গুজরাত গণহত্যার বিচার হয়নি: কুলদীপ শর্মার কথা

প্রদীপ দত্ত

 


কুলদীপ যখন আমেদাবাদে পুলিশ হেডকোয়ার্টারে ছিলেন তখন কয়েকজন রাজনীতিবিদ এবং সমাজবিরোধীর সঙ্গে কথোপোকথনের রেকর্ড সিবিআইয়ের হাতে তুলে দিয়েছিলেন। সেখানে সোহরাবুদ্দিন শেখের বিচারবহির্ভূত হত্যা মামলায় উপ-স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহর বিষয়ে কিছু গুরুত্বপূর্ণ সূত্র ছিল। এরপর সোহরাবুদ্দিন জাল এনকাউন্টার মামলায় সিবিআই সুপ্রিম কোর্টে মধ্যবর্তী রিপোর্ট জমা দিলে তার ভিত্তিতে কয়েকজন সিনিয়র আইপিএসকে গ্রেফতার করা হয়। এরই জেরে অমিত শাহকে মন্ত্রিত্ব ছেড়ে দিতে হয় এবং তিনি তিন মাসের জন্য জেলে যান। ২০০৫ সালে অভিযোগ ওঠে সোহরাবুদ্দিন শেখকে জাল এনকাউন্টারের প্রধান মস্তিস্ক হলেন অমিত শাহ

 

পূর্ব-প্রসঙ্গ: বিচারবহির্ভূত হত্যা, অমিত শাহ-যোগ

অমিত শাহের বিরুদ্ধে মুখ খুলেছেন বলে বিজেপির প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী কেশুভাই পটেল এবং সুরেশ মেহতাকে পার্টিতেও গুরুত্বহীন করে দেওয়া হয়। সুরেশ একসময়ে মুখ্যমন্ত্রীর ঘনিষ্ঠ ছিলেন, তিনি অভিযোগ করেন যে, তাঁর ফোন ট্যাপ করা হচ্ছে। শাহ-র বিরুদ্ধে অভিযোগ করেছিলেন বলে বিধায়ক ধীরুভাই গজেরা, রমিলাবেন দেশাই, দিলীপ পটেল, গোর্ধন জাডাফিয়া এবং নলিন ভাটের সরকারে তেমন গুরুত্ব ছিল না। তবে বিজেপির মধ্যে হরেন পান্ড্য ছাড়া গুজরাত দাঙ্গার জন্য আর কেউ মোদি এবং গুজরাত প্রশাসনের বিরুদ্ধে প্রকাশ্যে কথা বলেননি।

শুধু রাজনীতিকরাই মোদিকে শাহ-র বিরুদ্ধে সাবধান করেননি, পাঁচজন হুইসলব্লোয়ার আইপিএস অফিসার যাঁরা মোদিকে অমিত শাহর কুকর্ম সম্বন্ধে বলার সাহস দেখিয়েছেন সবাই পানিশমেন্ট পোস্টিং পেয়েছেন। ২০০৫ সালে যখন অমিত শাহ তাঁর মর্জিমতো স্বরাষ্ট্র বিভাগ চালাচ্ছেন, কয়েকজন আইপিএস অফিসার দায়িত্ব নিয়ে বিভাগটি ঠিক করতে চেয়ে অমিত শাহর বিরুদ্ধে মোদিকে একগুচ্ছ অভিযোগ-সহ সোহরাবুদ্দিন জাল এনকাউন্টারের কথা বলেন। তাঁরা এ-ও বলেন যে অমিত শাহর পদের অপব্যবহার যদি বন্ধ করা না যায় গুজরাত পুলিশের বদনাম হবে। মুখ্যমন্ত্রী মন দিয়ে তাঁদের কথা শুনলেন। তাঁদের মনে হয়েছিল এবার ওই মন্ত্রীর বিরুদ্ধে দ্রুত তিনি পদক্ষেপ করবেন, তাতে স্বরাষ্ট্র বিভাগের ভাবমূর্তি ভাল হবে। কিন্তু কিছুদিন পরই ওই অফিসাররা সবাই পানিশমেন্ট পোস্টিং পেলেন।

তবে এরপরও পুলিশের কয়েকজন আইপিএস অফিসার মাথা উঁচু করে ন্যায়ের পক্ষ নিয়েছেন, ক্ষমতার দাসত্ব করেননি। চাকরিক্ষেত্রে নিজের উন্নতি ও ভবিষ্যতের কথা না ভেবে তাঁরা সত্য এবং ন্যায়বিচারের পক্ষে দাঁড়িয়েছেন। তবে গুজরাতের প্রতিহিংসাপরায়ণ মোদি সরকার তাঁদের ছেড়ে দেয়নি। তাঁদের বিরুদ্ধে নানা মিথ্যা অভিযোগ এনেছে, কনফিডেন্সিয়াল রিপোর্ট খারাপ করা হয়েছে। গুরুত্বপূর্ণ পদ পেয়েছেন অভিযুক্ত পুলিশ অফিসার। পরবর্তীকালে বিজেপি কেন্দ্রে ক্ষমতায় আসার পর একদিকে দাঙ্গাকারীদের বাঁচানোর চেষ্টা করেছে, ওদিকে যেসব পুলিশ অফিসার ন্যায়ের পক্ষ নিয়েছেন তাঁদের আরও নানাভাবে নাস্তানাবুদ করেছে। তাঁদের লড়াইয়ের কথা বললে গুজরাত সরকার ও প্রশাসনের প্রতিহিংসা গভীরে গিয়ে বুঝতে যেমন সুবিধা হয়, তেমনি দাঙ্গার পর গুজরাতের মানুষ যেটুকু ন্যায়বিচার পেয়েছে সেই ক্ষেত্রে তাঁদের অবদান বোঝা যায়।

এখন আমরা সেরকম কয়েকজনের কথা আলোচনা করব। প্রথমে কুলদীপ শর্মার কথা।

 

পড়ুন, ইলেকশন এক্সপ্রেস ২০২৪

 

তিনি অভিযোগ করেছিলেন, মোদি এবং অমিত শাহ তাঁর উপর চাপ তৈরি করেছিলেন যেন তিনি আমেদাবাদের বিশিষ্ট নর্তকী ও সমাজকর্মী মল্লিকা সারাভাইকে মানবপাচারের অভিযোগে গ্রেফতার করেন।

তাঁর ভাই আইএএস অফিসার প্রদীপ শর্মা মোদি সরকারের বিরুদ্ধে অভিযোগ করেন যে, ২০০২ সালে কুলদীপ যখন আমেদাবাদে পুলিশের ইন্সপেক্টর জেনারেল, মোদির অফিস থেকে তাঁর কাছে ফোন আসে যে তিনি যেন তাঁর ভাইকে ২০০২ সালের দাঙ্গাকারীদের বিরুদ্ধে ধীরে চলার জন্য বলেন। সেই কথা ফাঁস করার ফলে কিছুদিন পরে প্রদীপকে ভুজে জমি নিয়ে ‘বেআইনি কাজ’-এর জন্য পুলিশ গ্রেফতার করেছিল।

কুলদীপ যখন আমেদাবাদে পুলিশ হেডকোয়ার্টারে ছিলেন তখন কয়েকজন রাজনীতিবিদ এবং সমাজবিরোধীর সঙ্গে কথোপোকথনের রেকর্ড সিবিআইয়ের হাতে তুলে দিয়েছিলেন। সেখানে সোহরাবুদ্দিন শেখের বিচারবহির্ভূত হত্যা মামলায় উপ-স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহর বিষয়ে কিছু গুরুত্বপূর্ণ সূত্র ছিল। এরপর সোহরাবুদ্দিন জাল এনকাউন্টার মামলায় সিবিআই সুপ্রিম কোর্টে মধ্যবর্তী রিপোর্ট জমা দিলে তার ভিত্তিতে কয়েকজন সিনিয়র আইপিএসকে গ্রেফতার করা হয়। এরই জেরে অমিত শাহকে মন্ত্রিত্ব ছেড়ে দিতে হয় এবং তিনি তিন মাসের জন্য জেলে যান। ২০০৫ সালে অভিযোগ ওঠে সোহরাবুদ্দিন শেখকে জাল এনকাউন্টারের প্রধান মস্তিস্ক হলেন অমিত শাহ। কুলদীপ তখন গুজরাত স্টেট শিপ অ্যান্ড উল ডেভেলপমেন্ট কর্পোরেশনের ম্যানেজিং ডিরেক্টর।

২০০৫ সালে কুলদীপ ছিলেন সিআইডি (ক্রাইম)-এর প্রধান। তিনি মুখ্যসচিবকে অভিযোগ করেন, গুজরাতের উপস্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ মাধবপুরা মার্কেন্টাইল কোঅপারেটিভ ব্যাঙ্কের ১২০০ কোটি টাকার জালিয়াত কেতন পারিখের থেকে ঘুষ নিয়েছেন। আড়াই কোটি টাকা ঘুষের বিনিময়ে তিনি প্রতারক কেতনের জামিন পাওয়ার ব্যবস্থা করেছেন। সিআইডি (ক্রাইম) ওই জালিয়াতির তদন্ত করছিল।

এতসবের পর গুজরাত পুলিশের সিআইডি (ক্রাইম) বিভাগ কুলদীপ-সহ তিনজনের বিরুদ্ধে ১৯৮৪ সালে কচ্ছের জুসাব জুমা মোখার পরিবারের দুজনকে এনকাউন্টার করা দুজনের নিখোঁজ হওয়া নিয়ে ২০১০ সালে এফআইআর দাখিল করে। কুলদীপ তখন গুজরাত শিপ অ্যান্ড উল ডেভেলপমেন্ট কর্পোরেশনের এমডি। সিআইডির একটি দল কচ্ছে গিয়ে এনকাউন্টার মামলার তদন্ত শুরু করে। এই উপলক্ষে সিআইডি প্রধান এসএস ত্রিবেদীকে নিয়ে ছজনের বিশেষ তদন্তকারী দল গঠন করা হয়। ঘটনার সময় কুলদীপ ছিলেন কচ্ছ জেলার পুলিশ সুপারিন্টেন্ডেন্ট। রাজকোট পুলিশ স্টেশনে এফআইআরের ভিত্তিতে তিনি, এক সাব ইন্সপেক্টর-সহ আরও কয়েকজন পুলিশের বিরুদ্ধে খুন, ষড়যন্ত্র-সহ নানা ধারায় মামলা করা হয়। কিন্তু গুজরাত হাইকোর্ট সেই এফআইআর বাতিল করে জানায়, এফআইআর করতে বিপুল দেরি হয়েছে, ঘটনাটি ২৬ বছর আগের এবং এর আগে যখন বিচার চলছিল সেই সময়ে কুলদীপকে অভিযুক্ত ছিলেন না। সরকার কুলদীপের বিরুদ্ধে প্রতিহিংসামূলক আচরণ করছে। কুলদীপ তার আবেদনে বলেন, মোখা জাল এনকাউন্টার নিয়ে আগে যে অভিযোগ করেছিল সেখানে বলা হয়েছিল যে, পুলিশ অফিসার এএস বিশনয় ওই লোকেদের তুলে এনে হত্যা করেছিল। কিন্তু ২০০৪ সালে আদালত বিশনয়কে নির্দোষ বলে খালাস করেছিল। হেবিয়াস করপাসের যে আবেদন করা হয়েছিল সেখানেও তাঁর নাম ছিল না।

২০১২ সালের ডিসেম্বরে তিনি গুজরাতের ডিরেক্টর জেনারেল অফ ব্যুরো ফর পুলিশ রিসার্চ অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট হিসাবে অবসর নেন। ২০১৫ সালে গুজরাত সরকারের স্বরাষ্ট্র বিভাগ তাঁর বিরুদ্ধে নতুন চার্জশিট দেয়। সেখানে বলা হয়, তিনি যখন গুজরাত শিপ অ্যান্ড উল ডেভেলপমেন্টের এমডি ছিলেন সেই সময় অব্যবহৃত অনুদান ঠিক সময়ে ফেরত দেননি। উত্তরে শর্মা লেখেন, সরকারে যা রুটিন প্র্যাকটিস সেই অনুযায়ী তিনি সেই অনুদান ব্যবহারের জন্য অনুমতি চেয়েছিলেন। কিন্তু এই চিঠি চালাচালির সময় তাঁকে কেন্দ্রীয় ডেপুটেশনে (ডিরেক্টর জেনারেল অফ দ্য ব্যুরো অফ পুলিশ রিসার্চ অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট পদে) দিল্লি যেতে হয়। তাই পরবর্তীকালে তাঁর জায়গায় যিনি এসেছিলেন তিনি ওই অনুদানের বিস্তারিত হিসাব জমা দিয়েছিলেন, কোনও অনিয়ম হয়নি।

অনেক চেষ্টা করেও কুলদীপকে ফাঁসানো যায়নি। পরবর্তীকালে তিনি কংগ্রেস পার্টিতে যোগ দেন।

 

Reference:

 

[পরের পর্ব- রজনীশ রাই-এর কথা]

 

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 4666 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

1 Trackback / Pingback

  1. গুজরাত গণহত্যার বিচার হয়নি: রজনীশ রাই-এর কথা – ৪ নম্বর প্ল্যাটফর্ম

আপনার মতামত...