বাংলা ভাষা উচ্চারিত হলে…

আইরিন শবনম

 


আসলে ভাষা দিয়ে, কিংবা বলা ভালো বিশেষ বিশেষ শব্দের ব্যবহার দিয়ে, মানুষকে (বিশেষ ধর্মের) চিহ্নিত করাই আসল উদ্দেশ্য। শুধু চিহ্নিত করা নয়, অপর করা, কোনঠাসা করা, প্রান্তিক করা, বাতিল করা। তাঁরা যে আমাদের দেশে বাস করেও আসলে বিদেশি, তা প্রমাণ করাই উদ্দেশ্য। ভাষার শুচিতা ব্যাপারটাই খুব গোলমেলে, অনেকটা রক্তের শুচিতা খোঁজার মতো। যেমন জার্মানিতে আর্য রক্ত খুঁজতে গিয়েছিলেন হিটলার

 

সম্প্রতি বাংলা ভাষা— ঠিকভাবে বললে বাংলাভাষীদের নিয়ে বিস্তর জলঘোলা হচ্ছে। যে অভিবাসী শ্রমিকরা বাংলার বাইরে বিভিন্ন রাজ্যে কাজ করতে যান, তাঁরা নানাভাবে আক্রমণ ও হেনস্থার শিকার হচ্ছেন। পরে দেখা গেল, টার্গেট মূলত বাঙালি মুসলমান অভিবাসীরা। চরম আতঙ্কে তাঁরা দিন কাটাচ্ছেন— বৈধ কাগজপত্র দেখালেও তাঁদের গ্রেপ্তার করা হচ্ছে, টাকা দাবি করা হচ্ছে, এমনকি বাংলাদেশি বলে দাগিয়ে দিয়ে পে-লোডারে করে সীমান্তের ওপারে ফেলে দেওয়া হচ্ছে। কারণ একটাই— তাঁরা যে ভাষায় কথা বলছেন সেটা বাংলা নয়, ‘বাংলাদেশি’ ভাষা; সুতরাং তাঁরা অনুপ্রবেশকারী। ভাষা শুনেই ঠিক করে ফেলা হল যে ওই মানুষগুলো অনুপ্রবেশকারী, কাগজপত্র সব ফালতু।

পরে তো দিল্লি পুলিশ এ-কথাও বলল যে বাংলা বলে কোনও ভাষাই নেই— যাকে সমর্থন করলেন বিজেপির আইটি সেলের আহ্বায়ক। ক-দিন আগে তাহলে কেন্দ্রীয় সরকার কোন ভাষাকে ধ্রুপদীর মর্যাদা দিল? সে যাই হোক, মূল প্রশ্নটা গিয়ে দাঁড়াল— ভাষাটা বাংলা না বাংলাদেশি? বাংলার ছাত্রী হিসেবে এখনও পর্যন্ত যা জানি— ‘বাংলাদেশি ভাষা’ বলে কোনও ভাষা নেই। বাংলাদেশে বাসকারী মানুষেরা বাংলাদেশি, কিন্তু তাঁদের ভাষার নাম বাংলা। “বাংলাভাষা উচ্চারিত হলে অন্ধ বাউলের একতারা বাজে উদার গৈরিক মাঠে, খোলা পথে, উত্তাল নদীর বাঁকে বাঁকে, নদীও নর্তকী হয়…”— বাংলাদেশের কবি শামসুর রাহমান লিখেছেন। তাহলে হঠাৎ করে এই ‘বাংলাদেশি’ ভাষার আমদানি হল কোথা থেকে?

 

আমরা যারা দেশ ও রাজ্যের রাজনীতি সম্বন্ধে একটু খোঁজখবর রাখি, তারা জানি— সামনে ভোট, আর সেখানে পশ্চিমবঙ্গে বাংলাদেশি অনুপ্রবেশকারীরা একটা বড় ফ্যাক্টর। সেই সূত্রেই বাংলাভাষী মুসলমান অভিবাসীদের উপর এই কোপ। পুরো ব্যাপারটাই রাজনৈতিক। সেই রাজনীতি করতে গিয়ে হয়তো তাঁরা নিজের অজান্তেই ভাষা-রাজনীতির মধ্যে ঢুকে পড়েছেন। বাংলা বলে কোনও ভাষা নেই— এ-কথা বলেই কেবল তাঁরা সেই রাজনীতির অংশ হয়ে যাননি, মালব্য তাঁর বক্তব্যে স্পষ্ট করে বলেছেন— ওরা (অভিবাসীরা) যে ভাষায় কথা বলে তা পশ্চিমবঙ্গে বলা বাংলা ভাষা নয়।

অর্থাৎ পশ্চিমবঙ্গে বাংলাভাষার একটাই রূপ এবং সেটি হল কলকাতায় প্রচলিত মান্য বাংলা বা প্রমিত বাংলা। এই বক্তব্যকে প্রতিষ্ঠা দিতে তাঁরা দিল্লির করোলবাগের উদাহরণ দিয়েছেন— সেখানকার বাঙালিরা কত ভালো আছে, বাংলা বলার জন্য তাঁদের তো কোনও সমস্যায় পড়তে হচ্ছে না! তাঁদের সমস্যা তো হবেই না, কারণ তাঁরা মূলধারার শিক্ষিত বাঙালি, কথা বলেন মান্য বাংলায়। এই ভাষাটিই একমাত্র বাংলা ভাষা; এ-ভাষায় যাঁরা কথা বলেন কেবলমাত্র তাঁরাই বাঙালি। বাকিরা না বাংলা বলেন, না তাঁরা বাঙালি! সুতরাং সেই ভাষাকে বাতিল করো, সেই মানুষদের বাতিল করো— অন্তত কোণঠাসা করো।

যাদের আদর্শ ‘হিন্দু–হিন্দি–হিন্দুস্তান’ কিংবা ‘এক জাতি এক ভোট’, তাঁদের পক্ষে এমনটা ভাবাই স্বাভাবিক। বৈচিত্র্য তাঁদের একান্তই না-পসন্দ। কিন্তু শিক্ষিত বাঙালিরা? তাঁরাও কি এরকমই ভাবেন না? তাহলে কালিয়াচকের একজন মানুষ কিংবা দিনাজপুরের কোনও গ্রামের মানুষ কলকাতা কিংবা কোনও মফস্বল শহরে গিয়েও নিজের ভাষায় (আঞ্চলিক ভাষায়) কথা বলতে পারেন না কেন? কারণ আঞ্চলিক ভাষায় কথা বলার অর্থই তো পশ্চাদপদ হিসেবে চিহ্নিত হওয়া। বাংলাতেই তো এই উপভাষাগুলোকে ব্রাত্য করে রাখা হয়েছে! তাই ভাষায় আঞ্চলিক টান থাকলেও খোদ কলকাতা শহরেই বাংলাদেশি বলে মার খেতে হয় (কারমাইকেল হস্টেলের ছাত্রদের মারধর)।

 

তবে বুদ্ধিমান বাঙালি অবশ্য এখানেই থেমে থাকেনি। বাংলাদেশের লোকেরা যে সত্যিই ‘বাংলাদেশি’ ভাষায় কথা বলে, বাংলায় নয়— তার প্রমাণস্বরূপ কিছু কথা হাওয়ায় (সমাজমাধ্যমে) ভাসিয়ে দেওয়া হয়েছে। তার মধ্যে জল/পানির সেই চিরাচরিত বিতর্ক তো আছেই, সঙ্গে আছে— গোসল, দাওয়াত, গোস্ত, নাস্তা, দুলাভাই, রংধনু ইত্যাদি। এগুলো নাকি বাঙালিরা বলে না। অর্থাৎ এই শব্দগুলো যারা ব্যবহার করে তারা বাঙালি নয়। কারা এই শব্দগুলো ব্যবহার করে? অবশ্যই মুসলমান বাঙালিরা।

সব মুসলমানরাই কি এই শব্দগুলো ব্যবহার করেন? এদের জানা উত্তরটা হল— হ্যাঁ। কারণ মুসলমান সম্পর্কে এটুকুই তাঁদের জ্ঞান। তাঁরা জানেন না অঞ্চলভেদে, শ্রেণিভেদে, গ্রাম-শহরভেদে, শিক্ষিত-‘অশিক্ষিত’ ভেদে, এমনকি নারী-পুরুষ ভেদেও মুসলমানে-মুসলমানে তফাত আছে। তফাত আছে তাঁদের ভাষা এবং সম্বোধনেও। মালদা উত্তর এবং দুই দিনাজপুরে পিসিকে ফুপু বলে না, বেটি বলে। পিসোকে বলে জামাই। কাকাকে চাচা বলে না, বেটা বলে সাধারণত। এরকম আরও অনেক ভেদ আছে সম্বোধনে। জলখাবারকে যেমন জলখাবার বলা হয় না, তেমন নাস্তাও বলে খুব কম লোক। নাস্তা মানে একটু ভালো-মন্দ সকালের খাবার, নইলে মুড়ি-পান্তাই বলে। আমি কোনওদিন মুড়ি-পান্তাকে নাস্তা বলতে শুনিনি। আর যদি কেউ বলেও থাকে, তাতেই বা কী মহাভারত অশুদ্ধ হল! কই— পাপা, ড্যাডি, মামা-মাম্মি এসব শব্দে তো বাংলা ভাষার জাত যায় না! তাহলে আব্বা-আম্মাতেই বা যাবে কেন? ওই শব্দগুলো আরবি/ফার্সি বলে? (আম্মা কিন্তু আরবি/ফার্সি শব্দ নয়, সম্ভবত সংস্কৃত ‘অম্ব’ শব্দ থেকে বিবর্তিত হয়েছে।) তাহলে তো বাবা-কাকাকেও বাদ দিতে হয়, গ্রহণ করতে হয় মুসলমানি শব্দ ‘চাচা’-কে, যা কিনা সংস্কৃত ‘তাত’ থেকে বিবর্তিত বলে অনেকে মনে করেন। আর পানিকে তো কোনওমতেই বাদ দেওয়া যায় না, কারণ ওটি আরবি/ফার্সি বা উর্দু নয়, যতদূর সম্ভব সংস্কৃত থেকে আসা। চর্যাপদেই তো ‘পানি’ শব্দের ব্যবহার আছে।

এভাবে যদি আরবি/ফার্সি শব্দ বেছে ফেলতে হয় তাহলে ঠগ বাছতে গাঁ উজাড় হয়ে যাবে! ‘রাস্তা’য় চলা যাবে না, ‘মিছিল’ করা যাবে না, ‘ইনকিলাব জিন্দাবাদ’ বলা যাবে না, কোনও ‘ফালতু’ কথার ‘জবাব’ দেওয়া যাবে না, ‘আইন-আদালত-দলিল-দস্তাবেজ-কাগজ-কলম-দোয়াত’ সব-ই ছাড়তে হবে। ভাবছেন ‘বাজে’ কথা বলছি? এ তো সবে ‘শুরু’! (ইনভার্টেড কমার ভেতরের সব শব্দগুলোই আরবি-ফার্সি থেকে এসেছে।)

সবচেয়ে বড় কথা, বাংলা শব্দের মূলে ফার্সি ‘বঙ্গালহ’ শব্দটি আছে বলে স্বয়ং সুকুমার সেন মনে করেছেন। ‘ফজর’ শব্দটির ব্যবহার নিয়েও আপত্তি দেখলাম। তাহলে কি আমরা মুকুন্দরাম চক্রবর্তীকেও বাদ দেব? কারণ তিনি লিখেছেন—

ফজর সময়ে উঠি
বিছায়ে লোহিত পাটি
পাঁচবেরি করয়ে নামাজ।

না কি বাদ দেব জসীমউদ্দিনকে, যিনি লিখেছেন—

এইখানে তোর দাদির কবর ডালিমগাছের তলে
তিরিশ বছর ভিজায়ে রেখেছি দুই নয়নের জলে।

 

বাংলা ভাষার শুদ্ধিকরণ করতে গিয়ে একদিকে যেমন আরবি/ফার্সি বা উর্দু শব্দ কিংবা ব্যক্তিগত স্তরে ব্যবহৃত শব্দগুলিকে তুলে ফেলার চেষ্টা হচ্ছে, তেমনি অন্যদিকে ঠিক এর বিপরীত একটি প্রক্রিয়াও (প্রতিক্রিয়া?) দেখা যাচ্ছে। তা হল— কথায় কথায় আরবি শব্দের ব্যবহার। সমাজমাধ্যমে একটু লক্ষ করলেই চোখে পড়ে মাশাল্লা, সুবহানাল্লা জাতীয় শব্দের ব্যবহার খুব বেড়ে গেছে। যেন এই ধরনের শব্দ ব্যবহার না করলে নিজের মুসলমান পরিচয়ে কোথাও ঘাটতি পড়ে যাবে!

অথচ মহম্মদের জন্ম বা কোরান লিখিত হওয়ার অনেক আগে থেকেই আরবে আরবি ভাষা প্রচলিত ছিল। ভাষা কোনও ধর্মের হয় না। যে ধর্ম যে ভাষাভাষী অঞ্চলে জন্ম নেয়, সেই ভাষাকে গ্রহণ করে এবং অবশ্যই সেই ভাষাকে প্রভাবিতও করে। বাংলায় এমন প্রচুর শব্দ আছে যার মূল কোনও ধর্মীয় আচার কিংবা আচরণ থেকে উদ্ভূত, কিন্তু বিবর্তিত হতে হতে তার অর্থ প্রসারিত, সঙ্কুচিত অথবা পরিবর্তিত হয়েছে। হিন্দু-মুসলিম উভয়েই অবলীলাক্রমে সে শব্দগুলি ব্যবহার করে। খুব খুঁটিয়ে খেয়াল না করলে তার মূলটা অজানাই থেকে যায়। তেমনি আরবির ক্ষেত্রেও একথা প্রযোজ্য— বিশেষ করে ধর্মীয় বিষয়গুলিতে।

আর সম্বোধনের ক্ষেত্রে বাঙালি মুসলমানদের মধ্যে মূলত উর্দুভাষী দিল্লি বা উত্তরপ্রদেশের সম্বোধনগুলো ব্যবহৃত হয়, কারণ ওই অঞ্চলগুলির মানুষরাই অভিজাত মুসলমান বলে স্বীকৃত। তাই যাঁরা মুসলমানদের অগ্রগতির ইতিহাস জানেন, তাঁরা লক্ষ করেছেন— আব্বা, আম্মা, ফুপু ইত্যাদি শব্দগুলির ব্যবহার বাংলায় খুব বেশি আগে শুরু হয়নি। তাঁদের শহরে যাওয়া, শিক্ষিত হওয়া এবং অভিজাত হওয়ার বাসনা থেকেই প্রথম এর সূচনা হয় বলে আমাদের ধারণা।

ব্যক্তিগতভাবে বলতে পারি, আমাদের আগের প্রজন্ম বাবাকে বাপু বলতেন, কেউ কেউ বাপ, আর মাকে তো মা-ই (এখনও অধিকাংশ মুসলমান তা-ই বলেন)। আমাদের প্রজন্মই প্রথম আব্বা বলতে শুরু করে। তবে দরিদ্র ও তথাকথিত অশিক্ষিতরা কিন্তু তা বলতেন না— অনেক পরে শুরু করেছেন।

তাই কিছু ভাষা ব্যবহার করলেই যেমন বাঙালিত্ব চলে যায় না, তেমনি কিছু শব্দ ব্যবহার না করলেই মুসলমানত্বও চলে যায় না। উভয় তরফেরই এই গোঁড়ামি বন্ধ হওয়া উচিত।

তবে শুধু গোঁড়ামি বললে বোধহয় সমস্যাটাকে খাটো করে দেখা হয়। আসলে এটা এক রাজনৈতিক প্রোজেক্ট— যে প্রোজেক্টে এলাহাবাদ হয়ে যায় প্রয়াগরাজ, মুঘলসরাই হয়ে যায় দীনদয়াল উপাধ্যায়। হিন্দি থেকে উর্দু শব্দ বেছে ফেলার চেষ্টা হয়। বাংলা ভাষার শুদ্ধিকরণও সেই রাজনৈতিক প্রোজেক্টেরই প্রসারিত রূপ।

আসলে ভাষা দিয়ে, কিংবা বলা ভালো বিশেষ বিশেষ শব্দের ব্যবহার দিয়ে, মানুষকে (বিশেষ ধর্মের) চিহ্নিত করাই আসল উদ্দেশ্য। শুধু চিহ্নিত করা নয়, অপর করা, কোনঠাসা করা, প্রান্তিক করা, বাতিল করা। তাঁরা যে আমাদের দেশে বাস করেও আসলে বিদেশি, তা প্রমাণ করাই উদ্দেশ্য। ভাষার শুচিতা ব্যাপারটাই খুব গোলমেলে, অনেকটা রক্তের শুচিতা খোঁজার মতো। যেমন জার্মানিতে আর্য রক্ত খুঁজতে গিয়েছিলেন হিটলার। আজ যারা ভাষার শুদ্ধতার কথা বলছেন, তাঁদের উদ্দেশ্যও অনেকটা সেরকম; ভাষা-প্রশ্ন একটা ছল মাত্র।

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 5217 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

Be the first to comment

আপনার মতামত...