ঈশিতা ভাদুড়ী
...যে সব সাহসী এবং বুদ্ধিদীপ্ত তরুণ কবিরা কবিতার প্রতি অনুরাগে রবীন্দ্রচর্চার সূত্রপাত করেন, যতীন্দ্রমোহন ছিলেন তাঁদের মধ্যে অন্যতম। যতীন্দ্রমোহন লিখেছেন, “আমাদের গৃহে একটি নামগোত্রহীন রবীন্দ্রচক্র ধীরে ধীরে গড়িয়া উঠিতেছিল। ঐ অনামিকা সভার কোনো বিশেষ নিয়মকানুন ছিল না। উহাও যেন খামখেয়ালী সভার দ্বিতীয় সংস্করণ।..."
সাহিত্যক্ষেত্রে মজলিশ বিষয়টি জানি আমরা। শঙ্খ ঘোষ, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, নবনীতা দেবসেনের বাড়িতে লেখক-কবিদের আড্ডায় আমরা অনেকেই গিয়েছি। এই মজলিশ বিষয়টি তো আজ থেকে নয়, বহুকাল আগে থেকেই প্রচলিত। রবীন্দ্রনাথ জীবনস্মৃতিতে লিখেছিলেন – “তখনকার কথা যতই ভাবি আমার একটি কথা কেবলই মনে হয় তখনকার দিনে মজলিস বলিয়া একটা পদার্থ ছিল, এখন সেটা নাই। পূর্বেকার দিনে যে একটি নিবিড় সামাজিকতা ছিল আমরা যেন বাল্যকালে তাহারই শেষ অস্তচ্ছটা দেখিয়াছি। পরস্পরের মেলামেশাটা তখন খুব ঘনিষ্ঠ ছিল, সুতরাং মজলিস তখনকার কালের একটা অত্যাবশ্যক সামগ্রী। যাঁহারা মজলিসি মানুষ তখন তাঁহাদের বিশেষ আদর ছিল। এখন লোকেরা কাজের জন্য আসে, দেখাসাক্ষাৎ করিতে আসে, কিন্তু মজলিস করিতে আসে না। লোকের সময় নাই এবং সে ঘনিষ্ঠতা নাই। তখন বাড়িতে কত আনাগোনা দেখিতাম – হাসিও গল্পে বারান্দা এবং বৈঠকখানা মুখরিত হইয়া থাকিত।”
রবীন্দ্র-যুগের অন্যতম কবি যতীন্দ্রমোহন বাগচীও আপাদমস্তক মজলিশী মানুষ ছিলেন। জন্মস্থান যমশেরপুর থেকে কলকাতায় এসে যতীন্দ্রমোহন প্রথমদিকে পৈত্রিক বাড়ি আরপুলি লেনে যমশেরপুর হাউসে বসবাস করতেন। সেখানে একটি আড্ডার আসর বসত। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সঙ্গে সঙ্গে অন্যান্য প্রতিভাবান মানুষেরও পদার্পণ হয়েছিল সেই বাড়িতে, সঙ্গীত সাহিত্য রাজনীতি সংক্রান্ত বিভিন্ন মজলিশে। সেই মজলিশের আকর্ষণ এড়ানো খুবই কঠিন ছিল অন্য মানুষদের পক্ষে। কাজী নজরুলের উপস্থিতিতে সেই আসর আরও জমজমাট হয়ে উঠত, তিনি একাই একশো ছিলেন। নজরুলের গানে, আবৃত্তিতে, অট্টহাসিতে আকৃষ্ট হয়ে পথচারীরাও এসে হাজির হতেন। আমরা এমনও জেনেছি যে কাজী নজরুল নাকি তাঁর বিবাহের দিন বিবাহ-পর্ব সেরে আরপুলি লেনের মজলিশে এসে বসেছিলেন এবং গল্পে গানে আলোচনায় সম্পূর্ণ আত্মবিস্মৃত হয়েছিলেন। রাত বারোটার সময় যতীন্দ্রমোহনের হঠাৎ খেয়াল হয় এবং তখন নজরুলকে তিনি তিরস্কার করে বাড়ি পাঠান। কাজী নজরুল ইসলাম যতীন্দ্রমোহনের অত্যন্ত স্নেহভাজন ছিলেন। তিনি যতীন্দ্রমোহনকে ‘যুবরাজ’ বলে সম্বোধন করতেন।
সেসময় আধুনিক চিন্তা-সম্পন্ন পাঠক ব্যতীত রবীন্দ্রনাথের কবিতার গ্রহণযোগ্যতা ছিল না সেভাবে। তখন যে সব সাহসী এবং বুদ্ধিদীপ্ত তরুণ কবিরা কবিতার প্রতি অনুরাগে রবীন্দ্রচর্চার সূত্রপাত করেন, যতীন্দ্রমোহন ছিলেন তাঁদের মধ্যে অন্যতম। যতীন্দ্রমোহন লিখেছেন, “আমাদের গৃহে একটি নামগোত্রহীন রবীন্দ্রচক্র ধীরে ধীরে গড়িয়া উঠিতেছিল। ঐ অনামিকা সভার কোনো বিশেষ নিয়মকানুন ছিল না। উহাও যেন খামখেয়ালী সভার দ্বিতীয় সংস্করণ। সন্ধ্যায় সুবিধামতো উহা বসিত এবং সুযোগমতো ভাঙিয়া যাইত। তবে দিনে দিনে সভা যে পুষ্টিলাভ করিতেছিল এবং অতি নীরবে কবির যে একটি শিষ্যদল গড়িয়া উঠিতেছিল তাহা নিঃসন্দেহ। প্রথমে যাহা আমাদের পাঁচ ছয়জনের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল, ক্রমে বাড়িয়া তাহা দশ-বারোজন উৎসাহী যুবকের মিলনক্ষেত্র হইয়া উঠিল।”
যতীন্দ্রমোহন বাগচী শুধু কবিতামনস্ক ছিলেন তাই নয়, অত্যন্ত সঙ্গীতপ্রিয়ও ছিলেন। গায়ক নলিনীকান্ত সরকারের লেখা থেকে জেনেছি – কেবল বাংলা কাব্যসঙ্গীতই নয়, হিন্দুস্থানী মার্গসঙ্গীতেও যতীন্দ্রমোহনের সমান অনুরাগ ছিল। একটি দিনের বিশেষ অনুষ্ঠানের কথাও উল্লেখ করেছেন তিনি,মার্গসঙ্গীতের আসর। গায়ক ভাগলপুরের ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট স্বনামধন্য সুরেন্দ্রনাথ মজুমদার। টপ্পা-খেয়াল গানে সারা ভারতের অন্যতম শ্রেষ্ঠ গুণী শিল্পী সুরেন্দ্রনাথ, কন্ঠস্বর অত্যন্ত মিষ্টি ছিল। যতীন্দ্রমোহন সে’ আসরের মর্যাদা আরও বাড়িয়েছিলেন, সেই আসরের প্রধান শ্রোতা ছিলেন রবীন্দ্রনাথ। দিলীপকুমার রায়, হেমেন্দ্রকুমার রায় প্রমুখ আরও অনেকে নিমন্ত্রিত ছিলেন। দোতলার হলঘরে গানের আসর বসেছিল। রবীন্দ্রনাথ, সুরেন্দ্রনাথ এসেছিলেন। যতীন্দ্রমোহন রবীন্দ্রনাথকে সঙ্গে করে নিয়ে এসেছিলেন। কবিকে আসরে স্বাগত জানালেন স্বয়ং সুরেন্দ্রনাথ, রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে তাঁর পূর্ব পরিচয় ছিল। এর আগে তিনি রবীন্দ্রনাথকে একাধিকবার তাঁর গান শুনিয়েছেন। তানপুরা, তবলা সুরে বেঁধে গান হলো। প্রায় দুঘন্টা ধরে সুরেন্দ্রনাথ সুরের সুধা বর্ষণ করলেন। গান শেষ হওয়ার কিছু পূর্বে দিলীপকুমার রবীন্দ্রনাথের কাছ ঘেঁসে গিয়ে রবীন্দ্রনাথকে কিছু বললেন। গান শেষ হতেই রবীন্দ্রনাথ সুরেন্দ্রনাথকে অনুরোধ করলেন, ‘আর একটি গান শুনতে চাই’। কৃতার্থ হয়ে তিনি বললেন – ‘কী গান শুনতে চান বলুন’। রবীন্দ্রনাথ বললেন – ‘কেদারের গান’। সুরেন্দ্রনাথ বললেন ‘ও গান গানই নয়, একটা ক্যারিকেচার। ও আপনার কাছে গাওয়া চলে না’। রবীন্দ্রনাথের আরও আগ্রহ বেড়ে গেল কেদারের গান শোনার জন্য। বললেন ‘শোনাতেই হবে আপনাকে’। সুরেন্দ্রনাথও গাইবেন না, রবীন্দ্রনাথও ছাড়বেন না। অগত্যা শেষাবধি সুরেন্দ্রনাথ সম্মত হলেন, তানপুরা সরিয়ে হারমোনিয়াম নিয়ে কেদারের গান ধরলেন। কেদার নামক এক ব্যক্তির কণ্ঠে আদৌ সুরের বালাই নেই। সাতটি স্বরের একটি স্বরও গলা দিয়ে বেরোয় না। সম্পূর্ণ বেসুরো। কিন্তু কি আশ্চর্য, অমন যে সুমিষ্ট সুরেলা-কণ্ঠী সুরেন্দ্রনাথ হারমোনিয়াম বাজিয়ে আগাগোড়া একটি গান বেসুরো কণ্ঠে গেয়ে গেলেন। আসরে শ্রোতাদের হাসির রোল উঠল। রবীন্দ্রনাথ অভিভূত।
পরবর্তীকালে যতীন্দ্রমোহন হিন্দুস্থান পার্কে অনেকখানি জমি নিয়ে মনের মত করে বাড়ি করেছিলেন, সামনে বিরাট বাগান। তিনি শৌখিন ছিলেন খুব। ফুলের ওপর তাঁর বিশেষ আকর্ষণ ছিল। গেটের মাথায় হাস্নুহানা, গেট দিয়ে ঢুকে তারপর দুধারে ফুলবাগান, বেল, জুঁই, চাঁপা, গন্ধরাজ, গোলাপ, কামিনী, ম্যাগনোলিয়া, ডালিয়া, এমন কোনো ফুল-গাছ নেই, যে গাছটি ছিল না তাঁর বাগানে। সেই ফুলবাগান পার করেই বাড়ির সামনে ছিল লম্বা টানা বারান্দা। সেই খোলা বারান্দায় কার্পেটের ওপর তাকিয়া নিয়ে বসে থাকতেন যতীন্দ্রমোহন। সামনে ছোট ছোট কাচের বাটিতে বিভিন্ন সুগন্ধী ফুল রাখতেন, সেই সব ফুলের ভরপুর গন্ধ নিতে নিতে তিনি লিখতেন। যখন লিখতেন না তখন পারিবারিক গল্পগুজবও চলত। শুধু ফুল নয় বিভিন্ন ফলেরও গাছ ছিল। তাঁর ঘরের পাশেই একটি লেবু গাছ ছিল, লেবু-গন্ধে ম-ম করত ঘরটি সারা দিন সারা রাত। বাড়ির নাম দিয়েছিলেন ‘ইলাবাস’।
সেই ইলাবাসেও একইরকম মজলিশ অব্যহত রেখেছিলেন তিনি। যতীন্দ্রমোহনের খুব রসবোধও ছিল। ইলাবাসে একতলায় একটি বিরাট হলঘর ছিল, সেইখানে বিভিন্ন খ্যাতনামা সাহিত্যিক কবি সঙ্গীতজ্ঞ ও যন্ত্রশিল্পীদের সমাবেশ হত। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরও সেই হলঘরে কবিতা পাঠ করেছিলেন, গান গেয়েছিলেন। সেখানে পূর্ণিমা সম্মিলনীর অধিবেশনে প্রবন্ধ পাঠ, সাহিত্যালোচনা, সঙ্গীত ইত্যাদি হত। করুণানিধান বন্দ্যোপাধ্যায়, মণিলাল গঙ্গোপাধ্যায়, সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত, হেমেন্দ্রকুমার রায়, শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, কাজী নজরুল ইসলাম, কালিদাস রায়, যতীন্দ্রনাথ সেনগুপ্ত, মেঘনাদ সাহা, কুমুদরঞ্জন মল্লিক, নরেন্দ্র দেব, রাধারাণী দেবী প্রমুখ কবি-সাহিত্যিকদের মজলিশ বসতো তাঁর বাড়িতে, সেই হলঘরে। ভীষ্মদেব চট্টোপাধ্যায়ের গানে, রাধিকামোহন মৈত্রের বাজনায়, এবং ড. মেঘনাদ সাহা, ড. কালিদাস নাগ, ড. কালীকিংকর সেনগুপ্ত, ড. সুনীতি চট্টোপাধ্যায় প্রমুখ ব্যক্তিত্বের উপস্থিতিতে সেই সব অধিবেশন অন্য মাত্রা পেত। গানের আসরে দ্বিজেন্দ্রলাল রায়, সুরেন্দ্রনাথ মজুমদার, রাধিকা গোস্বামী, জ্ঞান গোস্বামী, গিরিজাভূষণ, শচীন দেববর্মন, নলিনীকান্ত সরকার প্রমুখ অনেক বিখ্যাত গায়ক অংশ নিতেন। এরকম বিভিন্ন উজ্জ্বল ব্যক্তিত্বের সমাবেশে যতীন্দ্রমোহনের বাড়িতে আড্ডা উচ্চপর্যায়ে উত্তীর্ণ হয়েছিল। এছাড়া জলধর সেন, নন্দলাল সেনগুপ্ত, অনুরূপা দেবী, ড সুরেন দাশগুপ্ত, ড রমাপ্রসাদ চন্দ, যোগীন্দ্রনাথ গুপ্ত, চারুচন্দ্র দত্ত, অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্ত, প্রেমেন্দ্র মিত্র, প্রবোধ সান্যাল, বীরেন ভদ্র প্রমুখ বিভিন্ন ব্যক্তির সমাগমও ইলাবাসে কোনও-না-কোনও সময়ে হয়েছে।
অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্ত লিখছেন “১৩১৮ সালের কথা: বাগচি কবির বৈঠকখানায় কলকাতার একটা সেরা মজলিস্ বসত। বহু গুণী গায়ক ও সাহিত্যিক সে’ মজলিসে জমায়েত হতেন। বাংলাদেশের সব জ্যোর্তিময় নক্ষত্র—গ্রহপতি স্বয়ং যতীন্দ্রমোহন। কোথায় কোন ভাঙা দেওয়ালের আড়ালে ‘নৃতনের কেতন উড়ছে’ কোথায় কার মাঝে মৃদুতম সম্ভাবনা, ক্ষীণতম প্রতিশ্রুতি… আভাস একবার পেলেই উদ্বেল হৃদয়ে আহ্বান করে আনতেন। তাঁর বাড়ির দরজায় যে হাসনাহানার গুচ্ছ ছিল তার গন্ধ প্রীতিপূর্ণ হৃদয়ের গন্ধ।”যতীন্দ্রমোহন বাগচীর মজলিশী সত্ত্বার এরকম উল্লেখ আরও অনেক লেখাতে রয়েছে।