আমেদাবাদের বিমান দুর্ঘটনা— কয়েকটি এলোমেলো ভাবনা

প্রবীর মুখোপাধ্যায়

 


দুর্ঘটনা কেউই যদি রুখে দিতে না পারে, যা ঘটবার তা যদি ঘটতেই দেওয়া হয়, তাহলে প্রশাসন-সরকার-মন্ত্রী-আমলা এসবের কী দরকার? যাঁর কর্ম তিনিই করতে থাকুন, আমরা কেন নিমিত্তের ভাগী হতে যাই? নিরাপত্তাবিধি, সেই সব বিধি ঠিকমত পালন করা হচ্ছে কি না দেখার জন্য নানা স্তরের তত্ত্বাবধায়ক, এসব রাখার কী প্রয়োজন? জবাব আছে কি মাননীয় অমিত শাহ মহাশয়ের কাছে?

 

“রাখে হরি মারে কে?” যেমন শুনি তেমনই শুনি “মারে হরি রাখে কে?” সেই কারণে দেশের সম্মানিত মহান স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ যখন বলেন যে দুর্ঘটনা তো এড়ানো যায় না তখন আদৌ বিস্মিত হই না। ভুলে যাই স্কুলে পড়েছিলাম হাক্সলির বিখ্যাত সেই কথা যে আচম্বিত কোনও ঘটনা বা দুর্ঘটনার অপর নাম অজ্ঞতা [“Chances and accidents are aliases of ignorance.”]। দুর্ঘটনা সংক্রান্ত অজ্ঞতা দূর করে ওই ধরনের দুর্ঘটনা যেন প্রতিরোধ করা যায় বা এড়ানো যায় সেই কারণেই বিস্তারিত তদন্ত করা হয়। এক সময়ে কলকাতার রাস্তায় বিরাট বিরাট বিজ্ঞাপন থাকত— “Always alert accidents avert”। এখন দিন পালটে গেছে, আজকে আর ‘অ্যালার্ট’ থাকার দরকার নেই, আর থাকলেই বা কী হবে, সবই ভাগ্যের হাতে, যা হওয়ার তা হবেই, তুমি কে হে যে ভবিতব্যকে আটকে দেবে?

সত্যিই অনেক পথ আমরা পেরিয়ে এসেছি।

ভেবে দেখুন তো আমেদাবাদে যে বিমান দুর্ঘটনা ঘটল সেটা কি ঘটত যদি জওহরলাল নেহরু টাটা এয়ারলাইন্স-কে জাতীয়করণ করে এয়ার ইন্ডিয়া শুরু না করতেন? এয়ার ইন্ডিয়া না থাকলে এই দুর্ঘটনা ঘটার প্রশ্নই থাকত না। ইতিহাস থেকে এই শিক্ষা নিয়েই আমরা এয়ার ইন্ডিয়া-কে আপাতত বেসরকারিকরণ করে দিয়েছি, আর একটু বেশি ক্ষমতা থাকলে তুলেই দিতাম। আসলে ভারতে সব দুর্ঘটনার পিছনে ওই এক ব্যক্তি জওহরলাল নেহরু-র ভূমিকা খুঁজে পাবেন।

এই কথা যে কেন বলছি সেটা একটু ভেবে দেখুন। আকস্মিক ঘটনা বা দুর্ঘটনা বরাবরই ঘটে থাকে। কিন্তু এই প্রসঙ্গে নেহরুজি কী বলেছেন একটু খুঁজে দেখা যাক। ১৪ আগস্ট ১৯৪৭-এ স্বাধীনতার পূর্বমুহূর্তে প্রদত্ত ভাষণে নেহেরুজি বলছেন “বলা হয় শান্তি অবিভাজ্য, তেমনই স্বাধীনতাও অবিভাজ্য, বর্তমানে সমৃদ্ধি-ও। একইরকমভাবে এই সন্নিবিষ্ট পৃথিবীতে ঘটে যাওয়া কোনও দুর্বিপাককে পরস্পর-বিচ্ছিন্ন টুকরো ঘটনা বলে আর দেখা যাবে না।” [“Peace is said to be indivisible, so is freedom, so is prosperity now, and also is disaster in this one world that can no longer be split into isolated fragments.”]

দেশ পুনর্গঠনের প্রয়াস শুরুর সময়ে অনেকগুলি বিপর্যয় পরপর ঘটে গিয়েছিল। সেই প্রেক্ষিতে ১৯৫০ সালের ১ সেপ্টেম্বর তারিখে জওহরলাল দেশের বিভিন্ন রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীদের একটি চিঠি লিখেছিলেন। নিদারুণ মানসিক যন্ত্রণা নিয়ে লেখা সেই চিঠিতে নেহরু স্বীকার করছেন “… যা নিয়ে গর্ব করা যায় না এমন এক নতুন রেকর্ড ভারত সৃষ্টি করেছে। আর এই রেকর্ড হচ্ছে একের পর এক দ্রুত ঘটে যাওয়া বিপর্যয় আর আকস্মিক দুর্ঘটনার। এক বিরাট সংখ্যক মানুষের কাছে নিয়ে এসেছে দুঃখ আর দুর্দশা।” মানসিক যন্ত্রণা নিয়ে নেহরু লিখে চলেছেন “লক্ষ লক্ষ মানুষের ওপর ঘটে যাওয়া দুর্দশার পূর্ণ পরিণাম যে কতটা তা আমাদের এখনও জানা নেই।” এই ধরনের দুর্বিপাক মানুষ, সমাজ আর গোটা দেশের ওপর যখন নেমে আসে আর অভূতপূর্ব দুর্দশার সৃষ্টি করে তখন  আমাদের কী করা উচিত সেটা উপলব্ধি করার, কেন্দ্রীয় সরকারের প্রধান হিসাবে রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীদের সঙ্গে যোগাযোগ করে পরিস্থিতি মোকাবিলার প্রচেষ্টা নেহরু করছিলেন।

আর এখন কী হচ্ছে? এতদিন কেটে গেল অথচ প্লেন দুর্ঘটনায় কতজন মারা গেছেন আর আহত হয়েছেন তার সঠিক সংখ্যা আজ অবধি সরকার প্রকাশ করেনি। দুর্ঘটনাস্থল পরিদর্শনে এসে অমিত শাহ মহাশয় আমাদের মনে করিয়ে দেন যে “দুর্ঘটনা রুখে দিতে কোনও ব্যক্তিই পারে না।” আর মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ব্যস্ত থাকেন প্লেনের ধ্বংসাবশেষের নীচে দাঁড়িয়ে নিজের ছবি তোলাতে।

দুর্ঘটনা কেউই যদি রুখে দিতে না পারে, যা ঘটবার তা যদি ঘটতেই দেওয়া হয়, তাহলে প্রশাসন-সরকার-মন্ত্রী-আমলা এসবের কী দরকার? যাঁর কর্ম তিনিই করতে থাকুন, আমরা কেন নিমিত্তের ভাগী হতে যাই? নিরাপত্তাবিধি, সেই সব বিধি ঠিকমত পালন করা হচ্ছে কি না দেখার জন্য নানা স্তরের তত্ত্বাবধায়ক, এসব রাখার কী প্রয়োজন? জবাব আছে কি মাননীয় অমিত শাহ মহাশয়ের কাছে?

অবশ্য কোনও প্রশ্নেরই জবাব বর্তমান প্রশাসকেরা দিতে অভ্যস্ত নন। শুধু এই বিমান দুর্ঘটনা নয়, সাম্প্রতিক কোনও ঘটনার জবাব এরা দিয়েছেন কী ভেবে দেখুন। চার-পাঁচজন সন্ত্রাসবাদী পহেলগাঁও-তে এসে ঠান্ডা মাথায় দু-ঘন্টা ধরে হত্যালীলা চালিয়ে আবার নিজেদের জায়গায় ফিরে গেল বিনা বাধায়। আজ অবধি আমরা জানতে পারিনি কারা এই সন্ত্রাসবাদী, কোথা থেকে কোন পথ দিয়ে এরা এল আর চলে গেল, জম্মু-কাশ্মিরে এত পুলিশ-মিলিটারি থাকা সত্ত্বেও এরা কেন কোনও বাধা পেল না। এটাও কী ধরে নেব ‘ভগবানের হাত’, আর সেই কারণে অপ্রতিরোধ্য? দেশে একের পর এক ঘটে যাওয়া সাম্প্রতিক রেল দুর্ঘটনার কথা স্মরণ করুন। কুম্ভমেলায় আর নয়াদিল্লি রেলস্টেশনে পদপিষ্ট হয়ে মারা যাওয়ার ঘটনা। আরও আগে যদি যাই তাহলে মনে পড়বে ২০১৯ সালে পুলওয়ামায় ঘটে যাওয়া বিরাট বিস্ফোরণে ৪০ জন সিআরপিএফ জওয়ানের মৃত্যুর ঘটনা। এগুলি-ও কি ‘ভগবানের হাত’ দিয়েই ঘটে? আর সে-কারণে আমরা কিছুতেই এগুলি প্রতিরোধ করতে পারব না!

কিন্তু নেহরু-র ভাবনা ছিল অন্যরকম। মুখ্যমন্ত্রীদের উদ্দেশ্য করে নেহরুর লেখা যে চিঠির কথা আগে উল্লেখ করা হয়েছে সেই চিঠিতেই তিনি লিখছেন যে আচম্বিত দুর্ঘটনা দেখে ‘হতচকিত’ হয়ে কোনও লাভ নেই। বরং এই সব ঘটনাকে আমাদের জাতিসত্তা, আমাদের সাহস আর কাজ করার ক্ষমতার প্রতি একটা চ্যালেঞ্জ হিসেবে দেখতে হবে। হাত-পা গুটিয়ে ভবিতব্যের হাতে তুলে না দিয়ে দুর্ঘটনাকে জাতিসত্তার প্রতি চ্যালেঞ্জ হিসেবে নিয়ে তার যথোচিত প্রতিরোধ আর প্রতিকারের ব্যবস্থা করতে হবে— আর এখানেই নেহরুর রাজনৈতিক বিচক্ষণতা।

কোন পথে যে আছি আর কোন পথে যে যাব সে সিদ্ধান্ত আমাদের নিজেদেরই নিতে হবে।

 

২০ জুন ২০২৫


*Thewire.in এ ১৫ জুন ২০২৫ প্রকাশিত S N Sahu লিখিত Nehru’s Words on Disasters and the Modi Govt’s Lack of Accountability After the Ahmedabad Plane Crash প্রবন্ধ থেকে অনেক তথ্য এই লেখাটিতে গ্রহণ করা হয়েছে।

 

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 5094 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

Be the first to comment

আপনার মতামত...