
আশিস গুপ্ত
আজ সেই একই মিডিয়া এবং রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান— যারা এক সময় দাবি করেছিল বাগদাদে গণবিধ্বংসী অস্ত্র লুকিয়ে আছে, এবং পরে তা মিথ্যা প্রমাণিত হয়েছিল— তারা আবারও নীরব, তারা আবারও সেই সহজ প্রশ্নগুলো জিজ্ঞেস করছে না, যা সত্য উদঘাটনের জন্য অপরিহার্য। কেন ইজরায়েলকে ইরানের মতো একই মানদণ্ডে বিচার করা হচ্ছে না? কেন একটি অস্ত্রসজ্জিত রাষ্ট্র, যেটি যুদ্ধাপরাধের জন্য তদন্তাধীন, বৈশ্বিক নিরাপত্তা আলোচনায় কেন্দ্রবিন্দু নয়? কেন একটি বাস্তব অস্ত্রাগারকে উপেক্ষা করে একটি কাল্পনিক ইরানি বোমা নিয়ে উত্তেজনা তৈরি করা হচ্ছে? এই ভণ্ডামি শুধুমাত্র নৈতিক বোধকে আঘাত করে না, এটি গোটা আন্তর্জাতিক ব্যবস্থার বিশ্বাসযোগ্যতাকেই চূর্ণ করে। গ্লোবাল সাউথ এটি দেখছে, মুসলিম বিশ্ব এটি বুঝছে, ফিলিস্তিনিরা তো রক্ত দিয়ে তার মূল্য দিচ্ছে
বিশ্ব এই চিত্রনাট্য আগেও দেখেছে। একটি অস্তিত্বের হুমকির আখ্যান, মিডিয়ার এক প্রশ্নহীন কোরাস, রাজনীতিবিদদের যুদ্ধের দামামা, আগ্রাসনের পক্ষে নিরাপত্তার অজুহাত নির্মাণ— সব মিলিয়ে এক পুরনো ও অশুভ নাট্যগাথার পুনরাবৃত্তি। তখন ছিল ইরাক, এখন ইরান। তবুও, এই বর্ণনার পেছনে একটি মৌলিক সত্য নীরব রয়ে যায়: মধ্যপ্রাচ্যের একমাত্র পারমাণবিক শক্তিধর রাষ্ট্র ইজরায়েল, এবং এর অস্ত্রভাণ্ডারের জন্য তাকে কেউ জবাবদিহি করাচ্ছে না।
ইরান পারমাণবিক অস্ত্র বিস্তার রোধ চুক্তির (এনপিটি) স্বাক্ষরকারী রাষ্ট্র, আন্তর্জাতিক আণবিক শক্তি সংস্থা (আইএইএ)-কে পরিদর্শনের অধিকার দিয়েছে, বছরের পর বছর কঠোর নজরদারির মধ্যে থেকেছে, এবং সামান্য সন্দেহেই নিষেধাজ্ঞার মুখোমুখি হয়েছে। বিপরীতে, ইজরায়েল কখনওই এনপিটি-তে স্বাক্ষর করেনি, কখনোই আইএইএ-কে তার গোপন পারমাণবিক স্থাপনায় প্রবেশাধিকার দেয়নি, এবং তবুও, ব্যাপকভাবে বিশ্বাস করা হয় যে তার কাছে ৯০টিরও বেশি পারমাণবিক ওয়ারহেড রয়েছে। এই অস্বচ্ছতা শুধু অস্ত্রের সংখ্যা নয়, বরং একটি আন্তর্জাতিক কূটনৈতিক ছাড়পত্রের প্রতীক। এবং এটি ঘটছে এমন এক সময়ে, যখন ইজরায়েলের নেতারা গাজায় গণহত্যার জন্য আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতের (আইসিসি) তদন্তের মুখোমুখি।
গাজা আজ ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে। হাজার হাজার প্রাণ গেছে, শিশুদের দেহ ছিন্নভিন্ন হয়েছে, পরিবারগুলি ধ্বংসস্তূপের নিচে জীবন্ত কবরস্থ হয়েছে। একটি জাতিকে গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়েছে এক সহিংস রাষ্ট্রের হাতে, যে রাষ্ট্র আবার পারমাণবিক অস্ত্রে সজ্জিত এবং তার নিজের দায়িত্বহীন কর্মকাণ্ডের জন্য আন্তর্জাতিক পরিসরে পুরোপুরি অব্যাহতির সুবিধাভোগী। এই নির্মম বাস্তবতা আমাদের জানিয়ে দেয়— আন্তর্জাতিক আইন কেবল ক্ষমতাহীনদের জন্যই প্রযোজ্য। কিছু রাষ্ট্র আছে যাদের জন্য ভিন্ন নিয়ম চলে, যাদের উপরে আন্তর্জাতিক শৃঙ্খলা কার্যকর হয় না, কারণ তাদের পেছনে আছে ভূ-রাজনৈতিক ক্ষমতার সমর্থন, অস্ত্র সরবরাহকারীদের নীরব সম্মতি, এবং পশ্চিমি মিডিয়া ও রাজনীতির ছায়া। এই ব্যবস্থার মধ্যে এমন এক দ্বৈত নীতি কাজ করে, যা শুধু অমানবিকই নয়, ভবিষ্যতের জন্য বিপজ্জনক এক দৃষ্টান্তও বটে।
আজ সেই একই মিডিয়া এবং রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান— যারা এক সময় দাবি করেছিল বাগদাদে গণবিধ্বংসী অস্ত্র লুকিয়ে আছে, এবং পরে তা মিথ্যা প্রমাণিত হয়েছিল— তারা আবারও নীরব, তারা আবারও সেই সহজ প্রশ্নগুলো জিজ্ঞেস করছে না, যা সত্য উদঘাটনের জন্য অপরিহার্য। কেন ইজরায়েলকে ইরানের মতো একই মানদণ্ডে বিচার করা হচ্ছে না? কেন একটি অস্ত্রসজ্জিত রাষ্ট্র, যেটি যুদ্ধাপরাধের জন্য তদন্তাধীন, বৈশ্বিক নিরাপত্তা আলোচনায় কেন্দ্রবিন্দু নয়? কেন একটি বাস্তব অস্ত্রাগারকে উপেক্ষা করে একটি কাল্পনিক ইরানি বোমা নিয়ে উত্তেজনা তৈরি করা হচ্ছে?
এই ভণ্ডামি শুধুমাত্র নৈতিক বোধকে আঘাত করে না, এটি গোটা আন্তর্জাতিক ব্যবস্থার বিশ্বাসযোগ্যতাকেই চূর্ণ করে। গ্লোবাল সাউথ এটি দেখছে, মুসলিম বিশ্ব এটি বুঝছে, ফিলিস্তিনিরা তো রক্ত দিয়ে তার মূল্য দিচ্ছে। এমনকি পশ্চিমি দেশের জনগণও এখন ক্রমশ সচেতন হচ্ছে এই দ্বৈত মানদণ্ডের, যা যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্রদের নৈতিক কর্তৃত্বকে ক্ষয় করে দিচ্ছে। এটি ইরানকে রক্ষা করার প্রশ্ন নয়। এটি আন্তর্জাতিক শৃঙ্খলা ও ন্যায়বিচারের ধারাবাহিক ক্ষয়ের প্রশ্ন। যদি বিশ্বের নেতৃত্ব সত্যিই পারমাণবিক অস্ত্রবিস্তার রোধে আন্তরিক হয়, তাহলে সেই নীতির প্রয়োগে পক্ষপাত থাকার সুযোগ নেই। যারা স্বচ্ছতা প্রত্যাখ্যান করে, যারা আঞ্চলিক সংঘাতকে উস্কে দেয়, যারা যুদ্ধাপরাধে লিপ্ত— তাদেরও একইভাবে জবাবদিহির আওতায় আনতে হবে।
যদি ইজরায়েলকে এই ‘ছাড়পত্র’ দেওয়া চলতেই থাকে, তবে এনপিটি একটি ফাঁপা নথিতে পরিণত হবে, আইএইএ রূপান্তরিত হবে একটি দাঁতহীন প্রতিষ্ঠানে, এবং ভবিষ্যতের প্রতিটি “রেড লাইন” হয়ে উঠবে ভণ্ডামির একেকটি স্তর। আমরা আরেকটি যুদ্ধের দিকে ঠেলে দিচ্ছি বিশ্বকে, একই পুরনো অজুহাত, একই পুরনো মিথ্যা দিয়ে। ইরাক যুদ্ধের সেই বিপর্যয়কর চিত্রনাট্য বহু আগেই বাতিল হওয়া উচিত ছিল। কিন্তু যদি তা আবারও মঞ্চে আনা হয়, আমাদেরও প্রস্তুত থাকতে হবে তার বিরুদ্ধে সম্মিলিত প্রতিরোধ গড়ে তুলতে।
ইজরায়েলের পারমাণবিক অস্ত্রোপচারের বিরুদ্ধে প্রশ্ন তোলা ‘উগ্রতা’ নয়, বরং এটি নৈতিক স্পষ্টতা। এই প্রশ্ন তোলা এতটাই বিরল হয়ে উঠেছে যে নীরবতা আজ নিয়ম হয়ে দাঁড়িয়েছে। মিডিয়া ও রাজনীতি সেই অসম্ভবকে ঘুরিয়ে দেখানোর চেষ্টা করছে, যা পরিণামে আত্মঘাতী।
এবার কোনও হঠাৎ কেয়ামতের মঞ্চ প্রস্তুত ছিল না। ছিল না কোনও ২০০৩ সালের মতো “৪৫ মিনিটে ইউরোপে আঘাত হানতে সক্ষম”-জাতীয় ভুয়ো তথ্য। বরং, যখন ইজরায়েল ইরানে এই অপ্ররোচিত হামলা চালায়, তখন তেহরান যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে তার পারমাণবিক কর্মসূচি নিয়ে আলোচনায় ছিল। এমনকি তখনও ট্রাম্প প্রশাসন, সিআইএ-র স্পষ্ট মূল্যায়ন অগ্রাহ্য করে, ইরানের বিরুদ্ধে যুদ্ধের প্রস্তুতি নিতে থাকে। আরেকটি নুরেমবার্গ-নিষিদ্ধ ‘আগ্রাসী যুদ্ধ’ শুরু করার জন্য মাঠ প্রস্তুত হতে থাকে।
এই যে যুদ্ধ-উন্মত্ততা, তার পেছনে আছে বহু বছরের পূর্বপরিকল্পনা। ২০১৫ সালে ওবামার মধ্যস্থতায় সম্পাদিত পারমাণবিক চুক্তি, যেটি ইরানের ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধিকরণ কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ করেছিল, ট্রাম্প তা ছিঁড়ে ফেলেছিলেন কট্টর ইজরায়েলি চাপে। এরপর সেই আলোচনার ফাঁকে হামলা চালানো, সেই পুরনো ভয় দেখানো কৌশল, সবই ছিল এক বৃহৎ পরিকল্পনার অংশ— মধ্যপ্রাচ্যে ইজরায়েলকে একমাত্র পারমাণবিক শক্তিধর দেশ হিসেবে বজায় রাখা।
ইজরায়েলি পারমাণবিক অস্ত্রনীতি, যার নাম ‘অস্পষ্টতা’, আসলে এক জৈবিক মিথ্যাচার। মার্কিন আইন অনুযায়ী, কোনও অঘোষিত পারমাণবিক রাষ্ট্রকে সামরিক সহায়তা দেওয়া নিষিদ্ধ। কিন্তু ইজরায়েল সেই সহায়তার সবচেয়ে বড় প্রাপক। পশ্চিম এই অন্ধকারে থাকার ভান করে গেছে, কারণ তা তাদের কৌশলগত স্বার্থে অনুকূল।
ইরান যদি একদিন একটি অস্ত্র তৈরি করেও ফেলে, তখনও তা ব্যবহার করার ঝুঁকি নিতে তারা কখনওই রাজি হবে না— এই সত্য পশ্চিম জানে। কিন্তু আসল উদ্বেগ ভিন্ন: যদি ইরানও পারমাণবিক অস্ত্রে সজ্জিত হয়, তাহলে ইজরায়েলের একচ্ছত্র ক্ষমতা খর্ব হবে। এবং মধ্যপ্রাচ্যে পশ্চিমি সামরিক আধিপত্যে টান পড়বে। এই কারণেই, বোমার অস্তিত্ব নয়, বরং ইজরায়েলের একচেটিয়া পারমাণবিক আধিপত্যই রক্ষা করার মূল লক্ষ্য।
যখন ইজরায়েলের নিরাপত্তামন্ত্রী ইঙ্গিত করেন— “হিরোশিমা ও নাগাসাকি মনে রাখুন”— তখন তা কেবল একটি যুদ্ধ-বাজ হুমকি নয়, বরং এটি এক নিঃসন্দেহে অমানবিক বার্তা। ফিলিস্তিনের মতো দুর্বল জনগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে যে রাষ্ট্র পারমাণবিক অস্ত্রে সজ্জিত হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে, তাকে আর ‘রক্ষাকারী’ বলা যায় না, তাকে বলতেই হয়— আগ্রাসী।
আন্তর্জাতিক আইনের মৌলিক নীতিগুলোর উপর এই ধারাবাহিক আঘাত আজ ন্যায়বিচারের ভবিষ্যৎকে প্রশ্নের মুখে ফেলেছে। ইরান হয়তো ‘একদিন’ হুমকি হয়ে উঠতে পারে— এই কল্পনাপ্রসূত যুক্তি দিয়ে যে আগ্রাসনকে বৈধতা দেওয়া হচ্ছে, সেটি আসলে আইনের পরিপন্থী একটি মতাদর্শ: যে শক্তিশালী, সে যা খুশি করতে পারে।
এই মুহূর্তে, কোনও মানবিক বিবেকসম্পন্ন মানুষ নিরপেক্ষভাবে যদি এই পরিস্থিতি বিশ্লেষণ করেন, তবে তাঁর কণ্ঠে একটি কথাই উচ্চারিত হওয়া উচিত— ইজরায়েলকে তার যুদ্ধাপরাধ ও তার অঘোষিত পারমাণবিক অস্ত্রাগারের জন্য জবাবদিহি করতে হবে। না হলে, বৈশ্বিক নিরাপত্তা, আন্তর্জাতিক আইন এবং মানবতার পক্ষে দাঁড়ানোর সব নৈতিক ভিত্তিই ধসে পড়বে।