Site icon ৪ নম্বর প্ল্যাটফর্ম

সন্‌জীদা খাতুন ও রবীন্দ্রনাথের গান

ইন্দ্রনীল মজুমদার

 


সেই গান সন্‌জীদার দেহ ঘিরে ছায়ানটের ছাত্রছাত্রীদের পরিক্রমার গান হল এই কারণে যে রবীন্দ্রনাথের গান সন্‌জীদার কাছে সত্যিই ছিল সকল স্থূল বন্ধন মুক্ত করার আবাহন। রবীন্দ্রনাথ তাঁর কাছে ছিলেন গান নয়, প্রতিবাদের ভাষা; ছায়ানট ছিল বাঙালির স্বরূপসন্ধান। বন্ধন আজ যত বাড়ছে দিকে দিকে, তত বেশি প্রয়োজনীয় হয়ে উঠছে আপন ভাষা, আপনার গান— রবীন্দ্রনাথের গানে গানে সব বন্ধন খোলার ডাক

 

“গানে গানে সব বন্ধন যাক টুটে”

সাল ১৯১০। পুত্র রথীন্দ্রনাথের বিয়ে হল। নববধূ প্রতিমা দেবী (গগনেন্দ্রনাথের ভাগনি) এলেন শান্তিনিকেতনে। ইতিমধ্যে মেয়েদের পড়ানোর জন্য রবীন্দ্রনাথ কয়েকজন আশ্রমিকের আত্মীয়া বা কন্যাকে নিয়ে শুরু করেছিলেন বালিকা বিদ্যালয়— খুব আশা নিয়ে। নারীশিক্ষা নিয়ে হাঁকডাক থেকে অনেক দূরে, প্রচারের আড়ালে। পড়াশোনা হবে ছেলেদের সঙ্গেই। সমাজ তখনও ঠিক প্রস্তুত ছিল না এই বিপ্লবের জন্য।

ঠিক হল, ওই মেয়েরাই নতুন বৌমাকে নিয়ে অভিনয় করবে ‘লক্ষ্মীর পরীক্ষা’। লক্ষ্মীর ভূমিকায় নববধূ। কিন্তু মেয়েরা ছেলেদের সামনে অভিনয় করবে কীভাবে? রবীন্দ্রনাথ উল্টো পাশার দান দিলেন— মেয়েরা যথারীতি মঞ্চে অভিনয় করবে, পুরুষেরা দেখবে চিকের আড়াল থেকে।

হঠাৎ সেই আনন্দঘন পরিবেশে ছেদ পড়ল। ব্যক্তিগত রাগ-অনুরাগের কারণে এক ছাত্র আত্মহত্যা করল। গভীর দুঃখে কবি বন্ধ করে দিলেন বালিকা বিদ্যালয়, তুলে দিলেন বালিকাদের ছাত্রীনিবাস। ছাত্রীরা ঘরে ফেরার আদেশ পেল। এর পরের কথা ক্ষিতিমোহন-কন্যা অমিতা সেনের বর্ণনায়—

বালিকাদের আশ্রম ছেড়ে যাবার আগের সারা রাত রবীন্দ্রনাথ দেহলী বাড়িতে আপন মনে গান গেয়ে কাটিয়েছেন, সবই তীব্র বেদনার গান। সেই রাতটিতে রবীন্দ্রনাথ ও বালিকাদের কারও চোখে ঘুম ছিল না। ভোরবেলা যাবার জন্য প্রস্তুত হয়ে বালিকারা রবীন্দ্রনাথকে প্রণাম করতে দেহলী বাড়িতে গেলে রবীন্দ্রনাথ সিঁড়ি দিয়ে নেমে এলেন। ব্যথাভরা মনে রুদ্ধ কণ্ঠে বালিকাদের মাথায় হাত রেখে আশীর্বাদ করলেন।

ঘরের মেয়েরাও যে নাচ ও গানে প্রকাশ্যে শোভনসুন্দর হতে পারেন, সেটা প্রথম শান্তিনিকেতন থেকেই প্রমাণ করে দিলেন রবীন্দ্রনাথ। এই সেই যুগ, যখন মহিলারা প্রকাশ্যে গান করলেই বাঈ অভিধা পাচ্ছেন— নাচ তো দূরের কথা। শান্তিনিকেতনের মেয়েরা আবির্ভাবেই আলোড়ন ফেলে দিলেন কলকাতার প্রখ্যাত মঞ্চে। এর পরেই শুরু হল আর-এক প্রথাভাঙা কাজ। শান্তিনিকেতনের মেয়েদের জাপান থেকে শিক্ষক এনে শেখানো শুরু হল লাঠিখেলা, জুজুৎসু। গান লেখা হল— “সঙ্কোচের বিহ্বলতা নিজেরে অপমান”। বিসর্জন নাটক মঞ্চস্থ হবে কলকাতায়। এর জন্যই পাঁচটি নতুন গান তৈরি করে সাহানাকে শিখিয়ে দিলেন— “ও আমার আঁধা আলো”, “কোন ভীরুকে ভয় দেখাবি”, “আঁধার রাতে একলা পাগল”। সাহানা দেবী লিখেছেন,

স্টেজে আমার প্রবেশ করবার পথে দেখি রবীন্দ্রনাথ জয়সিংহের সাজে ভোঁ হয়ে বসে আছেন, যেন কিসের মধ্যে তলিয়ে গেছেন।

এই সব কথা মিলে একটি কথাই তৈরি হয়— রবীন্দ্রনাথের কাছে গান কেবল গান নয়, সেটি জীবনকে ধারণ করার ধর্মও। শুধু সুর ও বাণীর সঞ্চার নয়; জীবনের সব কাঠিন্য ও রুক্ষতার মুখোমুখিও সে দাঁড়াতে পারে। হতে পারে প্রতিবাদের অনুচ্চ স্বর, হতে পারে সংকীর্ণতাকে রুখে দেওয়ার ভাষা। যা কিছু মানুষকে সীমিত করে— ধর্ম, রাজনীতি, সম্প্রদায়, স্বাজাত্যভিমান, একনায়কের রক্তচক্ষু— সেই সব কিছুর বিরুদ্ধেই রবীন্দ্রনাথের গান উঠে দাঁড়িয়ে বলতে পারে: “জয় হোক মানুষের”।

এভাবেও দেখা যায় রবীন্দ্রনাথের গান। দেখেছেনও কেউ কেউ। যেমন সন্‌জীদা খাতুন আর তাঁর ‘ছায়ানট’। রাশি রাশি অনুপম গদ্য, উপন্যাস, কাব্যনাটকের পাশে পাশে গানই (নাটকের গান-সহ) ধরে রেখেছে রবীন্দ্রনাথের জীবনব্যাপী প্রতিষ্ঠানবিরোধী চিন্তার ধারাভাষ্য। তাই দিয়েই আমরা রুখে দিতে পারি রাষ্ট্রবিপ্লব, একনায়কের ফতোয়া, ধর্মপ্রতিষ্ঠানের উদ্যত তরবারি। সেরকমই ভেবেছিলেন সন্‌জীদা খাতুনও।

এপার বাংলায় আমরা এই পরীক্ষার তত বড় সুযোগ পাইনি, যতটা পেয়েছিলেন ভাষা আন্দোলনের সৈনিকেরা, সন্‌জীদা খাতুনের মতো মানুষরা। আমরা সেটা পেয়েছি অন্য বাতাবরণে— দেশভাগ, দাঙ্গা, শ্রমিক আন্দোলন। ঋত্বিক ঘটকের “কেন চেয়ে আছ গো মা”। সেখানে গণনাট্য সঙ্ঘ যতটা গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছিল, ততটা গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠেনি রবীন্দ্রনাথের গান— একটা সামাজিক আন্দোলনের হাতিয়ার হিসাবে। রবীন্দ্র জন্মশতবার্ষিকীকেই আমাদের রবীন্দ্রযাত্রার মাইলফলক হিসাবে ধরে নিতে পারি, অন্তত জাতিসত্তার প্রকাশ হিসাবে; একটা আন্দোলন হিসাবে নয়।

ওপারে অন্যরকম হয়েছিল। রবীন্দ্রসঙ্গীত নিষিদ্ধ হল। সেই প্রেক্ষিতে প্রবল আত্মশক্তি নিয়ে রবীন্দ্রনাথকেই হাতিয়ার করে রুখে দাঁড়ালেন অনেকে। সন্‌জীদা তাঁদের মধ্যে অগ্রগণ্য। তাঁর ছায়ানট শুধু রবীন্দ্রনাথের গানের পাঠশালা ছিল না— সেটি ছিল বাঙালির আত্মশক্তির ঘোষণাও ছিল। “গানে গানে সব বন্ধন যাক টুটে”।

সেই গান সন্‌জীদার দেহ ঘিরে ছায়ানটের ছাত্রছাত্রীদের পরিক্রমার গান হল এই কারণে যে রবীন্দ্রনাথের গান সন্‌জীদার কাছে সত্যিই ছিল সকল স্থূল বন্ধন মুক্ত করার আবাহন। রবীন্দ্রনাথ তাঁর কাছে ছিলেন গান নয়, প্রতিবাদের ভাষা; ছায়ানট ছিল বাঙালির স্বরূপসন্ধান। বন্ধন আজ যত বাড়ছে দিকে দিকে, তত বেশি প্রয়োজনীয় হয়ে উঠছে আপন ভাষা, আপনার গান— রবীন্দ্রনাথের গানে গানে সব বন্ধন খোলার ডাক।

কী ভেবেছিলেন সন্‌জীদা সারা জীবনে এই নিয়ে?

একাত্তর সালে এপার থেকে প্রাণ নিয়ে পালিয়ে ওপারে গিয়ে, বাংলাদেশের শিল্পীদের একত্র করে মহড়ায় বসা হয়েছিল। তৈরি হওয়া গান নিয়ে ‘রূপান্তরের গান’ গীতি-আলেখ্য খাড়া করা হয়। জাহির রায়হানের এক ভাই কাজটির দায়িত্ব নিলেন। ইনি শাহরিয়ার কবীর। বাছাই করা গানগুলি পরপর সাজিয়ে বাংলাদেশের ক্রমরূপান্তরের কাহিনী তৈরি হয়েছিল নকশাতে। এই গ্রন্থনার অন্যতম গান ছিল ‘দেশে দেশে ভ্রমি তব দুখগান গাহিয়ে’। স্বদেশ পর্যায়ের গান হিসেবেই অন্যান্য স্বদেশী গানের সঙ্গে এটি স্বরবিতান ষটচত্বারিংশ খণ্ডে ছাপা রয়েছে। … ১৮৮১ খৃষ্টাব্দে, নিতান্ত কুড়ি বছর বয়সে রবীন্দ্রনাথ এ গান লেখেন। আশ্চর্য এই, নাটকের প্রয়োজনে লেখা এই গানখানি ১৯৭১ সালে অর্থাৎ রচনার নব্বই বছর পরে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের কালে আবার প্রসঙ্গিক হয়ে ওঠে। আমরা তখন দেশ থেকে দেশে আর এক স্থান থেকে অন্য স্থানে দল নিয়ে ঘুরে ঘুরে গানটি গেয়েছি। ‘নগরে প্রান্তরে বনে বনে’ গাইতে গাইতে এ দেশের মানুষের চোখ যেমন ভিজে উঠেছে, তেমনি ভিজে উঠেছে সকল শ্রোতার চোখ ‘পাষাণ হৃদয়ে কাঁদে সে কাহিনী শুনিয়ে’। … স্বদেশ তখন হয়ে উঠেছে মানুষের ভাই-বন্ধু, পিতা-মাতা যথাসর্বস্ব। দেশমাতৃকার জন্যেই আমরা কেঁদেছি, অন্য সব মানুষকে কাঁদিয়েছি, এবার তাঁর জন্যে প্রাণ সমর্পণ করব। … বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে এ গান আমরা নিজেদের বক্তব্য হিসাবে গ্রহণ করেছি। আমাদের ইতিহাসের অঙ্গ হয়ে আছে এই গান। … রবীন্দ্রনাথের গান আমাদের জীবনের সব ক্ষেত্রে সহায়ক হয়ে প্রয়োজনমাফিক প্রশান্তি এনে দেয়, আবার উদ্দীপনাও সঞ্চার করে। সকল ক্ষেত্রেই এ গান জীবনের সহায়ক শক্তি হয়ে উঠতে পারে।

আবার—

শেষ বিকেলে সকলে একমত হয়ে ছায়ানট সংস্কৃতি সংগঠন তৈরি করেন। এভাবে সঙ্ঘবদ্ধ হয়ে আমরা আপন ঐতিহ্যে সুপ্রতিষ্ঠিত হবার সাধনা শুরু করি। শুধু রবীন্দ্রনাথ নন, তাঁকে ঘিরে বাঙালির আরও যে-সব সংস্কৃতিসাধক রয়েছেন, সার্বিকভাবে তাঁদের সবার সাধনার সঙ্গে পরিচিত হবার অনুশীলন শুরু হয়। একষট্টি সালের পূর্ব পাকিস্তানে এর প্রয়োজন ছিল। দেশের বাংলাভাষী মানুষ যে কেবল পাকিস্তানি মুসলমান নয়, তারা যে মনেপ্রাণে বাঙালি— এ উপলব্ধি তখনকার পরিস্থিতিতে ছিল জরুরি। সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য স্মরণ করিয়ে বাঙালিকে আত্মপরিচয়ে সমৃদ্ধ করবার জন্যেই এই সাধনা।

একাত্তর সালে বিজয় অর্জন করবার পরেও বাংলাদেশ এবং স্বাধীন রাষ্ট্রের জনকের প্রতি দেশদ্রোহী বাঙালিদের বিরোধিতা থেমে থাকেনি। ছায়ানটের রবীন্দ্রসঙ্গীত-শিক্ষক জাহিদুর রহিম এমনই এক দেশদ্রোহীর ষড়যন্ত্রের শিকার হয়েছিলেন। চাকরি খুইয়ে বিভ্রান্ত মানুষটি হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করেন। ১৯৭৮ সালের কথা। ‘জাহিদুর রহিম স্মৃতিপরিষদ’ নামে সংগঠিত হয়ে আশি সালে সেই সময়কার বাংলাদেশের চারটি বিভাগ আর ঢাকা মহানগরীতে রবীন্দ্রসঙ্গীতের প্রতিযোগিতা হল। পরে, বিরাশি সালে বাস্তব সমস্যা সমাধান করতে গিয়ে সংগঠনের নাম করা হল ‘জাতীয় রবীন্দ্রসঙ্গীত সম্মিলন পরিষদ’। আজ ২০১০ সালে সম্মিলন পরিষদের কাজ পরিচালিত হচ্ছে পঁয়ষট্টিটি শাখা থেকে।

বাংলাদেশে আমরা রবীন্দ্রনাথের আদর্শ স্মরণ রেখে পথ চলছি। মনে রেখেছি, “দেশকে আপনার জ্ঞানে, বুদ্ধিতে, প্রেমে, কর্মে, সৃষ্টি” করতে পারলেই জন্মের মাটিকে সত্যিকার “স্বদেশ” করে তুলতে পারব। রবীন্দ্রনাথ এ দেশের সংস্কৃতিকর্মীদের পথের দিশারী।

এ কথাও জানি, রবীন্দ্রবিরোধী বাঙালি মুসলমানের সংখ্যাও কম নয়, আর তারা অনেক বেশি প্রচারনিষ্ঠ, সংগঠিত ও প্রভূত বিত্তশালী বলে শক্তিমান কর্মীবাহিনী গড়ে তুলে সাধারণ মানুষকে সতত বিভ্রান্ত করে চলেছে। দূর প্রাচ্য থেকে অর্থ এবং অস্ত্রের সরবরাহ চলছে অবিরল। কাণ্ডজ্ঞানসম্পন্ন বাঙালি তাদের দুরভিসন্ধি বিষয়ে অবহিত। তাই সচেতন বাঙালিদের পথ ভিন্ন। এ পথেই বাঙালি জাতিসত্তার বাণীমূর্তি রবীন্দ্রনাথের হাতে হাত রেখে আমরা চলতে চাই, মানুষ হবার পথে।

সন্‌জীদার আশঙ্কা যে মিথ্যে নয়, তা প্রমাণিত হল গত দুদিনে— তাঁর জীবনাবসানের আঁচ মুছে যাওয়ার আগেই। হয়তো এটাই ২০২৪-পরবর্তী বাংলাদেশ। সোশাল মিডিয়া ভরে যাচ্ছে ট্রোলে। বাংলাদেশেই সরওয়ার কামাল সেখানে তাৎপর্যপূর্ণভাবে লিখলেন—

কাজী মোতাহার হোসেনের মেয়েকে কেন রবীন্দ্রসঙ্গীতে বিদায় নিতে হইল— আমি এখানে ইসলামিস্টদের পরাজয় দেখতে পাই।

পরিপ্রেক্ষিত: সন্‌জীদা খাতুনের পিতাকেও কন্যার মৃত্যুর পরেই নতুন করে ইসলামবিরোধী বলে প্রচার।

হায় রবীন্দ্রনাথ, হায় সন্‌জীদা, হায় বাংলাদেশ!

 

 

ঋণস্বীকার: