Site icon ৪ নম্বর প্ল্যাটফর্ম

গুজরাত গণহত্যার বিচার হয়নি: দাঙ্গা নিয়ে বিজেপির মধ্যে বিতর্ক

প্রদীপ দত্ত

 


গোয়াতে বিজেপির জাতীয় কর্মসমিতির মিটিং-এর আগে দলের সভাপতি কেজে কৃষ্ণমূর্তি এবং আরএসএস-প্রধানের কাছে শান্তাকুমারকে ক্ষমা চাইতে হল। বিশ্ব হিন্দু পরিষদ গোটা হিন্দু সমাজকে কলঙ্কিত করেছে, এই বিবৃতি থেকে শান্তাকুমার সরে দাঁড়ালেন। ২০০২ সালের ১২ এপ্রিল যখন বিজেপির কর্মসমিতির মিটিং শুরু হল, নরমপন্থীরা ততক্ষণে পরাজিত। মোদি-পন্থী শক্তির সঙ্গে বাজপেয়ির শক্তিপরীক্ষার বাসনা চলে গেছে। এক মাস আগে যে নরমপন্থী প্রধানমন্ত্রী মোদিকে সরাতে চেয়েছিলেন, তিনি আরএসএসের কাছে আত্মসমর্পন করলেন

 

পূর্ব-প্রসঙ্গ: নারোদা পাটিয়া হত্যাকাণ্ড

গুজরাতের ওই ভয়াবহ দাঙ্গা নিয়ে বিজেপি দলের মধ্যে বিক্ষোভ দেখা দেয়। দাঙ্গার পর জাতীয় নেতাদের মধ্যে যাঁরা কট্টরপন্থী তাঁরা মোদিকে সমর্থন করেন। ওদিকে নরমপন্থীরা মনে করেন, উদার হিন্দুরা এই জঙ্গি হিন্দুত্ব পছন্দ করবে না। প্রধানমন্ত্রী অটলবিহারী বাজপেয়ি পাঁচ মাস আগে মোদিকে হাতে ধরে তুলে এনে মুখ্যমন্ত্রীর পদে বসিয়েছিলেন। তিনি দাঙ্গা নিয়ে অসন্তোষ প্রকাশ করেন, মোদিকে রাজধর্ম স্মরণ করিয়ে দেন। ততদিনে তিনি বুঝেছেন মোদি মুখ্যমন্ত্রী পদে মোটেই মানানসই হননি।[1] বাজপেয়ি জানতেন, মোদি হিংসা নিয়ন্ত্রণ করবেন না। তাই তাঁকে সরাতে চাইছিলেন। তবে এও জানতেন, সেক্ষেত্রে আদবানি এবং আরএসএস তুমুল আপত্তি তুলবে, সঙ্ঘ-নেতৃত্ব মোদিকে সরাতে একেবারেই রাজি ছিল না। এই অবস্থায় অনেকে ভেবেছিলেন, ধর্মনিরপেক্ষ দলগুলো হয়তো বিজেপির নেতৃত্বে কোয়ালিশন সরকার থেকে সমর্থন তুলে নেবে।[2] ওদিকে বিজেপির এক প্রাক্তন জাতীয় সম্পাদক সাংবাদিক জোসকে বলেন, শক্তিশালী আরএসএস নেতা এবং বিজেপি সভাপতি কুশাভাও ঠাকরে সেই সময় দলের নেতাদের মধ্যে প্রচার করেন যে, মোদিকে সমর্থন করা দরকার, এমন কি বাজপেয়ি সরকারের মূল্যেও। দলের মধ্যে এই নিয়ে লবি-কাউন্টার লবি চলছিল।

মোদির বিরুদ্ধে প্রথম কথা বলেন বাজপেয়ি ক্যাবিনেটের শান্তাকুমার। তিনি গুজরাতের ঘটনাপ্রবাহে তাঁর ব্যথা ও বিরক্তির কথা বলেন। বলেন, যারা মৃতদেহ দেখে ভোট গোনে তারা হিন্দু নয়। যারা ভাবে গুজরাতে রক্ত ঝরিয়ে হিন্দুত্ব একত্রিত করবে তারা হিন্দুদের শত্রু। জবাবে এলকে আদবানি বললেন, যারা অনুশাসন ভাঙছে তাদের বিরুদ্ধে পদক্ষেপ নেওয়া হবে।

কয়েকদিন পরেই গোয়াতে ছিল বিজেপির জাতীয় কর্মসমিতির মিটিং। তার আগে দলের সভাপতি কেজে কৃষ্ণমূর্তি শান্তাকুমারকে ডেকে পাঠালেন। কৃষ্ণমূর্তি এবং আরএসএস-প্রধানের কাছে শান্তাকুমারকে ক্ষমা চাইতে হল। বিশ্ব হিন্দু পরিষদ গোটা হিন্দু সমাজকে কলঙ্কিত করেছে, এই বিবৃতি থেকে তিনি সরে দাঁড়ালেন। ২০০২ সালের ১২ এপ্রিল যখন বিজেপির কর্মসমিতির মিটিং শুরু হল, নরমপন্থীরা ততক্ষণে পরাজিত। মোদি-পন্থী শক্তির সঙ্গে বাজপেয়ির শক্তিপরীক্ষার বাসনা চলে গেছে। এক মাস আগে যে নরমপন্থী প্রধানমন্ত্রী মোদিকে সরাতে চেয়েছিলেন, তিনি আরএসএসের কাছে আত্মসমর্পন করলেন। শেষপর্যন্ত ঠাকরে, আদবানি, মোদি, জেটলির ক্যাম্প বাজপেয়িদের হারিয়ে দিল।

গোয়াতে তাঁর ভাষণে বাজপেয়ি মোদির ভাষাতেই কট্টরপন্থীদের পতাকা তুলে ধরলেন। বললেন: ইন্দোনেশিয়া বা মালয়েশিয়া— যেখানেই মুসলমানরা থাকে তারা সম্প্রীতি বজায় রেখে বাস করতে জানে না। সমাজে মেশে না, শান্তিতে বসবাস করতে আগ্রহী নয়… কারও কাছ থেকে আমাদের ধর্মনিরপেক্ষতা শেখার দরকার নেই। মুসলমান ও খ্রিস্টানদের আগেও ভারত ধর্মনিরপেক্ষ ছিল।

দেশে এই প্রথম কোনও প্রধানমন্ত্রী মুখ্যমন্ত্রীর পিছনে লাইনে দাঁড়ালেন। তারপর থেকে তিনি মোদিকে ভয়ই পেতেন।[3] শান্তাকুমারও মোদিভক্তদের লাইনে দাঁড়িয়ে মোদির গুনগান গাইতে শুরু করেন। গত দশকের শুরুতে তিনি সাংবাদিক জোসকে বলেন: যা ঘটেছে তা অতীত, একবার গুজরাতের দিকে ফিরে দেখুন। গত মাসে মোদিজির সঙ্গে দেখা হয়েছিল। গুজরাতে তিনি চমৎকার কাজ করেছেন। আমি বলি, গুজরাতে যা করেছেন গোটা দেশে একই জিনিস হওয়া দরকার— হিন্দুত্বের সঙ্গে অগ্রগতির মিশ্রণ।

 

Reference:

 

[পরের পর্ব- হরেন পান্ড্যর লড়াই]


[1] বাজপেয়ির ব্রাহ্মণত্ব, উঁচু স্বাদ-পছন্দ এবং কবিতা নিয়ে মোদিরও অস্বস্তি ছিল।
[2] এনডিএ সরকারের শরিক ধর্মনিরপেক্ষ আঞ্চলিক দলগুলো কী করে তা নিয়ে উদ্বেগ থাকলেও বিহারের জনতা দল (ইউনাইটেড), তামিলনাড়ুর ডিএমকে, অন্ধ্রপ্রদেশের তেলুগু দেশম এবং পশ্চিমবঙ্গের তৃণমূল কংগ্রেস— কেউই গুজরাত গণহত্যা নিয়ে বিজেপির লাইনের বিরোধিতা করে সরকার থেকে বেরিয়ে যায়নি।
[3] ২০০২ সালের ডিসেম্বর মাসে বিধানসভা নির্বাচনী প্রচারে ব্যস্ততার সময় দলকে মোদি জানিয়ে দিয়েছিলেন, প্রচারের কাজে প্রথমদিকেই বাজপেয়ি ও অন্য বড় নেতাদের আসতে হবে। তিনি চান না দলের বিজয়ের কৃতিত্ব নিতে কেউ বলুন যে তাঁরা শেষবেলায় এসে চূড়ান্ত ঠেলা দিয়েছিলেন বলেই জয় এসেছিল। প্রধানমন্ত্রী বা দলের কোনও বড় নেতা রাজ্যে গেলে সাধারণত রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী বিমানবন্দরে তাঁদের নিতে আসেন, মোদি তা করতেন না। ওদিকে মোদি শুধু বাজপেয়ির মধ্যে ভয় ধরাননি, পর পর দুবার রাজ্যের নির্বাচনে জিতেছেন। অথচ ওই একই সময়ে কিন্তু লোকসভা নির্বাচনে বিজেপি পরপর দুবার হেরেছে।