Nationalism and the Rise of Ethnic Democracy. Princeton University Press, 2021.
[4] Mudde, Cas. The Far Right Today. Polity Press, 2019.
[5] Banerjee, Paula. “Illegal Migrants and Refugees in India: Legal and Policy Issues.” Economic & Political Weekly 40(36), 2005.
[6] “CAA and NRC: Institutionalising Discrimination in India.” Amnesty International India. 2020.
[7] 18 Hawkers From West Bengal Detained by UP Police, Termed ‘Bangladeshi’: Report. The Wire. Sep 8, 2025.
[8] Thakur, Joydeep. Row as Delhi Police refer to Bengali language as ‘Bangladeshi’. Hindustan Times. Aug 3, 2025.
[9] Singh, Vijaita. Foreigners Tribunals can issue arrest warrants, send ‘foreigners’ to detention centres. The Hindu. Sep 3, 2025.
[10] Donthi, Praveen. The Great Purge. Caravan. Sep 5, 2018.
[11] Agarwala, Tora. Evictions and expulsions of Muslims to Bangladesh precede Indian state polls. Reuters. Jul 28, 2025.
[12] Mitra, Atri. Faced with BJP attacks, how TMC has mobilised to defend Bengali migrant workers. Indian Express. Jul 15, 2025.
[13] Annual Report 2023-24. MHA.
[14] Samaddar, Ranabir. The Marginal Nation: Transborder Migration from Bangladesh to West Bengal. Sage. 1999.
[15] India excludes nearly 2 million people from Assam citizen list. Al Jazeera. Aug 31, 2019.
[16] Jha, Prashant. How the BJP Wins: Inside India’s Greatest Election Machine. Juggernaut Books, 2017.
[17] Samaddar, Ranabir. The Marginal Nation: Transborder Migration from Bangladesh to West Bengal. Sage, 1999.
[18] Dutta, Alisha. Stop unlawful deportation of Bengali Muslims, Human Rights Watch tells government. The Hindu. Jul 25, 2025.
[19] Eatwell, Roger & Goodwin, Matthew. National Populism: The Revolt Against Liberal Democracy. Penguin, 2018.
[20] Kassam, Ashifa. ‘Most of this is symbolic’: the new wave of anti-migrant vigilantes in Europe. The Guardian. Aug 30, 2025.
[21] পূর্বোক্ত।
[22] Wodak, Ruth. The Politics of Fear: The Shameless Normalization of Far-Right Discourse. Sage, 2020.

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 5217 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

Be the first to comment

আপনার মতামত...