অঞ্জুশ্রী দে
রাধিকা যাদবের হত্যাকাণ্ড কেবল একটি ব্যক্তিগত ট্র্যাজেডি নয়; এটি আমাদের সমাজের গভীরে বাসা বাঁধা অসুস্থতা এবং তার সুদূরপ্রসারী প্রভাবের এক নির্মম প্রতিচ্ছবি। এই ধরনের ঘটনা শুধুমাত্র একটি পরিবারের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকে না, বরং এর প্রভাব ঢেউয়ের মতো ছড়িয়ে পড়ে সমাজের প্রতিটি স্তরে
রাধিকা যাদব ছিলেন রাজ্যস্তরের একজন প্রতিভাবান টেনিস খেলোয়াড়। তিনি উঠতি টেনিস খেলোয়াড়দের প্রশিক্ষণ দিতেন। এর জন্য তাঁর কোনও নিজস্ব অ্যাকাডেমি ছিল না; বরং তিনি বিভিন্ন জায়গায় টেনিস কোর্ট ভাড়া করে এই কাজটি করতেন। কিন্তু, তাঁর এই উজ্জ্বল পথচলা এক নির্মম হত্যাকাণ্ডে থেমে গেল— নিজের বাবার হাতেই তাঁকে প্রাণ দিতে হল। রাধিকার বাবার স্বীকারোক্তি অনুযায়ী, সামাজিক লাঞ্ছনা ও প্রতিবেশীদের উপহাসই তাঁকে এই চরম পদক্ষেপ নিতে প্ররোচিত করেছে। প্রতিবেশীরা তাঁকে লাগাতার কটাক্ষ করতেন এই বলে যে, তিনি নাকি মেয়ের রোজগারে জীবন কাটাচ্ছেন, আর এই কথাগুলোই যেন রাধিকার বাবাকে এক গভীর মানসিক সংকটে ফেলেছিল।
তদন্তকারী অফিসারের মতে, “রাধিকার বাবা দীপক, মেয়েকে বারবার এই প্রশিক্ষণ বন্ধ করতে বলতেন, কিন্তু রাধিকা তাঁর সিদ্ধান্তে অনড় ছিলেন। বাবা ও মেয়ের মধ্যে এটাই ছিল মূল বিবাদ।” এছাড়াও, রাধিকা সোশাল মিডিয়ায় রিল এবং মিউজিক ভিডিও তৈরি করতেন, যা আজকাল অনেক মেয়ের আয়ের গুরুত্বপূর্ণ উৎস। এই বিষয়টি নিয়েও তাঁর বাবা অসন্তুষ্ট ছিলেন। এই ঘটনাটি শুধু একটি পারিবারিক ট্র্যাজেডি নয়; এটি আমাদের সমাজের গভীরে প্রোথিত পিতৃতান্ত্রিক মানসিকতা এবং নারী স্বাধীনতার বিরুদ্ধে এক ভয়াবহ চিত্র তুলে ধরে।
পিতৃতন্ত্রের বিস্তার ও পুরুষত্বের সঙ্কীর্ণ ধারণা
নারীরা যখন জীবনের নতুন দিগন্ত উন্মোচন করেন, তখন সমাজ প্রায়শই এক অদৃশ্য প্রতিরোধ গড়ে তোলে। পিতৃতন্ত্র সহজে বিলুপ্ত হয় না; বরং এটি নতুন নতুন রূপে নিজেকে প্রকাশ করে, নারীর অগ্রগতিকে প্রতিহত করার চেষ্টা করে। রাধিকার ঘটনা তার একটি জ্বলন্ত উদাহরণ। সমাজের যে-অংশ নারীর সাফল্যকে সহজে মেনে নিতে পারে না, সেই অংশই এই পিতৃতন্ত্রের ধারক ও বাহক। তারাই ব্যবস্থাটিকে বাঁচিয়ে রাখতে চায়। এর প্রমাণ আমরা বিভিন্নভাবে দেখতে পাই: যেমন, নারীদের বিরুদ্ধে অনলাইনে লাগাতার অপমানজনক মন্তব্য ও আক্রমণের মাধ্যমে (অনলাইন সহিংস ট্রোলিং) তাদের কণ্ঠরোধ করার চেষ্টা করা হয়। বিবাহবিচ্ছেদের পর নারীর আইনি অধিকার হিসেবে নির্ধারিত খোরপোশকে অযৌক্তিকভাবে যৌতুকের মতো সামাজিক ব্যাধির সঙ্গে মিশিয়ে দেওয়া হয়, যা এই অধিকারের গুরুত্বকেই খাটো করে। এছাড়াও, ‘ইনসেল সংস্কৃতি’র বিস্তার— যেখানে কিছু পুরুষ, নারীর স্বাধীনতা ও নিজস্ব সিদ্ধান্তের প্রতি ক্ষোভ ও বিদ্বেষ পোষণ করে এবং নারীদের উপর নিজেদের নিয়ন্ত্রণ কায়েম করার চেষ্টা করে। এইগুলো সবই পিতৃতন্ত্রের বিভিন্ন রূপের বহিঃপ্রকাশ।
এই ট্র্যাজেডি আমাদের মনে করিয়ে দেয় যে, পিতৃতন্ত্র শুধু নারীর নয় পুরুষদেরও ক্ষতি করে। এটি পুরুষদের মানবিক গুণগুলোকে বিকশিত হতে দেয় না। অন্যের ‘মানুষ’ সত্তাকে চিনে নিতে তাদের বাধা দেয়। যে সমাজে একজন নারীর স্বাধীনতা বা তার নিজের মতো করে জীবনযাপনকে ‘শাস্তিযোগ্য’ বলে মনে করা হয়, সেই সমাজেই আবার একজন পুরুষের কদর নির্ভর করে তার অধীনস্থ মহিলাদের ওপর সে কতটা নিয়ন্ত্রণ রাখতে পারছে, তার ওপর। যখন একজন পুরুষ তার পরিবারের মাহিলাদের উপর নিয়ন্ত্রণ রাখতে ব্যর্থ হয়, তখন তাকে সামাজিকভাবে উপহাস করা হয়, তাকে দুর্বল বা অক্ষম বলে মনে করা হয়। রাধিকার বাবার ক্ষেত্রেও ঠিক এমনটাই ঘটেছিল। প্রতিবেশীদের বিদ্রূপ, ‘মেয়ের রোজগারে চলা’র অপবাদ তার পুরুষত্বে এক গভীর আঘাত হেনেছিল, যা তাকে মানসিকভাবে নড়বড়ে করে দিয়েছিল। হয়তো প্রতিবেশীরা সরাসরি রাধিকাকে গুলি করেনি, কিন্তু তাদের অপমানজনক কথাগুলোই এই ভয়ঙ্কর সহিংসতার মূল কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। এই ঘটনা প্রমাণ করে, নারীবিদ্বেষ কেবল কোনও ব্যক্তিগত অনুভূতি নয়; এটি সমাজের সমষ্টিগত ব্যাধি। কখনও পরিবার, কখনও সমাজ, এমনকি গণমাধ্যম— সমাজের স্বাভাবিক রীতিনীতির বাইরে গিয়ে এই নারীবিদ্বেষকে সমর্থন করে। দুঃখজনক হলেও সত্যি, রাধিকার সাফল্যও তাকে এই নারীবিদ্বেষ থেকে রক্ষা করতে পারেনি; বরং উল্টোটা হয়েছে, তার সাফল্যই যেন ‘তার বিপদ’ ডেকে এনেছে।
অতীত অভিজ্ঞতা: ধারাবাহিক সংগ্রামের ইতিহাস
রাধিকার ঘটনার মতো অতীতেও অনেক মর্মান্তিক ঘটনা ঘটেছে, যেখানে পিতৃতান্ত্রিক মানসিকতা এবং সামাজিক চাপের কারণে নারীরা সহিংসতার শিকার হয়েছেন, এমনকি প্রাণও হারিয়েছেন। ভারতে ‘অনার কিলিং’ (সম্মানরক্ষার্থে হত্যা)-এর ঘটনাগুলো এর অন্যতম উদাহরণ। রাধিকার ঘটনা সরাসরি ‘অনার কিলিং’ হিসেবে চিহ্নিত না হলেও, এর পেছনে যে সামাজিক চাপ, নারীর স্বাবলম্বিতাকে মেনে নিতে না পারা এবং পুরুষতান্ত্রিক কর্তৃত্বের ধারণা কাজ করেছে, তা অনার কিলিংয়ের ঘটনার সঙ্গে সাদৃশ্যপূর্ণ।
২০২২ সালে দিল্লির আয়ুষী যাদবের হত্যাকাণ্ড ছিল এমনই এক হৃদয়বিদারক ঘটনা। আয়ুষীকে তার বাবা গুলি করে হত্যা করে এবং মা তাকে সাহায্য করে, কারণ সে নিজের ইচ্ছামতো জীবনযাপন করতে চেয়েছিল এবং তাদের অমতে এক ভিন্ন বর্ণের ছেলেকে বিয়ে করেছিল। পরিবারের ‘সম্মান’ রক্ষার নামে আয়ুষীর স্বাধীনতাকে কেড়ে নেওয়া হয়েছিল, যার চূড়ান্ত পরিণতি ছিল তার নির্মম মৃত্যু। এই ঘটনা প্রমাণ করে পিতৃতান্ত্রিক মানসিকতা কতটা শক্তিশালী। তথাকথিত আধুনিক সমাজেও সন্তানরা যখন সমাজের অলিখিত নিয়ম ভাঙার সাহস দেখায়, তখন পরিবারগুলো নিজেদের সন্তানদের প্রতিও কতটা নিষ্ঠুর হতে পারে, এই নৃশংসতা তারই ইঙ্গিত দেয়।
এর বাইরেও, অসংখ্য ঘটনা বারবার আমাদের মনে করিয়ে দেয় পিতৃতন্ত্রের সর্বগ্রাসী প্রভাব। হরিয়ানা, উত্তরপ্রদেশ, রাজস্থানের মতো রাজ্যগুলিতে অহরহ এমন ‘অনার কিলিং’ ঘটে যেখানে তরুণ-তরুণীদের পছন্দ অনুযায়ী বিয়ে বা স্বাধীন সিদ্ধান্তের কারণে পরিবারের হাতে খুন হতে হয়। শুধু তাই নয়, যৌতুকের দাবিতে নারীদের উপর শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন এবং হত্যার ঘটনাও পিতৃতান্ত্রিক সমাজের এক ভয়াবহ দিক, যেখানে নারীর অর্থনৈতিক মূল্যকে তার জীবনের চেয়েও বেশি গুরুত্ব দেওয়া হয়। রাধিকার ঘটনাটি যেমন পারিবারিক সহিংসতার এক চরম রূপ, তেমনি অনেক সময় নারীরা তাদের পরিবারেই শারীরিক, মানসিক বা অর্থনৈতিক নির্যাতনের শিকার হন। তাদের সিদ্ধান্ত নেওয়ার স্বাধীনতা খর্ব করা হয়। এমনকি, কর্মক্ষেত্রে নারীর অংশগ্রহণ বাড়লেও, অনেক সময় তাদের পারিবারিক বা সামাজিক বাধার সম্মুখীন হতে হয়। রাধিকার নিজস্ব অ্যাকাডেমি চালানো বা সোশাল মিডিয়ায় কাজ করা তার বাবার কাছে ‘অসম্মানজনক’ মনে হওয়া— কর্মজীবী মহিলাদের প্রতি সমাজের এক নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গিরই প্রতিফলন। এই প্রতিটি ঘটনার মূলে রয়েছে পিতৃতান্ত্রিক সমাজের সেই একই মানসিকতা যা নারীর স্বায়ত্তশাসন, স্বাধীনতা এবং ব্যক্তিগত পছন্দকে মেনে নিতে পারে না। রাধিকার ঘটনাটি আবারও প্রমাণ করে যে, নারীর প্রতি সহিংসতা কেবল প্রত্যন্ত গ্রামেই নয়, বরং সমাজের তথাকথিত ‘আধুনিক’ বা ‘উন্নত’ পরিবেশেও বিদ্যমান।
সামাজিক প্রভাব: এক গভীর ক্ষত
রাধিকা যাদবের হত্যাকাণ্ড কেবল একটি ব্যক্তিগত ট্র্যাজেডি নয়; এটি আমাদের সমাজের গভীরে বাসা বাঁধা অসুস্থতা এবং তার সুদূরপ্রসারী প্রভাবের এক নির্মম প্রতিচ্ছবি। এই ধরনের ঘটনা শুধুমাত্র একটি পরিবারের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকে না, বরং এর প্রভাব ঢেউয়ের মতো ছড়িয়ে পড়ে সমাজের প্রতিটি স্তরে।
- যখন একজন সফল, আত্মনির্ভরশীল নারী তার নিজস্ব পরিবারের হাতেই এমন নির্মম পরিণতির শিকার হন, তখন তা অন্যান্য নারীদের মনে গভীর ভীতির সঞ্চার করে। নিজেদের স্বপ্নপূরণের পথে অগ্রসর হওয়া কি নিরাপদ? এই প্রশ্ন তাদের আত্মবিশ্বাসকে দমিয়ে দেয় এবং স্বাধীনভাবে সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতাকে প্রভাবিত করে।
- রাধিকার মৃত্যুর ঘটনা পরোক্ষভাবে পুরুষতান্ত্রিক মানসিকতাকে আরও শক্তিশালী করে। যখন একজন পুরুষ তার মেয়ের সাফল্যের কারণে ‘লজ্জিত’ বোধ করেন এবং সমাজের কটাক্ষের ভয়ে তাকে হত্যা করেন, তখন তা সমাজের সেই অংশকে উৎসাহিত করে যারা নারীর অগ্রগতিকে নিজেদের কর্তৃত্বের পরিপন্থী বলে মনে করে। এটি পুরুষদের মধ্যে এক ভুল বার্তা দেয়, নারীর উপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করাই যেন পুরুষত্বের লক্ষণ।
- যখন সামাজিক চাপ ও পিতৃতান্ত্রিক মানসিকতায় পরিবারের মধ্যেই বাবার হাতে মেয়ে খুন হয়— এই নৃশংসতায় প্রশ্ন ওঠে, সমাজ কি সত্যিই নারীদের নিরাপত্তা দিতে সক্ষম? যদি একজন সফল নারী তার নিজের পরিবারে নিরাপদ না থাকেন, তাহলে সাধারণ নারীর নিরাপত্তা কোথায়? এটি বিচারব্যবস্থার প্রতি এক চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দেয় এবং সমাজে এক ধরনের হতাশা ও নৈরাজ্য তৈরি করে।
- সবচেয়ে সুদূরপ্রসারী প্রভাব হল সমাজের সম্মিলিত নীরবতা এবং দায়বদ্ধতার অভাব। এই নীরবতা এবং দায়িত্বহীনতার কারণেই অন্যায়গুলো সমাজে টিকে থাকে এবং বারবার এমন ঘটনা ঘটে। রাধিকার বাবাকে যারা উপহাস করেছিল, তাদের ভূমিকা এই হত্যাকাণ্ডে কম ছিল না। এই ঘটনাটি চোখে আঙুল দিয়ে দেখায় যে, নারীবিদ্বেষ কেবল ব্যক্তিগত বিদ্বেষ নয়, এটি একটি সামাজিক রোগ। সমাজের বহু মানুষ প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে এই রোগে আক্রান্ত। উপহাসের মাধ্যমে পিতৃতান্ত্রিক মূল্যবোধকে উসকে দেওয়া, নারীর স্বাধীনতাকে খর্ব করার চেষ্টা এবং সহিংসতার নীরব সমর্থক হওয়া— এই সবই রাধিকার মতো ঘটনার পুনরাবৃত্তিতে ইন্ধন জোগায়।
রাধিকা যাদবের হত্যাকাণ্ড কোনও বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। এটি পিতৃতান্ত্রিক সমাজের গভীরে লুকিয়ে থাকা এক সুদূরপ্রসারী সমস্যার ইঙ্গিত। এই সমস্যা নারীর অগ্রগতিকে ব্যাহত করে, পুরুষতান্ত্রিক মানসিকতাকে টিকিয়ে রাখে এবং সামাজিক ন্যায়বিচারের পথে বড় বাধা সৃষ্টি করে।
রাধিকা, তুমি হয়তো আজ আর আমাদের মাঝে নেই, কিন্তু তোমার আত্মত্যাগ আমাদের বিবেককে এক নীরব প্রশ্নবাণে বিঁধল। প্রকৃত লিঙ্গসমতা শুধু কিছু প্রতিনিধিত্ব বা সুযোগের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়, এর জন্য প্রয়োজন আমাদের সামাজিক ব্যবস্থা ও ক্ষমতার এক আমূল পুনর্গঠন। কাঠামো, প্রতিষ্ঠান এবং আমাদের মনের গভীরে থাকা পিতৃতন্ত্রকে ভেঙে ফেলতে এক বিপ্লবী ও সম্মিলিত সংগ্রাম আবশ্যক। এই গভীর ক্ষত সারানোর জন্য প্রয়োজন ব্যাপক সামাজিক সচেতনতা, নারী-পুরুষ নির্বিশেষে মানসিকতার পরিবর্তন, এবং পিতৃতান্ত্রিক মূল্যবোধের বিরুদ্ধে নিরন্তর সংগ্রাম।
এই হৃদয়বিদারক ঘটনাগুলো থেকে আমরা কী শিখছি? সমাজে প্রকৃত পরিবর্তন আনতে আমাদের আর কত রাধিকার আত্মবলিদান প্রয়োজন? নারীর প্রতি এই অনন্ত অবিচারের বিরুদ্ধে আমরা কি নীরবতার জাল ছিন্ন করে রুখে দাঁড়াতে পারব না?

