বিশ্বভারতী: শতবর্ষে ভয়াবহ অন্ধকারের গ্রাসে

কুন্তল রুদ্র

 



প্রাক্তন অধ্যাপক, বিশ্বভারতী; কবি, প্রাবন্ধিক, আবৃত্তিকার

 

 

 

২০২১ ছিল বিশ্বভারতীর শতবর্ষপূর্তির বৎসর। নিছক পালনের আনুষ্ঠানিকতা নয়, এই সূত্রে কোথায় এই অনন্য প্রতিষ্ঠানটি যাত্রা শুরু করেছিল এবং আজ কোথায় পৌঁছেছে সেই বিচারের সময় এখন। ১৯৫১ সালে দেশের সংসদে গৃহীত বিশ্বভারতী আইনে প্রতিষ্ঠানটিকে যে ‘Institute of National Importance’ অর্থাৎ ‘জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠানে’র মর্যাদা দানের কথা বলা হয়েছিল, সংশ্লিষ্ট সকল পক্ষ সম্ভবত সেকথা বেমালুম ভুলে বসে আছেন। কী করে একটি মিথ্যা অনন্য এক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ঘাড়ে জাঁকিয়ে বসে, রবীন্দ্রোত্তর যুগের বিশ্বভারতী তার এক আশ্চর্য উদাহরণ! দেশের রবীন্দ্রানুরাগীসমাজ, শিক্ষাবিদগণ, অধ্যাপকসমাজ এবং বিশ্বভারতীর প্রাক্তনীগণও কি জানেন যে বিশ্বভারতী আইন বা Central University Act, কোনও আইনেই বিশ্বভারতী যে একটি ‘কেন্দ্রীয় বিশ্ববিদ্যালয়’ তেমন কোনও উল্লেখ নেই! তবে কি বিশ্বভারতী্র ‘কেন্দ্রীয় বিশ্ববিদ্যালয়’ বনে যাওয়াটা নিছক অসতর্কতায় ঘটে যাওয়া কোনও ভুল, নাকি এর পিছনে সঙ্ঘবদ্ধ শক্তিশালী কোনও স্বার্থ সক্রিয় আছে? বিশ্বভারতীর গায়ে ‘Govt. of India’ ছাপ মেরে দিয়ে তার অধ্যাপক-কর্মীদের সাম্প্রতিককালে যখন কেন্দ্রীয সরকারি কর্মচারীদের সার্ভিস রুলের অধীনে নিয়ে আসার প্রয়াস চালানো হয় তখন সন্দেহ গভীরতর হয় বইকি।

অর্ধেক জীবন দিয়ে গড়া প্রতিষ্ঠানটির সম্পর্কে দেশবাসীর নেতিবাচক ভূমিকা্র সূত্রেই তাঁর অনুপস্থিতিতে বিশ্বভারতীর অস্তিত্বসঙ্কটের চিন্তা ‘বৃদ্ধ’ রবীন্দ্রনাথকে প্রবলভাবে তাড়িত করেছিল। মৈত্রেয়ী দেবীর মংপুতে রবীন্দ্রনাথ গ্রন্থে উল্লিখিত রবীন্দ্রনাথের সেই বেদনাকাতর বিহ্বলতার কথাগুলি ছিল:

জীবন সম্বন্ধে আমার আর স্পৃহা নেই। কেবল একটি কথা মনে হয় কী জানো? এই যে বিশ্বভারতী এত পরিশ্রমে গড়ে তুলেছি, আমার অবর্তমানে এর আর মূল্য কিছুই থাকবে না? এর পিছনে যে কী পরিশ্রম আছে তা তো জানো না, কী দুঃখের সে-সব দিন গেছে যখন ছোট বৌয়ের গয়না নিতে হয়েছে। চারিদিকে ঋণ বেড়ে চলেছে, ঘর থেকে খাইয়ে পরিয়ে ছেলে জোগাড় করেছি, কেউ ছেলে তো দেবেই না, গাড়ি ভাড়া করে অন্যকে বারণ করে আসবে। এইরকম সাহায্যই স্বদেশবাসীর কাছ থেকে পেয়েছি। … এত বাধা যদি দেশের লোকের কাছ থেকে না পেতুম তাহলে শুধু অর্থাভাবে এত কষ্ট পেতে হত না। সাহায্য পাইনি সে সামান্য কথা, কিন্তু বাধা! … এত কষ্ট করে যা গড়ে তুলেছি আমার অবর্তমানে যদি তার মূল্য ক্ষয় হয়, তাহলে এতদিনের এত পরিশ্রম সব ব্যর্থ হয়ে যাবে… মৃত্যু সম্বন্ধে এই একটিমাত্র বাধা আমার মনে হয়, সে আমার বিশ্বভারতী, আর কিছুই নয়।

ট্রাজেডি এখানেই, তাঁর অবর্তমানে বিশ্বভারতীর দায়িত্ববহনের ভার রবীন্দ্রনাথ সেই দেশবাসীর প্রতিনিধিস্থানীয়  নেতৃত্বের হাতেই তুলে দিতে বাধ্য হন। মানুষ রবীন্দ্রনাথের প্রতি সেই প্রতিনিধিদের শ্রদ্ধা থাকলেও দেশ, রাষ্ট্র, জাতীয়তা, স্বাধীনতা, বিশ্বমানবতা, শিক্ষা, আধুনিক জীবনবোধ এইসকল ক্ষেত্রে রবীন্দ্রনাথের থেকে তাঁরা ভিন্ন মত ও পথের অনুসারী ছিলেন। সাধারণভাবে শিক্ষার ক্ষেত্রে এবং নির্দিষ্টভাবে বিশ্বভারতীর সম্পর্কেও তাঁরা জাতীয়তার গণ্ডি অতিক্রম করার কথা কখনও ভাবেননি। অন্যথায় বিশ্বভারতী আইনে প্রতিষ্ঠানটিকে জাতীয় নয়, সাগ্রহে আন্তর্জাতিক গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠান তথা Institute of International Importance-এর মর্যাদা দিতেন। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, ১৯৫২ সালের বিশ্বভারতী সমাবর্তনে তৎকালীন উপাচার্য রথীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর ভাষণে সেইদিকেই অঙ্গুলিনির্দেশ করে বলেছিলেন— “The small school with which Gurudeva Rabindranath Tagore began his work at Santiniketan developed in about thirty years time into an international University.” রথীন্দ্রনাথের কথাটি তাৎপর্যপূর্ণ, কারণ, ১৯০১ সালে শান্তিনিকেতন বিদ্যালয়ের সূচনার দিন থেকে বিশ্বভারতীর উল্লিখিত সমাবর্তনের সময় পর্যন্ত অর্ধশতক ধরে সবচেয়ে নিবিড় এবং ধারাবাহিকভাবে পর্বে পর্বে প্রতিষ্ঠানটির গড়ে ওঠার ধারাটির সঙ্গে তিনি যুক্ত ছিলেন।

জাতিপ্রেমের নামে স্বার্থের সংঘাতে যখন প্রথম বিশ্বযুদ্ধের আগুন জ্বলছে, রবীন্দ্রনাথের মনে তখনই জন্ম নিচ্ছিল বিশ্বমানবতার মিলনকেন্দ্রের একটি ভ্রূণ। ১৯১৬-১৭ সালে জাপান ও আমেরিকায় দীর্ঘ বক্তৃতা সফরে রবীন্দ্রনাথ What is Art বা The World of Personality-এর মত শিল্প বা দর্শন বিষয়ে অল্পস্বল্প কথা বললেও তাঁর ভাবনার একেবারে কেন্দ্রে ছিল জাতীয়তাবাদ এবং যুদ্ধ ও শান্তির প্রসঙ্গ। প্রশান্তকুমার পাল তাঁর রবিজীবনী-র ৭ম খণ্ডে আমাদের জানিয়েছেন:

তাঁর The Cult of Nationalism প্রবন্ধটি প্রথম থেকেই তীব্রভাবে সমালোচিত হচ্ছিল— কিন্তু আরও কতকগুলি তুলনামূলকভাবে নিরীহ প্রবন্ধ প্রস্তুত থাকা সত্ত্বেও তিনি এই প্রবন্ধটিই বারবার বিভিন্ন শহরে পাঠ করেছেন… তার কারণ, তাঁর বলবার মতো কিছু কথা ছিল— আর ফলনিরপেক্ষভাবে তিনি তা নির্ভীকচিত্তে বলে গেছেন; অল্প হলেও কিছু লোককে তা স্পর্শও করেছে।

সফর চলাকালীন ১১ অক্টোবর ১৯১৬ লস অ্যাঞ্জেলেস থেকে পুত্র রথীকে এক চিঠিতে রবীন্দ্রনাথ লিখছিলেন নতুন এক আরম্ভের কথা:

শান্তিনিকেতন বিদ্যালয়কে বিশ্বের সঙ্গে ভারতের যোগের সূত্র করে তুলতে হবে— ওইখানে সার্ব্বজাতিক মনুষ্যত্ব চর্চ্চার কেন্দ্র স্থাপন করতে হবে— স্বাজাতিক সংকীর্ণতার যুগ শেষ হয়ে আসচে— ভবিষ্যতের জন্যে যে বিশ্বজাতিক মহামিলন যজ্ঞের প্রতিষ্ঠা হচ্চে তার প্রথম আয়োজন ঐ বোলপুরের প্রান্তরেই হবে।

অর্থাৎ, আনুষ্ঠানিকভাবে ১৯২১-এ প্রতিষ্ঠা হলেও, শান্তিনিকেতন বিদ্যালয়ের পূর্ণ মানববিকাশের ধারণাটিকে ১৯১৬ সালেই বিশ্বভারতীতে আধুনিক বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে বিশ্বজনীন মানবতার মিলনভূমিতে প্রতিস্থাপিত করতে চাইছিলেন তিনি। জঙ্গি জাতীয়তাবাদের বিপুল দ্বন্দ্ব-বিরোধ ঐতিহাসিক সেই মানবমিলনের পরিপ্রেক্ষিত রচনা করে দিয়েছিল। তাঁর সেই বোধের ব্যাপ্তি, গভীরতা ও সমগ্রতায়, চেতনার শান্ত মহানদীর ধারায় উপনিষদের সত্যপ্রকাশের অভিব্যক্তিতে মিলে গিয়েছিল আধুনিক সভ্যতাসঙ্কটের থেকে মুক্তির প্রগাঢ় আকুতি। বিশ্বভারতী প্রতিষ্ঠার দুই বছর পর ১৩৩০ বঙ্গাব্দের ১লা বৈশাখ নববর্ষের মন্দিরের ভাষণে তিনি বললেন:

… নেশনরূপের মধ্যে মানুষ আপন সত্যকে আবৃত করে ফেলেছে; মানুষের আত্মা বলছে, ‘অপাবৃণু’— আবরণ উদ্ঘাটন করো। … ভারতের এই পূর্বপ্রান্তে এই প্রান্তরশেষে যেন আজ নববর্ষের প্রভাতে ভেদবাধার তিমির-মুক্ত মানুষের রূপ আমাদের এখানে সমাগত অতিথি বন্ধু সকলের মধ্যে উজ্জ্বল করে দেখতে পাই।

১৯২০ খ্রিস্টাব্দে রবীন্দ্রনাথের দীর্ঘ ইউরোপ ও আমেরিকা সফরেও জাতিতে জাতিতে স্বার্থের বিরোধের পটভূমিতে দাঁড়িয়ে তিনি গুরুত্ব দিচ্ছিলেন দুই সভ্যতার মিলনের প্রাসঙ্গিকতাকেই। সেই মনোভাব নিয়েই তিনি অক্সফোর্ডের ছাত্রদের কাছে The Message of the Forest এবং আমস্টার্ডাম বিশ্ববিদ্যালয়ে ওই প্রবন্ধসহ The Meeting of the East and West এবং Ideal of Education প্রবন্ধ তিনটি পাঠ করেন। আর, সেই প্রসঙ্গ উল্লেখ করে বিধুশেখর শাস্ত্রীকে এক চিঠিতে লেখেন:

… বিশ্বভারতীর উদ্যোগপর্ব সমুদ্রের দুই তীরে চলছে। … এ পর্যন্ত আমাদের কাজ যতদূর অগ্রসর হয়েছে তাতে আমার মন আশায় পূর্ণ হয়ে উঠেছে। … এই সকল বক্তৃতার ভিতর দিয়ে যে সব পথ কাটা হচ্চে সমস্ত পথই শান্তিনিকেতনের অভিমুখে।

এরপর আরও একবার আমেরিকা গিয়ে সেখানে ব্রুকলিন ও হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়-সহ আর যে-সব স্থানে তিনি বক্তৃতা করেন প্রায় সর্বত্রই তার কেন্দ্রে ছিল প্রাচ্য-পাশ্চাত্য মিলনের ভাবনা। শিকাগো থেকে জগদানন্দ রায়কে লেখা পত্রে মিলনকেন্দ্রটি যে বিশ্বভারতী তার উল্লেখ করে লেখেন:

Nationalism হচ্ছে একটা ভৌগোলিক অপদেবতা, পৃথিবী সেই ভূতের উপদ্রবে কম্পান্বিত— সেই ভূত ছাড়াবার দিন এসেছে। কিছুদিন থেকে আমি তারই আয়োজন করচি। দেবতার নাম করলে তবেই অপদেবতা ভাগে। … আমাদের বিশ্বভারতীতে সেই দেবতার মন্দির গাঁথচি।

 

বিশ্বভারতী প্রতিষ্ঠার সময় রবীন্দ্রনাথের বয়স ষাট বৎসর। পরের দুটি দশক তাঁর পরিচালনায় বিশ্বভারতীর বিকাশের কাল। একেবারে সূচনায় সেখানে দুটি বিভাগ ছিল— বিদ্যালয় বিভাগ এবং বিশ্বভারতী। বিশ্বভারতীর শিক্ষাক্রম আবার দুটি স্তরে বিভক্ত ছিল— কলেজ তথা শিক্ষাভবন এবং গবেষণাকেন্দ্র হিসাবে বিদ্যাভবন। এর পর কৃষিকাজ ও হাতের কাজ শিক্ষার কেন্দ্র হিসাবে যুক্ত হয় শ্রীনিকেতনের পল্লী সংগঠন বিভাগ। সূচনায় তিনটি ক্ষেত্রে বিশ্বভারতীর পঠনপাঠন ও গবেষণা শুরু হয়েছিল— সাহিত্য, ললিতকলা এবং সঙ্গীত। প্রাচ্য এবং পাশ্চাত্যের ভাষা, সাহিত্য, ধর্ম, দর্শন, ইতিহাস, বিজ্ঞান ও শিল্প-সংস্কৃতির চর্চা, আদানপ্রদান, মিশ্রণ এবং মিলনের একটি মুক্ত ক্ষেত্র হিসাবে বিশ্বভারতীকে গড়ে তোলার কাজটি ক্রমে বহুমুখী হয়ে উঠেছিল। পালি, সংস্কৃত, হিন্দি, বাংলা, ফারসি, আরবি, ফরাসি, জার্মান, ইংরাজি, চিনা ও তিব্বতি ভাষা-সাহিত্যের চর্চা, ভারতীয় চিত্রকলার পাশাপাশি জাপানি চিত্রকলার বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে চর্চা, ভারতীয় রাগাশ্রয়ী সঙ্গীত, বাউল ও কীর্তনাঙ্গের গানের পাশাপাশি ইউরোপীয় সঙ্গীতের সুর অনুসরণে গান রচনা ও চর্চা, মণিপুরি নৃত্য, গর্বা নৃত্যের সঙ্গে শ্রীলঙ্কা, জাভা, সুমাত্রার নৃত্যরীতির থেকে গ্রহণ ও পুনর্নির্মাণ, নাটকের ক্ষেত্রে ভারতীয় নাট্যরীতির সঙ্গে ইউরোপের শেকসপিরীয় নাটক, অপেরাধর্মী নাটক, প্রতীকী নাটকের ধারায় নাট্যচর্চা— এমনই সব বিচিত্র ধারায় শিক্ষা, চর্চা এবং সৃজনের প্রবাহ চলেছিল। ইংল্যান্ড, ফ্রান্স, চেকোশ্লোভাকিয়া, সুইজারল্যান্ড-সহ ইউরোপের বিভিন্ন দেশ থেকে, আমেরিকা, চিন, জাপান এবং শ্রীলঙ্কা থেকে পণ্ডিত, শিল্পী ও বিজ্ঞানীরা এসে সেই বৃহৎ যজ্ঞে সামিল হয়েছিলেন। আর এভাবেই প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের সেই মিলনোৎসবে জাতির গণ্ডি ছাড়িয়ে উঠে বিশ্বভারতী হয়ে উঠেছিল শিক্ষা, শিল্প ও সংস্কৃতির একটি আন্তর্জাতিক চর্চাকেন্দ্র।

আবিশ্ব সেই প্রসার ও মিলন-আয়োজনের অন্য যে অভিমুখটি শ্রীনিকেতনকে কেন্দ্র করে স্ফূরিত হয়ে উঠেছিল সেটি তাঁর স্বদেশ। স্বদেশি সমাজের সামঞ্জস্যসাধনের লক্ষ্যে শুরু হয়েছিল শিক্ষা, সমবায়, স্বাস্থ্য ও কৃষিবিকাশের সূত্রে গ্রাম পুনর্গঠনের কাজ। ১৯২১ সালেই প্রতিষ্ঠা হয় শ্রীনিকেতনের। বিশ্ববিদ্যালয়কে দেশের জীবনের সঙ্গে গভীরভাবে যুক্ত করতে চেয়েই তাঁর শ্রীনিকেতন প্রয়াসের সূচনা। বিশ্বভারতী গ্রন্থের সূচনাতেই সেই প্রয়াসের অভিমুখটি স্পষ্ট করে তিনি বলেন:

সকল দেশেই শিক্ষার সঙ্গে দেশের সর্বাঙ্গীণ জীবনযাত্রার যোগ আছে। আমাদের দেশে কেবলমাত্র কেরানিগিরি ওকালতি ডাক্তারি ডেপুটিগিরি দারোগাগিরি মুন্সেফি প্রভৃতি ভদ্রসমাজে প্রচলিত কয়েকটি ব্যবসায়ের সঙ্গেই আমাদের আধুনিক শিক্ষার প্রত্যক্ষ যোগ। যেখানে চাষ হইতেছে, কলুর ঘানি ও কুমারের চাক ঘুরিতেছে, সেখানে এ শিক্ষার কোনও স্পর্শও পৌঁছায় নাই। অন্য কোনও দেশে এমন দুর্যোগ ঘটিতে দেখা যায় না। তাহার কারণ, আমাদের নূতন বিশ্ববিদ্যালয়গুলি দেশের মাটির উপরে নাই, তাহা পরগাছার মতো পরদেশীয় বনস্পতির শাখায় ঝুলিতেছে। ভারতবর্ষে যদি সত্য বিদ্যালয় স্থাপিত হয় তবে গোড়া হইতেই সে বিদ্যালয় তাহার অর্থশাস্ত্র, তাহার কৃষিতত্ত্ব, তাহার স্বাস্থ্যবিদ্যা, তাহার সমস্ত ব্যবহারিক বিজ্ঞানকে আপন প্রতিষ্ঠাস্থানের চতুর্দিকবর্তী পল্লীর মধ্যে প্রয়োগ করিয়া দেশের জীবনযাত্রার কেন্দ্রস্থল অধিকার করিবে। এই বিদ্যালয় উৎকৃষ্ট আদর্শে চাষ করিবে, গোপালন করিবে, কাপড় বুনিবে এবং নিজের আর্থিক সম্বল-লাভের জন্য সমবায়প্রণালী অবলম্বন করিয়া ছাত্র শিক্ষক ও চারিদিকের অধিবাসীদের সঙ্গে জীবিকার যোগে ঘনিষ্ঠভাবে যুক্ত হইবে।

এইরূপ আদর্শ বিদ্যালয়কে আমি ‘বিশ্বভারতী’ নাম দিবার প্রস্তাব করিয়াছি।

পল্লীউন্নয়নকে বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্মসূচি এবং শিক্ষার অঙ্গ করে নেওয়ার সিদ্ধান্ত এবং তার প্রয়োগ নিঃসন্দেহে এক যুগান্তকারী পদক্ষেপ। বিশ্বভারতীতে শিক্ষার তিনটি লক্ষ্য নির্ধারণ করেন রবীন্দ্রনাথ— ১. প্রাচ্য ও প্রতীচ্যের সমস্ত চিত্তকে সম্মিলিত ও চিত্ত-সম্পদকে সংগৃহীত করার মাধ্যমে আপনাকে বিস্তীর্ণ ও সংশ্লিষ্ট করিয়া জানা, ২. বিদ্যার উদ্ভাবন করা, এবং ৩. অধীত জ্ঞানকে সমাজের, বিশেষ করে গ্রামীণ সমাজের হিতসাধনের জন্য প্রয়োগ করা। অর্থাৎ, শিক্ষাকে সমাজের সমস্ত অংশের মধ্যে ছড়িয়ে দেওয়ার মাধ্যমে সমাজের বিভিন্ন শ্রেণির মানুষ যাতে তার সুফল লাভ করতে পারেন তার জন্য ঐকান্তিক প্রয়াস চালানো।

১৯২১ সালের ২৩ ডিসেম্বর বিশ্বভারতী পরিচালনার জন্য গঠিত তার সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারক সংস্থা ‘বিশ্বভারতী পরিষদ’ ছিল বিশ্বভারতীর সদস্যদের দ্বারা নির্বাচিত সংস্থা। ওই বছরেই রচিত হয় বিশ্বভারতীর সংবিধান। প্রধান পরিচালন সংস্থা সংসদ এবং কর্মসমিতি নির্বাচিত হত কর্মী ও অধ্যাপকমণ্ডলীর দ্বারা। কালে কালে বিশ্বভারতীর আরও অনেক বিবর্তন ঘটেছে। কলাভবনের থেকে পৃথক হয়ে স্বতন্ত্র ভবন সঙ্গীতভবন জন্ম নিয়েছে। জন্ম নিয়েছে পুঁথিশালা, দ্বিতীয় বিদ্যালয় হিসাবে শিক্ষাসত্রের জন্ম হয়েছে, গড়ে উঠেছে বিশ্বভারতী সমবায় ব্যাঙ্ক এবং শিল্পভবন। রবীন্দ্রনাথের মৃত্যুর পর তাঁর স্মারক ও সৃষ্টির সংগ্রহশালা এবং গবেষণাকেন্দ্র হিসাবে জন্ম নিয়েছে রবীন্দ্রভবন। টিচার্স ট্রেনিং কলেজ বিনয়ভবন এবং সায়েন্স ফ্যাকাল্টি শিক্ষাভবনের জন্ম ঘটেছে আরও পরে। গড়ে উঠেছে ইন্দিরা গান্ধি জাতীয় সংহতি কেন্দ্র। সাম্প্রতিক অতীতে জন্ম ঘটেছে ভাষাভবন, জাপানি বিভাগ, গণমাধ্যম বিভাগ, শরীরচর্চা বিভাগ এবং উইমেন স্টাডি সেন্টারের।

রবীন্দ্রনাথ বিশ্বভারতী গড়ে তুলেছিলেন পরাধীন ভারতবর্ষে; তখন ভারতবর্ষে সরকারি উদ্যোগে গড়ে তোলা বিশ্ববিদ্যালয়গুলি ব্রিটিশ শাসক এবং তার সহযোগীদের শাসন, ব্যবসা-বাণিজ্য এবং অন্যান্য পরিপূরক প্রশাসনিক ও অর্থনৈতিক স্বার্থ চরিতার্থ করার লক্ষ্যে কাজ করত। বর্তমান সময়ের প্রেক্ষাপটে দাঁড়িয়ে প্রশ্ন জাগে, স্বাধীন ভারতবর্ষের বিশ্ববিদ্যালয়গুলি কি দেশের সর্বস্তরের মানুষের সার্বিক বিকাশের জন্য প্রয়োজনীয় জ্ঞানের উদ্ভাবন ঘটিয়ে তার সুফল সমাজের সর্বস্তরে পৌঁছে দিচ্ছে? দেশে-দেশে জ্ঞানচর্চা এবং জ্ঞানের আদানপ্রদান কি বিশ্বমানবমিলন, পারস্পরিক সহযোগিতা ও শান্তির অভিমুখে চালিত হচ্ছে? এককথায় এর উত্তর হল— না। দেশ স্বাধীন হলেও জ্ঞান শৃঙ্খলিত হয়েই আছে। স্বাধীন ভারতবর্ষেও জ্ঞানের উদ্ভাবন-পরিকল্পনায় ‘দেশ’ নামক একটি বায়বীয় ধারণার প্রচলন থাকলেও সর্বস্তরের মানুষ, বিশেষত পশ্চাদপদ মানুষের উন্নয়নকামী উদ্ভাবন অধিকাংশ ক্ষেত্রেই অগ্রাধিকার পায় না। এর সঙ্গে যুক্ত আছে জ্ঞান উদ্ভাবন এবং নিয়ন্ত্রণে রাজনৈতিক দৃষ্টিকোণ। দেশে দেশে জ্ঞানের আদানপ্রদানও রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি বিবর্জিত নয়। ‘ভয়শূন্য চিত্ত’ বা ‘মুক্ত জ্ঞান’-এর আকাঙ্ক্ষা যতই জাগুক, স্বদেশে বিদেশে, কোথাও, কোনও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে, কোনও বিশ্ববিদ্যালয়ে শৃঙ্খলহীন প্রাচীরহীন শিক্ষা নেই। ‘মানবকল্যাণমূলক রাষ্ট্রে’র কথা বলে কোনও কোনও ক্ষেত্রে সেই শৃঙ্খলের রূপটিকে আবছা ঝাপসা করা হয়; আবার স্বৈরাচারী, সাম্রাজ্যবাদী রাষ্ট্র প্রকাশ্যে প্রাচীরগুলিকে মজবুত করে, উঁচু করে তোলে, বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণাগারে মারণাস্ত্র নিয়ে গবেষণা চালায়। আশ্চর্যের হলেও সত্যি, ‘তোতাকাহিনী’ ‘অচলায়তন’-এর লেখক রবীন্দ্রনাথ সাম্রাজ্যবাদী শিক্ষার চরিত্র অনেকটা অনুধাবন করে বিশ্বভারতীতে মানুষের পূর্ণ বিকাশের এবং এই পোড়া দেশে শিক্ষাকে পশ্চাদপদ মানুষের উন্নয়নে হাতিয়ার হিসাবে প্রথম ব্যবহারের সাহসী শুভসূচনা করেও শিক্ষার সঙ্গে শ্রেণিরাজনীতির সম্পর্কটি অনুধাবনের চেষ্টা করেননি। কৃষিশিক্ষা, হাতের কাজে ফলিত জ্ঞানের চর্চা এবং সমবায়ের যৌথতার শক্তির অভিজ্ঞতায় গ্রামীণ দরিদ্র মানুষ আত্মশক্তিতে বলীয়ান হয়ে নিজের অধিকারে স্বপ্রতিষ্ঠ হবে— এই আশাবাদের গণ্ডিতেই তাঁর বিশ্বভারতী-নিরীক্ষায় দেশজ বিকাশের দিকটি আবর্তিত হয়েছে। তবে শিক্ষাচর্চার অনুকূল স্বাধীনতা সেখানে ছিল। প্রতিষ্ঠান পরিচালনায় ছাত্রসমাজের মতামতকে গুরুত্ব দেওয়া এবং উৎসাহিত করা হত। ছাত্রশাসনতন্ত্রের চর্চা বিশ্বভারতীর জীবনে সজীবতার যে পরিমণ্ডল গড়ে তোলায় বিশেষ সহায়ক হয়েছিল, আমাদের দেশের শিক্ষাক্ষেত্রে সেও ছিল এক অভিনব নিরীক্ষার অঙ্গ। এর ফলে যৌথ দায়িত্ববোধে ছাত্রসমাজ উদ্বুদ্ধ হতে পারত। সবচেয়ে বড় কথা ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে সুপ্ত সৃজনক্ষমতার উৎসারণে রবীন্দ্রনাথ-পরিকল্পিত উৎসব-অনুষ্ঠান এবং বিশ্বভারতীর মুক্ত প্রাকৃতিক পরিমণ্ডলের বিশেষ কার্যকরী ভূমিকা ছিল।

শতবর্ষ পেরিয়ে এসে বিশ্বভারতীকে নিয়ে মূল যে প্রশ্নটি বারবার সামনে এসে দাঁড়ায় সেটি হল, প্রতিষ্ঠান হিসাবে বিশ্বভারতীর সাফল্য কতখানি? সাধারণ একটি প্রতিষ্ঠানের সাফল্যবিচারের মাপকাঠি দিয়ে এই বিচার সম্ভব নয়। রবীন্দ্রনাথ বিশ্বভারতীতে বিকল্প শিক্ষার একটি নিরীক্ষা শুরু করেছিলেন। সেই নিরীক্ষা পূর্ণতা পাওয়ার আগেই রবীন্দ্রনাথ পৃথিবী ছেড়ে চলে যান। রবীন্দ্রনাথের অপূর্ণ কাজ সম্পন্ন করার জন্য প্রয়োজন ছিল আর একজন রবীন্দ্রনাথের, অথবা এমন এক সম্মিলিত প্রয়াসের যেটি রবীন্দ্রপ্রয়াসের স্তরে পৌঁছতে সক্ষম। তেমন কোনও সার্বিক প্রয়াস গড়ে ওঠেনি। তা গড়ে ওঠা মোটেই সহজ ছিল না। তারই মধ্যে দেশ স্বাধীন হওয়ার পর সংসদে আইন পাশ করে রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে বিশ্বভারতীর দায়িত্বগ্রহণের সূত্রে তাকে ধরে নিয়ে সেই খাঁচাটির মধ্যেই পুরে দেওয়া হয়, যে খাঁচাটির বিরুদ্ধে বিদ্রোহের সূত্রে তার জন্ম ঘটেছিল। এখন সে অন্য বিশ্ববিদ্যালয়গুলির সঙ্গে একই গোত্রভুক্ত। ১৯৬১ এবং ১৯৮৪ সালে বিশ্বভারতী আইনের পরিবর্তন সূত্রে ছাত্র অধ্যাপক কর্মীদের স্বাধীনতা খর্ব হতে হতে এখন শূন্যে পৌঁছেছে। পরিচালন ব্যবস্থায় ছাত্র-কর্মী-অধ্যাপকমণ্ডলীর নির্বাচিত প্রতিনিধিত্বের কোনও সুযোগ আর অবশিষ্ট নেই। স্বাধীনতাহীনতার পরিমণ্ডলে স্বতঃস্ফূর্ত স্বাভাবিক উদ্যোগ অন্মায় না, বাড়ে না, তার পায়ে আইনের বেড়ি যারা পরিয়েছে তারা তা চায়ও না। তারা চায়, যান্ত্রিক ছকে বাঁধা-পথে চলা একটি বিশ্ববিদ্যালয়। রবীন্দ্রনাথের প্রতিষ্ঠিত ধারা থেকে বিচ্যুত করে আজকের বিশ্বভারতীকেও অনেকটাই সেইরকম এক বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্রমশ পরিণত করা হচ্ছে। বিশ্বভারতীর ঐতিহ্য ও দার্শনিক প্রত্যয় সম্পর্কে অবগত ও শ্রদ্ধাশীল মানুষের সংখ্যাও দ্রুত অবলুপ্তির পথে। স্বল্প কিছু প্রাক্তনী ও আশ্রমিক তার জন্য বেদনাহত হলেও এক মহান নিরীক্ষার এমন নিষ্ঠুর পরিণতিকে প্রতিহত করার মত সামগ্রিক বোঝাপড়া, প্রত্যয় এবং সাংগঠনিক উদ্যোগ গ্রহণের ক্ষমতা তাঁদের নেই।

যে উগ্র জাতিবিদ্বেষের বিরুদ্ধে মানবমিলনের আকাঙ্ক্ষায় বিশ্বভারতী জন্ম নিয়েছিল, সেই শক্তিই আজ ভারতবর্ষের রাষ্ট্রক্ষমতায় অধিষ্ঠিত। শিক্ষাঙ্গনকে তারা ভয়ঙ্কর ফ্যাসিস্টচেতনা বিস্তারের কেন্দ্র করে তুলতে মরিয়া চেষ্টা চালাচ্ছে। বিশ্বভারতীতে এখন গোলওয়ালকার, নাথুরাম গডসের রাজনৈতিক মত ও পথের অনুগামী উপাচার্য নতুন নিরীক্ষায় ব্যস্ত— সে নিরীক্ষা মানবতার বিকারসাধন করে শিক্ষাক্ষেত্রে গণতান্ত্রিক চেতনার আমূল উৎপাটন ঘটিয়ে অনুদার, হীন, বিদ্বেষপরায়ণ ও বর্বর এক সঙ্কীর্ণ সমাজদর্শনকে ভারতীয়ত্বের মোড়কে প্রতিষ্ঠা দেওয়ার প্রয়াসী। সেখানে ছাত্র অধ্যাপক ও কর্মীদের গণতান্ত্রিক অধিকার প্রতিদিন ধ্বস্ত হচ্ছে। প্রতিবাদী শক্তির কণ্ঠরোধ করতে কর্মী অধ্যাপকদের চাকুরির উপর এবং ছাত্রছাত্রীদের শিক্ষাজীবনের উপর অন্যায় আক্রমণ নামিয়ে আনা হচ্ছে। শতবর্ষ ধরে বহু ত্যাগ-তিতিক্ষা-অধ্যবসায়ে, শ্রদ্ধায়, প্রেমে, যৌথ উদ্যোগে গড়ে তোলা একটি স্বপ্ন, এক অনন্য সৃষ্টি, আঘাতে আঘাতে দীর্ণ-বিদীর্ণ হয়ে চলেছে প্রতিদিন। এরই মধ্যে স্বল্প কিছু ছাত্রছাত্রী হার-না-মানা প্রত্যয়ে দুর্জয় প্রতিরোধ সংগ্রামে শান্তিনিকেতনের যুদ্ধের ময়দানে এক অসম লড়াইয়ে এখনও সক্রিয়। প্রতিষ্ঠানের ভিতরে বাইরে যাঁরাই বিশ্বভারতীর প্রতি শ্রদ্ধাশীল তাঁদের সকলের সম্মিলিত হওয়ার সময় এখন। সমস্ত ইতিবাচক শক্তির সমর্থনপুষ্ট শক্তিশালী এক বৃহত্তর সামাজিক আন্দোলনই বিশ্বভারতীকে সম্পূর্ণ ধংসের হাত থেকে রক্ষা করতে পারে।

নান্য পন্থাঃ বিদ্যতে অয়নায়।

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 4648 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

Be the first to comment

আপনার মতামত...