প্রদীপ দত্ত
সেদিন নারোদা পাটিয়ায় ৯৬ জনকে জ্যান্ত পোড়ানো হয়েছিল। ২০১২ সালে বিশেষ আদালত ওই মামলায় মায়া কোদনানি, বাবু বজরঙ্গি-সহ মোট ৩২ জনকে অভিযুক্ত করে। বজরঙ্গি জানিয়েছিল, সবকিছুর পিছনেই নরেন্দ্র মোদির হাত ছিল। না হলে, তিনি যদি নির্দেশ দিতেন, পুলিশ দাঙ্গাকারীদের ছিন্নভিন্ন করে ফেলতে পারত
পূর্ব-প্রসঙ্গ: গুলবার্গ সোসাইটি হত্যাকাণ্ড
‘তহেলকা’ পত্রিকার সাংবাদিক আশিস খেতানের ‘আন্ডারকভার: মাই জার্নি ইন্টু দ্য ডার্কনেস অফ হিন্দুত্ব’ প্রকাশিত হয় ২০২১ সালের জানুয়ারি মাসে। ২০০২ সালের গুজরাত হিংসা নিয়ে তাঁর তদন্ত নিয়েই বইটি লেখা হয়েছিল। তিনি চার বছরে তিন দফায় সেখানে গিয়েছিলেন। শেষবার, ২০০৭ সালে ছ-মাস ছিলেন। এক কুৎসিত ঘৃণাময় জগতে চায়ের কাপ হাতে অপরাধীরা খুন-ধর্ষণের গল্প বলেছেন। আশিসের সেই রিপোর্টে তাদের কথার বিবরণ যখন ‘তহেলকা’য় প্রকাশিত হয়, গোটা দেশ কেঁপে গিয়েছিল। সাংবাদিকের শার্টের বোতামে লাগানো ছোট্ট ক্যামেরাটি কথাবার্তা রেকর্ড করা ছাড়া ভিডিও ছবিও তুলেছে। যাদের সঙ্গে তিনি কথা বলেছেন তারা বলেছে, এই দাঙ্গা রাজ্য সরকারের সমর্থন ছাড়া হতেই পারত না। বইটিতে বজরং দলের নেতা বাবু বজরঙ্গির সাক্ষাৎকার রয়েছে। খেতানের তদন্তের ফলে বাবু বজরঙ্গি, মায়া কোদনানি এবং দাঙ্গার অন্যান্য সহযোগীরা সে-সময়ে কী ভূমিকায় ছিল তার প্রত্যক্ষ বিবরণ রয়েছে। ওদিকে বেস্ট বেকারি মামলায় আশিস তাঁর স্টিং অপারেশনের মাধ্যমে প্রমাণ করেন যে সাক্ষী জাহিরা শেখকে ঘুষ দিয়ে হোস্টাইল বা বিরূপ করা হয়েছিল।
বাবু বজরঙ্গি ছিল মুসলমান অধ্যুষিত নারোদা পাটিয়া আক্রমণকারীদের নেতা, যেখানে ৯৬ জনকে খুন করা হয়েছিল। আশিস লুকানো ক্যামেরা নিয়ে ২০০৪ থেকে ২০০৭ সালের মধ্যে তার সঙ্গে কয়েকবার দেখা করেন। বজরঙ্গি গর্বিতভাবে গণহত্যায় নিজের ভূমিকার কথা তাঁকে বলে, পুলিশ ও মুখ্যমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির ভূমিকার কথাও বলে।
২০০৭ সালের ১০ আগস্ট আশিসের সঙ্গে বজরঙ্গির দ্বিতীয়বার সাক্ষাৎ হয়। সে বলে, গোধরা থেকে ফিরে সে প্রকাশ্যে ঘোষণা করেছিল যে ট্রেনে হিন্দুহত্যার প্রতিশোধ নেবে। দাঙ্গাকারীদের জন্য সে ২৩টি রিভালভার জোগাড় করে। হত্যাকাণ্ডের সময় পুলিশকে বলেছিল, যা হচ্ছে চুপচাপ দাঁড়িয়ে থেকে তা হতে দিন।
আশিস বজরঙ্গিকে জিজ্ঞেস করেন, নারোদা পাটিয়া হিংসায় কি নরেন্দ্রভাইয়ের সমর্থন ছিল? বজরঙ্গি বলে, সবকিছুর পিছনে তাঁরই হাত ছিল। না হলে, তিনি যদি নির্দেশ দিতেন, পুলিশ দাঙ্গাকারীদের ছিন্নভিন্ন করে ফেলত।
হত্যাকাণ্ডের শেষে পুলিশ তাকে এলাকা ছেড়ে চলে যেতে বলে। গুজরাতের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীও (গোর্ধন জাডাফিয়া) তাকে আত্মগোপন করতে বলেন। তিন মাস সে আত্মগোপন করে ছিল। তার মতে, নরেন্দ্র মোদি তাকে গ্রেফতার করার জন্য অসম্ভব চাপের মধ্যে ছিলেন। তাই গ্রেফতার করার নাটক তৈরি করা হয়। জয়েন্ট পুলিশ কমিশনার (ক্রাইম) পিপি পান্ডে নাটকটি তৈরি করেছিলেন। তাকে গ্রেফতারের জন্য ১২-১৩টা গাড়ি এল… আগে থেকেই সব ঠিক করা ছিল। একটা নির্দিষ্ট সময়ে আমি নির্দিষ্ট রাস্তা দিয়ে যাব, পুলিশ আমায় গ্রেফতার করবে। গ্রেফতার করে পুলিশ হাতকড়া পরাল, সবটাই নাটক।
বজরঙ্গি বলে, আত্মগোপন করা অবস্থায় সে মোদির সঙ্গে কয়েকবার ফোনে কথা বলেছে। তবে সংবাদমাধ্যমের ভয়ে প্রকাশ্যে দেখা করতে পারত না। মোদিকে সে এতটাই শ্রদ্ধা করে যে, তিনি যদি তাকে সুইসাইড বম্বার হয়ে মানুষ মারতে বলেন, চোখের পলক ফেলার আগে সে তা মেনে নেবে। মোদির প্রশংসা করে বলে, ‘মরদ আদমি হ্যায় নরেন্দ্রভাই।’ এরপর এক সেবককে ডেকে সেই সময়ে তারা যে ৮ জন মহিলাকে উদ্ধার করেছিল তাদের নিয়ে আসতে বলে। তারা এলে অস্বস্তিতে পড়া অধোবদন ওই মহিলারা যে মুসলমান পুরুষদের সঙ্গে পালিয়ে গিয়েছিলেন তাদের সম্বোধন করে বজরঙ্গি কিছু কড়া কথা বলে।
এই সময়ে আশিসের বুকে লাগানো ক্যামেরার তাপমাত্রা বেড়ে অস্বস্তি শুরু হয়। তিনি বাথরুমে গিয়ে ক্যামেরার ব্যাটারি ও মেমরি কার্ড বদলে, ক্যামেরা ফের চালু করে ঘরে আসেন। এরপর গুজরাতি থালি নিয়ে দুপুরের খাওয়ার সময় বজরঙ্গি তাঁকে নারোদা পাটিয়া হত্যাকাণ্ডে জড়িত কয়েকজনের সঙ্গে আলাপ করায়।
আশিস বজরঙ্গির সঙ্গে তৃতীয়বার দেখা করেন ১৮ অগস্ট, ২০০৭ সালে। তিনি বলেন, নরেন্দ্র মোদি এসেছিলেন, তবে পাটিয়ার ভিতরে আসেননি। সেদিন (হত্যাকাণ্ডের দিন) যা ঘটছিল তার উপর ছিল মোদির কড়া নিয়ন্ত্রণ। পুলিশ যে কিছু করেনি তা নরেন্দ্রভাইয়ের জন্যই… নইলে আপনি ভাবতে পারবেন না যে কত পুলিশ সেখানে উপস্থিত ছিল। তারা যদি চাইত আমাদের মেরে ফেলতে পারত।
—তার মানে আপনারা পুলিশের সাহায্য নিয়েছিলেন?
সে-কথার উত্তর না দিয়ে আশিসের বোঝার সুবিধার জন্য ম্যাপ এঁকে বজরঙ্গি বলে, আমরা এখান দিয়ে ঢুকেছি, ওদের তাড়া করে এই খোলা মাঠে নিয়ে গিয়ে ধরেছি, বলে সে হেসে উঠে।
আশিস বজরঙ্গির সঙ্গে আরেকবার দেখা করে নারোদা পাটিয়া হত্যাকাণ্ডে আরও সুনির্দিষ্ট করে তাঁর ভূমিকার কথা জানতে চেয়েছিলেন। বজরঙ্গি বলে, দিল্লিতে তার কিছু কাজ রয়েছে এবং আনন্দজির[1] সঙ্গেও সে দেখা করতে চায়। কাজেই তরুণ তেজপালের[2] কাকা আরেকবার ‘আনন্দজি’ সাজলেন। ঘরের দেওয়ালে গোলওয়ালকর, হেডগেওয়ার, সাভারকারের মতো হিন্দুত্ববাদী নেতাদের বড় বড় ফ্রেমে বাঁধানো ছবি টাঙানো হল। বাড়ির ঠিকানা না দিয়ে বজরঙ্গিকে ক্যাবে তুলে নিয়ে আশিস সেই বাড়িতে এলেন।
আশিস জিজ্ঞেস করেন, মুসলমানদের কুপিয়ে মেরেছিলেন?
—কুপিয়েছি, পুড়িয়েছি, আগুন লাগিয়েছি, অনেক কিছু করেছি। আমরা ভেবেছিলাম ওদের আগুনেই পোড়াব, কারণ বেজন্মারা পুড়ে মরতে চাইত না, ভয় পেত। বলত, পুড়ে মরলে এটা-ওটা হয়। বলত, আমার একটাই শেষ ইচ্ছা, মেরে ফেলুন, তবে পোড়াবেন না।
—আপনার বিরুদ্ধে কজন সাক্ষী দিয়েছে?
—১৪ জন মুসলমান আর ১৬ জন পুলিশ। ওই ১৪ জন মুসলমানের মধ্যে কয়েকজন পাটিয়া ছেড়ে জুহাপুরায় চলে গেছে। আমাদের অগ্রাহ্য করে পাটিয়ায় থাকার সাহস তাদের নেই। বাকিরা কর্নাটকে চলে গেছে।
—তার মানে যেভাবে হত্যা করেছেন, ইতিহাস হয়ে থাকবে।
—এফআইআর-এ লেখা আছে, আমি এক গর্ভবতী মহিলার পেট কেটে ফেলেছিলাম, বেহেনচোদ শালা। ওদের দেখিয়ে দিয়েছি কত ধানে কত চাল, আমাদের লোকদের মারা হলে কী ধরনের প্রতিশোধ নিতে পারি। আমরা ভাত খাওয়া দুর্বল লোক নই। আজও বলব, ওদের সন্তান জন্ম দিতে দেওয়া উচিত নয়। মহিলা, বাচ্চা যেই হোক, তাদের সঙ্গে অন্য কিছু নয়, কেটে ফেলা দরকার। মার, কেটে ফেল, বেজম্মাদের পুড়িয়ে মার। অনেকে [হিন্দুরা] লুটপাট করে সময় নষ্ট করেছে। আরে, ওদের বাঁচিয়ে রাখিস না, তারপরে তো তাদের সবকিছুই আমাদের! সেদিন যা হয়েছে, যেন ভারত আর পাকিস্তানের মধ্যে হয়েছে। চারিদিকে মৃতদেহ পড়ে রয়েছে, দেখবার মতো দৃশ্য। মনে হচ্ছিল আমি যেন রানাপ্রতাপ, মহারানা প্রতাপের মতোই কিছু করেছি।
বজরঙ্গি ফের বলে, মোদির অনুমোদন ছাড়া নারোদা পাটিয়ার হত্যাকাণ্ড এবং অন্যান্য জায়গায় তার প্রসার সম্ভব ছিল না।
গুজরাতে নরেন্দ্রভাই যা করেছেন কেউ তা পারবে না। যদি নরেন্দ্রভাইয়ের সমর্থন না থাকত, আমরা গোধরার প্রতিশোধ নিতে পারতাম না। কারণ, পুলিশ আমাদের সামনেই দাঁড়িয়ে ছিল, যা ঘটেছে সবই দেখেছে, কিন্তু তারপরও তাদের মুখ বন্ধ। অন্তত পঞ্চাশজন পুলিশ সেখানে ছিল। তারা যদি মনে করত, আমাদের থামাতে পারত। আমরা পুলিশের ভাল সমর্থন পেয়েছি। তার কারণও নরেন্দ্রভাই। গুজরাতে যা হয়েছে, ভালর জন্যই হয়েছে। আমরা ওদের [মুসলমান] থেকে কিছুটা স্বস্তি পেয়েছি, খুব বেড়েছিল।
সেই সময় মুসলমানরা পুলিশকে ফোন করতে থাকে, তাদের কাছে দৌড়তে থাকে। একজনের নাম ছিল সালিম— সে ছিল নারোদা পাটিয়া অঞ্চলের দাদা, দৌড়ে সে পুলিশের জিপের মধ্যে ঢুকে পড়ে। আমি টেনে তাকে বাইরে আনি। পুলিশ বলে, ওকে মেরে ফেল, ও যদি বেঁচে থাকে আমাদের বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দেবে।
পড়ুন, ইলেকশন এক্সপ্রেস ২০২৪
সাংবাদিক আশিসের স্টিং অপারেশনে দাঙ্গায় মোদির ভূমিকা খুবই পরিষ্কার। আশিসকে সুরেশ ল্যাংড়া (রিচার্ড) বলেছে:
[মিস্টার মোদি] ২৮ ফেব্রুয়ারি সন্ধ্যা সাতটা-সাড়ে সাতটা নারোদা পাটিয়ায় এসে যারা গণহত্যা ও গণধর্ষণ করেছে সেই তাকে এবং অন্যদের অভিনন্দন জানান।
হরেশ ভাট ছিলেন বজরং দলের নেতা, পরে তিনি বিজেপির এমএলএ হয়েছিলেন। তিনি বলেন:
আমি বিবৃতি দিতে পারব না… কিন্তু তিনি যা করেছেন কোনও মুখ্যমন্ত্রীই তা কখনও করেননি… আমরা যা করতে পারি তার জন্য তিনি আমাদের তিন দিন সময় দিয়েছিলেন। তিনি বলেন, তারপর তিনি আর সময় দেবেন না… এ-কথা প্রকাশ্যে বলেছিলেন… তিনদিন পর তিনি আমাদের থামতে বলেন।
রাজেন্দ্র ব্যাস সেদিন সবরমতি এক্সপ্রেসে ছিলেন। তিনি বলেন:
তিনি [মোদি] প্রথমে বলেন যে আমরা প্রতিশোধ নেব… সে-কথা আমিও প্রকাশ্যে বলেছি, তখনও পর্যন্ত আমি কিছুই মুখে দিইনি… এক বিন্দু জলও না… এতজন মারা গেছে বলে আমি এতই আবেগাপ্লুত ছিলাম যে আমার চোখ থেকে জল গড়াচ্ছিল, কিন্তু যখন আমার শক্তির ব্যবহার শুরু করলাম… গালগালি দিতে শুরু করলাম… তিনি [মোদি] বললেন, রাজেন্দ্রভাই ঠান্ডা হোন, সবকিছুই বুঝে নেওয়া হবে… সে-কথা বলতে তিনি কী বুঝিয়ে ছিলেন?… যারা বুঝতে চান বুঝে গিয়েছিলেন।
অরবিন্দ পান্ডিয়া ছিলেন নানাবতী কমিশনের সরকারি কৌসুলি। তিনি বলেন:
এরপর দ্বিতীয় হিরো, যার নাম… নরেন্দ্র মোদি… এলেন এবং তিনি পুলিশকে মৌখিক নির্দেশ দিলেন যে তাদের হিন্দুদের সঙ্গেই থাকতে হবে কারণ রাজ্যটিই রয়েছে হিন্দুদের সঙ্গে।
ভাদোদরার এমএস ইউনিভার্সিটির চিফ অডিটর ও প্রাক্তন বিধায়ক ধীমন্ত ভাটের কথায়:
আমরা যদি যথেষ্ট প্রতিক্রিয়া না তৈরি করতে পারি তাহলে আরেকটা ট্রেনও জ্বালিয়ে দেওয়া হবে… এটাই ছিল আইডিয়া, চিন্তাটা এসেছিল তাঁর [মোদি] কাছ থেকে… আমি মিটিঙে ছিলাম… আমার মতো প্রায় ৫০ জনকে পুলিশ কমিশনারের[3] বিশেষ অনুমতি দেওয়া হয়েছিল যেন আমরা কারফিউ জারি করা অঞ্চলে চলে ফিরে শান্তি-শৃঙ্খলায় বজায় রাখায় সাহায্য করতে পারি… সেটা ছিল অজুহাত… আমি এ-ব্যাপারে পরিষ্কার… কিন্তু কীভাবে হিন্দুদের সাহায্য করব? সেইসময় হিন্দুবাড়িতে একটা লাঠিও ছিল না। তাহলে আমাদের কী করতে হবে? আমরা তিন ফুটের লোহার পাইপ নিলাম… লোহার বার, বজরং দলের লোক হলে ঘরে ছিল ত্রিশূল… বজরং দলের সমস্ত অস্ত্র জড়ো করার পরিকল্পনা ছিল, আমরা নানা পাড়ায় গিয়ে নেতাদের তা সরবরাহ করলাম… এসবের খুবই প্রয়োজন ছিল…
সেদিন নারোদা পাটিয়ায় ৯৬ জনকে জ্যান্ত পোড়ানো হয়েছিল। ২০১২ সালে বিশেষ আদালত ওই মামলায় মায়া কোদনানি, বাবু বজরঙ্গি-সহ মোট ৩২ জনকে অভিযুক্ত করে। মায়া কোদনানি নারোদা পাটিয়ার তিনবারের এমএলএ।[4] তাঁর ২৮ বছরের জেল হয়। হত্যাকাণ্ডের সময় তিনি যে সেখানে উপস্থিত ছিলেন তার প্রমাণ তাঁর ফোনকলের নথি বা রেকর্ড। গুজরাতের সিনিয়র আইপিএস রাহুল শর্মার উদ্যোগে তা পাওয়া গিয়েছিল। তিনি কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ স্থানে সেই রেকর্ড জমা দিয়েছিলেন। ওই রেকর্ড থেকে রাজনৈতিক এবং পুলিশমহলে কোদনানির প্রভাব প্রমাণিত হয়। ঘটনার দিন মুখ্যমন্ত্রীর অফিসের সঙ্গে তাঁর চারবার ফোনে কথা হয়েছিল। রাতে জাডাফিয়ার সঙ্গে দুবার কথা বলেছিলেন। নারোদা থানার ইনচার্জ ছাড়া উপরমহলের পুলিশের সঙ্গেও বারবার কথা বলেন। ওদিকে আদালতের বিচারক সুপ্রিম কোর্ট-নিযুক্ত স্পেশাল ইনভেস্টিগেশন টিমকে (সিট) বারবার সেই হত্যাকাণ্ডের রিপোর্ট জমা দিতে বললেও সিট তা জমা দেয়নি। সিট দাঙ্গাকারী ও রাজনীতিবিদদের যুক্ত করে বৃহত্তর ষড়যন্ত্রের কথাও বলেনি। তবে তারা ফোনকলের রেকর্ডের ভিত্তিতে কোদনানিকে চার্জশিট দিয়েছিল।
ওদিকে ২০১৭ সালের ১৮ সেপ্টেম্বর অমিত শাহ নারোদা গাম মামলায়[5] কোদনানি যে নারোদা গাম হত্যাকাণ্ডের সময়ে ঘটনাস্থলে ছিলেন না সাক্ষ্যে সে-কথা বলতে এসেছিলেন। তিনি আদালতে বলেন, গুজরাত বিধানসভায় সকাল সাড়ে আটটা নাগাদ এবং সোলা সিভিল হাসপাতালে এগারোটা পনেরো নাগাদ তিনি কোদনানিকে দেখেছিলেন। এরপর ২০১৮ সালের আগস্ট মাসে সিট বিশেষ আদালতে জানায়, অমিত শাহের বিবৃতি বিশ্বাসযোগ্য নয়, ঘটনাস্থলে কোদনানি দশ মিনিট ধরে জনতাকে উত্তেজিত করেছেন। এরপর আদালত আশিস খেতানের স্টিং অপারেশনের রেকর্ড খতিয়ে দেখে। তবে শেষ পর্যন্ত ২০২৩ সালের এপ্রিল মাসে ওই মামলায় বিশেষ আদালত কোদনানি, বজরঙ্গি-সহ ৬৭ জন অভিযুক্তকেই মুক্তি দিয়েছিল।
বেস্ট বেকারিতে হিন্দু দুষ্কৃতিরা ১৪ জনকে পুড়িয়ে মারে। খেতান দেখিয়েছেন ওই মামলায় কেমন করে বিচারব্যবস্থা নিয়ে খেলা করা হয়েছে। তাঁর স্টিং অপারেশন থেকে জানা গেছে পাবলিক প্রসিকিউটর মুখ্য সাক্ষীদের ডাকেনি, ভুল নথিকে এফআইআর হিসাবে দেখিয়েছে, ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শীদের রক্ষা করতে ব্যর্থ হয়েছে এবং সাক্ষীদের বিরূপ করায় সাহায্য করেছে। তিনি দেখিয়েছেন ব্যতিক্রম নয়, প্রতারণামূলক বিচারই নিয়ম। এই প্রসঙ্গে তিনি সুপ্রিম কোর্টের এক বিচারপতির মন্তব্য উল্লেখ করেছেন: “বেড়া যখন শস্যকে গিলে ফেলতে থাকে আইনশৃঙ্খলা এবং সত্য ও ন্যায়বিচার বাঁচিয়ে রাখার উপায় থাকে না।”
আশিসের দুঃসাহসিক গোপন স্টিং অপারেশনে অতীতের যেসব বিবরণ একত্রিত হয়েছে তাতে বোঝা যায় গুজরাতে কয়েক যুগ ধরে ক্রমাগত চেষ্টা করে শত্রুতা ও ভয়, বিরোধ ও বশংবদ তৈরি করা হয়েছে। পক্ষপাতিত্ব পুরস্কৃত হয়েছে, দণ্ডিত হয়েছে উৎকর্ষ। সৎ তদন্তকারী তিরষ্কৃত হয়েছেন বা তাঁকে সরিয়ে দেওয়া হয়েছে, ওদিকে অসৎরা পুরস্কৃত হয়েছেন। তিনি গুজরাতের স্থানীয় রাজনীতি, ধর্মান্ধ এবং বস্তিবাসীদের ছায়াচ্ছন্ন ভূবনের কথা তুলে ধরেছেন।[6]
Reference:
- Khetan, Ashish. Under Cover: My Journey into the Darkness of Hundutva. Payal Enterprises, 2021.
- Baweja, Harendra. Naroda verdict may spell trouble for top cops, ex-minister. Sep 1, 2012.
- Mudgal, Vipul. Review: Under Cover; My Journey into the Darkness of Hindutva by Ashish Khetan. Hindustan Times. Sep 17, 2021.
[পরের পর্ব: দাঙ্গা নিয়ে বিজেপির মধ্যে বিতর্ক]
[1] আশিসের পরিচিত আরএসএসের সাজানো নেতা।
[2] ‘তহেলকা’র সম্পাদক।
[3] ভাদোদরার পুলিশ কমিশনার ডিডি তুতেজা।
[4] মায়া কোদনানি ১৯৯৮ সালে জিতেছিলেন ৭৫ হাজার ভোটে, ২০০২ সালে ১ লাখ ১০ হাজার এবং ২০০৭ সালে ১ লাখ ৮০ হাজার ভোটে। অর্থাৎ দাঙ্গার পর বিজেপির ভোট বাড়তে থাকে।
[5] এখানে ১১ জনকে হত্যা করা হয়েছিল।
[6] বইটা পড়তে পড়তে আমরা যেন সংবাদের পিছনে যে বাস্তব ও ভয়াবহতা থাকে সেইসব জানছি। আনমনাভাবে এমন মানুষের সঙ্গে চা-জলখাবার খাচ্ছি যারা বলছে মুসলমানদের কীভাবে কুপিয়েছে। পরিবারের লোকের সামনে ধর্ষণ ও শরীর বিকৃত করে দেওয়ার কথা বলছে। এইসব গল্প জড়ো হয়েছে ‘তহেলকা’র উদ্যোগে সাংবাদিক আশিস খেতানের দুঃসাহসী গোপন অভিযানে। আশিস নারোদা পাটিয়া গণহত্যার মূল অভিযুক্ত বাবু বজরঙ্গির জগতেও হানা দিয়েছিলেন। দাঙ্গা চলাকালীন বজরঙ্গি ২৩টি রিভলভার জোগার করেছিল। সে বলে মুসলমান ও খ্রিস্টানরাই তার শত্রু। বজরঙ্গি জানিয়েছে, যেসব মুসলমানদের স্ত্রী হিন্দু, অবসর সময়ে সেই সব পরিবার থেকে হিন্দু মেয়েদের সে ছিনিয়ে আনে। তার দাবি এইরকম ৯৫৬ জন মহিলাকে সে ছিনিয়ে এনেছে। সে রাজ্যের বিজেপি নেতৃত্বের প্রশংসা করলেও তার দুঃখ হিন্দুত্বের কথা বলে যে ফান্ড তোলা হয়েছে ভিএইচপির বড় নেতারা তা পকেটে পুরেছেন।
হিন্দুত্বের প্রকল্প নিয়েই বিজেপি গুজরাত থেকে দিল্লিতে ক্ষমতায় এসেছে। আশিসের মতে, মানুষের মন ও প্রতিষ্ঠান নিয়ে কারচুপি চালাতে ডিপ স্টেট বা গভীর রাষ্ট্র ছায়াবৃত নেটওয়ার্ক গড়ে তুলেছে। ক্রমাগত পরীক্ষার মাধ্যমে গুজরাতে তা পরিণত হয়েছে। একবার ভিত্তি তৈরি হয়ে গেলে যে কোনও অবাস্তবতাও মানুষের মুখেচোখে বিশ্বাস হিসাবে ধরা পড়ে। দল এবং দলের বিরোধী, আমলা, বিচারব্যাবস্থা, সংবাদমাধ্যম এবং কিছু কিছু ব্যক্তির বিষয়ে শাসকের নাক গলানো চলছে। ভারতের গণতন্ত্র এখন এইভাবেই এগোচ্ছে।