সঞ্জীব দেবলস্কর
আজ যারা কথায় কথায় হাতে বন্দুক তুলে নেয়, বারবার রক্তপাত, নৃশংস হত্যালীলায় দেশের মাটিকে ভিজিয়ে তোলে, যারা এই দেশ থেকে বেরিয়ে গিয়ে সহিংস পথে চলে আলাদা দেশ বানানোর হুমকি দেয়, খিলঞ্জিয়া, থলুয়া কত বিশেষণে ভূষিত করে বেছে বেছে তাদেরই বোঝানো হয়, “তোমরা ভারতবাসী”। অথচ যাদের প্রাণের গভীরে ভারতমাতার চিরকালীন অধিষ্ঠান, তাদের ওপর “বিদেশি” তকমা লাগিয়ে তাদের শায়েস্তা করতে ডি-ভোটার, এন-আর-সি, ভোটার তালিকা পুনর্নিরীক্ষণ (এস-আই-আর), এমন-কি তাঁদের মুখের ভাষার অস্তিত্বকে নস্যাৎ করে আসাম থেকে দিল্লি, গুজরাত থেকে মণিপুর— সর্বত্র এদের তাড়না করতে আজ দেশব্যাপী এত আয়োজন!
না, আমি “মহাদেবের জটা” হইতে আসিনি, হিমালয়ের ওপার থেকে নয়, সেই ঐতিহাসিক প্রাচীর ডিঙিয়েও নয়। আমি আসিনি পাতকই পাহাড় পেরিয়ে ‘শান’ দেশ থেকেও। ভারত মহাসাগরের ওপার থেকেও আমি আসিনি।
তবে কোথা থেকে আসিয়াছ তুমি, বাঙালি?
বাঙালি আর কোথা হইতেই বা আসিবে? তার উৎসভূমি তো এই আদি-অনাদি ভারতবর্ষের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চল। আবহমান ভারতের মূলভূমির সঙ্গেই নিবিড়ভাবে সংলগ্ন অঞ্চলের বাসিন্দাই বাঙালি।
বাঙালি এ-দেশে কোনও বহিরাগত জাতি নয়; তার বিস্তার উত্তর-পূর্ব ভারতের সমতলভূমি থেকে শুরু করে উত্তর, মধ্য এবং দক্ষিণ ভারতের উপকূলবর্তী উৎকল অঞ্চলের অংশ পর্যন্ত। এক দীর্ঘ ইতিহাসের পরিসরে প্রাক্-ঔপনিবেশিক ভারতবর্ষে যে একত্রে উচ্চারিত হত “বাংলা-বিহার-উড়িষ্যা”— সেই ভূখণ্ডই হল বাঙালির আত্মপ্রকাশ এবং সম্প্রসারণের ক্ষেত্র।
বাঙালি কোনও আগ্রাসী জনগোষ্ঠী নয়। তাঁর প্রব্রজনের ইতিহাস কোনও রক্তক্ষয়ী আগ্রাসনের ইতিহাস নয়। ইতিহাসে কেউ কখনও তাকে যোদ্ধা হিসেবে চিহ্নিত করেনি। ‘সিংহল সমুদ্র থেকে মালয় সাগরে’র দ্বীপমালার লোকস্মৃতিতে, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার নানা কোণে বাঙালির প্রাক-পুরাতন প্রপিতামহদের বিচরণের কাহিনিও সাক্ষ্য দেয় বাঙালি ছিল শান্তির বার্তাবহ। “বিজয়সেনের হেলায় লঙ্কা জয়ে”র কথা কথঞ্চিৎ উচ্চগ্রামে প্রচারিত হলেও ইতিহাস বা লোকশ্রুতি— কোথাও এ-অনুষঙ্গে রক্তক্ষয়ের কোনও প্রমাণ নেই। এ-ও এক অহিংস সাংস্কৃতিক অভিযাত্রা হতে পারে।
কিন্তু স্বাধীনতার ৭৮ বছর পর আজ, সেই বাঙালি “এই ভারতের মহামানবের সাগরতীরে” নানাভাবে অপমানিত, লাঞ্ছিত, অত্যাচারিত। আসাম থেকে দিল্লি, কর্নাটক থেকে গুজরাত— সর্বত্রই বাঙালিকে “বিদেশি”, “বাংলাদেশি”, “অনুপ্রবেশকারী” বলে দেগে দেওয়া হচ্ছে। তাঁদের ভাষাকে আখ্যায়িত করা হচ্ছে বিদেশি ভাষা বলে। কেন্দ্রীয় সরকারের প্রশ্রয় আর একাধিক প্রাদেশিক সরকারের প্রত্যক্ষ অংশগ্রহণে এদের উপর চলছে পুলিশি অভিযান, তাদের ঘরবাড়ি উচ্ছেদ, গণ-গ্রেপ্তার এবং নির্বিচারে এদের সীমান্তের ওপারে ঠেলে ফেলার ষড়যন্ত্রকে করা হচ্ছে জোরদার এবং সুসংহত।

এই প্রক্রিয়ার সূচনা হয়েছে সত্তর দশকের শেষদিকে। তথাকথিত ‘বিদেশি বিতাড়ন আন্দোলন’ সেদিন এক রক্তক্ষয়ী, অমানবিক আন্দোলনের রূপ নিয়েছিল। সেদিন দেশের অপরাপর অঞ্চলের বাঙালি এদিকে মোটেই দৃষ্টিপাত করেননি। সেই আন্দোলনের (১৯৭৮-৮৫) অভিঘাত আজ ৪৭ বছর পরেও বাঙালি জীবনের উপর কালো ছায়া ফেলেছে। প্রশাসনিক ও আইনগতভাবে বাঙালিকে এমন এক কঠিন পরীক্ষায় ফেলা হয়েছে যার উদ্দেশ্য তার ভারতীয়ত্বেকে অস্বীকার করা। এখন শুধু আসাম নয়, খোদ পশ্চিমবঙ্গের মাটিতেও বাঙালির হাতে পৌঁছে যাচ্ছে ভারতীয় নাগরিকত্ব প্রমাণের ফরমান। ভারতের বিভিন্ন প্রদেশেই আজ বাংলাভাষা উচ্চারিত হলে বিদেশি বলে অভিযোগের তর্জনী উঠছে।
এই ভয়াবহ পরিস্থিতির পেছনে রয়েছে দীর্ঘদিন ধরে চলে আসা এক চক্রান্ত, ভাষা-সাম্প্রদায়িকতা। সেদিন যে-প্রাতিষ্ঠানিক সাম্প্রদায়িকতার সূতিকাগার ছিল আসাম— আজ তা বিস্তার লাভ করছে সারা দেশে। কে-ই বা ভাবতে পেরেছিল বাঙালিকে নথিপত্র দেখিয়ে প্রমাণ করতে হবে যে এরা এ-দেশে ‘উড়ে এসে জুড়ে বসা’ কোনও আগন্তুক জনগোষ্ঠী নয়? আসাম, উত্তর পূর্বাঞ্চল-সহ এ ভারতীয় উপমহাদেশে এদের অস্তিত্বের শিকড় যে বহু গভীরে প্রোথিত— পাঁজিপুথি ঘেঁটে এ তথ্য বের করে দেখাতে হবে!
সময়ের দাবিতে তাও করতে হবে। অতীত অন্বেষণ তার আশঙ্কার কারণ হবে না, অতীত ইতিহাস তো বাঙালির শক্তিরই উৎস। বাঙালি জাতিসত্তার আত্মপ্রকাশ।
একটু পেছনে যাওয়াই যাক বরং। ইতিহাস বলে বাংলা (ও অসমিয়া) ভাষার জন্মের বহু আগে থেকেই প্রব্রজনের ধারায় একাধিক ভিন্ন ভিন্ন মানবগোষ্ঠী ভারতবর্ষের দক্ষিণ-পূর্ব, এবং উত্তর-পূর্ব নিয়ে সমতল ভূখণ্ডে বসতি স্থাপন করেছিল। এর মধ্যে অন্যতম ছিল পূর্বদিক থেকে আগত বোড়ো জনগোষ্ঠীর প্রাচীন শাখা— Old Bodos। এরা প্রথমে উজান ও মধ্য আসামে বসতি গড়ে, পরে নিম্ন আসাম হয়ে আরও দক্ষিণে ছড়িয়ে পড়ে। আবার অপরদিকে ভারতীয় মূলভূমি থেকেও পূর্বমুখী জন-প্রব্রজনধারা চলতে থাকে। সেটা প্রাগৈতিহাসিক কালের কথা। সমাজ ও জাতিগঠন প্রক্রিয়ায় বোড়ো এবং অস্ট্রিক, দ্রাবিড় ও মঙ্গোলীয় বংশোদ্ভূত জনগোষ্ঠী “বঙ্গ” বলে কথিত অঞ্চলকে “হা-বাংলা” বলে অভিহিত করে, এটা ইতিহাসবিদ ও ভাষাতাত্ত্বিকদের ধারণা। এ-ধারণা থেকে এটা বলা যায় বাঙালিদের জাতিবাচক পরিচিতি হয়েছে ওই আগন্তুক জনগোষ্ঠীর কল্যাণেই। অর্থাৎ খ্রিস্টীয় প্রথম সহস্রাব্দের সূচনায় বা এরও আগে এ-ভূখণ্ডটি “বঙ্গ” নামে পরিচিতি লাভ করেছে।
ভোটব্রহ্ম বা অস্ট্রিক ভাষায় “হা-বাংলা” শব্দের অর্থ হল পূর্ণতার দেশ, বঙ্গ। এরই সংস্কৃতায়িত রূপ “বঙ্গলম”। হরিচরণ বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁর অভিধানে এ-অঞ্চল সম্বন্ধে ভাষাতাত্ত্বিক ডঃ হ্যালজেস (Halzesh)-এর একটি মন্তব্য উদ্ধার করেছেন যেখানে বঙ্গদেশকে বলা হয়েছে— “the land where rainfall never ends”[1]।
প্রসঙ্গটি উত্থাপন করার অর্থ হল বাঙালি জাতিসত্তার উদ্ভব ও বিকাশ যে এই দেশের অভ্যন্তরেই— এটা মনে করিয়ে দেওয়া। যাঁরা ইচ্ছাকৃতভাবে “বাঙালি আর বাংলাদেশি”কে সমার্থক বলে ভাবছেন, যাঁরা নিজেদেরই ভারতবর্ষের একমাত্র মূল বাসিন্দা বলে ভাবতে শুরু করেছেন, এঁদের জন্য সামান্য প্রাগৈতিহাসিক তথ্য তুলে ধরা তাই একান্ত প্রয়োজন।
এ-প্রসঙ্গে এক্ষণে সর্বপ্রথম আসামের কথা আসাই স্বাভাবিক। এ-মুহূর্তে যে বাঙালিবিদ্বেষ একটি জাতীয় চারিত্র্যের রূপ ধারণ করার পথে চলছে এর পেছনে রয়েছে আসাম থেকে উদ্ভূত জাতিবিদ্বেষই।
একটা সময়ের কথা বলা প্রয়োজন যখন “আসাম” নামটির উদ্ভব হয়নি। আসামের অন্যতম শ্রেষ্ঠ ইতিহাসবিদ অধ্যাপক হেরম্বকান্ত বড়পূজারি, আসাম সরকারের উদ্যোগে প্রকাশিত A Comprehensive History of Assam (in 5 Vol, 1962) বইতে উল্লেখ করেছেন— খ্রিস্টীয় পঞ্চম শতক (কিংবা তাঁর কথায় “if not earlier”) থেকেই প্রাগজ্যোতিষপুর ও কামরূপ রাজ্যে (আসামের সমতলভূমি) বঙ্গদেশ থেকে ব্রাহ্মণদের আমন্ত্রণ করে আনা হয়েছিল। এই আমন্ত্রণ করে আনার প্রথা কোচ ও আহোম রাজদরবারেও প্রচলিত ছিল।
এটা প্রতিষ্ঠিত সত্য ১২২৮ সালে শান দেশ থেকে আহোমদের আগমনের বহু আগে থেকেই বঙ্গদেশীয় জনগোষ্ঠীর অবস্থান ছিল আসামে। আহোম শাসন প্রতিষ্ঠিত হলে পরেও বঙ্গ (সে সঙ্গে উত্তর ও দক্ষিণ ভারত) থেকেও রাজসভা-আমন্ত্রিত জনস্রোত আসামে অব্যাহত ছিল। আহোম রাজা শিবসিংহের (১৭১৪–৪৪) আমলে যে ব্রাহ্মণরা এ-রাজ্যে আমন্ত্রিত হয়ে আসেন এঁদের মধ্যে নবদ্বীপের মহন্ত নৈয়ায়িক কৃষ্ণরাম ভট্টাচার্য আসামের সামাজিক ইতিহাসে স্মরণীয় হয়ে রয়েছেন। তিনি আসামে স্মার্ত রঘুনন্দনের স্মৃতি প্রচলন করেন যা অদ্যাবধি সচল রয়েছে।
এই সামাজিক প্রেক্ষাপটে ঐতিহাসিক প্রক্রিয়ায় বাঙালি ও অসমিয়া— দুই জনগোষ্ঠী ক্রমে স্বতন্ত্র ভাষিক ও সামাজিক সত্তা হিসেবে গড়ে ওঠে। এদের মধ্যে আবার যাঁরা পূর্বপুরুষের ভাষা ত্যাগ করে অসমিয়া সমাজের সঙ্গে নিজেদের বিলীন করে দিয়েছেন, তাঁদের মুখে অসমিয়া বুলি ফুটলেও নৃতাত্ত্বিকভাবে এঁরা বাঙালিই। সে সঙ্গে রয়েছেন দ্বিতীয় আরও একটি শ্রেণি— যে শ্রেণি বঙ্গীয় ভাষা ও সংস্কৃতিতে স্থিত রয়ে গেছেন—। উভয়েরই নাগরিক বৈধতার মধ্যে কোনও মৌল পার্থক্য থাকার কথা না। এই ভূমির আদি বাসিন্দা বলে দ্বিতীয়োক্তদের গণ্য না করার কোনও সঙ্গত কারণ নেই।
একটু মুক্ত দৃষ্টিতে দেখলে বোঝা যাবে এ-রাজ্যে অসমিয়া আর বাঙালির অবস্থানের ইতিহাস মূলত সমন্বয় ও সহাবস্থানেরই ইতিহাস। কচারি, বোড়ো, মরাণ, বরাহি প্রভৃতি জাতিগোষ্ঠীর সঙ্গে হাত মিলিয়ে এরা এক সমন্বিত সমাজ এবং রাষ্ট্রগঠন প্রক্রিয়ার বহুদূর অগ্রসর হয়েছিলেন, স্বাধীনতা-উত্তরকালে বিভেদের রাজনীতি ও উগ্রজাতীয়তাবাদের অভ্যুত্থানে এ-প্রক্রিয়াটি, বলা বাহুল্য বিঘ্নিত হয়েছে। এমনটি তো হওয়ার কথা ছিল না। আমাদের মনে রাখা প্রয়োজন, বাংলা ও অসমিয়া ভাষার উৎপত্তি ও বিকাশ ঘটেছে প্রায় একই সময়ে। আরও যা মনে রাখা প্রয়োজন তা হল সেই চর্যাপদর যুগ থেকেই এ দুই ভাষার মধ্যে রয়েছে অন্তর্নিহিত আত্মীয়তা— একপ্রকার ভগ্নীপ্রতিম সম্পর্ক।
এ কথাটিও উল্লেখ্য, গাঙ্গেয় সমভূমিতে বাঙালি জাতিসত্তার আত্মপ্রকাশ ও বিবর্তন-প্রক্রিয়া পূর্ববঙ্গ, আসাম-সহ বৃহত্তর বঙ্গভূখণ্ডেও ক্রিয়াশীল ছিল। এ-প্রক্রিয়া নিম্ন আসাম ও কাছাড় অঞ্চলেও প্রাচীনকাল থেকে প্রাক্-ঔপনিবেশিক যুগ পর্যন্ত সচল ছিল— এ ঐতিহাসিক সত্য উপলব্ধি করা শুধু বাঙালির দায়িত্ব নয়— অশান্ত উত্তর-পূর্বাঞ্চলে স্থায়ী শান্তির স্বার্থে অসমিয়াদেরও দায়িত্ব। ভাষাচার্য সুনীতিকুমার চট্টপাধ্যায়, দীনেশচন্দ্র সেন, নীহাররঞ্জন রায় থেকে আহমদ শরীফ, গোলাম মুরশিদ— এরা এই বিষয়ে বিস্তৃত তথ্য ও বিশ্লেষণ দিয়েছেন। আসামে সুজিৎ চৌধুরী, জয়ন্তভূষণ ভট্টাচার্য, বাণীপ্রসন্ন মিশ্র প্রমুখ ইতিহাস ও সমাজতত্ত্ববিদেরা প্রাগৈতিহাসিক যুগে বঙ্গভূমিতে ইন্দো-মঙ্গোলীয়, অস্ট্রিক ও ভোটব্রহ্ম জনগোষ্ঠীর সংমিশ্রণেই বাঙালি জাতিসত্তার উদ্ভব[2] ও বিকাশের ধারাটি অনুসরণ করার প্রয়াস পেয়েছেন। বিস্তৃত এ-ভূমিতে সমাজ ও রাষ্ট্রগঠন প্রক্রিয়ায় (Social and Polity formation process) বঙ্গভূমির সঙ্গে আসামের সম্পর্কের সূত্রও তাঁদের গবেষণায় স্পষ্ট হয়েছে।
এই সত্যটি না-বুঝলে আসামের জাতি ও ভাষা সমস্যা এবং এ থেকে উদ্ভূত জটিল বিভাজনের রাজনীতির গতিপ্রকৃতি অনুধাবন করা অসম্ভব হবে, “বিদেশি অনুপ্রবেশ”, “খিলঞ্জিয়া আর ভগনিয়া” নিয়ে কূট রাজনীতির জাল থেকে অসমিয়া আর বাঙালি উভয়েরই বেরিয়ে আসা কঠিন হবে।
প্রশ্ন হল— এ দায়িত্ব নেবে কে?
প্রথম দায়িত্ব বাঙালির। যদি বাঙালিরা নিজের ইতিহাস ও স্বরূপ না বোঝে, তবে অন্যেরা তা বোঝার চেষ্টা করবে কেন?
বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় বলেছিলেন— “বাঙ্গালার ইতিহাস চাই, নইলে বাঙ্গালী কখনও মানুষ হইবে না।” আপাতত আসামের বাঙালির গভীরভাবে এই সত্য অনুধাবন করা বিশেষ প্রয়োজন।

দুই.
বাঙালির বিরুদ্ধে নবপর্যায়ের অভিযানের সূচনাবিন্দু আসাম নিয়ে আরও কিছু কথা বলা প্রয়োজন। দেশবিভাগের ফলে পূর্বপাকিস্তান থেকে বাস্তুচ্যুত বাঙালির আগমন এই পর্যায়ে আসামে প্রচণ্ড জাতিবিদ্বেষের জন্ম দিয়েছে। নিজ মাতৃভূমির একটি অংশ পাকিস্তানে হস্তান্তরিত হয়ে গেলে মাতৃভূমির অবশিষ্ট যে অংশটিতে শ্রীহট্ট এবং সংলগ্ন জেলাগুলো থেকে যাঁরা সরে এলেন, এঁরা কোনও ভিন্ন রাষ্ট্রের বাসিন্দা হিসেবে তো আসেননি— ভারতবাসী হিসেবেই এসেছেন। কোথায় এসেছেন? না, ভারতবর্ষের যে অংশটি রেডক্লিফের ফিতের এপারে পড়েছে সে অংশতেই। এ আশ্রয়প্রার্থীদের চিরকালীন আনুগত্য স্বাধীন, সার্বভৌম, ধর্মনিরপেক্ষ ভারতবর্ষের প্রতিই। দেশবিভাগের পূর্বে যেমন ছিলেন ভারতীয়, পরবর্তীতেও আসামবাসী হয়ে এঁরা ভারতীয়ই রয়েছেন। পাকিস্তানি তো নন, আর বাংলাদেশ তো এই সেদিনের কথা।
একটু বিশেষ করে কাছাড়ের কথা বলতে হলে, সেই ১৮৭৬ সালে বেঙ্গল প্রেসিডেন্সি থেকে কেটে এনে নবসৃষ্ট চিফ কমিশনার শাসিত আসাম প্রদেশের সঙ্গে (সিলেট এবং) কাছাড়কে জুড়ে দিলেও কাছাড় কদাপি আসামের অংশ ছিল না। বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন রাষ্ট্রশক্তির শাসনাধীনে থাকলেও কাছাড়ে বাঙালি জাতিগোষ্ঠীর আত্মপ্রকাশের ইতিহাস হাজার বছরেরও প্রাচীন। সেই হরিকেল, সমতট, কামরূপ অধ্যায়, নিধনপুর-পশ্চিমভাগ-কালাপুর-ভাটেরা তাম্রশাসন-বর্ণিত অঞ্চলের সমাজ ও রাষ্ট্রনৈতিক উত্তরাধিকার নিয়েই কাছাড়ের আত্মপ্রকাশ। এই বাঙালি কোনও ভুঁইফোড় জনগোষ্ঠী নয়— তাদের উত্তরাধিকারের সঙ্গে নিবিড়ভাবে যুক্ত হয়ে আছে চৈতন্য–শাহজালাল সমকালীন সুফি-বৈষ্ণব ভাবান্দোলনের ইতিহাস, সঙ্গে রয়েছে প্রাক্-ঔপনিবেশিক ডিমাসা পর্বের আরেকটি উজ্জ্বল ইতিহাসও। সমতল কাছাড়ের সংস্কৃত-বাংলায় উৎকীর্ণ প্রস্তরলিপি, রাজদরবারের পৃষ্ঠপোষণায় বাংলায় রচিত ‘হেরম্ব দণ্ডবিধি’, রাজকীয় সনদ, রাজসভা প্রকাশিত মুদ্রায় উৎকীর্ণ বাংলা বর্ণমালা— সবই এ ভূমিতে বাঙালির প্রাচীনত্বের জীবন্ত সাক্ষ্য হয়ে আছে। এসব উপেক্ষা করে কাছাড়কে “আগন্তুক অধ্যুষিত ভূমি” (immigrant infested land) বলে দেগে দেওয়ার মধ্যে সরকারি মদতপুষ্ট ঔদ্ধত্য ছাড়া কোনও বাস্তবতা নেই।
বিশ শতকের প্রথম দশক থেকেই স্বাধীনতা আন্দোলনে এ ভূমির সক্রিয় অংশগ্রহণ, দলে দলে কারাবরণ, এবং ‘স্বদেশি’ বলে চিহ্নিত হয়ে ইংরেজ প্রশাসকের হাতে অত্যাচারিত হওয়ার ইতিহাস আজও জীবন্ত ইতিহাস। কিন্তু আজ সেই বাঙালির উত্তরসূরিকে ‘বিদেশি’ বলে চিহ্নিত করে এদের ভোটাধিকার কেড়ে নেওয়া, ডিটেনশন ক্যাম্পে পাঠানো, নাগরিকপঞ্জি থেকে লাখে লাখে নাম মুছে ফেলা— এ সবই ঘটছে প্রাদেশিক সরকারের প্রত্যক্ষ প্রশ্রয়ে, কেন্দ্রীয় সরকারের নীরব সমর্থনে।
স্বাধীনতা আন্দোলনের উত্তাল মুহূর্তে গান্ধিজির ডাকে পড়াশোনা ছেড়ে আইন অমান্য আন্দোলনে অংশগ্রহণকারী এমনই এক বাস্তুহারার কথা লিখেছেন তাঁরই খ্যাতিমান ইতিহাসবিদ পুত্র। পিতৃপুরুষের প্রসঙ্গে মর্মস্পর্শী ভাষায় তিনি বলেন—
সেদিনের যাঁরা সংগ্রামী, তাঁরা ভারতমাতাকে মুক্ত করতেই ঘর ছেড়ে পথে বেরিয়েছিলেন, বাংলাদেশকে কিংবা পূর্ব পাকিস্তানকে নয়। ভারতবর্ষ তাঁদের কাছে কোনও ভৌগোলিক মানচিত্র ছিল না, তা ছিল একটি ধ্যানের প্রতীক…। তাই মানচিত্র যখন খণ্ডিত হল, তখন সেই ধ্যানটুকু সম্বল করে আমাদের পিতৃপুরুষেরা ছুটে এসেছিলেন এই দেশে, যেখানে তাঁদের ধারণা জন্মেছিল যে, ধ্যানের ভারতবর্ষ বাস্তবে রূপ নেবে।
ইতিহাসের নির্মম বিচার— যাঁরা সেই ধ্যানের মানচিত্রকে কেটে টুকরো করেছিলেন, তাঁরাই যে আজ মাতৃভক্ত সেজে দেশকে “বিদেশি অনুপ্রবেশকারীমুক্ত” করার নামে এই হতভাগ্য বাঙালিকে দেশময় তাড়না করে ফিরছেন।
বাস্তুহারার এ করুণ জবানবন্দিতে উচ্চারিত হয়েছে—
স্বাধীনতা বৃক্ষের ফলটি নিঃশেষে গলাধঃকরণ করার জন্যে আমরা তো মাতৃঅঙ্গে কুঠারাঘাত করিনি।
স্বাধীনতা সংগ্রামীর অভিমানী সন্তান অভিযোগ করেছেন—
মাতৃঘাতী পরশুরামের ভূমিকায় যারা অভিনয় করেছেন, তারা তো তোমার ক্ষমাসুন্দর আশ্রয় পেয়ে গেল। মাতৃঅঙ্গচ্ছেদের দরুণ যে অনিবার্য রক্তক্ষরণ, তার দায় তো পুরোটা আমরাই মিটিয়েছি। সে রক্তমূল্যের বিনিময়েও কি তোমার মাটিতে পা রাখবার অধিকার আমাদের জন্মায় না?[3]

বাঙালির হাজারটা দোষ থাকলেও একটা গুণের কথা বলতেই হয়— রাষ্ট্রকর্তৃক নিগ্রহ, অপমান ও অবিচার তাঁর নিত্যদিনের প্রাপ্তি সত্ত্বেও, বাঙালি কখনও অভিমানবশতও বিচ্ছিন্নতাবাদী হয়নি, দেশমাতৃকার প্রতি বেইমানি করেনি।
কেবল উত্তর–পূর্বাঞ্চলের কথাই ধরলে বলতে হয়— আজ যারা কথায় কথায় হাতে বন্দুক তুলে নেয়, বারবার রক্তপাত, নৃশংস হত্যালীলায় দেশের মাটিকে ভিজিয়ে তোলে, যারা এই দেশ থেকে বেরিয়ে গিয়ে সহিংস পথে চলে আলাদা দেশ বানানোর হুমকি দেয়, খিলঞ্জিয়া, থলুয়া কত বিশেষণে ভূষিত করে বেছে বেছে তাদেরই বোঝানো হয়, “তোমরা ভারতবাসী”। অথচ যাদের প্রাণের গভীরে ভারতমাতার চিরকালীন অধিষ্ঠান, তাদের ওপর “বিদেশি” তকমা লাগিয়ে তাদের শায়েস্তা করতে ডি-ভোটার, এন-আর-সি, ভোটার তালিকা পুনর্নিরীক্ষণ (এস-আই-আর), এমন-কি তাঁদের মুখের ভাষার অস্তিত্বকে নস্যাৎ করে আসাম থেকে দিল্লি, গুজরাত থেকে মণিপুর— সর্বত্র এদের তাড়না করতে আজ দেশব্যাপী এত আয়োজন!

১২ আগস্ট, ২০২৫
[1] দ্রষ্টব্য: বন্দ্যোপাধ্যায়, হরিচরণ। বঙ্গীয় শব্দকোষ। সাহিত্য অকাদেমি। ২০১১ সংস্করণ।
[2] শ্রীহট্ট-কাছাড়ের প্রাচীন ইতিহাস।
[3] চৌধুরী, সুজিত। সময়ের পদাবলী। করিমগঞ্জ: ২০০৬।

